নকশীকাঁথার মতো বিচিত্র এক পৃথিবী ছিলো আমাদের শৈশবে৷ এখনও পায়ের তলায় পৃথিবীর মাটি, চারিদিকে গাছপালা, মাথার উপর আকাশ৷ বুক ভরে শ্বাস টেনে দেখি৷ না, শীতের সকালে কুয়াশায় ভেজা বাগান থেকে যে রহস্যময় বন্য গন্ধটি পাওয়া যেতো তা আর পাওয়া যায় না৷ আমাদের সাওতাল মালী বিকেলের দিকে পাতা পুড়িয়ে আগুন জ্বালতো; সেই গন্ধ কতোবার আমাকে ভিন্ন এক জন্মের স্মৃতির দিকে টেনে নিয়ে গেছে৷ আর মনে আছে মায়ের ঘ্রাণ৷ সে গন্ধে ঘুমের ভেতরেও টের পেতাম, মা অনেক রাতে বিছানায় এলো৷ মার দিকে পাশ ফিরে শুতাম ঠিক৷ তখন নতুন ক্লাসে উঠে নতুন বই পেতাম ফি বছর৷ কি সুঘ্রাণ ছিলো সেই নতুন বইয়ের পাতায়৷ মনে পড়ে বর্ষায় কদম ফুল কুড়িয়ে এনে বল খেলা৷ হাতে-পায়ে কদমের রেণু লেগে থাকতো বুঝি৷ কি ছিলো, কি থাকে মানুষের শৈশবে! বিকেলের আলো মরে এলো যেই, অমনি পৃথিবীটা চলে যেতো ভূতেদের হাতে৷ এক ঘর থেকে অন্য ঘর যাওয়া ছিলো ভারি শক্ত৷ বিশাল বাড়িতে কয়েকটি প্রাণি আমরা গায় গায়ে ঘেষে থাকতাম৷ ভোরের আলোটি ফুটতে না ফুটতে ঘুম ভেঙে লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নেমে ছুটতাম বাইরে৷ বাইরেটাই ছিলো বিষ্ময়ের৷ সূর্য উঠছে, আকাশটা নীল, গাছপালা সবুজ৷ সব ঠিক আগের দিনের মতোই৷ তবু অবাক হয়ে দেখতাম, মনে হতো, গতকাল ঠিক এরকম দেখি নি তো!
সেই আনন্দিত ছেলেবেলায় একটা দুঃখের ঘটনা ঘটে গেলো৷ আমার ছোটকাকা মৃত্যু শয্যায়৷ মাত্র দেড় বছর আগে কাকীমা এসেছেন ঘরে৷ একটা ফুটফুটে মেয়েও হয়েছে৷ সে তখন হাত-পা নেড়ে উপুড় হয়, কত আহ্লাদের শব্দ করে৷ তবু বৌ বাচ্চা রেখে ছোটকাকার মরণ ঘনিয়ে এলো৷ বিকেলে শ্বাস উঠে গেছে৷ দাদু তখন বাইরের বারান্দায় বসে আছেন৷ বাঁ হাতে ধরা তামাকের নল, কল্কেতে আগুন নিভে গেছে কখন৷ সন্ধ্যের পর জ্যোৎস্না উঠেছে সেদিন৷ দাদু সেই জ্যোৎস্নায় পা মেলে বসে আছেন৷ ভিতর বাড়িতে কান্নার শব্দ উঠেছে৷ বাবা আর জ্যাঠামশাইরা এসে দাদুকে ডাকলেন- আসুন, প্রিয়নাথকে একবার দেখবেন না?
দাদু খড়মের শব্দ তুলে ভিতর বাড়িতে এলেন৷ তার মুখখানা একটু ভার দেখাচ্ছিলো, আর কিছু নয়৷ ছোটকাকা তখন বড় বড় চোখে চারদিকে তাকাচ্ছেন৷ কাকে যেনো খুঁজছেন, কি যেনো খুঁজে পাচ্ছেন না৷ বার বার বলছেন- তোমরা সব চুপ করে আছো কেনো? কিছু বলো, আমাকে কিছু বলো৷
জ্যাঠামশাই নিচু হয়ে বললেন- কি শুনতে চাও প্রিয়নাথ?
ছোটকাকা ক্লান্ত, বিরক্ত হয়ে বললেন- আমি কি জানি! একটা ভালো কথা, একটা সুন্দর কথা কিছু আমাকে বলো, আমার কষ্ট ভুলিয়ে দাও৷ আমি কেনো এই বয়সে সবাইকে ছেড়ে যাচ্ছি-- আমার মেয়ে রইলো, বউ রইলো-- আমার এই কষ্টের সময় কেউ কোনো সুখের ক্থা বলতে পারো না?
