আজ নিজের মনোভাব মনোবল আর শিক্ষাকে বড়ই তুচ্ছ মনে হচ্ছে!
=========================================
গল্পটা আজ দুপুরের। মন মেজাজ খারাপ। ভালো একটা চাকরী বুঝি আর হলোই না। তার সাথে যোগ হলো রুমার নতুন জ্বালাতন বিয়ে বিয়ে বিয়ে। জীবন তো পুরাই তেতো। আজ অনেক অনুরোধের পর বাইকে করে আমি আর আমার এক ফ্রেন্ড অনেক ঘুরাঘুরি করলাম। প্লানিং আজ গরম পানি পিকবো। ষাট ফিট রাস্তার পাশেই একটি টং দোকানে চা খেতে বসলাম একটু ক্লান্ত হযে। এমন সময় দেখলাম কম বয়সী একটি ছেলে রাস্তা পার হচ্ছে। ঠিক ওই মুহুর্তে একটি রিক্সা এসে ওর পাশে থামলো। রিক্সায় থাকা ছেলেটি ডানে বায়ে না তাকিয়েই নামার জন্য হুট করে পা বাড়ালো। কম বয়সী ছেলেটির ঝুড়ির সব বাদাম পরে গেলো।
ছেলেটি কোটি টাকা দামের একটি হাসি দিয়ে বললোঃ মামা ইকটুর লাইগ্গা ধাক্কাডা লাইগ্গা গেছে। রিক্সা থেকে নামা ছেলেটিও বিনয়ের স্বরে সরি টরি বললো।
তারপর বললোঃ তোমার বাদামের দাম কত বলো আমি দিয়ে দিচ্ছি।
কিন্তু কম বয়সী সেই ছেলেটি মৃদু একটা হাসি দিয়ে বললোঃ
মামা এইডা তো এক্সিডেন। আপনে তো ইচ্চা কইরা ফালাইয়া দেন নাই।
দূর থেকে দেখলাম অনেক রিকুয়েশ্ট করার পর ও কম বয়সী ছেলেটি কোন টাকাই নিলো না। আমি আর আমার ফ্রেন্ড সেই দৃশ্যগুলো দেখছিলাম। মজার ব্যাপার হলো কম বয়সী ছেলেটির মুখে একটি বারের জন্য ও কোন দুশ্চিন্তার ছাপ বা মুখ ভার করা এমন কিছুই চোখে পড়লো না। কিন্তু তার সবগুলো বাদাম কিন্তু তখন খোলা ড্রেন দিয়ে ভাসছে। খুব আগ্রহ জাগলো একটি বার ছেলেটির সাথে কথা বলার। ভেবে দেখলাম এমনিতে হয়তো ডাকলে বা কথা বলতে চাইলেই ও বিরক্ত হবে। আমাদের কাছাকাছি আসার পর বললামঃ ভাইয়া একটু শোন তো। ছেলেটি পাশে আসলো, মুখে সেই কোটি টাকা দামের হাসি। বললামঃ ভাইয়া কে একটা কাজ করে দিবা। খুব আগ্রহ নিয়ে বললো বলেনঃ পারলে কইরা দিমু। বললামঃ এখন তো প্রচন্ড গরম তাই না? ভাইয়াদের একটা বড় ঠান্ডা পানির বোতল এনে দাও তো। ও টাকা নিয়ে এক দৌড়ে রাস্তা পার হলো। মুহুর্তেই পানির বোতল নিয়ে আসলো। ওর সাথে আস্তে আস্তে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলা শুরু করলাম। বাব নেই মা আছে। মা ঠুঙা বানায়। আশপাশের দোকানে বিক্রি করে। বাবা নেই ওর। কোন ভাই বোন ও নেই। কোন আত্মীয় স্বজনও নেই এই এতো বড় ঢাকা শহরে। ওর মা ঠুঙা বানানোর সময় ওকে মুখে মুখে পড়ালেখা শেখায়। আরো অনেক কিছু জানলাম। যাতে বুঝা গেলো তার মা যতটুকু পড়ালেখাই করুক না কোন, তিনি একজন শিক্ষিত মা। ওর কাছে জানতে চাইলাম বাদামগুলো যে নষ্ট হয়ে গেলো, তোমার মা