somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সুইসাইডাল সেরেনাদে | সোনার বাংলা সার্কাস

৩১ শে মার্চ, ২০২০ বিকাল ৩:৫৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




যেকোন কিছু আবিষ্কারের মধ্যে থাকে নির্মল আনন্দ। আবিষ্কৃত বিষয়টি মাথায় থেকে যায়। যতবার ভাবি ততবারই অবাক হই। কীভাবে সম্ভব এভাবে লেখা এসব ভেবেই বারবার মুগ্ধতা যেন জড়িয়ে যায় নিউরনের সেলে। বলছিলাম সোনার বাংলা সার্কাসের নতুন এবং প্রথম অ্যালবাম "হায়েনা এক্সপ্রেস"-এর কথা। এই পুরো অ্যালবামটি মানব সভ্যতার একটি কনসেপ্টচুয়াল গল্প। আপনি গানে গানে যতবার এই গল্প শুনবেন ততবার নতুন ক্যানভাস আবিষ্কার করবেন।

হায়েনা এক্সপ্রেস অ্যালবাম আসলে মহাকালের সময়কে ধরে ফেলেছে। এই অ্যালবামের গানগুলো সবসময়ের জন্য প্রাসঙ্গিক হয়ে থাকবে। এসব সম্ভব হয়েছে এই ব্যান্ডের সাথে জড়িত সকলেই আসলে সামাজিকভাবে সচেতন, সমাজের অন্যায় অনাচার আমাদের মতো তাদেরকেও ছুঁয়ে যায়। এবং এই সচেতনতা তারা ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন গানের মাধ্যমে। এই সচেতনতা উঠে এসেছে প্রবর রিপনের গলায়, এই সচেতনতা ঝঙ্কার হয়ে বেজেছে গিটারিস্ট পান্ডুর গিটারের ছয়টি তারে।

হায়েনা এক্সপ্রেস অ্যালবামের গানগুলো একদিকে যেমন খুব তীক্ষ্ণ যেন প্রখর রোদ্দুরে আগুনের মতো আঁচ লেগে যায় শরীরে। অন্যদিকে খুব সুক্ষ্ণভাবে প্রচুর মেটাফোর লুকিয়ে রাখা হয়েছে প্রতিটি গানের লিরিকে। তেমনই একটি গান "আত্মহত্যার গান"। এটি অ্যালবামের অষ্টম গান। ছয় মিনিটের এই গানে ধরে রাখা হয়েছে মানব সভ্যতার দুই লক্ষ বছরের ইতিহাস। শৈল্পিকভাবে কীভাবে বিজ্ঞানকে ধরা যায় তার প্রমাণ এই গান। আমি বিশ্বাস করি একমাত্র কবিদের পক্ষেই সম্ভব এটা। আর সেই কবি এবং গায়ক হলেন সোনার বাংলা সার্কাসের ভোকাল প্রবর রিপন। আসুন গানটির লিরিকে একটু চোখ বুলিয়ে নিই -

পাহাড়ের চূড়ো থেকে পাথর গড়িয়ে পড়ছে তোমার পায়ে
যেন সূর্যের হৃদয় চুরি করে কে যেন ছড়িয়ে দিয়েছে গায়ে
পাথর ঘষে ঘষে যে আগুন জ্বেলেছিলে
তারই শিখায় পুড়ছো তুমি নিজেই
এমনকি যে বৃষ্টির অপেক্ষায় বেঁচে আছো
আগুনের আাঁচে সেই মেঘ বাষ্প হয়ে
মিলিয়ে গেছে হৃদয়শূন্য নভোনীলে

