শান বাঁধানো ঘাটটির চারদিকের গাছপালা দেখে মনে হয় গাছগুলো পুকুরটাকে ঢেকে রেখেছে। বড় বড় আম, জাম, জামরুল, লিচু ও কৃষ্ণচূড়া গাছগুলো আজীবন পুকুরটির আব্রু রক্ষা করছে। কিন্তু আজ খুব একটা লাভ হচ্ছেনা, মাঝে মাঝে বেহায়া বাতাস পুকুরটির শ্লীলতাহানি করে যাচ্ছে।
আমার অত্যন্ত প্রিয় জায়গা এইটা, মন খারাপ হলেই এইখানে আসি মন ভাল করতে। কিন্তু সেইদিন মন ভাল করার একমাত্র উপায়, এই প্রিয় জায়গাটাও মন ভাল করতে পারছিলনা বরং এইখানে এসে আরও বিরক্ত লাগছিল আমার। তাই তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে যাচ্ছি।
আমার এইভাবে ফিরে যাওয়াটা মনে হয় কেউ পছন্দ করছিল না তা-ই একটু পরপর বাতাস দৌড়ে এসে আমাকে জাপটে ধরছে আর পাতাগুলো পতপত শব্দ করে তাতে সমর্থন জানাচ্ছে। কিন্তু আমি থামবনা, আমি এই পৃথিবী থেকেই বিদায় নিতে চাই। আমি এই পৃথিবী, পৃথিবীর মানুষ সকলের প্রতি খুবই অতিষ্ঠ।
বাসার পথে হাঁটতে হাঁটতে আপন মনে ভাবছি, ‘আমি একটা অকর্মা, দুনিয়ার সকল অঘটনের মধ্যমণি। আমার মধ্যে কোনই গুন নেই, এই জন্যই হয়ত আমি আজও একা। আমি এই পৃথিবীর বোঝা ছাড়া আর কিছুই না।‘
ভাবতে ভাবতে থামলাম। নিজেকে প্রশ্ন করলাম ________আসলেই কি আমি বোঝা? আচ্ছা, একটা মানুষ কি সব কাজ পারে? পারেনা তো। আমিও তেমন পড়ালেখা পারি না। পড়ালেখাটা আমার জন্য না। এইটা জহির স্যার কেন বোঝে না! আজ ক্লাসে পড়া পারলাম না বলে জহির স্যার এইভাবে বকা দিলেন! গোটা ক্লাসের সামনে এইভাবে অপমান করলেন! একটা পড়ায় তো পারিনি, কি এমন হয়েছে? এই জন্য এত্ত এত্ত কড়া কথা, আমি ভার্সিটিতে ঘুরতে আসি! আমি তো ভার্সিটিতে পড়তেই এসেছি, আমার কোন বন্ধু তো দুরের কথা, বান্ধবীও নেই। তাহলে উনি কেন বললেন!
আমার মনের উথাল-পাথাল, নাড়ার শব্দে স্পষ্ট বোঝা গেল। দরজা খুলে মা জিজ্ঞেস করল, “কি রে, মন খারাপ মনে হচ্ছে?”
মায়ের কথার উত্তর না দিয়ে সে হনহন করে ঘরে গেলাম। ব্যাগটাকে জহির স্যার ভেবে আছড়ে ফেলল বিছানায়! টেবিলের থেকে পাজেলটা হাতে নিয়ে বিছানায় শুলাম। মা এসে একবার দরজায় বারিয়ে জিজ্ঞেস করল, কি রে খাবি না ?
