somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রোমের তৃতীয় দাস বিদ্রোহ

০১ লা জুন, ২০১২ ভোর ৫:৪৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


( সামুতে এটি আমার প্রথম ব্লগ, তাই ভুল ত্রুটি অবশ্যই মার্জনীয় দৃষ্টিতে দেখবেন :!> )


বর্তমানে এই যে প্রাচীন সম্রাটদের এত এত প্রাসাদ যাদুঘর আমরা দেখি তাতে কত মানুষের রক্ত আর ঘাম মিশে আছে কে তা হিসাব রাখে । একটি জিনিস পৃথিবীতে দেখা যায় যে প্রায়শই বড়রা মানে ক্ষমতাবানরা দরিদ্র ও দুর্বলদের গিলে খায় । আগে ব্যাপারটা সুজোসুজি ছিল আর এখন ব্যাপারটা ঘোড়ালো-প্যাঁচালো । রোমান সম্রাজ্যের জয়জয়কার সময়ের ঘটনা । তখন রোমানরা যদিকেই যাচ্ছে যুদ্ধবন্দী হিসেবে ধরে নিয়ে আসছে হাজার হাজার মানুষ । আর তাদেরকে কাজে লাগানো হচ্ছে খনির অতল অন্ধকারে নয়ত করানো হচ্ছে অমানুষিক পরিশ্রম । রোমের প্রতিটি দালান, অট্টালিকার প্রতিটি ইট বহন করে সেই মানুষদের অশ্রু । এইসব মানুষেরা পরিচিত দাস বা ক্রীতদাস নামে । সাধারণত আর দশটা পশুপাখির সাথে তাদের তেমন একটা অমিল ছিল না কারন বিত্তবানরা তাদের সাথে পশুসুলভ আচরণই করত । যে সব বন্দী সৈন্য ও যোদ্ধাদেরকে দাসস্বরূপ আনা হত তাদের কাছ থেকে কায়িক শ্রমের চেয়ে রোমানরা নিজেদের বিকৃত রুচির বিনোদনটাই বেশি আশা করত । যেমন সেইসব দাসদেরকে গ্ল্যাডিয়েটর নামে একপ্রকার আত্নঘাতী খেলোয়াড় হিসেবে নিয়োজিত করা হত । রাজকার্যে নিয়োজিত ধনীদের স্ত্রীরা অবসর সময়ে মানুষে মানুষে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ দেখে নিজেরা আমোদ পেত । ক্ষুধার্ত সিংহ যখন একজন গ্ল্যাডিয়েটরকে ছিঁড়ে খুঁড়ে খেত তখন সেই দৃশ্য দেখে চারপাশ থেকে উল্লাস ও হাততালির জোয়ার ভেসে আসত । এ সবই ছিল নিষ্ঠুর বর্বরতা যার শিকার ছিল নিরীহ দাসরা ।
বস্তুত পৃথিবীর প্রত্যেকটি গৌরবময় সভ্যতার পেছনের দেয়ালে আছে অগণিত দাসসের রক্ত ও শ্রম । সে সময়ে প্রাচীন রোমে কয়েকটি দাস বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল যারমধ্যে রোমের তৃতীয় দাস বিদ্রোহটি ছিল অধিকতর উল্লেখযোগ্য । কারন সেটি ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বড় দাস বিদ্রোহ যার নেতৃত্ব দেন বিখ্যাত গ্ল্যাডিয়েটর যোদ্ধা স্পার্টাকাস । তাই সবার কাছে এই বিদ্রোহটি স্পার্টাকাসের বিদ্রোহ নামে বেশি পরিচিত ।
স্পার্টাকাসের বিদ্রোহ সম্পর্কে ঐতিহাসিকভাবে খুব অল্পই জানা যায় তারমধ্যে আবার কিছু কিছু ঘটনা বিশ্বাসযোগ্য নাও হতে পারে । যাইহোক, সমস্ত উৎস দ্বারা এটা সম্মত হওয়া যায় যে স্পার্টাকাস ছিলেন সাবেক গ্ল্যাডিয়েটর ও একজন উদ্যাপিত নেতা । তার জন্মস্থান হচ্ছে রোম সম্রাজ্যের অধীনস্থ ত্রেস্‌ গোত্রে । ক্রীতদাস হিসেবে বন্দী হবার আগেও ছিলেন তিনি একজন সাহসী যোদ্ধা । বন্দীদশা থেকে পালিয়ে যাওয়ার অপরাধে শাস্থিস্বরুপ তাঁকে গ্ল্যাডিয়েটর বা মল্লযোদ্ধা ক্রীতদাস হিসেবে নিযুক্ত করা হয় । তার নেতৃত্বে পরিচালিত হয়েছিল ইতিহাসের সর্ববৃহৎ দাস-বিদ্রোহের প্রস্তুতি । এই বিদ্রোহের প্রথম পরিকল্পনা করা হয় রোমের ক্যাপুরা শহরের কয়েকজন গ্ল্যাডিয়েটর বা মল্লযুদ্ধ ক্রীতদাস কতৃক । দুঃখজনক ব্যাপার হল যে তাদের এই পরিকল্পনার কথা ফাঁস হয়ে যায় । কিন্তু প্রায় আশিজন দাস পালিয়ে যেতে সক্ষম হয় । প্রাথমিক পর্যায়ে তারা ভিসুভিয়াস পর্বতে শিবির স্থাপন করে এবং স্পার্টাকাসকে তাদের নেতা নির্বাচন করে । কারন সবাই জানত যে তিনি নিঃসন্দেহে একজন অবিসাংবাদী নেতা, উপযুক্ত সংঘটক ও সুদক্ষ সামরিক অধিনায়ক । যাই হোক, প্রথম দিকে দাস বিদ্রোহের গুরুত্ব বুঝতে না পারায় রোম এদিকে বিশেষ মনোযোগ দেয় নি । ধীরে ধীরে চারদিকে এই বিদ্রোহের খবর ছড়িয়ে পরে যার ফলে দলে দলে দাসরা পালিয়ে এসে স্পার্টাকাসের বাহিনীতে যোগ দিতে লাগল । তখন একসময় রোম বিরাট সৈন্যবাহিনী পাঠায় এই বিদ্রোহ দমনের উদ্দেশ্যে । রোমান বাহিনী কৌশলে ভিসুভিয়াস পাহাড়ে ওঠার পথ রুদ্ধ করে দাঁড়াল এবং স্পার্টাকাসের বাহিনীর সবধরনের খাবার ও অন্যান্য রসদ সরবরাহের পথ বন্ধ করে দিল । এ বিপদে স্পার্টাকাস পরম বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেন । ভিসুভিয়াস পাহাড়ের উপরে ছিল বিস্তৃত আঙ্গুরের ক্ষেত । স্পার্টাকাসের নির্দেশে তার বাহিনী আঙ্গুরের লতা দিয়ে শক্ত দড়ি তৈরি করল এবং তার সাহায্যে গভীর রাতের অন্ধকারে তারা পাহাড় বেয়ে নেমে পড়তে লাগল । এভাবে দলে দলে দাস সৈন্যরা ভিসুভিয়াস থেকে নেমে রোমান সৈন্যদের শিবিরে অতর্কিত আক্রমণ করে এবং রোমান বাহিনীকে সমূলে ধ্বংস করে দেয় ।