পাথর ঘষে ঘষে আগুন আবিষ্কারের ঘটনাকে তুলনা করা হয়েছে সূর্যের হৃদয় চুরি করার সাথে। সেই হাজার হাজার বছর আগে সূর্য ছাড়া কোথাও আগুন পেতো না মানুষ। সেই সূর্যের আগুন ধরানোর সাধ্যও ছিলো না তাদের। কিন্তু একদিন, মহাবিশ্বের সবচেয়ে নিঃসঙ্গতম প্রাণি মানুষ আগুন জ্বালানো শিখে গেলো। পাথরে পাথর ঘষে যে আগুনের আঁচ জ্বালিয়ে দিলো মানুষ, সেই আঁচে হাজার হাজার বছর ধরে পুড়ে যাচ্ছে সব। সেই আগুনের তাপে আজ পৃথিবীর বৈষ্ণিক উষ্ণতা বেড়ে চলেছে। থামানোর কোন উপায় নেই। গত দুইশ বছরে বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব অগ্রগিত এবং তা থেকে সুবিধা নেয়া কর্পোরেট বেনিয়াদের অপরিণামদর্শী দৌড়াত্ম্যে পৃথিবী মাত্র একশত বৎসর পূর্বের অবস্থা থেকে বর্তমানে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। প্রকৃতপক্ষে বর্তমানের প্রযুক্তিগত অর্জন এতো বেশি যে নিকট ভবিষ্যতে এই পরিবর্তিত অবস্থাকে পূর্বের অবস্থানে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। একশত বৎসর পূর্বের গড় তাপমাত্রার তুলনায় বর্তমান বিশ্বে গড় তাপমাত্রা প্রায় ০.৬০ ডিগ্রী সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে। কম্পিউটার প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে জলবায়ুগত পরিবর্তন সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে যে, ২১ শতকের সমাপ্তিকালের মধ্যে বিশ্ব তাপমাত্রায় আরও অতিরিক্ত ২.৫ ডিগ্রী থেকে ৫.৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা যুক্ত হতে পারে। ফলে, পৃথিবী পৃষ্ঠের পানির স্ফীতি, অত্যুচ্চ পর্বতের বরফশীর্ষ এবং মেরু অঞ্চলের হিমবাহের দ্রুত গলনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের পানির উচ্চতার ক্ষেত্রে একটি বৃহৎ পরিবর্তন ঘটতে পারে। সে পরিবর্তন আসলে মানুষ এবং ভূপৃষ্ঠে বেঁচে থাকা প্রাণীদের জন্য খুব সুখকর নয়। বৈষ্ণিক উষ্ণায়ন এখনও মানুষ বুঝতে পারছে না, তারা এখনও সেই আগুন নিয়েই খেলে যাচ্ছে, সেই খেলায় কোন নিয়ন্ত্রণ রাখেনি মানুষ কোনকালে। দূষণ রোধে নেই কোন পরিকল্পনা। এমনকি যে গুটিকয়েক মানুষ ভাবছে একদিন সব নিভে যাবে, একদিন হর্তাকর্তারা সতর্ক হবে, তাদের ভাবনাও ভুল। কারণ ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে বসে আছে যেসব মানুষ তাদের হৃদয় বলতে কিছু নেই। আমাদের পৃথিবীকে বাঁচানোর আকুতি তাদের হৃদয়ে পৌছায় না, অর্থের চাহিদার আগুনে তারা নিজেরা পুড়ছে, পৃথিবীকেও পোড়াচ্ছে।

মহাশূণ্য তোমার চোখের কোটর
তুমি পৃথিবীর কবর
মানুষ হতে যাকে খুন করেছিলে সেই বর্বর
তার অভিশাপে তুমি ঢেউছাড়া মহাসাগর

এই প্যারাটুকু খুব বেশি অসাধারণ। আমি আবারও বলছি, একমাত্র কবিদের পক্ষেই সম্ভব এভাবে লেখা। বিবর্তনের বিশাল সময়ের পরিক্রমাকে মাত্র দুটি লাইনে ধরে ফেলা। বিজ্ঞানীদের মতে নিয়ান্ডারথাল এবং হোমো সেপিয়েন্সদের মধ্যে খাদ্য নিয়ে প্রতিযোগীতা এবং টিকে থাকার লড়াইতে নিয়ান্ডারথাল প্রজাতি নিশ্চিহ্ন হয় হোমো সেপিয়েন্সদের হাতেই। যদিও নিয়ান্ডারথালরা আকারে শক্তিশালি কিন্তু যে কারণে আজকের মানুষ এতো দানব হয়ে উঠেছে তার কারণ ছিলো হোমো সেপিয়েন্সদের মস্তিষ্কের ব্যবহার। বুদ্ধি দিয়েই হোমো সেপিয়ান্সরা খাদ্যের লড়াইয়ে পরাজিত করেছে নিয়ান্ডারথালদের। সেই শুরু, তারপর হাজার হাজার বছর পেরিয়ে গেছে, হোমো সেপিয়েন্স তথা মানুষ আরও উন্নত হয়েছে। নিশ্চিহ্ন করেছে আরও অসংখ্য প্রজাতিকে যাদের কেউই হয়তো মানুষের প্রতিপক্ষ ছিলো না, স্রেফ মানুষের অনন্ত চাহিদার কাছে ধ্বংস হয়ে গ্যাছে। আজকে মানুষ নিজেই হুমকীর মুখে, পৃথিবী নিতে পারছে না মানুষের এতো চাহিদার বোঝা। এ বুঝি সেই মুছে যাওয়া নিয়ান্ডারথালদেরই অভিশাপ?