মায়ের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার থেকে আমার মন ভাল করাটা বেশি জরুরি কাজ তাই মায়ের কথা ভ্রূক্ষেপ না করে মিনার চেহারা মিলাতে ব্যস্ত হয়ে পরলাম। মাগরিবের আযানে ঘুম ভাঙল। গায়ের কাপড় ঠিক করতে করতে ভাবছি, ঘুমটা কার্যকর ছিল। আজ থেকে আর সময় নষ্ট না, লেখাপড়ায় গভীর মনযোগী হতে হবে। পরবর্তীতে যেন আমার performance দেখে জহির স্যার মনে করে, ভার্সিটিতে উনি পড়াতে না, ঘুরাফেরা করে বেতন নিতে আসেন।
বিছানা থেকে নেমে চুল বাধতে বাধতে হাক দিলাম, মা এক কাপ কফি বানিয়ে দাও তো, আজ অনেক পড়া আছে।
একঘণ্টা থেকে টেবিলে বসে বইখাতা নাড়াচাড়া করছি কিন্তু এখনও পর্যন্ত একটা পৃষ্ঠা পড়ে শেষ করতে পারলাম না! পড়তে বসলেই কি যেন সব ভাবনা আসে মাথায়। এত্ত গুলো স্বপ্ন গিজগিজ করে। একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ চোখে ধরা দেয়। এমন একটা দিন যেদিন কেউ আমাকে অবহেলা করবে না, কথায় কথায় বাবা আমাকে অনুভব করাবেনা, আমি দুনিয়ার বোঝা। সবাই আমাকে নিয়ে গর্ব করবে। আমার পরিচয়ে পরিচিত হতে চাইবে। এমন দিন কি পাব আমি! নাকি সব টুকুই শুধু কল্পনা। _________ এইসব ভাবতে ভাবতেই প্রতিদিনের মত আজও আমার লেখাপড়া গোল্লায় গেল।
মায়ের ডাকে সকাল হল। তাড়াতাড়ি উঠে ভার্সিটির উদ্দেশে রওনা হলাম। ক্লাসে ঢুকতেই শুনতে পেলাম আবির চেঁচিয়ে উঠল, এই দেখ, ভার্সিটিতে ঘুরতে এসেছে।
আবিরের কথা শুনে সবাই হাঁসিতে ফেটে পড়ল। এসব দেখে আমি পারলাম না চোখের পানি আটকে রাখতে। এসব কিছুই ছিল সহ্যের অতীত তাই ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেলাম। আবির মজা করতে এত ব্যস্ত ছিল যে আমার ক্লাস থেকে বেরিয়ে যাওয়া ওর দৃষ্টি এড়িয়ে গেল।
স্যার ক্লাসে আসতেই পুরো ক্লাস শান্ত হল, একেবারে যেন শ্মশান ঘাট! শান্ত ক্লাসে আবির খেয়াল করল আমি ক্লাসে নেই। স্যারকে উপেক্ষা করে আবির ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেল আমাকে খোঁজার জন্য। হয়ত ওর অনুশোচনা হচ্ছিল।
জহির স্যার এমনি অনেক কড়া হলেও আবিরের ক্ষেত্রে অত্যন্ত সহৃদয়, ক্লাস এর ফার্স্ট বয় বলে কথা। জহির স্যার আবির এর মধ্যে শুধু সম্ভাবনাই নয়, নিজেকেও দেখতে পান। তাই সবসময় ওর সাতখুন মাফ করে দেন।
আমি আমার প্রিয় জায়গায় যাওয়ার জন্য রিকশাতে উঠছিলাম সেই মুহূর্তে কেউ একজন আমাকে আকুল আবেদন জানাল, না যাওয়ার জন্য। পিছে ঘুরে আমি যা দেখলাম তা স্বপ্নই ছিল, আবির আমাকে না যাওয়ার জন্য অনুরোধ করছে।
আবিরের পোশাক, চালচলন, কথাবার্তা সব মেয়ের নজর কাড়ে। এসবের সাথে ওর রেজাল্টটা যেন তার প্রতি মেয়েদেরকে আকৃষ্ট করার মূল জাল হিসেবে কাজ করে। এক কথায়, Mr. Perfect হওয়ার যোগ্যতা আবির রাখে। আবির মুলত আমার মনেও একটা বিশেষ জায়গা নিয়ে আছে। সুতরাং আবির এর আমার কাছে মাফ চাওয়াতে আমি অনেকটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। বুঝতে পারছিলাম না, কি বলব! আমি কিছু একটা বলার জন্য মুখ নাড়াচ্ছিলাম কিন্তু কোন শব্দ বের হচ্ছিল না। নিজের সাথে যুদ্ধ করে অবশেষে উত্তর দিলাম- না, ঠিক আছে।
___________ কীভাবে ঠিক আছে! সব কিছু ঠিক থাকবে যদি আপনি আমার সাথে হাফিজ ভাইয়ের দোকানে ১০মিনিট বসেন।
আমি প্রতিবাদি কণ্ঠে উত্তর দিলাম, আমাকে আপনি বলার দরকার নেই।
