বাসস্টপ একটু দূরে। হাঁটতে ইচ্ছে করছে না। অফিস শেষে আমার স্ত্রী’র নতুন শাড়ীর প্যাকেট হাতে রাস্তায় অজায়গায় দাঁড়িয়ে বাসের জন্যে অপেক্ষা করছি। শাড়ীটি বদলাতে হবে। ইফতারের আরও এক ঘণ্টা বাকী আছে। পথে প্রচুর ঘর ফিরতি মানুষ ঘরে ফেরার যুদ্ধে ব্যস্ত। আমি তেমন তাড়া অনুভব করছি না। গতকাল ঈদের বাজার করতে স্বপরিবারে বের হয়েছিলাম। মেয়েটা এবার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে। আর ছেলেটা চার মাস আগে এই টানাটানির সংসারে ভুল বশত পৃথিবীতে চলে এসেছে। ছেলেটার জন্মের পর থেকে বেশ কিছুদিন মেয়েটা তার মায়ের সাথে কথা বলেনি। হয়তো লজ্জায়। নাকি এই বয়সে নতুন ভাইটিকে সে কোন ভাবেই মেনে নিতে পারছিল না? ভাই বোন দুজনের মাঝে বিরতিটা একটু বেশীই হয়ে গেল। তবে ক’দিন ধরেই দেখছি সে সবসময় ছোট্ট ভাইটিকে কোলে নিয়ে মনের আনন্দে এঘর ওঘর ঘুরে বেড়াচ্ছে।
বাচ্চার মায়ের শখ হয়েছে বাচ্চার জন্যের জিন্সের প্যান্ট কিনবে, তাও আবার ফুল প্যান্ট। সন্ধ্যা সাতটা থেকে রাত বারটা নাগাদ কয়েকটি মার্কেটের প্রত্যেকটির অলিগলি ঘুরতে হয়েছে সেই দুর্লভ জিনিসের খোঁজে। তার পড়নের হাপ প্যান্টটাই ফুল প্যান্টের মত দেখাচ্ছে আর ফুল প্যান্টগুলো না জানি কেমন দেখাবে। দোকানিরা আকারে ইঙ্গিতে বাচ্চার মাকে বিষয়টা বোঝানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। আসল কথা হল, ছেলের বয়স চার মাস হলেও শরীরটা দেখতে যেন চার দিনের নবজাতকের। দীর্ঘ পাঁচ ঘন্টার পরিশ্রম অবশেষে সফল হয়েছে, তবে অর্ধেক। জিন্সের একটি হাফ প্যান্ট পাওয়া গেছে তাও প্রায় দু’বছরের বাচ্চার। পড়ানোর পরে প্যান্টের কোমরের অংশটা আলতো করে টেনে ধররে হা হয়ে থাকে। মনে হয় যেন দন্তহীন কোন শত বর্ষীয় বৃদ্ধ হা করে হাসছে। অফিস থেকে এবার বোনাস দেবে না বলেছে। পকেটের অবস্থা খুবই করুণ। স্ত্রী কন্যারা তা ভালভাবেই জানে। কন্যাটি এবার ঈদে কিছু কিনবে না বলেছে। হয়তো বাবার জন্য তার মায়া হচ্ছে। যদিও কন্যার চাইতেও স্ত্রীর সাথে আমার সম্পর্ক আরো দীর্ঘ দিনের, সে কেন আমাকে বুঝবে না? কিন্তু এটাই সত্যিকারের সত্যি যে, সে আমাকে সত্যিই বুঝবে না। প্রায় দেড় যুগ পার হয়ে গেল, আমাকে বোঝার চেষ্টা করার তেমন কোন লক্ষণ এখনো পর্যন্ত দেখলাম না। প্রাণান্ত চেষ্টা করে যাচ্ছি, বহু কষ্টে