আববুর সাথে দাদুর বাড়ি বছরে একবার যাওয়ার সুযোগ হয় বটে, কিন্তু কখনো দু'বার হয় না। গ্রীষ্মে স্কুল ছুটি থাকলেও (দাদুর বাড়ি) আববুর সাথে যেতে পারি না। যাবোই বা কেমনে! তিনি তো আমাদের মতো গ্রীষ্মের ছুটি পান না। গ্রামে গেলে অনেক ইচ্ছে পূরণ হয়। হৈ হুল্লোড় করে এখানে ওখানে ছুটাছুটি। দীঘি কিংবা পুকুরে কলার মোঁচার নৌকা ভাসানো। দুপুরে নদীতে সাঁতার কাটা। কতো আনন্দ। এবার স্কুল গ্রীষ্মের পরিবর্তে ছুটি হলো বর্ষাতে। লম্বা ছুটি। আগে থেকে আববুকে বলেছি, এবার ছুটিতে অবশ্যই গ্রামে নিয়ে যাবেন। দাদু ভাইয়া, বারবার যেতে বলেছেন।
ঢাকা শহরে আবহাওয়া তীব্র রুক্ষ। আষাঢ় মাস। তবুও বৃষ্টির কোন দেখা নেই। ওপরে আকাশ মুখ গোমরা করে আছে। প্রচন্ড ভ্যাপসা গরম। অথচ গ্রামে তীব্র রুক্ষরূপ সহসা চোখে পড়ে না। আববু-আম্মুর সাথে গ্রামের বাড়ি যাচ্ছি। রাতের ট্রেনে চড়ে সকালে নামলাম। আকাশে মেঘের ঘনঘটা। সূর্য মেঘের আড়ালে ঢেকে আছে। দু'এক ফোঁটা বৃষ্টিও পড়ছে। দাদুর বাড়ি পৌঁছতে না পৌঁছতে শুরু হলো কি ঝমঝম বৃষ্টি। ওহঃ কী আনন্দ। বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে মজা করে গোসল করছি। আম্মু দেখে বললেন, ‘তোমাকে না বৃষ্টিতে ভিজতে নিষেধ করেছি?' আম্মুর কথা শুনে দাদু তৎক্ষণাৎ বললেন, আরে বাবা বৃষ্টিতে ভিজেছে, তাতে কি হয়েছে? এদেরকে ফার্মের মুরগি বানিয়ে দিও না। ফার্মের মুরগি ঠান্ডা গরম কোনোটাই সহ্য করতে পারে না। তদ্রুপ এদের অবস্থা না হয়। প্রকৃতি তো মানুষের জীবনের একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং পরম বন্ধু, প্রকৃতির সাথে মানুষের নিবিড় সম্পর্ক থাকা প্রয়োজন। তা না হলে প্রকৃতি বিরূপ মনোভাব দেখাবে, পরস্পরের মাঝে বিরোধ সৃষ্টি হবে। নিসর্গের ছোঁয়া পাবার জন্য তো কষ্ট করে তোমাদের গ্রামে আসা, কী বলো?' আম্মু আর কিছু না বলে থেমে গেলেন।
আমরা গ্রামের মানুষ। প্রকৃতির সাথে মিলেমিশে আছি। রোদ-বৃষ্টিতে কিছু হয় না। দাদুকে দেখলে আম্মু আববু আর কিছু বলতেন না। এরপর থেকে বৃষ্টিতে গোসল করেছি। অদূর তালপুকুর। কখনো কাগজের, কখনো কলার মোচার খোল কখনো বা কেয়াপাতার নৌকা ফুল দিয়ে সাজিয়ে তালপুকুরে ভাসাই। চুপচুপ ডুব দেয়া। পানিকৌড়ের ঢেউয়ে ঢেউয়ে সাজানো নৌকা ভেসে যায় দূরে। তালপুকুর থেকে শাপলা তুলে এনে মালা গাঁথি। ভরদুপুরে আম-কাঁঠালের স্নিগ্ধ ছায়ায় বসে দাদুর কাছে তন্ময় হয়ে গল্প শুনি। ঠাকুর মার ঝুলি ও আরব্য রজনীর উপন্যাসের কতো রকমের গল্প। একদিন দাদুর কাছে ভূতের গল্প শুনতে চাইলাম। দাদু বললেন, ভূত বলতে কিছু নাই। এসব মানুষের মনের ভ্রম (মনের বাধা) তবুও মানুষ ভূতের অহেতুক গল্প বলে আর তোমাদের মতো কোমলমতি ছেলেমেয়েরা মনোযোগ দিয়ে শুনে থাকে। তোমাদের ভূতের নয় একটি বাস্তব গল্প শুনাবো।
