বছর খানেক আগের কথা। মুখ ভচকিয়ে ল্যাবে ঘুরে বেড়াই। কাজে যুত করতে পারছি না। দেড় বছরের কাজ ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে আবার নতুন প্রজেক্ট শুরু করেছি। পিএইচডি নামের এই সুড়ঙ্গের শুরু আছে, কিন্তু শেষ নেই। কাজটা ফুসফুসের ক্রনিক রোগ নিয়ে। সপ্তাহের পর সপ্তাহ বিড়ি-সিগারেট ধরিয়ে ইঁদুরের বাক্সের সামনে বসে থাকি। বেচারাদের ফুসফুসের বারোটা বেজে গেলে তাদের কেটেকুটে চলে নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা। এই করে করে জীবন চিরতার মত তিতা হয়ে যাচ্ছে।
তেমনি একদিন সকাল। খিটখিটে মেজাজে ল্যাবে ঢুকেছি। দুনিয়াদারি চিবিয়ে খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু কে জানত এমন একটা খবর অপেক্ষা করছে আজকে। ‘ও মাগো’ বলে গালে হাত দিয়ে ধপ্ করে চেয়ারে বসে পড়ালাম। কিছুটা নাটুকে হয়ে গেল বোধহয়। কিন্তু হাজার চেষ্টাতেও অকৃত্রিম প্রতিক্রিয়াটা লুকানো গেল না। তুর্কি সুপারভাইজার ডক্টর ইলদ্রিম কিছু একটা উত্তর শোনার অপেক্ষায় চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। বাংলা ‘ও মাগো’ সে বুঝতে পারে নি। ভেবেছে খুশিতে খাবি খেয়ে হেঁচকি তুলেছি।
কাহিনী হচ্ছে গিয়ে, আমার হেঁজিপেঁজি রদ্দি মার্কা কাজটা কিভাবে কিভাবে যেন বড় একটা কনফারেন্সের ‘বেস্ট অ্যাবস্ট্রাক্ট’ বিভাগে প্রথম হয়েছে। কনফারেন্সটা এ বছর পড়েছে ক্যালিফোর্নিয়ার সান ডিয়াগোতে। সব শুনে আনন্দে ফড়িং নাচ দেয়ার বদলে কেমন দুঃখ দুঃখ লাগছে। কারন, এমন দারুন সুযোগ পেয়েও হারাবো। প্রথমত, মাত্র চার সপ্তাহের ভেতরে জার্মানি থেকে আমেরিকার ভিসা পাব কিনা বিশাল সন্দেহ আছে। দ্বিতীয়ত, খরচে কুলাবে না। ট্যাঁকের পয়সা ফেলে পাগলেও কনফারেন্সে যায় না। বাকি থাকে তুর্কি বদান্যতা। কিন্তু সেও বলে দিয়েছে হাতে টাকা বাড়ন্ত। রিসার্চ গ্রান্টের খরা চলছে। এদিকে, প্রাইজ মানিতেও চিড়া ভিজবে না। প্লেনের টিকেটের পর হোটেলের পয়সা আর হবে না। হোটেলের অভাবে রাতে ফুটপাথে চিৎ কাৎ হয়ে কাটিয়ে দিতে হলে তো মুসিবত।
