অবশেষে মেডিকেল জীবনে পা রাখল সামি। আজ তার কঙ্কাল কিনতে যাওয়ার দিন...... বাবার উপর যদিও খুব অভিমান ছিল তাকে জোর করে মেডিকেলে ভর্তি করার জন্য কিন্তু এখন সে মজাই পাচ্ছে। এপ্রন, মেডিকেলের পরিবেশ, ডাক্তারদের ব্যস্ততা...... বরাবরই ব্যস্ত জীবন পছন্দ সামির। ওহ... সামির সবচেয়ে যে বিষয়টা পছন্দ মেডিকেল জীবনে সেইটার কথা তো বলাই হয়নি, কঙ্কাল!! ও এতদিন বিনা অস্ত্রেই সবাইকে ভয় দেখাতো কিন্তু আজ থেকে তার কাছে ভয় দেখানোর একটা পার্মানেন্ট অস্ত্র থাকবে। এইটা ভেবেই বেশ মজা পাচ্ছে সামি।
সামির বাবা চেয়েছিল, সেকেন্ড হ্যান্ড কঙ্কাল কিনবেন কিন্তু সামির জেদ, নতুন কঙ্কাল কেনার।
কঙ্কালটা এনে সামি নিজের ঘরে রাখল। কঙ্কালটা দেখে তার কেমন যেন একটা আকর্ষণ বোধ হল যেন কঙ্কালটা তার জন্যই এতদিন হাসপাতালের ঘরটাতে অপেক্ষা করছিল; সামির আনন্দ আর কে দেখে! সে এখন নিশ্চিত, বাবা তার জন্য সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্তটা নিয়েছে, ডাক্তারিই তার জন্য উপযুক্ত পেশা।
দেখতে দেখতে কয়েক মাস কেটে গেল, সামির ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। কাল ওর পরীক্ষা, অনেক পড়া বাকি! ভাবল, ২ঘণ্টা ঘুমিয়ে ৩টার সময় উঠে আবার পড়া শুরু করবে।
রাত জেগে লেখাপড়া করার অভ্যাস সামির চিরকালের। তার মতে, রাতের পরিবেশ ঘুমানোর জন্য না, কাজে লাগানোর জন্য, উপভোগ করার জন্য।
লাইটটা বন্ধ করে ঘুমাতে গেল সামি। তন্দ্রা আসতেই মনে হল, কে যেন দাড়িয়ে আছে কঙ্কালের জায়গায়...
কে আর...... মা-ই হবে।______ ভাবে সামি।
নাহ, মা না। মা এতক্ষণ এমনি দাঁড়িয়ে থাকবে না। হয় কথা বলবে, না হয় আমাকে দেখে চলে যাবে। অন্যকেও দাঁড়িয়ে আছে এবং তার চুল বেশ বড় যেগুলো বাতাসের সাথে নাচছে। তড়িঘড়ি করে উঠে রুমের লাইট জ্বালালো সামি।
সবই তার দৃষ্টিভ্রম, সবকিছু আগের মতই আছে। আবার ঘুমাতে গেল, আবার এমন মনে হল ওর।
অবশেষে বিরক্ত হয়ে আর ঘুমালো না, পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে শুরু করল।
ঘটনার এক সপ্তাহ পর সামি কঙ্কালটা বিক্রি করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল, খরিদ্দরও ঠিক করে ফেলেছে। রাখবে না নিজের কাছে কঙ্কালটা। এটা তাকে রাতে ঘুমাতে দেয়না। রাতে যখনই ঘুমোতে যায়; কোন না, কোন বাধা আসেই।
আজ কঙ্কালটার সাথে তার শেষ দিন, মনটা একটু খারাপ কিন্তু প্রশান্তিই বেশি।
রাত ৮ টা, হঠাৎ ঝড় উঠল।
বাইরে প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে, বৈশাখের বৃষ্টি। বিদ্যুৎও নাই, এই বিষয়টা অবশ্য এখনকার ফ্যাশান ও অঘোষিত আইন হয়ে দাঁড়িয়েছে, ঝড়বৃষ্টি হলেই বিদ্যুৎকে গায়াব হতে হবে!