সংসারের ঘানি টেনে চলেছি। ইদানীং ঘানির কলকব্জায় জং ধরেছে, ঘানি আর ঘুরতে চায় না। আচ্ছা, ঘানিটা আমি যেভাবে টেনে চলেছি তা আসলে অমনভাবে টানার কোন প্রয়োজন আদৌ ছিল কি? নাকি কপালের ফেরে প্রয়োজনটা সৃষ্টি হয়েছে? যা আয় করছি তা দিয়ে ছোট্ট সংসারটা বেশ চলে যাওয়ার কথা। কিন্তু প্রতিনিয়তই আমার অভাব লেগে থাকে কেন? প্রত্যেক মাসে এর ওর কাছ থেকে ধার করতে হয় কেন? আজ তিন মাস হতে চলল আমার পাশের টেবিলের সহকর্মীর কাছ থেকে পাঁচ হাজার টাকা ধার নিয়েছি। দিতে পারছি না এখনো। কিছুদিন আগে সৌজন্যবশত ওঁকে বলেছিলাম টাকাটা দিতে একটু দেরী হচ্ছে ভাইজান’। তিনি কপট গাম্ভীর্য নিয়ে বললেন, ‘ঠিক আছে . . . ঠিক আছে . . .।’ কিন্তু তাঁর চেহারা দেখে মনে হয়েছে, ‘ঠিক নেই।’ প্রতিনিয়ত অভাব লেগে থাকার কারণ অনুসন্ধান অফিসে বসে কিছুদিন আগে একটা অনুসন্ধানী রিপোর্ট তৈরী করার চেষ্টা করেছিলাম। রিপোর্টটা অনেকটা এরকম,
১) প্রত্যেক মাসে আমার স্ত্রী’র আত্মীয় স্বজন বা বন্ধুদের, কিংবা তাদের সন্তান সন্ততির বিয়ে বা অন্য কোন অনুষ্ঠান লেগেই থাকে।
২) সেখানে সব সময় ভরা হাতে উপস্থিত থাকতে হয়।
৩) এর মধ্যে আবার কোন কোন অনুষ্ঠানে যেতে বিশেষ বিশেষ কাপড় চোপড় খরিদ করতে হয়। (যেমন, তাদের অনেক প্যাঁচানো সম্পর্কের বোন সম্পর্কৃত কারো গায়ে হলুদে, সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হয়েছে, বোনেরা সকলে অমুক রঙের জামদানি শাড়ী পড়বে। সুতরাং এবার অমুক রঙের জামদানি শাড়ী কিনতে এসি অলা কোন মার্কেটে ছোটো।)
৪) মহিয়সী’র ভাতিজার জন্ডিস হয়েছে, ওর রোগ মুক্তির জন্য অমুক মাজারে একটি ছাগল মানত করতে হবে। ব্যাস এবার ছাগল কিনেত ছোটো।
৫) তালিকা তৈরীর এক পর্যায়ে শব্দের গঠনশৈলী ঠিক করতে এবং আরো কারণ খুঁজে বের করতে, চিন্তা করার জন্য একটু ধূমপানের উদ্দেশ্যে বাইরে গিয়েছিলাম। ফিরে এসে দেখি রিপোর্টের অসমাপ্ত পঞ্চম নম্বরটির নীচে কলম দিয়ে চাপা দেয়া আছে একটি খোলা চিরকুট। সেখানে সবুজ কালিতে আমার ঋণদাতা সহকর্মীটি লিখে রেখেছেন, ‘ভাইকে বলতে লজ্জা লাগছে তাই লিখে জানাচ্ছি, দুইদিন পরে ঈদ, টাকাটা বড়ই দরকার।’
