রবি-তাপ যখন চরমে তখন নজরুল ইসলামের জন্ম। রাবীন্দ্রিক-আকাশে সহসা উড়িয়ে ফ্যান আত“নামখচিত পতাকা। কবি, রোমান্টিক কবি তিনি। প্রেম ও দ্রোহের আয়োজনে ব্যস্ত। রূপ-রস-আনন্দ সমুদ্রে মজ্জমান। বাঁধ ভাঙা জোয়ারের মতো তাঁর আবেগ- কবিতায় কোনো ভণিতা নেই, আছে নিখিল মানবের পক্ষে সাহসী উচ্চারণ। আপন দুঃখবোধকে গেঁথে দিয়েছেন আনন্দবোধের সঙ্গে। সব কিছুকে ছুঁয়ে দেয়ার জন্য চাই অমোঘ শব্দ। নজরুল শব্দ-সন্ধানী বিচিত্র শব্দ, প্রতীক ও ছন্দে তিনি তাঁর কবিতাকে সাজিয়েছেন। তাঁর কবি-ব্যক্তিত্বের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে ছন্দ। নানান দেশের নানান ভাষার উপাদানকে তিনি সচ্ছন্দে ব্যবহার করেছেন কবিতা, গান ও অনুবাদে। নজরুল ভাষাবিজ্ঞানী নন, তবে ভাষার অন্তর্নিহিত ব্যক্তিকে চমৎকারভবে কাজে লাগিয়েছেন। আরবি, ফারসি, উর্দু, হিন্দি, সংস্কৃত, ইংরেজি, তুর্কি শব্দ-প্রয়োগে তাঁর দক্ষতা লক্ষণীয়। কোরাআনের শেষ অনুচ্ছেদ ‘আমপারা’ তিনি ‘বাংলা ছন্দে অনুবাদ করেন’। এ পুস্তিকাতে তাঁর গভীর আরবি জ্ঞান ধরা পড়ে না- ধরা পড়ে তাঁর কবিজনোচিত অন্তর্দৃষ্টি এবং আমপারার সঙ্গে তাঁর যে আবাল্য পরিচয়। বিশেষ করে ধরা পড়ে, দরদ দিয়ে সৃষ্টিকর্তার বাণী (আল্লাহর কালাম) হƒদয়ঙ্গম করার তীক্ষè ও সূক্ষ্ম প্রচেষ্টা। তিনি মূল ফারসি থেকে ‘রুবাইয়াৎ-ই-হাফিজ’ ও ‘রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম’ নামে দৃষ্টি গ্রন্থ অনুবাদ করেন। বিশেষত রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম নজরুলের একটি সাড়া জাগানো অনুবাদ গ্রন্থ। অনুবাদের মাধ্যমে তিনি ইরান-তুরানের স্বপ্নভূমিকে ফুটিয়ে তুলেছেন, ফুটিয়ে তুলেছেন ওমর খৈয়ামের মানস জগৎকে।
খৈয়ামের জন্ম ইরানের নিশাপুর শহরে। তাঁর জন্ম সাল ঠিকমতো জানা যায়নি, এমন কি তাঁর, মৃত্যুর সন ও মোটামুটি ১১২৩ খ্রিস্টাব্দ বলে ধরে নেয়া হয়েছে।
খৈয়াম শব্দের অর্থ ‘তাম্বু নির্মাণকারী’। অথচ ওমর খৈয়াম তাঁবুর ব্যবসা কখনো করেননি। খৈয়াম নাম তাঁর বংশ পদবী বলে বিবেচিত। ওমর তাঁর এটা পদবীটি নিয়ে তীব্র ব্যঙ্গ করেছেন :
জ্ঞান-বিজ্ঞান ন্যায়-দর্শন সেলাই করিয়া মেলা
খৈয়াম কত না তাম্ব গড়িল; এখন হয়েছে বেলা
নরককুন্তে জ্বলিবার তরে। বিধি-বিধানের কাঁচি
কেটেছে তাম্বু-ঠোককর খায়, পথ-প্রান্তরে ঢেলা।
[অনুবাদ: সৈয়দ মুজতবা আলী]
খৈয়াম ছিলেন গণিত শাস্ত্রে অসাধারণ পণ্ডিত। অবসর কাটানোর জন্য দৈবেসৈবে চতুষ্পদী লিখতেন, তাঁর নামে প্রচলিত গজল, মসনবী যা অন্য কোনো শ্রেণীর দীর্ঘতর কবিতা আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।
