somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

স্মৃতিচারণমূলক পোস্টঃ আমার প্রিয় শিক্ষকেরা- যাদের ঋণ কোনদিনও শোধ হবার মত নয়।

০২ রা জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ৩:৪১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১) মৃধা স্যার (মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল)ঃ
মৃধা স্যার আমাদের তখন আমাদের ক্লাশ টিচার ছিলেন। অঙ্ক পড়াতেন। খুব ছিমছাম সাধারণ মানুষ ছিলেন তিনি। বেলা শেষে তাকে প্রায়ই দেখতাম ফেনলী লাইব্রেরীর সামনে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানতেন আর রিকশার খোজ করতেন বাড়ি যাবেন বলে। মাঝে মাঝে যখন ক্ষেপে যেতেন ক্লাশে তখন এই শুয়োর বলে গালি দিতেন, আর পড়া না পারলে পিঠে পড়ত কিল। ব্যাস এইটুকুই। কোন ছাত্রকে তিনি অহেতুক শাস্তি দিতেন না। আমাদের স্কুলে খারাপ রেজাল্ট করাদের অস্পৃশ্য মনে করা হত - ধরা যাবে না, ছোয়া যাবে না, তাদের সাথে কথা বলা যাবে না এই টাইপের। কিছু কিছু শিক্ষক ছিলেন যারা ক্লাশে এসেই এধরনের ছাত্রদের টার্গেট করতেন যাদের শাস্তি দিয়ে তারা মজা পেতেন। মৃধা স্যারকে আমি কোনদিন এইরকম কিছু করতে দেখিনি। খানিকটা রাগী ছিলেন কিন্তু সবাইকে ইন্সপায়ার করতেন। আমার এখনও মনে আছে বৃত্তি পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশন এর সেইদিন ছিল লাস্ট দিন - ক্লাশে ছয়শ টাকার মত জমা দিতে হবে। আম্মা টাকা দিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু বাসা থেকে স্কুল এ আসার পথে টাকাটা হারিয়ে ফেলি। তখন বাসার অবস্থা এমন ছিল না যে, আম্মাকে বললেই আম্মা বিকালে টাকা নিয়ে হাজির হয়ে যাবে। ছয়শ টাকা তখন আমাদের কাছে নিতান্তই অনেক বড় অঙ্কের টাকা ছিল। স্যার সেইদিন রেজিস্ট্রেশন এর টাকাটা দিয়েছিলেন; যদিও পরে বৃত্তি পাওয়া হয় নি।
২) মোস্তফা কামাল স্যার (মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল)ঃ
যদিও স্যার এর সাথে আমার সুসম্পর্ক ছিল ক্লাশ পর্যন্তই, কিন্তু আমার এখনও মনে আছে স্যার আমাকে ভীষণ আদর করতেন। পঞ্চম শ্রেণীতে ষান্মাষিক পরীক্ষার রেজাল্ট এর উপরে বৃত্তি কোচিং এর জন্য সিলেক্ট করা হত। সেইবার রেজাল্ট ভয়াবহভাবে খারাপ হওয়ায় অনেকের পিছনে ছিলাম আমি। ক্লাশে এসে হেডস্যার একে এক নাম বলে যাচ্ছেন, আর প্রতিবার কামাল স্যার আমার দিকে তাকাচ্ছেন আর ইশারায় জিজ্ঞাসা করছেন, আমার এই অবস্থা কেন?
৩) বকর স্যার (মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল)ঃ
এই স্যার এর কথা না বললেই নয়, আমাদের পরিবারে তখন ভয়াবহ রকম অর্থনৈতিক মন্দা বিরাজমান। বাবার যা আয় ছিল তা দিয়ে কোনভাবে বাসার ভাড়া, মাসের নূন্যতম বাজার, আর তিন ভাইবোনের স্কুলের বই খাতার খরচ আর বেতন দেয়া সম্ভব ছিল। কারও কাছে গিয়ে পড়ার মত নূন্যতম অবস্থাটাও আমাদের ছিল না। আমার এখনও মনে আছে আমার মা স্যার এর কাছে গিয়ে বলেছিলেন যে স্যার এর ব্যাচ এর যা ফী তা দেবার মত সামর্থ্য আমাদের নেই। দুই মাসে আম্মা এক মাসের টাকা দিতেন, পরে অভাব এর জন্যও তা দেয়া হয় নাই। স্যার ও কোনদিন টাকা চাইতেন না। স্যার এর টাকা ঠিকঠাক দিতে পারতাম না বলে আমার নিজেরও লজ্জা লাগত। মাঝে মাঝেই দীর্ঘ দিনের জন্য তার কাছে পড়তে যেতাম না। স্যারও কোনদিন টাকা কেন দিতে পারছি না তাও জানতে চাইতেন না। আমার নবম দশম শ্রেণীর পুরোটাই এই স্যার এর কাছে পড়া, তাও একরকম বিনা বেতনে।
৪) রতন স্যার (মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল)ঃ
স্যার আমাদের বাংলা পড়াতেন। বাংলা দ্বিতীয় পত্রে আমার যাচ্ছেতাই অবস্থা ছিল, আর সেই সাথে নৈর্ব্যত্তিক এর। সবাই ক্লাশ টেন এ উঠতে না উঠতেই ফাটাইয়া বাংলা তে মডেল টেস্ট দিয়ে যাচ্ছে - বিশেষত নৈর্ব্যত্তিক আর বাংলা ২য় পত্রে। আমার এক বন্ধু আমার বাজে অবস্থা দেখে জোর করে স্যার এর কাছে নিয়ে যায়। প্রথম এক কি দুই মাসের টাকা দিয়েছিলাম স্যারকে। এরপর টাকা দেয়ার মত অবস্থা ছিল না। তাই যেতে ইচ্ছাও করত না। আমি আসিনা দেখে স্যারই একদিন নিজ থেকে আমার বন্ধুকে বলল, রিয়াদকে বল আসতে। যেইখানে সবাই হাজার হাজার টাকা খরচ করে মডেল টেস্ট দিত, সেইখানে আমাকে এরপরে কোন টাকা স্যারকে দিতে হয় নাই।