হঠাৎ একটি মাইকের আওয়াজ শুনে চমকে উঠলাম। শ্লেষ্মা জড়িত ভাঙ্গা ভাঙ্গা কক্তে কে একজন বলে চলেছেন, ‘চিকন ইন্দুর, মোটা ইন্দুর, গুরা ইন্দুর, ধাঁড়ি ইন্দুর . . .’ তার পর পরই মাইকে কাশির শব্দ শোনা যেতে লাগল। আমি অবাক হলাম। এবার ঈদে কি পথে ঘাটে ইঁদুরও বিক্রি হচ্ছে? বাম পাশে তাকিয়ে দেখি বাসস্টপের দিক থেকে এক বয়স্ক লোক এদিকেই এগিয়ে আসছেন। এক হাতে একটি হ্যান্ড মাইক আর অন্য হাতে দশ বারো বছর বয়সের একটি মেয়ের কাঁধ ধরা রয়েছে। মেয়েটির অন্য কাঁধে বিশাল এক ঝোলা। কোন রকমে কাশি সামলে বৃদ্ধ তার পূর্ব কথার খেই ধরলেন, ‘এক রাইতেই সব খতম হয়া যাইবো।’ আমার কপালের ভাঁজ ঢিল হল। কাছাকাছি আসতেই বৃদ্ধ কাশতে কাশতে ফুটপাতে বসে পড়লেন। দেখলাম অন্ধ লোকটি আসলে তেমন বয়স্ক নন। হয়তো ঘানি টানতে টানতে ন্যুজ হয়ে পড়েছেন। মনে হল, এ আমার মতই আরেক বলদ। তফাৎ শুধু এই, আমি কিছুটা কেতাদুরস্ত আর সে বিবর্ণ। আচ্ছা, দুই বলদে একটা কথা হলে কেমন হয়? কৌতুহল নিয়ে এগিয়ে গেলাম। জিজ্ঞেস করলাম, ‘এই অসুধে ইঁদুর মরে?’ লোকটি কাশতে কাশতে বললেন, ‘মানুষ সহ মইরা যায় আর ইন্দুর . . . দিমু এক পাকিট?’ আমি বললাম, ‘নাহ্ . . . বাসায় ইঁদুর নাই।’ লোকটি রেগে গিয়ে ধমকে উঠলেন, ‘তাইলে খামাকা কথা কন ক্যান . . . সরেন।’ আমি থতমত খেয়ে এদিকে ওদিক তাকালাম। না, কেউ দেখতে পায়নি। কাশতে কাশতে তার হাত থেকে মাইকটা পরে ব্যাটারী গুলো খুলে গেল। মেয়েটি অনেক চেষ্টা করেও সেগুলো লাগাতে পারছে না। আমি তার কাছ থেকে ব্যাটারী চারটা চেয়ে নিয়ে সব ঠিকঠাক করে দিলাম। তারপর একতা সেকথায় লোকটির সাথে খানিক ভাব হয়ে গেল। ইঁদুরের অষুধ নাকি এখন তেমন একটা কেউ কেনে না। শহরে নাকি ধীরে ধীরে ইঁদুর কমে আসছে। ভেবে দেখলাম তাইতো, আমার বাসাতেও ইঁদুর নেই। এই ভাল, ইঁদুরেরা বড়ই নাদান। শুধু ঘর কাটতে ব্যস্ত। ক্ষতি টের পাওয়ার পরে গেরস্থের তখন হা পিত্যেস করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। তবে হ্যাঁ, চিকন-মোটা বা গুরা ইঁদুর কমে আসলেও দাঁড়ি ইঁদুর সম্ভবত এখনো রয়ে গেছে কিছু কিছু জায়গায়।
ঔষধ বিক্রেতা নাকি আজ সারাদিনে তিন প্যাকেট ঔষধ বিক্রি করে মাত্র ত্রিশ টাকা কামাই করেছে। আগামী পরশু ঈদ হওয়ার সম্ভাবনা বেশী। কথায় কথায় সে জানাল সবার কেনা কাটা প্রায় শেষ। তার বউ হোটেলে মরিচ পেষার কাজ করে। বউটা তার স্বামীর জন্য পাঞ্জাবী আর মেয়ের জন্য ফ্রক কিনে এনেছে। সে ঠিক করেছে যেভাবেই হোক তার বউকে একটা শাড়ী