somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দেখা হবে

২৬ শে নভেম্বর, ২০১০ রাত ১:৪৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

নকশীকাঁথার মতো বিচিত্র এক পৃথিবী ছিলো আমাদের শৈশবে৷ এখনও পায়ের তলায় পৃথিবীর মাটি, চারিদিকে গাছপালা, মাথার উপর আকাশ৷ বুক ভরে শ্বাস টেনে দেখি৷ না, শীতের সকালে কুয়াশায় ভেজা বাগান থেকে যে রহস্যময় বন্য গন্ধটি পাওয়া যেতো তা আর পাওয়া যায় না৷ আমাদের সাওতাল মালী বিকেলের দিকে পাতা পুড়িয়ে আগুন জ্বালতো; সেই গন্ধ কতোবার আমাকে ভিন্ন এক জন্মের স্মৃতির দিকে টেনে নিয়ে গেছে৷ আর মনে আছে মায়ের ঘ্রাণ৷ সে গন্ধে ঘুমের ভেতরেও টের পেতাম, মা অনেক রাতে বিছানায় এলো৷ মার দিকে পাশ ফিরে শুতাম ঠিক৷ তখন নতুন ক্লাসে উঠে নতুন বই পেতাম ফি বছর৷ কি সুঘ্রাণ ছিলো সেই নতুন বইয়ের পাতায়৷ মনে পড়ে বর্ষায় কদম ফুল কুড়িয়ে এনে বল খেলা৷ হাতে-পায়ে কদমের রেণু লেগে থাকতো বুঝি৷ কি ছিলো, কি থাকে মানুষের শৈশবে! বিকেলের আলো মরে এলো যেই, অমনি পৃথিবীটা চলে যেতো ভূতেদের হাতে৷ এক ঘর থেকে অন্য ঘর যাওয়া ছিলো ভারি শক্ত৷ বিশাল বাড়িতে কয়েকটি প্রাণি আমরা গায় গায়ে ঘেষে থাকতাম৷ ভোরের আলোটি ফুটতে না ফুটতে ঘুম ভেঙে লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নেমে ছুটতাম বাইরে৷ বাইরেটাই ছিলো বিষ্ময়ের৷ সূর্য উঠছে, আকাশটা নীল, গাছপালা সবুজ৷ সব ঠিক আগের দিনের মতোই৷ তবু অবাক হয়ে দেখতাম, মনে হতো, গতকাল ঠিক এরকম দেখি নি তো!

সেই আনন্দিত ছেলেবেলায় একটা দুঃখের ঘটনা ঘটে গেলো৷ আমার ছোটকাকা মৃত্যু শয্যায়৷ মাত্র দেড় বছর আগে কাকীমা এসেছেন ঘরে৷ একটা ফুটফুটে মেয়েও হয়েছে৷ সে তখন হাত-পা নেড়ে উপুড় হয়, কত আহ্লাদের শব্দ করে৷ তবু বৌ বাচ্চা রেখে ছোটকাকার মরণ ঘনিয়ে এলো৷ বিকেলে শ্বাস উঠে গেছে৷ দাদু তখন বাইরের বারান্দায় বসে আছেন৷ বাঁ হাতে ধরা তামাকের নল, কল্কেতে আগুন নিভে গেছে কখন৷ সন্ধ্যের পর জ্যোৎস্না উঠেছে সেদিন৷ দাদু সেই জ্যোৎস্নায় পা মেলে বসে আছেন৷ ভিতর বাড়িতে কান্নার শব্দ উঠেছে৷ বাবা আর জ্যাঠামশাইরা এসে দাদুকে ডাকলেন- আসুন, প্রিয়নাথকে একবার দেখবেন না?

দাদু খড়মের শব্দ তুলে ভিতর বাড়িতে এলেন৷ তার মুখখানা একটু ভার দেখাচ্ছিলো, আর কিছু নয়৷ ছোটকাকা তখন বড় বড় চোখে চারদিকে তাকাচ্ছেন৷ কাকে যেনো খুঁজছেন, কি যেনো খুঁজে পাচ্ছেন না৷ বার বার বলছেন- তোমরা সব চুপ করে আছো কেনো? কিছু বলো, আমাকে কিছু বলো৷

জ্যাঠামশাই নিচু হয়ে বললেন- কি শুনতে চাও প্রিয়নাথ?
ছোটকাকা ক্লান্ত, বিরক্ত হয়ে বললেন- আমি কি জানি! একটা ভালো কথা, একটা সুন্দর কথা কিছু আমাকে বলো, আমার কষ্ট ভুলিয়ে দাও৷ আমি কেনো এই বয়সে সবাইকে ছেড়ে যাচ্ছি-- আমার মেয়ে রইলো, বউ রইলো-- আমার এই কষ্টের সময় কেউ কোনো সুখের ক্থা বলতে পারো না?