বড় কঠিন সেই পরীক্ষা৷ কেউ কিছু বলতে পারে না৷ সবাই কেবল মরোনোম্মুখ মানুষটার মুখের দিকে চেয়ে থাকে, কথা খুঁজে পায় না৷ কিন্তু প্রত্যেকের ঠোঁট কাঁপে৷
একজন অতি কষ্টে বললো- তুমি ভালো হয়ে যাবে প্রিয়নাথ৷ শুনে ছোটকাকা থমকে বললেন- যাও যাও!
আর একজন বললো- তোমার মেয়ে বৌকে আমরা দেখবো, ভয় নেই৷
শুনে ছোটকাকা মুখ বিকৃত করে বললেন- আঃ তা তো জানিই, অন্য কিছু বলো৷
কেউ কথা খুঁজে পাচ্ছিলো না৷
সেই সময়ে দাদু ঘরে এলেন৷ স্বাভাবিক ধীর পায়ে এসে বসলেন ছোটকাকার বিছানার পাশে৷ ছোটকাকা মুখ ফিরিয়ে তাকে বললেন- বাবা, সারাজীবন আপনি কোন ভালো কথা বলেন নি, কেবল শাসন করেছেন৷ এবার বলুন৷
সবাই নিস্তব্ধ; সেই নিস্তব্ধতার একটা পাহাড় প্রমাণ ঢেউ অদৃশ্য থেকে এগিয়ে আসছে৷ ছোটকাকাকে জীবনের তীরভূমি থেকে অথৈ অন্ধকারের এক সমুদ্রের দিকে নিয়ে যাবে বলে ঢেউটা আসছে, আসছে৷ আর সময় নেই৷ ছোটকাকার জিভটা এলিয়ে পড়েছে, বার বার চোখ বন্ধ হয়ে আসছে, মুখ প্রবল ব্যথায় বিকৃত!
দাদু একটু ঝুঁকে শান্ত স্বরে বললেন- প্রিয়নাথ, আবার দেখা হবে৷
কি ছিলো সেই কথায়! কিছুই না৷ অতিথি অভ্যাগত বিদায় দেয়ার সময় মানুষ যেমন বলে, তেমনি সাধারণভাবে বলা৷ তবু সেই কথা শুনে মৃত্যুপথযাত্রী ছোটকাকার মুখ হঠাৎ আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে গেলো৷ তিনি শান্তভাবে চোখ বুজলেন৷ ঘুমিয়ে পড়লেন৷
এসব অনেকদিন আগেকার কথা৷ নক্সীকাঁথার মত বিচিত্র সুন্দর শৈশবের পৃথিবী কোথায় হারিয়ে গেছে৷ সেই সুন্দর গন্ধগুলো আর পাই না, তেমন ভোর আর আসে না৷ মায়ের গায়ের সুঘ্রানের জন্য প্রাণ আনচান করে৷ পৃথিবী বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে ক্রমে৷ বুড়ো গাছের মতো শুকিয়ে যাচ্ছে আমার ডালপালা৷ খসে যাচ্ছে পাতা৷ মহাকালের অন্তঃস্থলে তৈরি হচ্ছে একটি ঢেউ৷ একদিন যে এই পৃথিবীর তীরভূমি থেকে আমাকে নিয়ে যাবে৷
বুকের মধ্যে শৈশবের একটি কথা তীরের মতো বিঁধে থর থর করে কাঁপছে আজও৷ সেই অমোধ ঢেউটিকে যখনই প্রত্যক্ষ করি, মনে মনে তখনই ঐ কথাটি বুকের মধ্যে কেঁপে উঠে৷ শৈশবের সব ঘ্রাণ, শব্দ ও স্পর্ষ ফিরিয়ে আনে৷ মায়ের গায়ের ঘ্রাণ পেয়ে যেমন ছেলেবেলায় পাশ ফিরতাম, তেমনি আবার পৃথিবীর দিকে পাশ ফিরে শুই৷ মনে হয়, দেখা হবে, আবার আমাদের দেখা হবে৷
(শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ছোটগল্প৷ খুব প্রিয় ছিলো এক সময়৷ পুরোটা মুখস্থ ছিলো৷ অনেকদিন পর আজ হঠাৎ গল্পটা হাতে পেলাম৷ হাতে পেয়েই টাইপ করে ফেললাম৷)