somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শান্ত হ্রদের স্নিগ্ধ শহরঃ রিভা দেল গার্দা-২

২৫ শে মার্চ, ২০১৯ রাত ৩:৪৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
পর্ব ১ এখানে


২.
হোটেলে পৌঁছালাম যখন তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল। হোটেল বলা হয়তো ভুল হবে। ভ্যাকেশন অ্যাাপার্টমেন্ট বা ভ্রমন নিবাস বললে বোধহয় বেশি মানানসই হয়। তিনতলা বাড়ির অনেকগুলি ফ্ল্যাটের একটা। হোটেলের তুলনায় সস্তা। কিন্তু রুম সার্ভিস নেই, চাদর-তোয়ালেও নিত্য নিত্য নিজ থেকে পাল্টে যাবে না। আর ঘরের ধুলা-ময়লা ভ্যাক্যুম চেপে নিজেদেরই সাফসুতরো করতে হবে। এ যেন পুরোপুরি বিটিভি’র ‘এসো নিজে করি’ অনুষ্ঠান। তবে নিজেদের মত করে এলোমেলো থাকার আর রান্নাঘরে যথেচ্ছা রেঁধে বেড়ে খাওয়ার স্বাধীনতা আছে। সেটাও বা কম কিসের?

কিন্তু ঘরে তো ঢুকতে পারছি না। বাড়ির মালিককে ফোন লাগানো হয়েছে। ভদ্রমহিলার আসার নাম নেই। বোঁচকা-বুঁচকি নিয়ে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে। তাও মিনিট বিশেক হয়ে গেছে। অবশ্য আমাদের সঙ্গ দেবার জন্যে ঘাড়ের ওপর থেকে উঁকি দিচ্ছে আল্পসের সুউচ্চ প্রাচীর। জায়গাটার তিন দিক পর্বত প্রাচীরে ঘেরা আর আরেক দিক জুড়ে গার্দা হ্রদের তীর। যেন কোন যুদ্ধবাজ রাজা সুরক্ষিত এক দূর্গ বানিয়ে শেষে সবচেয়ে জরুরী অভেদ্য ফটকটা লাগাতেই ভুলে গেছেন। ফটকবিহীন দূর্গটায় হু হু করে মাতাল হাওয়া ঢুকে চারপাশে পড়ে থাকা জলপাই গাছের পাতাগুলোকে মর্মর সুরে নাচিয়ে বিচিত্র এক অভ্যর্থনা জানিয়ে গেল অপেক্ষায় থাকা ক্লান্ত আমাদের দলটাকে।

আধা ঘন্টা পর কাঙ্খিত গৃহপ্রবেশ ঘটল। কিন্তু কোথায় সবাই হাত-মুখ ধুয়ে তাজা হবার চেষ্টা করব, তা না করে হাতের ফোন উঁচিয়ে ঘরের কোনাকানচি, চিপা-চুপা সব পরখ করে বেড়ানো শুরু করলাম। উদ্দেশ্য এক ও অভিন্ন। ওয়াই-ফাই সংকেত পাকড়াও করা। বাড়িওয়ালী চলে গেছে, কিন্তু তাকে আবার ফোন লাগিয়ে পাসওয়ার্ড যাচাই করা হল। অক্সিজেন না হলেও চলতে পারে আমাদের, কিন্তু অন্তর্জাল নামের অদৃশ্য মাকড়সার আঠালো জালে নিজেরদের স্বেচ্ছায় বন্দী করে না ফেলা পর্যন্ত কেমন অসহ্য রকমের মুক্ত মুক্ত লাগতে থাকে। অবশেষে সদর দরজার সামনের বড় আয়নাটার কাছে মিলল বহু কামনার মোক্ষ। সদলবলে গর্জে উঠলাম, ‘হুররে...!’। এই আধুনিক মোক্ষের সন্ধানে অশ্বথ গাছের ছায়ায় গৌতম বুদ্ধের মত অনন্ত কাল বসে থাকতে হয় না। পাসওয়ার্ড টিপ দিলেই সিসিম দুয়ার খুলে যায়। পর্যাপ্ত পরিমান চেক ইন আর স্ট্যাটাসের বন্যা বইয়ে দিতে কেউ নীল-সাদা জগতটা হারালাম। কেউ বা দেশে ফোন লাগিয়ে ‘আম্মা, আমি পৌঁছায় গেসি’ জাতীয় আশ্বস্তবানী শুনিয়ে বাঙ্গালী মায়ের মাঝ তিরিশের চিরশিশু সাজলাম। আর সত্যিকারে শিশুগুলো তখন পর্দার কোনা ধরে ঝুলছে কিংবা সোফার হাতল কামড়ে লালা দিয়ে ভিজিয়ে ফেলতে ব্যস্ত। মোক্ষ তো আসলে এরাই লাভ করে বসে আছে।

