somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কত এলোমেলো পথ হেটেছি দু'জন

১৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৩ দুপুর ২:৫৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



"কিরে তোকে খুব খুশী খুশী লাগতেছে ঘটনা কি ? আবার প্রেমে ট্রেমে পড়সস্ নাকি ? " জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রাজিব তার ছোটো বেলার বন্ধু মাহমুদের হাসোজ্জল মুখের দিকে। "ধূর ! হালা আর কথা পাস না, জীবনে একবারই প্রেম করছিলাম আর এমন ছ্যাকা খাইছি পুরাই ব্যাকা হইয়া আছি। No More Prem ." বলে হেসে উড়িয়ে দিল রাজিবের কৌতুহলি প্রশ্ন ।সেই ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের ক্লাস থ্রী থেকে দু'জনের পরিচয়। কত মান -আভিমান, ঝগড়া -খুঁনসুটি ,কত এলোমেলো পথ হেঁটেছে দু'জন ।এভাবেই রাজিব আর মাহমুদের বেড়ে উঠা , কেটে গেছে শৈশব, কৈশর এমনকি আজকের তারুন্য। একজনের সুখ -দুংখ, বেদনা-বিষন্নতা অন্যজনকে ছুঁয়ে যায় ।

রাজিব ছোট বেলা থেকেই মাতৃস্নেহ বঞ্চিত । বাবা- মার ডিভোর্সের কারনে রাজিবের দায়িত্ব পড়ে বাবার উপোড়। সরকারি কর্মকর্তার বদলির চাকুরির কারনে রাজিব কে সাথে রাখা বাবার পক্ষে সম্ভব ছিল না তাই নিতান্ত বাধ্য হওয়েই একমাত্র সন্তানকে ভর্তি করে দিলেন ঢাকার রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুলে ক্লাস থ্রীতে । মা ছেড়ে চলে গেছেন বাবাও হোস্টেলে রেখে নিজ শহর ময়মনসিংহ ফিরে গেছেন ছোট্ট রাজিবের তাই বুক ভরা অভিমান , ক্ষোভ, ক্রোধ সবার উপর । দুষ্টু রাজিবের একমাত্র বিনোদন ছিল ক্লাসের ছেলেদের উত্যাক্ত করা ।