স্পার্টাকাস বাহিনীর এ বিজয়ের খবরে উল্লাসিত হয়ে সম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থান থেকে আরো ক্রীতদাসরা পালিয়ে এসে তাঁর দলে যোগদান করল । অচিরেই স্পার্টাকাসের বাহিনী কয়েক হাজারে উন্নীত হল এবং দাস বিদ্রোহ সমগ্র ইতালীতে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ল ।
স্পার্টাকাসের উদ্দেশ্য ছিল যেহেতু সব দাসরাই এখন মুক্ত সে জন্য তাদের সবাইকে নিজ নিজ দেশে পাঠিয়ে দেয়াটাই ভাল কিন্তু তাঁর বাহিনীতে বিভিন্ন জাতির সমাবেশ ঘটেছিল যেমন থ্রেসিয়ান, গ্রীক, গল ও জার্মান । এদের সবাইকে একই নীতিতে বিশ্বাস করানো বাস্তবিক পক্ষেই ভীষণ কঠিন কাজ ছিল । তাদের মধ্যে আবার বেশীরভাগ দল ইতালী ছেড়ে নিজ দেশে না গিয়ে সরাসরি রোম আক্রমণের পক্ষেই ছিল । কিন্তু স্পার্টাকাস বুঝতে পেরেছিলেন যে তাঁর বাহিনী রোম আক্রমণ করার মত অতখানি শক্তিশালী ছিল না । এজন্য স্পার্টাকাস এ ব্যাপারে নিজের মতামতকেই বেশি গুরুত্ব দিলেন এবং রোম আক্রমণের চিন্তা বাতিল করে দিলেন । তাঁর সাথে ভিন্নমত হওয়ার দরুন দুটি দল তাঁর বাহিনী পরিত্যাগ করে ও চলে যায় এবং এটা পরবর্তীকালে তাঁর বিপর্যয়ের কারন হয়ে দাঁড়ায় ।
স্পার্টাকাসের সেনা বাহিনী উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে এগিয়ে যেতে লাগল । অপরদিকে তাঁর আগমনের সংবাদে ভীত হয়ে রোমান সিনেট ক্রেসাস্‌-এর অধীনস্থ বিরাট সৈন্য দল সমবেত করা হল । তারা ছিল স্পার্টাকাস বাহিনীকে বাধা দিতে প্রস্তুত । স্পার্টাকাস কিন্তু রোম আক্রমণ না করেই দক্ষিণ দিকে এগিয়ে চললেন । পথিমধ্যে রোমান বাহিনীর দু’একটি দলের সাথে তাদের খন্ড যুদ্ধ হয় । তাদের পরাজিত করে স্পার্টাকাস বাহিনী শেষ পর্যন্ত ইতালীর সর্ব দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে এসে উপস্থিত হয় । তাদের উদ্দেশ্য ছিল সিসিলিতে গমন করা । কিন্তু সেখানে স্বাভাবিক ভাবেই জাহাজ যোগাড় করা তাদের পক্ষে সম্ভভ হয় নি । কাঠের ভেলায় সমুদ্র পার হওয়ার চেষ্টাও ব্যর্থ হয়ে যায় প্রচণ্ড ঝড়ের কারনে । ইতিমধ্যে ক্রেসাস-এর বাহিনী উপস্থিত হয়ে তাদের পথ রোধ করে দাঁড়াল । কোনো উপায় না পেয়ে স্পার্টাকাস যুদ্ধে লিপ্ত হলেন রোমান বাহিনীর বিপক্ষে । খৃষ্টপূর্ব ৭১ অব্দে রোমানদের সাথে যুদ্ধে স্পার্টাকাসের ক্রীতদাস বাহিনী শেষ পর্যন্ত পরাজিত হয় । স্পার্টাকাস শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করে মৃত্যুবরণ করেন । রোমানরা শক্তিশালী হওয়া স্বত্বেও এ যুদ্ধে তাদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয় । ইতিমধ্যে সিনেট সভার পম্পির নেতৃত্বে রোমানদের আরকটি বাহিনী বলকান উপদ্বীপ থেকে উক্ত যুদ্ধক্ষেত্রে এসে পৌঁছায় । সেখানে তারা অসহায় মৃতপ্রায় ও আহত ক্রীতদাসদের ধরে ধরে ক্রুশে বিদ্ধ করে ঝুলিয়ে রাখে । বিদ্রোহের প্রথম অগ্নি বিপ্লব যেখানে প্রজলিত হয় – সেই কাপুয়া শহর থেকে রোম পর্যন্ত বিস্তৃত রাস্তায় দু’ধারে খুঁটি পুঁতে এভাবে প্রায় ছয় হাজার ক্রীতদাসকে ঝুলিয়ে দেয়া হল শুধুমাত্র বিভীষিকা সৃষ্টি করার জন্য – যাতে ভবিষ্যতে আর কখোনো দাস বিদ্রোহ না ঘটে ।
কিন্তু এত কিছু করেও রোম তার সংকট এড়াতে পারল না । যে সংকটের বীজ রোম নিজে বপন করেছিল ক্রীতদাস প্রথাকে টিকিয়ে রেখে, তা শেষ পর্যন্ত তার নিজেরই পতন ডেকে এনেছিল ।
৩টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ডেল্টা ফ্লাইট - নিউ ইয়র্ক টু ডেট্রয়ট