____________ আচ্ছা, চল।
ডিপার্টমেন্টের যত হইচই আর গ্যাঞ্জাম সব যেন হাফিজ ভাইয়ের দোকানেই বোঝা যায়। আমরা দু’জন হাফিজ ভাইয়ের দোকানে বসতেই পিকলু একটা প্লেট আবিরের দিকে বারিয়ে বলল, নেন আবির ভাই আপনার সিংগারা আর ডিমের চপ।
___________ পিকলু আজ এই অর্ডার নিয়ে যা। আজ এই আপা যা খাবে সেইটা নিয়ে আয়।
আমার কিছু লাগবে না। আমি নাস্তা করে এসেছি। _______ কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে আমার উত্তর।
__________ সবাই সকালে নাস্তা করেই বের হয়। তাই বলে পরে কিছু খাওয়া যাবেনা এই নীতি আমি এই পর্যন্ত কোন দেশের সংবিধানে পড়িনি। এখন জহির স্যারকে জিজ্ঞেস করে দেখতে হবে। যদি উনি এমন নীতির কথা জেনে থাকেন তাহলে জানবো আমার আইনে পড়াশুনা করা বৃথা।
আবিরের কথা শুনে আমি খিলখিল করে হেসে উঠলাম।
সেই দিন থেকে শুরু হল আমাদের বন্ধুত্ব। সেদিনের পর আমি আর জহির স্যার এর কাছে বকাও খাইনি। কারন ক্লাস শেষে আবিরের সাথে আড্ডা দেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে আগামী ক্লাস এর পড়াটাও বুঝে নিতাম।
এইভাবে কয়েক মাস কেটে গেল। একদিন ডিপার্টমেন্ট এ ঢুকতেই দেখি সবাই আমার দিকে আড় চোখে তাকাচ্ছে। সবার এমন চাহনিতে আমি একবার ভাল করে নিজের দিকে চোখ বুলিয়ে নিলাম।
না, আমি তো ঠিকই আছি তাহলে সবাই এইভাবে আমার দিকে তাকাচ্ছে কেন! _________ ভাবতে ভাবতে অনুভব করলাম কেউ আমার হাত শক্ত করে চেপে ধরে হাঁটতে শুরু করল।
হাঁটতে হাঁটতে আবির বলল, তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।
সারপ্রাইজটা কি টা জানতে চাওয়ার সাহস হল না আমার, এইসব নিজের মুখে জানতে চাওয়া যায় নাকি! আমি অতি আনন্দে আবিরের সাথে হাঁটছি, আজ আবির তার মনের কথা বলবে আমাকে, আমি নিশ্চিত। সেই আনন্দে আমার হাত শক্ত করে চেপে ধরার ব্যথাটাও সয়ে যাচ্ছে। নোটিশ বোর্ডের কাছে এসে থামল ও।
___________ নোটিশ বোর্ডটা দেখো।
নোটিশ বোর্ড আমার সকল আশাকে হত্যা করে জানান দিল, আমি আন্তর্জাতিক দাবা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করছি। আমার আশা হত্যা করে সে (নোটিশ বোর্ড ) শুধু খুশি না, এখন আমাকেও হত্যার চিন্তা করছে দেখছি। এইসব দেখে কি আর চুপ থাকা যায়!
চেঁচিয়ে উঠলাম _________ দাবা খেলায় আমার নাম!! কে দিয়েছে?
___________ আমি দিয়েছি কারন you are the Queen of Chess. শোন, কারো কথায় কান দিবেনা। আমি জানি তুমি কতটা ভাল দাবা খেলো। আমি তোমার খেলা দেখেছি বলেই নাম দিয়েছি।
________ দেখো, আমি খুব একটা ভাল খেলি না। সবাই জানে আমি অকর্মা সেজন্যই অরা এভাবে তাকাচ্ছে। তাছাড়া এর আগে আমি কখনো প্রতিযোগিতায় যায়নি, শখে খেলেছি। দেখো, প্লিজ আমি পারব না।
_________ মোটেও এই কথা বলবে না। আমি তো বলছি তুমি পারবে। আমার উপরে বিশ্বাস নেই?
_________ আছে তো।
অগত্যা প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে হল। শুরু হল আমার দাবা খেলা; শুধু ফাইনালেই ২য় হয়েছিলাম তাছাড়া কখনই ২য় হয়নি।
এখন আমার বাবা ছাড়াও অনেকে আমাকে নিয়ে গর্ব করে, অনেকে আমার মত হতে চাই। কাল আমার বড় ছেলেটা প্রথমবার কোন প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছে, দাবা খেলায় অংশগ্রহণ করতে যাচ্ছে। আশা করি, ওর বাবার অনুপ্রেরণা আমার মত ওকেও আজ দাবার রাজা বানিয়ে রাখবে।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে জুলাই, ২০১৫ রাত ১০:৪৫