( সামুতে এটি আমার প্রথম ব্লগ, তাই ভুল ত্রুটি অবশ্যই মার্জনীয় দৃষ্টিতে দেখবেন :!> )
বর্তমানে এই যে প্রাচীন সম্রাটদের এত এত প্রাসাদ যাদুঘর আমরা দেখি তাতে কত মানুষের রক্ত আর ঘাম মিশে আছে কে তা হিসাব রাখে । একটি জিনিস পৃথিবীতে দেখা যায় যে প্রায়শই বড়রা মানে ক্ষমতাবানরা দরিদ্র ও দুর্বলদের গিলে খায় । আগে ব্যাপারটা সুজোসুজি ছিল আর এখন ব্যাপারটা ঘোড়ালো-প্যাঁচালো । রোমান সম্রাজ্যের জয়জয়কার সময়ের ঘটনা । তখন রোমানরা যদিকেই যাচ্ছে যুদ্ধবন্দী হিসেবে ধরে নিয়ে আসছে হাজার হাজার মানুষ । আর তাদেরকে কাজে লাগানো হচ্ছে খনির অতল অন্ধকারে নয়ত করানো হচ্ছে অমানুষিক পরিশ্রম । রোমের প্রতিটি দালান, অট্টালিকার প্রতিটি ইট বহন করে সেই মানুষদের অশ্রু । এইসব মানুষেরা পরিচিত দাস বা ক্রীতদাস নামে । সাধারণত আর দশটা পশুপাখির সাথে তাদের তেমন একটা অমিল ছিল না কারন বিত্তবানরা তাদের সাথে পশুসুলভ আচরণই করত । যে সব বন্দী সৈন্য ও যোদ্ধাদেরকে দাসস্বরূপ আনা হত তাদের কাছ থেকে কায়িক শ্রমের চেয়ে রোমানরা নিজেদের বিকৃত রুচির বিনোদনটাই বেশি আশা করত । যেমন সেইসব দাসদেরকে গ্ল্যাডিয়েটর নামে একপ্রকার আত্নঘাতী খেলোয়াড় হিসেবে নিয়োজিত করা হত । রাজকার্যে নিয়োজিত ধনীদের স্ত্রীরা অবসর সময়ে মানুষে মানুষে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ দেখে নিজেরা আমোদ পেত । ক্ষুধার্ত সিংহ যখন একজন গ্ল্যাডিয়েটরকে ছিঁড়ে খুঁড়ে খেত তখন সেই দৃশ্য দেখে চারপাশ থেকে উল্লাস ও হাততালির জোয়ার ভেসে আসত । এ সবই ছিল নিষ্ঠুর বর্বরতা যার শিকার ছিল নিরীহ দাসরা ।
বস্তুত পৃথিবীর প্রত্যেকটি গৌরবময় সভ্যতার পেছনের দেয়ালে আছে অগণিত দাসসের রক্ত ও শ্রম । সে সময়ে প্রাচীন রোমে কয়েকটি দাস বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল যারমধ্যে রোমের তৃতীয় দাস বিদ্রোহটি ছিল অধিকতর উল্লেখযোগ্য । কারন সেটি ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বড় দাস বিদ্রোহ যার নেতৃত্ব দেন বিখ্যাত গ্ল্যাডিয়েটর যোদ্ধা স্পার্টাকাস । তাই সবার কাছে এই বিদ্রোহটি স্পার্টাকাসের বিদ্রোহ নামে বেশি পরিচিত ।
স্পার্টাকাসের বিদ্রোহ সম্পর্কে ঐতিহাসিকভাবে খুব অল্পই জানা যায় তারমধ্যে আবার কিছু কিছু ঘটনা বিশ্বাসযোগ্য নাও হতে পারে । যাইহোক, সমস্ত উৎস দ্বারা এটা সম্মত হওয়া যায় যে স্পার্টাকাস ছিলেন সাবেক গ্ল্যাডিয়েটর ও একজন উদ্যাপিত নেতা । তার জন্মস্থান হচ্ছে রোম সম্রাজ্যের অধীনস্থ ত্রেস্ গোত্রে । ক্রীতদাস হিসেবে বন্দী হবার আগেও ছিলেন