শেষ বিকালের রোদটা আমাদের ছেলেমানুষি আর সইতে না পেরে বারান্দায় হানা দিয়ে একেবারে ঘাড় ধরে ঘরের বাইরে ডেকে নিল। বেরিয়ে এসে দেখি পাহাড় মুচকি হাসছে, ‘এতক্ষনে সময় হল বুঝি?’। আকাশের পড়ন্ত সূর্যঘড়ির দিকে তাকিয়ে বুঝলাম, আসলেই তো, বেলা যে পড়ে গেল। পাহাড়ের বিশালতার কাছে লজ্জা পেয়ে পা বাড়ালাম মধ্যযুগে গড়ে ওঠা এই শহরটা ঘুরে দেখবো বলে। পথের বাঁ পাশে গার্দা হ্রদও আমাদের সাথে তাল মিলিয়ে বয়ে চলল। আল্পসের গ্লেসিয়াস থেকে সর্বশেষ বরফযুগের একেবারে শেষ প্রহরে এই হ্রদের সৃষ্টি। এর অববাহিকায় রিভা ছাড়াও গড়ে উঠেছিল আরো কতগুলো শহর। সব তো দেখা সম্ভব না। একটাই না হয় প্রান ভরে দেখি এই দু’টো দিন।

এককালের সাদামাটা রিভা এখন পুরো মাত্রায় খাঁটি পর্যটন শহর। শহরে এখানে ওখানের প্রাচীন দালানকোঠায় ভেনিশিয়ান স্থাপত্যের ছাপ আছে পড়েছি। স্থাপত্যের এই ধারার জন্ম সেই চৌদ্দশ শতকের প্রাচীন ভেনিসে। এতে মিশেছে তৎকালীন কন্সট্যান্টিনোপলের বাইজেন্টাইন নকশার কিছু মিছু আর সে যুগের আন্দালুসিয়ার মুরিশ স্থাপত্যের প্রভাব। সাথে ইটালির নিজস্ব গথিক ধারার অনেকটা অংশ তো আছেই। কিন্তু আমরা যে পথে হাঁটছি, সেখানে তেমন কোন বাহারি দালানগুলো চোখে পড়ছে না তো। ঐ তো সব একালের চারকোনা বাক্সগুলো সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। হয়তো জানালাটা ভারিক্কী কিংবা ফটকটা রাশভারী। বড়জোর আয়েশি ঝুল বারান্দা। ব্যস, এই তো। কিংবা কে জানে হয়তো একটা শিল্পীমনের অভাবে সূক্ষ্ণ সৌন্দর্য আমি দেখতে পাই না। বাহারের চাইতে বরং একেকটা বাড়িঘরের একেক রঙ বেশি চোখে লাগল। বেগুনী, নীল, আসমানি, সবুজ, হলুদ, কমলা-এ যেন রংধনুর শহর! কটকটে লাগছে না মোটেই, বরং একটা মোমরঙ্গা স্নিগ্ধতা আছে। হঠাৎ মাঝে চোখের পড়ল বেমানান এক ধূসর মিনার। মধ্যযুগে গড়ে ওঠা সান মার্কো নামের এই মিনারটা ভেনিশীয় যুগে এসে আবার নতুন করে তৈরি করা হয়েছিল। তারপর ক্ষয়ে ক্ষয়ে এটুকুতে এসে ঠেকেছে। তবু সেটুকু নিয়েই সে কালের সাক্ষী হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তার পাল্লাবিহীন বিশাল দরজা এখনও তার অতীত দর্প জানিয়ে যায় যে, এককালে সে ছিল শহরের প্রধান প্রবেশদ্বার।