মাহমুদ গ্রামের মেধাবী ছেলে, পিতৃহীন শান্ত মুখচোরা স্বভাবের মাহমুদ চার বোনের একটি মাত্র ভাই। শত অভাব অনটনের মাঝেও গ্রামের স্কুলের শিক্ষিকা মা ছেলে মেয়েদের মাঝে নৈতিকতা,সততা, আত্মমর্যাদার বীজ বপন করে দিয়েছিলেন । মুলত হেডস্যারের পরামর্শেই মাহমুদের মা ছেলে পর্যাপ্ত সুজোগ সুবিধা বেশি পাবে এই আশা নিয়ে রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুলে ভর্তি করান ।সেই একই বয়সি মাহমুদকে রুমমেট হিসেবে পেয়ে রাজিব খুবই খুশি ।হবেই না বা কেন , এখানে কে ওকে ভাই এর মত আগলে রাখবে ?
তারপর স্কুল কলেজের গন্ডি পেড়িয়ে রাজিব ঢাকা ইউনিভার্সিটির IBA থেকে MBA শেষ করে সনামধন্য টেলিকম কোম্পানিতে ঢুকলো মার্কেটিং এক্সিকিউটিভ হিসেবে আর মাহমুদ একই ইউনিভার্সিটির Computer Science থেকে পাশ করে ক'জন মিলে নিজেদের ছোট্ট একটা ফার্ম খুলেছে ।
মাহমুদের business করবার মত টাকা ছিল না, প্রায় ৭ লক্ষ টাকা রাজিব তাকে দিয়েছে তাও তার বাবার রেখে যাওয়া FDR ভাঙ্গিয়ে আজো মনে আছে সেদিনের কথা । দু'জনে মিলে আড্ডা দিচ্ছিল TSC র মাঠে । মাহমুদের শুকনো মুখ দেখে রাজিব বার বার কারন জিঙ্গেস করছিল কিন্তু কোন সদুত্তর পাওয়া যায়নি । রাজিব ভাবল হয়তো নতুন নতুন মেসের জীবনে অভ্যস্হ হতে পারছেনা ।শেষে রাজিবের চাপাচাপিতে মাহমুদ বলতে বাধ্য হয় ৩জন মিলে যে ফার্ম খুলবার কথা ছিল তা আর হচ্ছে না টাকার অভাবে, অথচ পুরো business plan টা মাহমুদ করেছে । মাহমুদের পক্ষে ১ লক্ষ টাকাই যেখানে যোগার করা সম্ভব না সেখানে ৭ লক্ষ টাকা তো কল্পনাই করা যায় না। দেশে যে টুকটাক জমিজিরাত ছিল বড় দুই বোনের বিয়েতে শেষ , মায়ের পেনশনের গুটি কয়েক টাকা দিয়ে ছোট বোনকে নিয়ে মা চলেন আর মাহমুদ তো সারাটা জীবন চালিয়ে দিল টিউশন আর স্কলারশিপের টাকা দিয়ে। শুনে রাজিবের কি হাসি .........."দোস্ত এত চিন্তা করস কেন ? এক সপ্তাহের মধ্যে তোর টাকা যোগার কইরা দিমু নে, জানসই তো বাপ মরনের সময় ময়মনসিংহ শহরের একতলা বাড়ী আর কিছু টাকা রাইখা গেছিল এখন ঐ টাকা তোরে ধার দিমু পারলে এক বছরের মধ্যে শোধ কইরা দিস ।" মাহমুদ কিছু বলতে পারল না বন্ধুর হাত দুটি কেবল ধরে থাকল, দুফোটা উষ্ণ চোখের জল বলে দিল হৃদয়ের আকুতি । সৃস্টিকর্তা তাকে আর কিছু দিক না আর না দিক মেধা আর কঠিন পরিশ্রম করবার ক্ষমতা দিয়েছে। দিন যায় এদিকে রাজিবের ব্যস্ততা ব্রান্ড মার্কেটিং নিয়ে বাড়ে মাহমুদেরও একই অবস্হা । দিন রাত ছুটতে হয় খুলনা, রাজশাহি, চট্টগ্রাম, নারায়নগঞ্জ এমনি আরো কত জায়গায় ।
ওদের যোগাযোগ কমে আসে, আগের মত দুই বন্ধুর দেখা হয় না প্রতিদিন, তবে সুজোগ পেলেই ছুটির দিনে আড্ডা দেয় । ক'দিন আগে মালিবাগের অফিস ছেড়ে মহাখালি অফিস নিয়েছে ওরা , নতুন অফিসে রাজিব কে চা খেতে ডাকে মাহমুদ , বন্ধুর উন্নতিতে অনেক খুশি রাজিব জমিয়ে আডডা দিয়ে যায়। যাবার সময় হাতে একটা খাম ধরিয়ে দেয় তাতে ৩ লক্ষ টাকার চেক আর মাহমুদ বলে ৭ মাসে এর বেশী দিতে পারিনি তোকে কিন্ত্ত কথা দিচ্ছি খুব তাড়াতাড়ি বাকিটাও দিয়ে দিতে পারবো। চিটাগং শিপইয়ার্ডে online ordering system একটা বড় কাজ পেয়েছে মাহমুদ রা । ওটার বিল পেলেই বাকিটাকাটা পরিশোধ করবে সে-----------অবশেষে ঋণমুক্ত । আহ্ ভাবতেই কেমন লাগছে মাহমুদের ।পরশুদিন মিটিং এ ছিল রাজিব তাই মাহমুদের ফোনটা রিসিভ করতে পারেনি, পরে আর মনে ছিল না । আবার রাতে ঘুমাতে যাবার আগে ফোনটা সাইলেন্ট করতে গিয়ে মনে পড়ল।ফোন দিতেই মাহমুদের হাসি খুশী গলা । বসে আছে সৌদিয়া পরিবহনের বাসে , রাতের বাসে চট্টগ্রাম যাচ্ছে বিল আনতে কালকেই আবার ফিরে আসবে ঢাকায় ।