তিনি একজন সাহসী যোদ্ধা । বন্দীদশা থেকে পালিয়ে যাওয়ার অপরাধে শাস্থিস্বরুপ তাঁকে গ্ল্যাডিয়েটর বা মল্লযোদ্ধা ক্রীতদাস হিসেবে নিযুক্ত করা হয় । তার নেতৃত্বে পরিচালিত হয়েছিল ইতিহাসের সর্ববৃহৎ দাস-বিদ্রোহের প্রস্তুতি । এই বিদ্রোহের প্রথম পরিকল্পনা করা হয় রোমের ক্যাপুরা শহরের কয়েকজন গ্ল্যাডিয়েটর বা মল্লযুদ্ধ ক্রীতদাস কতৃক । দুঃখজনক ব্যাপার হল যে তাদের এই পরিকল্পনার কথা ফাঁস হয়ে যায় । কিন্তু প্রায় আশিজন দাস পালিয়ে যেতে সক্ষম হয় । প্রাথমিক পর্যায়ে তারা ভিসুভিয়াস পর্বতে শিবির স্থাপন করে এবং স্পার্টাকাসকে তাদের নেতা নির্বাচন করে । কারন সবাই জানত যে তিনি নিঃসন্দেহে একজন অবিসাংবাদী নেতা, উপযুক্ত সংঘটক ও সুদক্ষ সামরিক অধিনায়ক । যাই হোক, প্রথম দিকে দাস বিদ্রোহের গুরুত্ব বুঝতে না পারায় রোম এদিকে বিশেষ মনোযোগ দেয় নি । ধীরে ধীরে চারদিকে এই বিদ্রোহের খবর ছড়িয়ে পরে যার ফলে দলে দলে দাসরা পালিয়ে এসে স্পার্টাকাসের বাহিনীতে যোগ দিতে লাগল । তখন একসময় রোম বিরাট সৈন্যবাহিনী পাঠায় এই বিদ্রোহ দমনের উদ্দেশ্যে । রোমান বাহিনী কৌশলে ভিসুভিয়াস পাহাড়ে ওঠার পথ রুদ্ধ করে দাঁড়াল এবং স্পার্টাকাসের বাহিনীর সবধরনের খাবার ও অন্যান্য রসদ সরবরাহের পথ বন্ধ করে দিল । এ বিপদে স্পার্টাকাস পরম বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেন । ভিসুভিয়াস পাহাড়ের উপরে ছিল বিস্তৃত আঙ্গুরের ক্ষেত । স্পার্টাকাসের নির্দেশে তার বাহিনী আঙ্গুরের লতা দিয়ে শক্ত দড়ি তৈরি করল এবং তার সাহায্যে গভীর রাতের অন্ধকারে তারা পাহাড় বেয়ে নেমে পড়তে লাগল । এভাবে দলে দলে দাস সৈন্যরা ভিসুভিয়াস থেকে নেমে রোমান সৈন্যদের শিবিরে অতর্কিত আক্রমণ করে এবং রোমান বাহিনীকে সমূলে ধ্বংস করে দেয় ।
স্পার্টাকাস বাহিনীর এ বিজয়ের খবরে উল্লাসিত হয়ে সম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থান থেকে আরো ক্রীতদাসরা পালিয়ে এসে তাঁর দলে যোগদান করল । অচিরেই স্পার্টাকাসের বাহিনী কয়েক হাজারে উন্নীত হল এবং দাস বিদ্রোহ সমগ্র ইতালীতে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ল ।
স্পার্টাকাসের উদ্দেশ্য ছিল যেহেতু সব দাসরাই এখন মুক্ত সে জন্য তাদের সবাইকে নিজ নিজ দেশে পাঠিয়ে দেয়াটাই ভাল কিন্তু তাঁর বাহিনীতে বিভিন্ন জাতির সমাবেশ ঘটেছিল যেমন থ্রেসিয়ান, গ্রীক, গল ও জার্মান । এদের সবাইকে একই নীতিতে বিশ্বাস করানো বাস্তবিক পক্ষেই ভীষণ কঠিন কাজ ছিল । তাদের মধ্যে আবার বেশীরভাগ দল ইতালী ছেড়ে নিজ দেশে না গিয়ে