কথাগুলো আহমেদ সাহেবকে রাতে খাবার টেবিলে পিনপিনিয়ে বলে স্বান্তনা আদায়ের চেষ্টা চালালাম। বছরখানেক হল এই ভদ্রলোকের ঘাড়ে সিন্দাবাদের ভূত হয়ে চেপে বসেছি। বিনিময়ে তার পদবীটা নিজের নামের সাথে জুড়ে নেবার সৌজন্যতাটুকুও করি নি। বরং ইখতিয়ারুদ্দিন বখতিয়ার খিলজী টাইপের সুদীর্ঘ নামটাই রেখে দিয়েছি। তো সিন্দাবাদের ভূত দিন কয়েকের জন্যে বিদায় হবার সূক্ষ্ণ সম্ভাবনা দেখে স্বান্তনার বদলে বিরাট উৎসাহের সাথে বুদ্ধি বাতলে দেয়া হল যেন রিসার্চ সেন্টারের নিজের কোনো ফান্ড আছে কিনা তার খোঁজ নেই। আহমেদ সাহেবের ভূত তাড়ানোর দোয়া কবুল হল কিনা জানি না, কিন্তু জোড়াতালি দিয়ে ব্যবস্থা একটা হয়েই গেল। ভিসাও বাকি থাকলো না। এক ভোরে আলো ফোঁটার আগেই চামবাদুড়ের মত ডানা ঝটপটিয়ে উড়াল দিলাম আটলান্টিক নামের বড় পুকুরটার ওপাড়ে।
একাবোকা যাচ্ছি। সঙ্গী সাথী শূন্য। যাওয়া একেবারে শেষ মুহূর্তে ঠিক হওয়ায় এই দশা। ল্যাবের সব কলিগদের বন্দোবস্ত মাস খানেক আগেই করা ছিল। তাদের ফ্লাইট, হোটেল সব আলাদা। একদিন আগেই তারা দল বেঁধে হল্লা করে রওনা দিয়েছে। গিয়ে একটু ধাতস্থ হতে পারবে। আর আমি পৌঁছানোর পরের দিনই পড়িমড়ি করে ছুটবো কনফারেন্সে যোগ দিতে। জেটল্যাগ হলেও কিছু করার নেই।
আটলান্টায় ট্রানজিট। এয়ারপোর্টে দোজখের গরম। তার উপর ইমিগ্রেশনের বিশাল লাইন দেখে অজানা আশঙ্কা কাজ করছে। পরের ফ্লাইট ছুটে যাবে না তো? ভাবতে ভাবতে ঘেমে কুলুকুলু হয়ে ইমিগ্রেশন অফিসারের সামনে দাঁড়ালাম। কাঁধে পোস্টারের খাপটাকে এরা আবার রকেট লঞ্চার ভেবে সন্দেহ করে কিনা, তাই আলপটকা নামিয়ে ফেলতে গেলাম। সাথে সাথে ঘটে গেল অঘটন। তড়িঘড়িতে সেটা মেঝেতে দড়াম করে আছড়ে পড়ে পুরানো নকিয়া ফোনের মত তিন টুকরো হয়ে তিন দিকে ছড়িয়ে পড়লো। ঘাবড়ে গিয়ে আমি পুরো হাঁ। বোয়াল মাছ লেভেলের হাঁ দেখে অফিসারের মনে দয়ামায়া হল বোধহয়। হাত বাড়িয়ে ধরা কাগজগুলো নিয়ে বললেন, ‘তোলো তোমার জিনিস আস্তে ধীরে, আমি কাগজ দেখি ততক্ষনে’।
উবু হয়ে পোস্টার গুছিয়ে নিয়েছি, ভদ্রলোক সহাস্যে বললেন, ‘আরে তুমি দেখছি ইঁদুরের ডাক্তার।‘ মৃদু প্রতিবাদ করতে গেলাম, ‘কোন দুঃখে ইঁদুরের ডাক্তার হতে যাবো? আমি বায়োলজির ছাত্র। ইঁদুর আমার গবেষনার মডেল মাত্র’। লাভ হল না, তবে পার পেয়ে গেলাম এই দফায়। ইঁদুরের ডাক্তারের তকমা গলা ঝুলিয়ে দৌড় দিলাম পরের প্লেনটা ধরতে। পোস্টারের খাপটা এবার এমন করে জাপটে ধরেছি যে বেচারার দম বলে কিছু থাকলে যেকোনো সময়ে ঠুস্ করে বেরিয়ে যেতে পারে। (চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই মে, ২০১৯ রাত ১:৫৯