নভোযানে চেপে চলেছো ধীরে ধীরে খুলেছো মহাশূন্যের দরজা
ওপাশে মরা ঈগল পোড়া আকাশ তার নখরে
তার শিশুর চোখে আগুনে পুড়ছে মহাকাল
সেই মহাকালে তুমি ছিলে নিজেকে বারবার পিছে ফেলে
যুদ্ধবিধ্বস্ত শহরের মত তোমার হৃদয়
হৃদয় ঘষে ঘষে পোড়াও সেই শহরের স্মৃতিরেখাও।

পাখিদের জন্য মুক্ত আকাশ, পশুদের জন্য মুক্ত চারণভূমি'র ব্যবস্থা না করেই মানুষ মহাশুণ্যে পাড়ি দিতে চাচ্ছে। পৃথিবীকে মানুষ নিজের ইচ্ছেমতো ব্যবহার করে এখন যখন পৃথিবীর সম্পদ শেষ হবার পথে তখন সে মঙ্গলগ্রহে যাবার জন্য কোটি কোটি টাকা খরচ করছে। ভাবছে তার অস্তিত্ব পৃথিবীতে আর টিকিয়ে রাখা যাবে না, অথচ এমনতো কথা ছিলো না। এই পৃথিবী যেমন মানুষ বাঁচিয়ে রেখেছে তেমন বাঁচিয়ে রেখেছে একটা ছোট্ট পতঙ্গকেও। কিন্তু মুক্ত আকাশ, সুস্থ পরিবেশ এসবে মানুষের কোন ভ্রুক্ষেপ কখনও কোনকালে ছিলো না। সে সবসময় পৃথিবীকে পেছনে ফেলে নিজেই এগিয়ে যেতে চেয়েছে। মহাবিশ্বের প্রাণের কেন্দ্রবিন্দু পৃথিবী এবং তার সন্তানদের নিয়ে আগানোর কথা মানুষ কখনও ভেবেছিলো কি? মানুষও কি পৃথিবীর সন্তান নয়? সুন্দর পৃথিবী, আনন্দময়ী পরিবেশের কোন স্মৃতিই কি মানুষের মনে নাই? সর্বজয়ী সন্তানের কাছ থেকে এতো অযত্নই কি পৃথিবীর প্রাপ্য ছিলো? প্রশ্ন থেকেই যায়।

পৃথিবী এবং তার নিপীড়িতদের নিয়ে সোনার বাংলা সার্কাসের এই সচেতনতা আমি দীর্ঘদিন ধরেই লক্ষ্য করছি। টিভিতে তাদের যতগুলো শো আমি দেখেছি, সবগুলোতেই তারা এসব বলেছেন। আমার মনে আছে একবার এক উপস্থাপিকা জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনাদের গান থেকে এসব দুঃখবোধ কবে যাবে। উত্তরে ব্যান্ডের ভোকাল প্রবর রিপন বলেছেন, "যেদিন পৃথিবী ভালো থাকবে, কোন নিপীড়িত মানুষ থাকবে না হয়তো সেদিন।" এমন অকপট স্বীকারোক্তি আমাকে মুগ্ধ করেছে। পৃথিবী সোনার বাংলা সার্কাসকদেরকেই চায়, কিন্তু আফসোস পৃথিবীর জন্য চিন্তা করার সময় কই মানুষদের?

পরিশেষে বলতে চাই, আমাদের এই প্রতিবাদহীন মনোটোনাস জীবনে সোনার বাংলা সার্কাস আসলে একটা ম্যাজিক। যে ম্যাজিকের স্পর্শে আমরা একটু ভালো থাকতে পারি, অনুভব করতে পারি আমাদের কাঙ্খিত পৃথিবীর অস্পর্শ ছোঁয়া। অন্ধ দেয়ালের মতো সুরে বেজে ওঠে -

আমার এই গানে,
মুক্তির কোন পথ খোলা নেই
হতেও পারে এই গানের বাইরে
কোথাও তোমার দেশ

পুরো অ্যালবাম পাবেন ইউটিউব প্লেলিস্টে
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে মার্চ, ২০২০ বিকাল ৪:০১
৫টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×