কিছু বলবে না। কিন্তু সে একটু হেসে বললো ভাইয়া মায়রে কইলে মায়ে বুঝবো। আমি ঠাট্টা করে বললাম তোমার মত যদি আমার কিছু এভাবে পানিতে পড়ে যেতো আমি সারাদিন মন খারাপ করে থাকতাম। সাথে সাথে ও উত্তর দিলো মায়ে কইছে দেওনের মালিক আল্লা, নেওনের মালিক ও আল্লা। মন খারাপ করলে তো আল্লাহ নারাজ হইবো। এতোটুকু ছেলের মনোবল বিশ্বাস আর দৃঢ়তা! আমি রীতিমত হতবম্ভ। আমাদের কথার মাঝেই হঠাৎ করেই কেউ একজন নজরুল বলে ডেকে উঠলো। নজরুল উনাকে সালাম দিলো। তারপর আমরাও উনাকে সালাম দিলাম। নজরুলকে উনি বললো আজ আমার সাথে সারা বিকেল থাকতে পারবি না? নজরুল লাজুক ভঙ্গিতে বললো পারবো স্যার। উনি বললো আজ আমার পরীক্ষার খাতাগুলো গুছাতে হবে। তোর ম্যাডাম তো বাড়ি গেছে। তুই আমার ব্যাগটা নিয়ে বাসায় যা। আমি বাসায় ফোন করে বলে দিচ্ছি। বাজারের ব্যাগটা হাতে দিয়ে রিক্সায় করে নজরুলকে উনি বাসায় পাঠালেন। তারপর মান্নান স্যারের মুখে আরো অনেক কিছু শুনলাম। অনেক প্রশংসা করলো নজরুলের।
কাজ ছাড়া কারো কাছ থেকে কোন টাকা নিতে চায় না। আমি কখনো আমার ছোট খাটো কাজ থাকলে ওকে দিয়ে করাই। যদিও আমিই করতে পারি। কিন্তু ওকে টাকা দিয়ে হেল্প করতে চাইলে নিবে না। খুব ভালো ছেলে। তাই ওকে দিয়ে করাই। কারন ও যে মনোবলটা নিয়ে বেড়ে উঠছে তা আরো শক্ত হোক।...আমরা স্যারে কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাসায় ফিরলাম।
নজরুলের মা কতটুকু শিক্ষিত তা জানি না। কিন্তু একটি ছেলেকে মানুষ করার জন্য যতটুকু শিক্ষা থাকা দরকার তা উনার আছে। আর নজরুল ও সেই মায়ের যোগ্য সন্তান। যে বাদাম বিক্রি করে কিন্তু মায়ের কথা মায়ের উপদেশ সব মনে ধারন করেই পথ চলে। আমার বা অনেকের মতো সে স্কুল কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডি পেরুয় নি। কিন্তু যা দিয়ে আমাদের সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে তা হলো, মায়ের দেওয়া শিক্ষা আর দৃঢ় মনোবল। যেখানে আমার মত অনেকেই একটি ভালো চাকরী না পেলেই বা ছোট খাটো অনেক বিষয়েই মনোবল হারিয়ে ফেলে। তারপর বিড়ি আর গরম পানি ডালি হতাশা কাটানোর জন্য। বর্তমান যুগের দেবদাষ সাজার চেষ্টা করি। আর নজরুল তার মায়ের শেখানো কথা, বিশ্বাস আর নিষ্পাই হাসি দিয়েই ও রকম সব হতাশা মুহুর্তেই জয় করে নেয়।
আজ নিজের মনোভাব মনোবল আর শিক্ষাকে বড়ই তুচ্ছ মনে হচ্ছে!
কারনে অকারনে মাঝে মাঝে কী সব করি।
যেখানে একটি ছোট্ট ছেলের কথা আর আচরন থেকেও নিজেকে পাল্টাতে হয়!
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জুলাই, ২০১৬ বিকাল ৪:১৭