রাত জেগে লেখাপড়া করে সামির বদঅভ্যাস হয়ে গেছে, তাড়াতাড়ি ঘুমোতে পারেনা। কাল শুক্রবার, ছুটির দিন। ক্লাসের চিন্তাও নাই তাই শুয়ে শুয়ে গান শুনছিল।
সামি অনুভব করল, তার আশেপাশে কেউ আছে। “নাহ... পিছে কে থাকবে!! বিছানার পিছে তো কোন দরজা নেই। আমি একটু বেশিই ভাবছি।“______ নিজের মনে আওড়ায় সামি।
কে যেন সামির কানের এয়ার ফোনটা খুলে দিল। সামি অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে ধমক দিল, আপু... কি এইসব জ্বালাস না তো। রাত বিরাতে ফাজলামি ভালো লাগছে না।
ওর সামনে থাকা ছায়াটি হেসে উঠল।
_________ তুমি শত চেষ্টা করলেও আমার থেকে দূরে যেতে পারবে না সামি।
সামির ধৈর্যের বাদ ভেঙ্গে গেল। অনেকটা লাফিয়ে উঠে টর্চটা জ্বালিয়ে বলল, আপু, দেখ এইসব ভালো লাগছে না। জ্বালাস না বলছি। জানিসই তো কত টেনশনে আছি এই ঝামেলাটা নিয়ে।
আহ্লাদি কান্নার শব্দ________ আমি তোমার ঝামেলা, এইটা শুনে নিজেকে আটকাতে পারলাম না। আমি তোমার কাছে ঝামেলা হলেও হতে পারি কিন্তু তুমি আমার কাছে সব।
এসব শব্দ শুনে একটু ভয় পেল সামি।
ধমক দিয়ে উঠল, আপু.........
সামি, আপু তো কখন ঘুমিয়ে গেছে। খিক... খি..._________________ ছায়া হাসে।
হাসির শব্দটা এইবার চারদিক থেকে আসছে। শব্দটা আরও কাছে আসছে। সামি ভয় পাচ্ছে।
সামির ভয়ের থেকেও বেশি তীব্র হাসির শব্দটা। শব্দটা অসহনীয় হচ্ছে ওর কাছে। সহ্য করা যাচ্ছে না, কান ফেটে যাচ্ছে সামির।
হাসি থামল... রুঢ় কণ্ঠ শোনা গেল________ এইটা আমি, রেণু। যাকে তুমি এতদিন কঙ্কাল বলে জেনেছ।
কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে সামির উত্তর, কি চাও তুমি?
__________আমি তোমার সাথে থাকতে চাই সারাজীবন।
কথাটা শুনে গলা শুকিয়ে আসে সামির।
রেণু আপন মনেই আবার বলতে শুরু করে, আমিও ডাক্তার হতে চেয়েছিলাম কিন্তু পারিনি। আমার বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন কেউ বোঝেনি মেডিকেল পরীক্ষায় কৃতকারজ না হওয়ায় সবচেয়ে বেশি কষ্ট আমি পেয়েছি। তারা আমকে যা নয় তাই বলেছে, আমি মেনে নিয়েছি। যখন মেডিকেলে চান্স না পাওয়ায় নিজেকে নষ্ট মেয়ে তকমা পেতে হয়েছে তখন আমি মেনে নিতে পারিনি, আত্মহত্যা করেছি।
সামি, তুমি যখন পড়া না করে রাতে ঘুমাও তখন ইচ্ছে হই, তোমার চোখে আঙ্গুল ঢুকিয়ে দেই।________ বলে খিলখিল করে হাসতে শুরু করল রেণু।
রেণু থামার পর সামি খেয়াল করল, তার পুরো শরীর ঘামের খরস্রোত আর গলা জ্যৈষ্ঠর মাঠ হয়ে আছে। হাত ও পায়ের তালু হিমালয়ের মত ঠাণ্ডা।
রেনুর অক্ষিকোটর রক্তলাল হয়ে আছে। সেই রক্তে ধীরেধীরে রেণু সম্পূর্ণ লাল হয়ে গেল, তার আকৃতি শুধু বোঝা যাচ্ছে।
“আমি তোমার কোন ক্ষতি করতাম না যদি তুমি আমাকে সারাজীবন তোমার সাথে থাকতে দিতে। কিন্তু তুমি তা করোনি। আমার প্রতি তুমিও বিরক্ত হয়েছ।“_____ গোলাপি পোশাক পরা একটা মেয়ে কঙ্কালের জায়গাতে দাঁড়িয়ে কথা গুলো বলল।
মেয়েটার চোখের মণি রক্তের দলা এবং গলা দিয়ে রক্ত ফিনকি দিচ্ছে আর মুখটা কেমন যেন ফ্যাকাসে!
সামি এবার তার ঠিক পিছে সেই খিল খিল হাসির শব্দ শুনতে পেল। কোন কিছু না ভেবেই বাবার ঘরের দিকে দৌড় দিল।
দরজা পর্যন্ত পৌঁছাতেই রেণু সেই বিভৎস আকৃতি নিয়ে তার গলা চেপে ধরে হিহি করে হেসে উঠল।
ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠলেন সামির বাবা। নিজে নিজেই বিড়বিড় করছেন_______ “এমন একটা অপ্রীতিকর সপ্ন দেখলাম কেন? ছেলের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে ডাক্তার বানাতে চেয়ে ছেলের ক্ষতি করছি না তো? নিজের জেদের কারণে কি ছেলের ধ্বংস নিশ্চিত করছি?”
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই জানুয়ারি, ২০১৬ সকাল ৮:৩৬