সরাসরি রোম আক্রমণের পক্ষেই ছিল । কিন্তু স্পার্টাকাস বুঝতে পেরেছিলেন যে তাঁর বাহিনী রোম আক্রমণ করার মত অতখানি শক্তিশালী ছিল না । এজন্য স্পার্টাকাস এ ব্যাপারে নিজের মতামতকেই বেশি গুরুত্ব দিলেন এবং রোম আক্রমণের চিন্তা বাতিল করে দিলেন । তাঁর সাথে ভিন্নমত হওয়ার দরুন দুটি দল তাঁর বাহিনী পরিত্যাগ করে ও চলে যায় এবং এটা পরবর্তীকালে তাঁর বিপর্যয়ের কারন হয়ে দাঁড়ায় ।
স্পার্টাকাসের সেনা বাহিনী উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে এগিয়ে যেতে লাগল । অপরদিকে তাঁর আগমনের সংবাদে ভীত হয়ে রোমান সিনেট ক্রেসাস্-এর অধীনস্থ বিরাট সৈন্য দল সমবেত করা হল । তারা ছিল স্পার্টাকাস বাহিনীকে বাধা দিতে প্রস্তুত । স্পার্টাকাস কিন্তু রোম আক্রমণ না করেই দক্ষিণ দিকে এগিয়ে চললেন । পথিমধ্যে রোমান বাহিনীর দু’একটি দলের সাথে তাদের খন্ড যুদ্ধ হয় । তাদের পরাজিত করে স্পার্টাকাস বাহিনী শেষ পর্যন্ত ইতালীর সর্ব দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে এসে উপস্থিত হয় । তাদের উদ্দেশ্য ছিল সিসিলিতে গমন করা । কিন্তু সেখানে স্বাভাবিক ভাবেই জাহাজ যোগাড় করা তাদের পক্ষে সম্ভভ হয় নি । কাঠের ভেলায় সমুদ্র পার হওয়ার চেষ্টাও ব্যর্থ হয়ে যায় প্রচণ্ড ঝড়ের কারনে । ইতিমধ্যে ক্রেসাস-এর বাহিনী উপস্থিত হয়ে তাদের পথ রোধ করে দাঁড়াল । কোনো উপায় না পেয়ে স্পার্টাকাস যুদ্ধে লিপ্ত হলেন রোমান বাহিনীর বিপক্ষে । খৃষ্টপূর্ব ৭১ অব্দে রোমানদের সাথে যুদ্ধে স্পার্টাকাসের ক্রীতদাস বাহিনী শেষ পর্যন্ত পরাজিত হয় । স্পার্টাকাস শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করে মৃত্যুবরণ করেন । রোমানরা শক্তিশালী হওয়া স্বত্বেও এ যুদ্ধে তাদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয় । ইতিমধ্যে সিনেট সভার পম্পির নেতৃত্বে রোমানদের আরকটি বাহিনী বলকান উপদ্বীপ থেকে উক্ত যুদ্ধক্ষেত্রে এসে পৌঁছায় । সেখানে তারা অসহায় মৃতপ্রায় ও আহত ক্রীতদাসদের ধরে ধরে ক্রুশে বিদ্ধ করে ঝুলিয়ে রাখে । বিদ্রোহের প্রথম অগ্নি বিপ্লব যেখানে প্রজলিত হয় – সেই কাপুয়া শহর থেকে রোম পর্যন্ত বিস্তৃত রাস্তায় দু’ধারে খুঁটি পুঁতে এভাবে প্রায় ছয় হাজার ক্রীতদাসকে ঝুলিয়ে দেয়া হল শুধুমাত্র বিভীষিকা সৃষ্টি করার জন্য – যাতে ভবিষ্যতে আর কখোনো দাস বিদ্রোহ না ঘটে ।
কিন্তু এত কিছু করেও রোম তার সংকট এড়াতে পারল না । যে সংকটের বীজ রোম নিজে বপন করেছিল ক্রীতদাস প্রথাকে টিকিয়ে রেখে, তা শেষ পর্যন্ত তার নিজেরই পতন ডেকে এনেছিল ।