রাজিব বকা দিল এই টাকা টাকা করবার জন্য, এইসব কথা ভাল লাগে না আর শুনতে । ধমক খেয়ে চুপ মেরে গেল মাহমুদ কিছুক্ষন যাপিত জীবনের গল্প বলে দু'জন, রাত আনুমানিক ১ টার দিকে ফোন রেখে ঘুমাতে যায় রাজিব।
ভোর ৪:১৫ কুমিল্লা চৌদ্দগ্রাম থানা থেকে ফোন এসেছে। ঘুম জরানো চোখে রাজিব ফোনে ধরে ওপাশ থেকে পুলিশ কন্সটেবল বলে যাচ্ছেন।'লাসট কল টা আপনার ছিল বলে আপনাকে বিরক্ত করছি আপনি কি মাহমুদুর রহমানের কিছু হন ? রাজিব হমম্ ছাড়া আর কিছু বলতে পারল না। লোকটি বলে চলল দয়া করে এখুনি আসতে পারবেন চৌদ্দগ্রাম
থানায় , বাস এক্সিডেন্টে ৪ জন স্পট ডেড আর ৯ জন আহত । আহত দের স্হানীয় হাসপাতালে নেয়া হয়েছে । আর মৃতদেহ সনাক্ত করবার জন্য আপনাকে দরকার । এটুকু শুনেই হাতের ফোনেটা মাটিতে পরে গেল
লোকটি আর কি কি যেন বলছিল রাজিবের কানে যাচ্ছিল না। ঝটপট উঠে কাপড় পরে নিবে এটাও ওর দ্বারা হচ্ছে না । টিশার্ট একটা কোনোমতে গায়ে চাপিয়ে হাফপ্যান্ট ,স্পঞ্জের চপ্পল পড়ে রাস্তায় নামল রাজিব । এত ভোরে রাস্তায় মর্নিং ওয়াকের লোকজন ছাড়া কেউ নেই। যানবাহন আসবে কোথা থেকে ? চট করে মনে পড়ল অফিসের গাড়িটা কাছেই আছে গ্যারাজে, ড্রাইভার কে ডেকে তুলে সেটা নিয়েই রওনা হল রাজিব ।
তার প্রানের বন্ধুকে তুলে আনতে। " বন্ধু তুই কেমন আছিস বল ? খুব কষ্ট হচ্ছে ? দোস্ত তোকে ছাড়া গত ২০ টা বছর আমি আমার জীবন কাটায়নি ,সেই ছোট্ট বেলার সাথী আমার কি করে পারলি আমায় এমন একা করে চলে যেতে ? যেই কাধে হাত রেখে আমারা দুজনে হাসতে হাসতে হোস্টেলের রুমে ফিরে আসতাম সেই কাধে তোর লাশ বহন করতে হবে আমাকে এখন ।" রাজিবের চোখ ভিজে যায় ডুকরে কেঁদে উঠে সে। সৃষিটকর্তা তার একমাত্র সুখ-দুংখের সাথী কে তুলে নিয়ে গেলেন তারই পাওনা টাকা ফিরত দিবার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল তার বন্ধু । নিজেকে কি বলে সান্তনা দিবে সে ? মাহমুদের মৃত্যুর দায়ভার কি তার উপড়ো বর্তায় না ? সে কি বলতে পারত না এত তাড়াহুড়ার কিছু নেই , আরো একটু সময় নে............ঈশ্বর তুমি এ আমাকে কি নড়ক যন্ত্রনায় ফেলে দিলে !

এক হারিয়ে যাওয়া বন্ধু
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৩ বিকাল ৩:২৫
১৬টি মন্তব্য ১৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাওরের রাস্তার সেই আলপনা ক্ষতিকর

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৫৯

বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন উপলক্ষে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম আলপনা আঁকা হয়েছে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম হাওরের ‘অলওয়েদার’ রাস্তায়। মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই আলপনার রং পানিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×