আমাদের দলটা এগিয়ে চলছে। বাতাসে ক্যারামেলে ভাজা অ্যালমন্ড বাদামের মিষ্টি ঘ্রান। বড়দিন ঘনিয়ে আসছে। ঈশান কোন থেকে বেহালার সুরে ভেসে আসছে, ‘জিঙ্গেল বেল, জিঙ্গেল বেল...’। ঘের দেয়া জমকালো পোশাকে ডাইনী বুড়ি সেজেছে জনাকয়েক তরুনী। পোশাকের সর্বাঙ্গে জড়ানো ছোট ছোট রঙ্গীন বাতি। সাঁঝের জোনাকির মত সেগুলো জ্বলছে আর নিভছে। সাথের ষোল-সতেরো বছরের সুশ্রী চেহারার দুই কিশোর ড্রাম পেটাচ্ছে তালে তালে। তাদের ছোট দলটা মূর্ছনার রেশ তুলে হ্যামিলিয়নের বাঁশিওয়ালা হয়ে শহরের অলি গলি ধরে হাঁটতে থাকলো। আমরাও মন্ত্রমুগ্ধ ইঁদুরের দলের মত তাদের পিছু নিলাম। ডাইনী্রা আবার আমাদের গার্দা হ্রদের পাড়ে না নিয়ে গেলে হয়। অল্প সাঁতার জানা আমাদের সলীল সমাধি তখন আর ঠেকানো যাবে না।

একটু এগোতেই আরেক বাজনার দল পাওয়া গেল। বয়সে এরা প্রবীণ। কিন্তু তারুন্য যে সাদা চুল আর চামড়ার ভাঁজেও অনায়েসে থাকতে পারে, সেটা বোঝা গেল যখন দলটা তাদের অদ্ভূত চেহারার কিম্ভূত একেকটা বাদ্যযন্ত্র বেদমভাবে বাজানো শুরু করলো। একেবারে সুরের তুমুল কালবৈশাখী বয়ে গেল। আবার বাজনার মাঝপথে থেমে তারা হঠাৎ হঠাৎ হুংকার ছাড়ছে, ‘গাবালু হেহ্ হেহ, গাবালু হোহ্ হোহ...’। গাবালু যে কি বস্তু, ক্যোঁৎ করে গিলে খায়, নাকি চপচপে করে তেলের মত মাথায় দেয়, কিছুই বুঝতে পারছি না। শুধু অভিভূতের মত দেখছি এই বুড়ো যুবকদের তেলেসমাতি কান্ড। বাচ্চারাও সুযোগ পেয়ে তালে তাল মিলিয়ে ক্ষ্যাপা নাচ জুড়ে দিয়েছে।

এদিকে বাচ্চাদের বাবারা কফি আর স্ন্যাক্সের খোঁজে লাপাত্তা হয়ে গিয়েছে সে অনেকক্ষন হল। মৌরি আপু আর আমি আর না পেরে কুটিল রমনীর মত লাপাত্তা বাবাদের নামে একে অন্যের কাছে নালিশ করছি। হাদী ভাই নাকি মৌরি আপুর সোনার জীবন তামা তামা করে দিয়েছে। শুনে প্রবল আবেগে আমিও যোগ করলাম, ছেলের বাবাও কিভাবে আমার কচি পাতার মত সবুজ কলিজাটা একদম তেজপাতা করে ছেড়েছে। এরা সব দুষ্ট লোক। বলতে না বলতেই দুষ্ট লোকেরা কফি আর স্যান্ডউইচ হাতে উদয় হল। আর আমরা দুই ঘষেটি বেগম, আমাদের তামা জীবন আর তেজপাতা কলিজার দুঃখ ভুলে ছোঁ মেরে খাবারগুলো বাগিয়ে নিলাম। হাত বাড়িয়ে ছানাগুলোকেও ডেকে নিলাম। এখন আর লোকগুলোকে অতটা দুষ্ট লাগছে না।

সন্ধ্যাটা বাদুড়ডানায় ভর করে কখন যে নিশব্দে নেমে এসেছে, খেয়ালই করি নি। গার্দার নিস্তরঙ্গ জলে পাহাড়ি বাতাসের তোড়ে মৃদুমন্দ কৃত্রিম ঢেউ খেলছে। কেন যেন মনে হচ্ছে এই বুঝি বা ঢেউ মাথায় রহস্যময় কোনো জলদানব ভেসে উঠবে। কিন্তু না, উপকথার কোনো লকনেস দানবের দেখা মিলল না। অগত্যা পা বাড়ালাম ভালো কোন রেস্তোরার খোঁজে। ক্লান্ত শ্রান্ত শরীর কফি-স্যান্ডউইচ নিমেষে হজম করে নিয়ে বুভুক্ষের মত আরো চাইছে। (চলবে)

ছবি কৃতজ্ঞতায়ঃ হাদি ভাই

সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই এপ্রিল, ২০১৯ রাত ৩:৩০
৯টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×