রুবাইয়াৎ বা চতুষ্পদী কবিতা হচ্ছে এক ধরনের পদবন্ধ বিশেষ বা ছন্দস্তবক (গবঃৎরপধষ ঝঃধহুধ)। তার প্রথম, দ্বিতীয় ও চতুর্থ চরণে মিল রয়েছে, তৃতীয় চরণ স্বাধীন বা অমিল। ইরানি আলঙ্কারকরা বলেন, তৃতীয় ছত্রে মিল না দিলে চতুর্থ ছত্রের শেষ মিলে বেশি ঝোঁক পড়ে এবং শ্লোক সমাপ্তি তার পরিপূর্ণ গাম্ভীর্য ও তীক্ষèতা পায়। ঃ পাঠককে এ বেলাই বলে রাখি, তৃতীয় ছত্রে মিলহীন এই জাতীয় শ্লোক পড়ার অভ্যাস করে রাখা ভালো। নইলে নজরুল ইসলামের ওমর-অনুবাদ পড়ে পাঠক পরিপূর্ণ রস গ্রহণ করতে পারবেন না। কারণ কাজী আগাগোড়া ক-ক, খ-ক মিলে ওমরের অনুবাদ করেছেন। কান্তি ঘোষ করেছেন বাংলা রীতিতে অর্থাৎ ক-ক খ-খ। কান্তি চন্দ্র ঘোষ কবি ছান্দসিক সত্যেন্দ্রনাথ দত্তকৃত রুবাইর মিল পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন। ফলে রুবাইর ছাদ তাঁদের অনুবাদে অনুসৃত হয়নি। তাঁদের অনুবাদে রুবাইয়াতের তৃতীয় পঙ্ক্তি স্বাধীন নয়। বাংলায় ভাষায় প্রথম ওমরের রুবাই অনুবাদ করে পরিবেশন করেন কবি অক্ষয় কুমার বড়াল (১৮৬৫-১৯১৮)।
তিনি তাঁর অনুবাদে ফারসি রুবাইর মিল বিন্যাস বজায় রেখেছেন। নজরুলও ওমর খৈয়ামের রুবায়াইৎ অনুবাদে অসাধারণ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। ভাব ও ছন্দ এবং মিল বিন্যাসকে তিনি অক্ষুণœ রাখতে সচেষ্ট হয়েছেন। ওমর খৈয়ামের রুবাইয়াৎ প্রসঙ্গে তাঁর মন্তব্য প্রণিধান যোগ্য ওমরের রুবাইয়াৎ বা চতুষ্পদী কবিতা চতুষ্পদী হলেও তার চারটি পদই ছুটেছে আরবি ঘোড়ার মতো দৃপ্ততেজে সমতালে ভাণ্ডামি, মিথ্যা-বিশ্বাস, সংস্কার, বিধি-নিষেধের পথে ধূলি উড়িয়ে তাদের বুক চূর্ণ করে। সেই উচ্চঃশ্রবা আমার হাতে পড়ে হয়তো বা বজদ্দি ঘোড়লের ঘোড়াই হয়ে উঠেছে। আমাদের গ্রামের কাছে এক জমিদার ছিলেন তাঁর নাম বজদ্দি মোড়ল। তাঁর এক বাগনামানা ঘোড়া ছিল, সে জাতে অশ্ব হলেও গুণে অশ্বতর ছিল। তিনি যদি মনে করতেন পশ্চিম দিকে যাবেন, ঘোড়া যেত পূর্ব দিকে। ঘোড়াকে কিছুতেই বাগ মানাতে না পেরে শেষে বলতেন ‘আচ্ছা চল, এদিকেও আমার জমিদারি আছে।’
ওমরের বোররাক বা উচ্চৈঃশ্রবাকে আমার মতো আনাড়ি হওয়ার যে বাগ মানাতে পারবে, সে ধৃষ্টতা আমার নেই। তবে ওই বজদ্দি মোড়লের মতো ঘোড়াকে তার ইচ্ছামতো পথেও যেতে দিইনি। লাগাম কষে প্রাণপণ বাধা দিয়েছি যাতে সে অন্য পথে না যায়। ঃতবে এটুকু জোর করে বলতে পারি তাঁর ঘোড়া আমার হাতে পড়ে চতুষ্পদী ভেড়াও হয়ে যায়নি প্রাণহীন চারপায়াও হয়নি। নজরুলের কিছু অনুবাদ উদ্ধৃত করছি :
(ক) একমণী ঐ মদের জালা গিলব, যদি পাই তাকে,
যে জ্বালাতে প্রাণের জ্বালা নেভাবার ওষুধ থাকে।
পুরানো ঐ যুক্তি-তর্কে দিয়ে আমি তিন তালাক,
নতুন করে করবো নিকাহ আঙ্গুর-লতার কন্যাকে।
[ // ৫১ //]
(খ) ‘এক সোরাহি সুরা দিও, একটু রুটির ছিলকে আর,
প্রিয় সাকী, তাহার সাথে একখানি বই কবিতার,
জীর্ণ আমার জীবনজুড়ে রইবে প্রিয়া আমার সার্থ
এই যদি পাই চাইবো না কো তখ্ত আমি শাহানশার’।
(গ) তত্ত্বগুরু খৈয়ামেরে পৌঁছে দিও মোর আশিস্
ওর মতো লোক বুঝলো কিনা উল্টো করে মোর হদিস !
