আচ্ছা কেউ কি বলতে পারেন কাজী নজরুল ইসলামের প্রথম মুদ্রিত গল্প “বাউন্ডেলের আত্নকাহিনি” কোন পত্রিকায় ছাপা হয়েছিলো?
বাংলাদেশের প্রথম মহিলা সাংবাদিক কে এবং কোন পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রথম ছাপা হয়েছিলো?
খুব সাধারণ দুটি প্রশ্ন, যারা লেখালেখির খোঁজ রাখেন, বা লেখালেখির ইতিহাসে খানিক আগ্রহ আছে তাঁরা চট জলদি বলে দিতে পারবেন, সন্দেহ নেই। কিন্তু গড়পড়তা বাংলাদেশী পাঠক বা নতুন প্রজন্মের অনেকেই এর উত্তর দিতে পারবেন না। খুব অস্বাভাবিক না, আমাদের দেশে ইতিহাস চর্চা বিশেষত সাহিত্যর ইতিহাস চর্চা সেখানে আবার ম্যাগাজিন, তার খতিয়ান রাখবার লোকের সংখ্যা কমই হবার কথা।
যে পত্রিকা নিয়ে কথা বলছি সেটি ছিল এক সময় প্রগতিশীল মানুষদের অত্যন্ত প্রিয়। রবি ঠাকুর জানান যে, পিছিয়ে পড়া বাংলাদেশের মুসলিম সমাজ থেকে ইতিপূর্বে এই রকম কোন ম্যাগাজিন বের হয়েছে কিনা তাঁর জানা নেই।
আর এই পত্রিকার সম্পাদক বেগম রোকেয়ার সংগে পত্রালাপে দাবি করেন যে, তাঁর এই পত্রিকাই হবে বাঙালি মুসলিম সমাজ থেকে প্রকাশিত হওয়া প্রথম আধুনিক সাহিত্য পত্রিকা।
যদিও এই পত্রিকাটি প্রকাশিত হবার আগে আরও তিনটি উদার ভাবধারার ও আধুনিক পত্রিকা বের হয়ে গিয়েছিল, সে গুলো হল, “মিহির”; “কোহিনুর” ও “নব নুর”। তবে সন্দেহের অবকাশ নেই যে পত্রিকাটি নিয়ে কথা হচ্ছে সে একটি যুগ সৃষ্টিকারী এবং অনন্য এক প্রকাশনা। তাঁর পথ ধরেই আরও অনেক পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিলো।
সে পত্রিকা ছিল তৎকালীন মুসলমান সমাজের সাংস্কৃতিক জীবনের ভরকেন্দ্র! সাহিত্য, সমাজ, রাজনীতি নারীমুক্তি, বিশ্ব সংবাদ কি না ছিল?! আলকচিত্রের পাশাপাশি লেখিকাদের ছবি পর্যন্ত ছাপা হত। এমন কি চলচিত্র সমালোচনাও ছিল। আজকে এই সমাজে বসে আমরা বুঝতেও পারবো না কি বিশাল বিপ্লব ঘটিয়েছিল সে পত্রিকা। এতক্ষনে বুদ্ধিমান পাঠকেরা বুঝে গেছেন কোন পত্রিকার কথা হচ্ছে!
একদম ঠিক পাঠক “সওগাত”!
আজ থেকে ঠিক একশ বছর আগে ১৯১৮ সালে আলোর মুখ দেখে এই পত্রিকাটি। মোহাম্মদ নাসিরুদ্দিন ছিলেন সম্পাদক! আর কিচ্ছু বলতে হবে না। সচেতন পাঠক মাত্রই জানেন, “সওগাত” কি এবং জনাব মোহাম্মদ নাসিরুদ্দিনের অবদান! কিন্তু দুঃখের বিষয় এমন একটি পত্রিকা প্রকাশের শতবর্ষ পূর্ণ হল দেশের অধিকাংশ মানুষই সে বিষয়ে ওয়াকিবহাল না!
প্রথম প্রকাশের পর ১৯২২ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়, তারপর বিরতি দিয়ে ১৯২৬ এ পুন প্রকাশ হয়ে ১৯৪৭ পর্যন্ত টানা প্রকাশিত হয়।
আর হ্যাঁ এ পত্রিকাটিতেই নজরুলের প্রথম গল্প ছাপা হয়। আর জনাব মোহাম্মদ নাসিরুদ্দিন সাহেবের কন্যা নুরজাহান বেগমই এ দেশের প্রথম মহিলা সাংবাদিক। উনার প্রথম লেখা যখন ছাপা হয় তাঁর বয়স তখন মাত্র পনের।
সেই সওগাত প্রকাশনার একশ বছর হয়ে গেছে। কার না লেখা ছাপা হত সেখানে, সে যুগে? শুধু মুসলিম না, হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষ ছাপা হত লেখা। কুমুদ রঞ্জন মল্লিক, জীবনানন্দ দাশ, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, কালিদাস রায়, জসীম উদ্দিন, কায়কোবাদ, বন্দে আলি মিয়া এঁদের লেখার পাশাপাশি থাকত মানকুমারী বসু, বেগম রোকেয়া, বেগম সুফিয়া কামাল সহ আরও সব লেখকদের লেখা।
নজরুলের বেশ কিছু লিখায় তাঁর নাম তিনি উল্লেখ করেছেন “হাবিলদার কাজী নজরুল ইসলাম” হিসেবে, নিঃসন্দেহে এর এক ঐতিহাসিক মুল্য রয়েছে। “বাউন্ডেলে” নজরুল কিছু দিন সেখানে বাঁধাও পড়েছিলেন নিয়ম মেনে চাকুরির ফাঁদে। এখানেই প্রথম ছাপা হয়েছিল আমাদের রণ সংগীত “চল্ চল্ চল্...”।
শুধু সাহিত্য বা সংস্কৃতিই না, ধর্মীয় নাগপাশ বা মোল্লা সংস্কৃতির বিরুদ্ধেও ছিল সওগাত সোচ্চার! বাংলা ভাষায় মুসলমানি শব্দের এক অসামান্য দলিল হয়ে আছে এ পত্রিকায় ছাপা, আবুল ফজল ও রবীন্দ্রনাথের পত্রাবলী! আরও সব ইতিহাসের অংশ হয়ে আছে এই সওগাত, যা বলে শেষ করা যাবে না। যার মহিলা বিষয়ক প্রকাশনা বেগম বাংলার নারী জাগরণের অবিচ্ছেদ্দ অংশ!
শতবর্ষ পূর্ণ হওয়া এই সওগাত যে আলো জ্বেলেছিল, জানি না আমরা উত্তর প্রজন্ম সে আলোতে কতটুকু আলোকিত হতে পেরেছি!
তথ্য সুত্রঃ
“বাংলা সাহিত্যে সওগাত যুগ”
“শতবর্ষে সওগাত”
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে আগস্ট, ২০১৮ রাত ১:১৫