কিনে দেবে। আড় দু’শ টাকা যোগাড় করতে পারলে তিনশ টাকা দিয়ে মোটামুটি ভাল মানের একটি শাড়ী পাওয়া যাবে। কেন যেন তার স্ত্রীর শাড়ীটি আমার কিনে দিতে ইচ্ছে হল। লোকটি দু’শ টাকার জন্য ঔষধ বিক্রি করতে যে পরিমাণ কষ্ট করছেন, তার চাইতে অনেক কম পরিশ্রমে ভিক্ষা করেও ঐ টাকা যোগাড় করতে পারত। কিন্তু সবাই সবকিছু পারে না, কিংবা সবকিছুর প্রতি সকলের আগ্রহও তেমন থাকে না। যেমন, এই মুহূর্তে আমি শাড়ী বদলাবার আগ্রহ দূরে থাক বাস ধরার আগ্রহও বোধ করছি না বিন্দুমাত্র। আমার স্ত্রী বলেছে এই শাড়ী বদলিয়ে একই ডিজাইনের কমলা রঙের শাড়ীটা নিয়ে যেতে। আমার ভেতরটায় কেমন জানি করছে। আচ্ছা লোকটির জন্যই কি এমন বোধ হচ্ছে, নাকি তার সুখের সংসারটির জন্য? যদিও পকেটের সার্বিক অবস্থা সুবিধার নয়, তবু ইচ্ছে হল লোকটিকে যদি কিছু সাহায্য করতে পারতাম। অবশ্য লোকটি আমার সাহায্য নিতে চাইবে কিনা সেটাও একটা কথা। দেখেশুনে যা মনে হচ্ছে সে কারো করুণার তোয়াক্কা করে না। মেয়েটাকে বললাম, ‘আমাকে দুই প্যাকেট দাওতো মা?’ লোকটি বললেন, ‘কইলেন না আপনার ঘরে ইন্দুর নাই?’ কোন উত্তর খুঁজে পেলাম না। তবু কিছু একটা বলার জন্য বললাম, ‘থাকতেও তো পারে।’ সে বলল, ‘আপনারে ভাল্লাগছে . . . পয়সা কিন্তুক নিমু না।’ ওমা এ বলে কি! কিছুক্ষণ একটু কথাবার্তা হয়েছে আর তাতেই পয়সা নিতে চাইছে না, অদ্ভুত পৃথিবী! কাছেই একটি বাস এসে থামল। একটি যাত্রী উঠছে। আমি দু’প্যাকেট ঔষধ নিয়ে অন্ধের হাতে দু’টা নোট গুঁজে দিয়ে দ্রুত পায়ে বাসের দিকে এগিয়ে গেলাম। পেছন থেকে শুনলাম মেয়েটি তার বাবাকে বলছে, ‘বাজান . . . ব্যাডা দেহি তোমারে দুইটা একশতি দিয়া গেছে।’ মাইক হতে লোকটির শ্লেষ্মা জড়িত ডাক শোনা গেল, ‘টেকা বেশী দিছেন . . . ও ভাই . . . ও ভাইজা . . . ন।’
বাসে বসার সিট দূরের কথা দাঁড়ানোর মত কোন জায়গাও নেই। এক হাতে শাড়ীর প্যাকেট আর অন্য হাতের ক’টি আঙ্গুল দিয়ে বাসের হাতল ধরে আছি। হাতল ধরা হাতের বাকী আঙ্গুলে অপ্রয়োজনীয় ঔষধের প্যাকেট দুটি অতিকষ্টে ধরা রয়েছে। আরে, আমি শুধু শুধু প্যাকেট দু’টা কেন ধরে রেখেছি? মাথার ভেতর আজগুবি সব চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। প্যাকেট গুলো ফেলে দেয়ার জন্য হাতটা জানালার বাইরে নিতে গিয়ে অবচেতনে প্যান্টের পকেটে পুরে নিলাম।