উঠোন হতেই হাক ছেড়ে ডাকেন “বউ ও ছোট বউ , সবার বাড়িতেই তো পিঠা উৎসব শেষ আমাগো বাড়ি কবে হইবো ??”
ছোট বউ অনুরোধের স্বরে বলে “ আব্বা পোলাগো পরীক্ষা শেষ হউক , তারপর না হয় । ”
পরিবারে বেপারী সাহেবের সবচেয়ে আব্দারের জায়গা তার ছোট ছেলের বউ । ছোট বউ যখন বেপারী বাড়ি আসে তখন মাত্র ১৪/১৫ বছরের কিশোরী , একে একে বেপারী সাহেবের সবগুলো মেয়ের বিয়ে হয়ে গেল আর ছোট বউ হয়ে রইলেন এ বাড়ীর মেয়ে ।
আর ছোট বউই আগলে রেখেছেন পুরো সংসার , ১২০ বছর বয়স্কা দাদী-শাশুড়ীর সাথে শ্বশুর-শাশুড়ী আর স্বামী সন্তান সমেত এক বিশাল পরিবার ।
বেপারী সাহেব হার মানে “ হ তাইলে পরীক্ষাই শেষ ওক তোমার পোলাগো , কি কউ মা ??”
বেপারীর মা রাগে গজ গজ করে “খালি নেহাপড়া কি অয় অত পইড়া , ছাইক্কাপাল , আমিও তো ১ কুড়ি পোলাপাইন পালছি । ”
আসল কথা হলো বেপারীর বুড়ি মা তার নাতনীদের অনেক ভালোবাসেন , যে ভালোবাসা তার নাতনীরা নানী হয়ে গেলেও কমে নি এক রত্তি ।
অবশেষে বাচ্চাদের পরীক্ষা শেষ হয় , এবার দাওয়াত করার পালা । নাতীকে খাতা কলম নিয়া বসতে বলে বেপারী সাহেব আর তিনি একাধারে নাম বলতে থাকেন , যত মানুষকে চিনেন কাউকে বাদ দিতে ইচ্ছে করে না বেপারীর । একটা দিন ঠিক করা হয় পিঠা উৎসবের । মেয়েরা ২/১ দিন আগেই চলে আসে ছেলে-মেয়ে নিয়ে ।
সারারাত্রিব্যাপী চলে কর্মযজ্ঞ , কেউ পেয়াজ-মরিচ কাটছে , কেউবা বানাচ্ছে পিঠা কিংবা মিষ্টি সেমাই আর মেয়ের জামাইরা সব বাংলোঘরে আড্ডায় ব্যাস্ত ।
ওদিকে বেপারী সাহেব নাতীদের মাঝে খুলে দিয়েছেন গল্পের ঝাপি , তার পাটের নৌকায় ডাকাতের আক্রমণ কিংবা যাত্রাদলের অভিনয় কিছুই বাদ পড়ে না । নাতীদের মধ্যে যারা একটু বড় তাদের এ গল্পে আগ্রহ নেই । তাদের ভীন্ন গ্রুপে আড্ডা চলে কেউ একটু বেশী দুষ্টু আর ডানপিটে । হড়হড় করে উঠে যায় খেজুরগাছে তাজা রস খেতে - মধ্যরাত্রির রস নাকি বেশী সুস্বাদু ।
ওদিকে সবার শোবার প্রস্তুতি শুরু হলেও ছোটদের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলে যে যত বেশী রাত জাগতে পারবে সেই তত বড় পালোয়ান , একটু যারা বড় তাদের আলোচনা অব্যাহতভাবে চলে সারারাত্রিব্যাপী সমসাময়িক সিনেমা কিংবা স্কুলের সহপাঠী আর শিক্ষকদের নিয়ে ।
অবশেষে কুয়াশাচ্ছন্ন সকালের আবির্ভাব হয় তুমুল হৈচৈ এর মধ্যে , জামাইয়ের দল চলে যায় বাজারে , সবচেয়ে বড় মাছটা কিনতে হবে আজ , শ্বশুরের মান সম্মান জড়িত এর মধ্যে ।
ছোটদের উঠিয়ে দেয়া হয় ঘুম থেকে , বসে যেতে হবে বারান্দায় লম্বা করে বিছানো মাদুরে , রাতভর রসে ভিজিয়ে রাখা পিঠা খেতে হবে শীতে ঠকঠক করতে করতে । সবার মধ্যে চলে একটা প্রতিযোগিতা যে যত বেশী খেতে পারবে, তার মিলবে বাহবা ।
আর বেপারী সাহেব ইতোমধ্যে বেরিয়ে পড়েছেন পাড়ার সবাইকে ডাকতে , কেউ যেন বাদ না পড়ে এই আয়োজন থেকে , যারা একটু বেশী বয়স্ক -তাদের খাবার পৌছে দেয়া হয় বাড়ীতে বাড়ীতে । বৃদ্ধ বেপারী সাহেবের ডায়াবেটিস তাই তিনি মিষ্টি পিঠা খান না কিন্তু পুরো গ্রামকে খাইয়ে পান আত্মার তৃপ্তি ।
এইসব বেপারী সাহেবরা হয়তো সম্পদশালী নন ,শুধু ভালোবাসা দিয়ে ধরে রেখেছেন সামাজিক বন্ধন ।
কোথা থেকে এক শহুরে হাওয়া এসে আজ স্বার্থপর করে তুলেছে ভালোবাসাময় গ্রামকে !!
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ১১:১৮