লিখেছেন ঢাকার লোক, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:২৬

আজই শ্রদ্ধেয় খাইরুল আহসান ভাইয়ের "নিউ ইয়র্কের পথে" পড়তে পড়তে তেমনি এক বিমান যাত্রার কথা মনে পড়লো। সে প্রায় বছর দশ বার আগের ঘটনা। নিউ ইয়র্ক থেকে ডেট্রিয়ট যাবো,... ...বাকিটুকু পড়ুন

ল অব অ্যাট্রাকশন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৪৫

জ্যাক ক্যান ফিল্ডের ঘটনা দিয়ে লেখাটা শুরু করছি। জ্যাক ক্যানফিল্ড একজন আমেরিকান লেখক ও মোটিভেশনাল স্পিকার। জীবনের প্রথম দিকে তিনি হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। আয় রোজগার ছিলনা। ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অর্থ ছিলনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

চরফ্যাশন

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৫৯



নয়নে তোমারি কিছু দেখিবার চায়,
চলে আসো ভাই এই ঠিকানায়।
ফুলে ফুলে মাঠ সবুজ শ্যামলে বন
চারদিকে নদী আর চরের জীবন।

প্রকৃতির খেলা ফসলের মেলা ভারে
মুগ্ধ হয়েই তুমি ভুলিবে না তারে,
নীল আকাশের প্রজাতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

কর কাজ নাহি লাজ

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ১৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪


রাফসান দা ছোট ভাই
ছোট সে আর নাই
গাড়ি বাড়ি কিনে সে হয়ে গেছে ধন্য
অনন্য, সে এখন অনন্য।

হিংসেয় পুড়ে কার?
পুড়েপুড়ে ছারখার
কেন পুড়ে গা জুড়ে
পুড়ে কী জন্য?

নেমে পড় সাধনায়
মিছে মর... ...বাকিটুকু পড়ুন

নতুন গঙ্গা পানি চুক্তি- কখন হবে, গ্যারান্টি ক্লজহীন চুক্তি নবায়ন হবে কিংবা তিস্তার মোট ঝুলে যাবে?

লিখেছেন এক নিরুদ্দেশ পথিক, ১৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:২৬


১৬ মে ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস। ফারাক্কা বাঁধ শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে খরা ও মরুকরণ তীব্র করে, বর্ষায় হঠাৎ বন্যা তৈরি করে কৃষক ও পরিবেশের মরণফাঁদ হয়ে উঠেছে। পানি বঞ্চনা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

×