অনেকদিন আগের কথা। এখানে ওখানে ঝোপজঙ্গলে ভরা। রাস্তা-ঘাট কম। পাকা রাস্তা এবং বৈদ্যুতিক আলো ছিল শহরে। আমাদের পাগলা নদী তোমরা দেখেছ। ওটা তখন এঁকেবেঁকে প্রবাহিত হতো। আষাঢ় মাস হলে পানিতে ভরে যেতো। প্রস্থে কম। তীব্র স্রোত। কখনো এপার কখনো ওপার ভেঙ্গে ফেলে। পরক্ষণে আবার শান্তি নীরব নিথর। চৈত্র বৈশাখ মাসে হাঁটু পানিতে পাড় ভাঙ্গে। হাঁটু পানিতে হেঁটে পার হলে আর সে পথ দিয়ে ফেরা যায় না, গভীর পানি হয়েছে। বাঁশের সাঁকো কোনদিন দেয়া যায়নি। এ কারণে এ নদীর নাম পাগলা নদী। পাগলা নদীর এপার ওপারে তিন/চার মাইল জুড়ে ফাঁকা। মাঠ আর মাঠ। রাতের বেলায় সেখানে ভূতুরে কান্ড ঘটে। এসব ঘটতো নদী ভরা কিংবা হাঁটুপানি থাকা দু'অবস্থায়। গ্রাম থেকে শহরে বা শহর থেকে গ্রামে গেলে নদী পার হতে হতো। কেউ ফাঁকা মাঠে এলেই ভয়ঙ্কর দৃশ্যের মুখোমুখি হতে হতো। দু'একজন হলে এটা হতো। তবে লোকজন বেশিহলে তা হতো না। যারা দেখেছে সবার বর্ণনা ছিল ভিন্ন ভিন্ন। কেউ কেউ দেখেছে কঞ্চি পাতাসহ বিরাটকায় বাঁশ খাঁড়াভাবে পথে চলেছে। কেউ কেউ দেখেছে সাদা পোশাক পরিহিত এবং কালো হাড়ি দিয়ে মাথাটা ঢাকা। আবার কেউ কেউ দেখেছে মেঠো পথের আড়াআড়িভাবে চল্লিশ পঞ্চাশ হাত লম্বা সাদা ধপধপে কাপড় পথে বিছানো, কী যেন তার ভেতরে নড়াচড়া করছে। একেক সময় একেক আদলে (ভাবমূর্তি) ভীতিকর দৃশ্য। যারা এসব জানত, পারতপক্ষে তারা রাতে একা এ পথে আসত না। নির্ঘাত বিপদ ঘটবে ভেবে। পথটি ছিল সবার কাছে শ্বাপদসংকুল পথের চেয়েও ভয়ঙ্কর। কেউ টের পায়নি, প্রকৃত রহস্যটা কি? কিংবা কেনই বা ঘটছে। আত্মবিস্মৃত হয়ে সবাই বলতো এসব ভূতরে ব্যাপার, অর্থাৎ ভূতরে কান্ড।
আমাদের গ্রামের তৈয়ব আলী। চাকরি সূত্রে তাকে থাকতে হতো দূরে। সময় সুযোগ পেলে বাড়ি আসত। ফাঁকা মাঠ দিয়ে ছিল পথ। ভূতুরে ব্যাপারটা জানত বলে সে সচরাচর রাতে এ পথ দিয়ে চলাচল করত না। চৈত্র-বৈশাখ মাসে নদীতে হাঁটুপানি। পায়ে হেঁটে লোকজনের চলাচল। এমন সময় একবার কয়েকজন লোকের সাথে তৈয়ব আলী আসছিল। নদী পার হবার পর ওরা অন্য পথ ধরে চলে গেল। তৈয়ব আলী অনন্যোপায় হয়ে হাঁটতে লাগল। চারদিক ঘোর অন্ধকার। হঠাৎ অনাকাঙ্ক্ষিত ভয়ানক দৃশ্য চোখের সামনে। গরুর মাথার কংকাল সদৃশ মুখোশ, দেহ সাদা ধপধপে কাপড়ে মোড়ানো। ডানে বামে এবং সামনে থেকে আসছে। কিন্তু