বড় কঠিন সেই পরীক্ষা৷ কেউ কিছু বলতে পারে না৷ সবাই কেবল মরোনোম্মুখ মানুষটার মুখের দিকে চেয়ে থাকে, কথা খুঁজে পায় না৷ কিন্তু প্রত্যেকের ঠোঁট কাঁপে৷

একজন অতি কষ্টে বললো- তুমি ভালো হয়ে যাবে প্রিয়নাথ৷ শুনে ছোটকাকা থমকে বললেন- যাও যাও!
আর একজন বললো- তোমার মেয়ে বৌকে আমরা দেখবো, ভয় নেই৷
শুনে ছোটকাকা মুখ বিকৃত করে বললেন- আঃ তা তো জানিই, অন্য কিছু বলো৷

কেউ কথা খুঁজে পাচ্ছিলো না৷
সেই সময়ে দাদু ঘরে এলেন৷ স্বাভাবিক ধীর পায়ে এসে বসলেন ছোটকাকার বিছানার পাশে৷ ছোটকাকা মুখ ফিরিয়ে তাকে বললেন- বাবা, সারাজীবন আপনি কোন ভালো কথা বলেন নি, কেবল শাসন করেছেন৷ এবার বলুন৷

সবাই নিস্তব্ধ; সেই নিস্তব্ধতার একটা পাহাড় প্রমাণ ঢেউ অদৃশ্য থেকে এগিয়ে আসছে৷ ছোটকাকাকে জীবনের তীরভূমি থেকে অথৈ অন্ধকারের এক সমুদ্রের দিকে নিয়ে যাবে বলে ঢেউটা আসছে, আসছে৷ আর সময় নেই৷ ছোটকাকার জিভটা এলিয়ে পড়েছে, বার বার চোখ বন্ধ হয়ে আসছে, মুখ প্রবল ব্যথায় বিকৃত!

দাদু একটু ঝুঁকে শান্ত স্বরে বললেন- প্রিয়নাথ, আবার দেখা হবে৷

কি ছিলো সেই কথায়! কিছুই না৷ অতিথি অভ্যাগত বিদায় দেয়ার সময় মানুষ যেমন বলে, তেমনি সাধারণভাবে বলা৷ তবু সেই কথা শুনে মৃত্যুপথযাত্রী ছোটকাকার মুখ হঠাৎ আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে গেলো৷ তিনি শান্তভাবে চোখ বুজলেন৷ ঘুমিয়ে পড়লেন৷

এসব অনেকদিন আগেকার কথা৷ নক্সীকাঁথার মত বিচিত্র সুন্দর শৈশবের পৃথিবী কোথায় হারিয়ে গেছে৷ সেই সুন্দর গন্ধগুলো আর পাই না, তেমন ভোর আর আসে না৷ মায়ের গায়ের সুঘ্রানের জন্য প্রাণ আনচান করে৷ পৃথিবী বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে ক্রমে৷ বুড়ো গাছের মতো শুকিয়ে যাচ্ছে আমার ডালপালা৷ খসে যাচ্ছে পাতা৷ মহাকালের অন্তঃস্থলে তৈরি হচ্ছে একটি ঢেউ৷ একদিন যে এই পৃথিবীর তীরভূমি থেকে আমাকে নিয়ে যাবে৷

বুকের মধ্যে শৈশবের একটি কথা তীরের মতো বিঁধে থর থর করে কাঁপছে আজও৷ সেই অমোধ ঢেউটিকে যখনই প্রত্যক্ষ করি, মনে মনে তখনই ঐ কথাটি বুকের মধ্যে কেঁপে উঠে৷ শৈশবের সব ঘ্রাণ, শব্দ ও স্পর্ষ ফিরিয়ে আনে৷ মায়ের গায়ের ঘ্রাণ পেয়ে যেমন ছেলেবেলায় পাশ ফিরতাম, তেমনি আবার পৃথিবীর দিকে পাশ ফিরে শুই৷ মনে হয়, দেখা হবে, আবার আমাদের দেখা হবে৷

(শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ছোটগল্প৷ খুব প্রিয় ছিলো এক সময়৷ পুরোটা মুখস্থ ছিলো৷ অনেকদিন পর আজ হঠাৎ গল্পটা হাতে পেলাম৷ হাতে পেয়েই টাইপ করে ফেললাম৷)
৭টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

লালনের বাংলাদেশ থেকে শফি হুজুরের বাংলাদেশ : কোথায় যাচ্ছি আমরা?

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:১৪



মেটাল গান আমার নিত্যসঙ্গী। সস্তা, ভ্যাপিড পপ মিউজিক কখনোই আমার কাপ অফ টি না। ক্রিয়েটর, ক্যানিবল কর্পস, ব্লাডবাথ, ডাইং ফিটাস, ভাইটাল রিমেইনস, ইনফ্যান্ট এনাইহিলেটর এর গানে তারা মৃত্যু, রাজনীতি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪১


প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি! চুরি! সুপারি চুরি। স্মৃতি থেকে(১০)

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৪


সে অনেকদিন আগের কথা, আমি তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। স্কুলে যাওয়ার সময় আব্বা ৩ টাকা দিতো। আসলে দিতো ৫ টাকা, আমরা ভাই বোন দুইজনে মিলে স্কুলে যেতাম। আপা আব্বার... ...বাকিটুকু পড়ুন

যেকোন বাংগালীর ইন্টারভিউর সময়, 'লাই-ডিটেক্টটর' যোগ করে ইন্টারভিউ নেয়ার দরকার।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৫ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০৭



আপনার এনলাকার এমপি, প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী কামাল সাহেব, যেকোন সেক্রেটারী, যেকোন মেয়র, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান, বিএনপি'র রিজভী, আওয়ামী লীগের ওয়ায়দুল কাদের, আপনার থানার ওসি, সীমান্তের একজন বিজিবি সদস্য, ঢাকার... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:২৬


আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×