এই গেল স্কুল শিক্ষকের পালা, অর্ডার টা ক্লাশ অনুসারে মেইনটেইন করা।এইবার আসি গৃহশিক্ষক এর তালিকায়।
১) রফিক স্যার ঃ আমরা তখন যাত্রাবাড়ি থাকতাম। পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা আমাদের ভালই ছিল তখন, আর আমার মা ও আমার পড়ালেখা নিয়ে আমার চেয়ে বেশি সিরিয়াস ছিলেন। খুব ছোটবেলা থেকেই আমাকে তিনি পড়াতেন। শুধু পড়াতেন বললে ভূল হবে- আমাদের পরিবারের একজন সদস্য এর মত ছিলেন। মাঝে মাঝে বাইরে ঘুরতেও নিয়ে যেতেন। আমার থার্ড গ্রেডের স্কুলে বিভিন্ন প্রজেক্ট দিতঃ যেমন কার্ডবোর্ড দিয়ে ঘর বানানো, ক্লাশরুম বানানো, পালকি বানানো ইত্যাদি। ছুটির দিনগুলাতে তিনি আমাকে সেইসব বানাতে সাহায্য করতেন। আমার বাবার ব্যাবসা এর প্রয়োজনে আর আমার স্কুল কাছে হবে বিধায় আমরা পরে খিলগাও এ চলে আসি, যদিও তিনি তার আগেই গোরানে শিফট হয়েছিলেন যাত্রাবাড়ি থেকে। বোধকরি একবছর আমাদের অবস্থা ভাল ছিল, এরপর বাবা ব্যবসা তে লস করেন এবং এরপর আমাদের পরিবারে শুরু হয় অর্থনৈতিক দূর্দশা। অভাবের দিনগুলাতে তিনি আমাকে বাসায় এসে পড়িয়েছিলেন। আম্মা তাকে বলেছিল, যে আম্মা তাকে মাসে মাসে আর টাকা দিতে পারবে না। যখন আম্মার কাছে কিছু টাকা জমবে তখনই আম্মা তার টাকাটা দিয়ে দিবে। পুরো দুই বছর এইভাবে চলেছিল। পরে তিনি অন্য কোথাও চলে যাওয়ায় আর আমাকে তার পড়ানো হয় নাই।
২) রঞ্জন-অঞ্জনস্যার - আর ঝুটন দাঃ
তারা ছিলেন তিন ভাই। প্রথম দুইজন জমজ এর তিন নম্বর সবার ছোট। তখন বোধকরি ক্লাশ সেভেনে পড়ি। বীজগণিত আর ইংরেজী খানিকটা কঠিন লাগত। কিভাবে যেন আম্মা তাদের খোজ পায়। বাসায় এসে তারা কেউ পড়াতে পারবেন না আর তাদেরকে সেই পরিমাণ টাকা দেয়ার মত সামর্থ্যও আমাদের ছিল না। তাই আমিই বাসাবোতে তাদের বাসায় পড়তে যেতাম। একজন আমাকে পড়াতেন ইংরেজী, একজন পাটিগণিত আর জ্যামিতি আর সবার ছোট ঝুটনদা আমাকে বীজগণিত দেখিয়ে দিতেন। সেভেন-এইট পুরাটাই তাদের কাছে এইভাবে পড়া। টাকা কম দেই বলে, কিংবা মাসের টাকা বাকী থাকত বলে কোনদিন আমাকে অবহেলা করেন নি। কিংবা আমার মা কেও ডেকে কোনদিন বলেন নি, আম্মা কেন তাদের টাকা দিতে পারছেন না।