কোথায় আমি বলেছি, যে সবার তরেই মদ, হারাম
জ্ঞানীর তরে অমৃত এ, বোকার তরে উইাই বিষ।
[//১৯৭//]
নজরুল লোকছন্দ বা স্বরবৃত্ত ছন্দে ফারসি কবিতায় ছন্দ-মেজাজকে ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর অনুবাদ কর্মে বিশেষত ওমর খৈয়ামের রুবাই অনুবাদে। নজরুলের বহু আগে ফারসি রুবাইার গঠন পদ্ধতি মেনে ১৮৫৯ সালে প্রকাশিত হয় ফিটজেরান্ডের জঁনধরুধঃ ড়ভ ঙসধৎ কযধুুধস. ওমর খৈয়ামের কবিতায় শারাব সাকীর ছড়াছড়ি, গোলাপ, বুলবুলও ঠাঁই পেয়েছে। ফিটজেরাল্ডের মতে, ওমর যে শারাবের কথা বলেছেন তা দ্রাক্ষাসব, তাঁর সাকীও রক্তমাংসের। নজরুলের মতে, ওমরের কাব্যে শারব-সাকীর ছড়াছড়ি থাকলেও তিনি জীবনে ছিলেন আশ্চার্য রকমের সংযমী। তাঁর কবিতায় যেমন ভাবের প্রগাঢ়তা, অথচ সংযমের আঁটসাঁট বাঁধুনী, তাঁর জবনও ছিল তেমনি।
মসিয়েঁ নিকোলাসের মতে, ওমর খৈয়াম ছিলেন হাফিজের মতো মিরে সুফি। কিন্তু ফিট জেরাল্ডের মতে, ওমর ছিলেন বস্তুতান্দ্রিক ভোগবাদী। নজরুল মনে করেন, ওমরকে ঊঢ়রপঁৎবধহ কতকটা বলা যায় শুধু তাঁর ‘ফুকরিয়া’ শ্রেণীর কবিতার জন্য। ওমরের কাব্য-ভাবনায় ছয়টি বিষয় প্রাধান্য পেয়েছে ১. শিকায়াত-ই-রোজগার অথাৎ গ্রহের ফের বা অদৃষ্টের প্রতি অনুযোগ। ২. ‘হজও’ অথাৎ ভণ্ডদের, বকধার্মিকদের প্রতি ক্লেশ-বিদ্রƒপ ও তথাকথিত আলেম বা জ্ঞানীদের দাম্ভিকতা এবং মূর্খদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ। ৩. ‘ফিবাফিয়া’ ও ‘ওসালিয়া’ বা প্রিয়ার বিরহ ও মিলনে বিশেষ অনুভূতি। ৪. ‘বাহরিয়া’বসন্ত, ফুল, বাগান, ফল, পাখি ইত্যাদির প্রশংসা। ৫. ‘কুফরিয়া’ ধর্ম শাস্ত্র বিরুদ্ধভাব। ৬.‘মেনাজাত’ বা খোদার কাছে প্রার্থনা [নজরুল রচনাবলি, চতুর্থ খণ্ড, রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম ভূমিকা কাজী নজরুল ইসলাম, পৃ: ২৮৮]
ওমরের রুবাইয়াতের মতবাদের জন্য তাঁর দেশের তৎকালীন ধর্মগোঁড়াদের অত্যন্ত আক্রোশ ছিল, তবু তাঁকে দেশের শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী বলে সম্রাট থেকে জনসাধরণ পর্যন্ত ভক্তির চোখে দেখত। ঃ সাধারণের শ্রদ্ধাভাজন হওয়ার শাস্তি তাঁকে পেতে হয়েছিল হয়তো এভাবেই যে, তিনি নিজের স্বাধীন ইচ্ছামতো জীবন যাপন করতে পারেননি। শারাব-সাকীর স্বপ্নই দেখেছেন তাদের ভোগ করে যেতে পারেননি। ঃ ওমর যেন মরুভূমির বুকের খর্জুর তরু। [ভূমিকা/নজরুল]