দূরে থাকা অবস্থায় কানে মানুষের কণ্ঠের স্বর ভেসে এলো। এতো মানুষের কণ্ঠস্বর। তৈয়ব আলী ছিল অত্যন্ত প্রতুৎপন্নমতি। সে মনে মনে বলল, ভীত হবার কোন কারণ নেই। অতঃপর একটা বুদ্ধি অাঁটলো। আতঙ্কিত হওয়ার ভান করে পথের পাশে শুয়ে পড়ল। গোঁ গোঁ শব্দ আরম্ভ করল। দাঁতে দাঁত ঠেকিয়ে কটমট করতে লাগল। ভূতরূপীরা কাছে এসে তৈয়ব আলীর এ অবস্থা দেখে গরুর মাথার কংকালের মুখোশ খুলে ফেলল। তৈয়ব আলীর পাশে পড়ে থাকা ব্যাগটা নিয়ে নিলো। অতঃপর ভূতরূপীরা তৈয়ব আলীর পকেট খুঁজে টাকা পয়সা এবং হাতের ঘড়িটাও খুলে নিল। এসব কান্ড দেখে তৈয়ব আলী মনে মনে বলল, ভুতেরা কখনো কোনো কিছু কিংবা টাকা পয়সা কেড়ে নেয় না। ভুতেরা ভয়-ভীতি দেখাবে, এটাই স্বাভাবিক। তৈয়ব আলীর বুঝতে আর বাকি রইল না। এরা প্রকৃত ভূত নয়, ভূতরূপী দুর্বৃত্ত। এভাবে দুর্বৃত্তরা ওৎ পেতে থেকে মানুষের সর্বস্ব লুটে নেয়। আসলে আগে কেউ জানাতো না, ঘাপটি মেরে বসে থাকা এটা দুর্বৃত্তদের কৌশল এবং জঘন্য কাজ। তৈয়ব আলীর মনে অনুসন্ধিৎসা (খুঁজে বের করার ইচ্ছা) জাগল।
দুর্বৃত্তরা চলে গেল। তৈয়ব আলী উঠে দাঁড়ালো। ওদের পিছনে পিছনে চুপে চুপে যেতে লাগল। দুর্বৃত্তরা যেন টের না পায়। পথে কেড়ে নেয়া টাকা পয়সা ভাগবাটোয়ারা করল। এসব তৈয়ব আলী দূর থেকে দেখল এবং কথোপকথন শুনলো। কোনটা কার বাড়ি তাও চিনে নিলো। আরব্য রজনী উপন্যাসের আলী বাবা ও চল্লিশ ডাকাত গল্পের আলী বাবার মতো দুর্বৃত্তদের সবকিছু তৈয়ব আলী জেনে ফেলল। দুর্বৃত্তরা এসব ক্ষুর্ণাক্ষরে টেরই পেল না।
তৈয়ব আলী কালবিলম্ব না করে থানাতে চলে গেল। পুরো ঘটনা সবিস্তারে দারোগা বাবুর কাছে খুলে বলল। দারোগা বাবু রাতেই দুর্বৃত্তদের বাড়ি ঘেরাও করে ধরে ফেলল এবং সব গোপন তথ্য বের করল। জানা গেল, রাতের অাঁধারে পথিকদের সর্বস্ব এরাই কেড়ে নেয়। ভয়বিস্ময়াদি দেখিয়ে কেড়ে নেয়া এদের ব্যবসা। এ গ্রামের কিছু লোকের এ ধরনের আচরণ। দুর্বৃত্তদের ধরে শাস্তি দেয়া হলো। আর তৈয়ব আলী সাহসিকতার জন্য পুরস্কার পেল। ফাঁকা মাঠে দুর্জনদের দুরাচার দূর হলো। লোমহর্ষক (রোমাঞ্চকর) ভয়ভীতি থেকে নিষ্কৃতি পেল। সবার মনে স্বস্তি ফিরে এলো। দাদুর গল্প শেষ। ঝমঝম বৃষ্টি নামলো। মেঘ বালিকার সাথে রোদের লুকোচুরি। রঙিন আলোর রেখা অর্থাৎ রংধনু এঁকে আকাশ দাদুকে ধন্যবাদ জানালো। তখনই বুঝে গেলাম, দাদুর গল্প শোনার জন্য আকাশও আমাদের সাথে যোগ দিয়েছিল। আবার ঝমঝম বৃষ্টি শুরু হলো। এমনিভাবে প্রকৃতি গ্রামের মানুষের কাছাকাছি। ছুটি শেষ, পরদিন ঢাকার পথে ফেরার অপেক্ষা।