এই মানুষগুলার কাছে আমি আজীবন ঋণী থাকব। তাদের ঋণ আসলে কীভাবে শোধ হবে তা আমার জানা নেই। আমাদের সময়টাতে ছাত্র-শিক্ষকের একটা সুসম্পর্ক ছিল, শ্রদ্ধার সম্পর্ক ছিল। নিজেদের জীবিকার তাগিদে তারা বাসায় গিয়ে কিংবা ব্যাচে পড়াতেন ঠিকই কিন্তু এখনকার জেনারেশন এর শিক্ষকদের মত স্টুডেন্ট হান্টার ছিলেন না। এখন নাকি স্কুলগুলাতে এইটাই বড় রকমের ব্যবসা। পুরা ক্লাশরে এমনভাবে টাইট দিয়ে রাখ যাতে ছেলেমেয়েরা তাদের কাছে ব্যাচে পড়তে বাধ্য হন। শিক্ষকদের জ্ঞান বিতরণ আজকাল টাকার সাথে সমানুপাতে হারে পরিবর্তিত হয়; আর তাই তাদের সম্মান করাটাও সময়ের সাথে ব্যাস্তানুপাতে পরিবর্তিত হচ্ছে।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ৩:৪২
২টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অনির্বাণ শিখা

লিখেছেন নীলসাধু, ০৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



রাত ন’টার মত বাজে। আমি কি যেন লিখছি হঠাৎ আমার মেজো মেয়ে ছুটতে ছুটতে এসে বলল, বাবা একজন খুব বিখ্যাত মানুষ তোমাকে টেলিফোন করেছেন।

আমি দেখলাম আমার মেয়ের মুখ উত্তেজনায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

=ইয়াম্মি খুব টেস্ট=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:১৪



©কাজী ফাতেমা ছবি
সবুজ আমের কুচি কুচি
কাঁচা লংকা সাথে
ঝালে ঝুলে, সাথে চিনি
কচলে নরম হাতে....

মিষ্টি ঝালের সংমিশ্রনে
ভর্তা কি কয় তারে!
খেলে পরে একবার, খেতে
ইচ্ছে বারে বারে।

ভর্তার আস্বাদ লাগলো জিভে
ইয়াম্মি খুব টেস্ট
গ্রীষ্মের... ...বাকিটুকু পড়ুন

অণু থ্রিলারঃ পরিচয়

লিখেছেন আমি তুমি আমরা, ০৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৭


ছবিঃ Bing AI এর সাহায্যে প্রস্তুতকৃত

১৯৪৬ কিংবা ১৯৪৭ সাল।
দাবানলের মত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশে।
যে যেভাবে পারছে, নিরাপদ আশ্রয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। একটাই লক্ষ্য সবার-যদি কোনভাবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

পেইন্টেড লেডিস অফ সান ফ্রান্সিসকো - ছবি ব্লগ

লিখেছেন শোভন শামস, ০৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:১৯

"পেইন্টেড লেডিস অফ সান ফ্রান্সিসকো", কিংবা "পোস্টকার্ড রো" বা "সেভেন সিস্টারস" নামে পরিচিত, বাড়িগুলো। এটা সান ফ্রান্সিসকোর আলামো স্কোয়ার, স্টেইনার স্ট্রিটে অবস্থিত রঙিন ভিক্টোরিয়ান বাড়ির একটি সারি। বহু... ...বাকিটুকু পড়ুন

এশিয়ান র‍্যাংকিং এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান !!

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ০৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:২০

যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিক্ষা সাময়িকী 'টাইমস হায়ার এডুকেশন' ২০২৪ সালে এশিয়ার সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা প্রকাশ করেছে। এশিয়ার সেরা ৩০০ তালিকায় নেই দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়।তালিকায় ভারতের ৪০, পাকিস্তানের ১২টি, মালয়েশিয়ার ১১টি বিশ্ববিদ্যালয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×