অনুবাদের ক্ষেত্রে নজরুল ওমর খৈয়ামের ‘রুবাইয়াৎ’-এর ভাব ভাষা-ছন্দের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন বেশি।
প্রাসঙ্গিকভাবে নজরুলের ‘রুবাইয়াৎ-ই-ওমর’এর ভূমিকা থেকে একটু অংশ উদ্ধৃত করছি : ‘আমি ওমরের রুবাইয়াৎ বলে প্রচলিত প্রায় এক হাজার রুবাই থেকেই কিঞ্চিতোধিক দুশ’ রুবাই বেছে নিয়েছি এবং তা ফারসি ভাষার রুবাইয়াৎ থেকে। কারণ আমার বিবেচনায় এইগুলি ছাড়া বাকি রুবাই ওমরের প্রকাশভঙ্গি বা স্টাইলের সঙ্গে একেবারে মিশ খায় না। ঃআমি আমার ওস্তাদি দেখবার ওমর খৈয়ামে ভাব ভালো বা স্টাইলকে বিকৃত করিনি অবশ্য আমার সাধ্যমতো। এর জন্য আমাকে অজস্র পরিশ্রম করতে হয়েছে। কাগজ-পেন্সিলের যাকে বলে আদ্যশ্রাদ্য। তাই করে ছেড়েছি। ওমরের রুবাইয়াতের সবচেয়ে বড় জিনিস ওর প্রকাশের ভঙ্গী বা ঢঙ। ঃ আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি ওমরের সেই ঢঙটির মর্যাদা রাখতে, তার প্রকাশভঙ্গি যতটা পারি কায়দায় আনতে।’
ওমর খৈয়ামের রুবাইর সংখ্যা কত তা আজ ও সঠিকভাবে জানা যায়নি। অবশ্য সংখ্যা দিয়ে কী হবে ওমরের প্রতিটি রুবাই গুণমান সম্পন্ন। তাঁর রুবাইয়াতে আমরা শুনতে পাই জ্ঞান-তরঙ্গ-ধ্বনি, বিলাপ, গর্জন, জীবন্মৃত্যুর রহস্যময় প্রশ্নবিদ্ধ আওয়াজ। আমাদের সুখে-দুঃখে ঈশ্বর নির্বিকার, আমরা তাঁর হাতের খেলার পুতুল ছাড়া আর কিছু নই। জগতের সব কিছু মিথ্যা। একমাত্র সত্য, যে মুহূর্তে তোমার হাতের মুঠোয় এলো তাকে চুটিয়ে ভোগ করে নাও।
গণিত ও জ্যোতি বিজ্ঞানে ওমর খৈয়ামের ছিল অসাধারণ পাণ্ডিত্য। ইরানের অধিকাংশ গুণীই একমত যে, ওমর তাঁর জীবনের প্রায় সব সময়টুকু কাটিয়েছেন বিজ্ঞান চর্চায় এবং অতি অল্প সামান্য সময় ‘নষ্ট’ করেছেন বিজ্ঞান আরাধনায়। বিজ্ঞানের রহস্যঘন জগতে কখন যে তিনি কবিতার স্বপ্নবীজ বুনে দিয়েছেলেন তা ভাবলে আমাদের আশ্চর্য লাগে।
আমরা শরাব খেলে মাতাল হই, বখামি করি, কবিতা লিখি না; কিন্তু ‘ওমর খেলে রুবাইয়াৎ লেখেন’। আর আমরা ডুবে যাই রুবাইয়াতের রসে-আনন্দে বিভিন্ন লেখকের অনুবাদের কল্যাণে। সৈয়দ মুজতবা আলীর ভাষায় বলা যায়, ‘কাজীর অনুবাদ সকল অনুবাদের কাজী।’ ম
সহায়ক গ্রন্থ : নজরুল রচনাবলি, (চতুর্থ খণ্ড) ১৯৮৪
২. রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম, মোহন লাইব্রেরি, ১৯৯৮।