১.
বাসে বসে অরুদ্র ভাবছিল, এত দুরের পথ কি করে পাড়ি দেবে । সময় কাটানোর জন্যে,সাথে একটি পুরোন ডায়রি আছে, যার কিছু পৃষ্টা নেই। এই ডায়রিটা অবশ্য বেশ কয়েক বার তার পড়া হয়ে গেছে, তবুও কেন যেন অরুদ্র’র এই একই ডায়রি পড়তে বেশ ভাল লাগে, অরুদ্র কি মনে করে ডায়রিটা বের করে পড়া শুরু করবে, এমন সময়, একটি এসএমএস এলো, মুঠো ফোন বের করে যা পেল, তার ভাষা ছিল কিছুটা এরকম_
‘Jury was good; I was expecting you there, clapping for me….. This could have been never possible without your help. Hope to see you very soon’
অরুদ্র’র ঠোঁটে কোনে একটু হাসি দেখা গেল, নিজের অজান্তেই বলে ফেললো,
‘হয়তো...’ । অরুদ্র ফোন সুইচ অফ করে দিল । বাস চলতে শুরু করেছে, বাইরে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছে, সাথে মেঘ এর গর্জন। ডায়রিটা হাতে নিয়ে, প্রথম পাতা উলটোতেই তার গায়ে শিহরন দিয়ে ঊঠল, লেখাগুলো পাঁচ বছর আগের, অথচ দেখলেই মনে হয় এই মাত্র বুঝি কেউ লেখা শেষ করলো। অরুদ্র খুব আগ্রহের সাথে পড়তে লাগলো ...
জুলাই ১৯,২০০৯ রবিবার
ইউনিভারসিটি তে আজ প্রথম ক্লাস ছিল । জীবনের নতুন একটি অধ্যায় শুরু করতে যাচ্ছি, তা আগে থেকেই জানতাম, কিন্তু এখানে এসে প্রথম দিনেই এমন একটি অভিজ্ঞতা হবে, তা ভাবিনি। আমার খুব লজ্জা করছে । প্রিয় ডায়রি, কথা গুলো শুধু তোমায় বলছি, খুব যত্নে রেখো, কেউ যেন জানতে না পারে । জানলে আমি কিন্তু মরে যাবো, এ আমি কথা দিলাম তোমাকে । এবার শুনো আজ কে যা হলো _ তুমি তো জানোই আমি বাংলাদেশ এর একটি অতি পরিচিত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার সুযোগ পেয়েছি, তাও একদম প্রথম যে অনুষদ – ‘স্থাপত্য’ সেখানে । বাবা’র ইচ্ছায় এলাম, আমারও যে আগ্রহ নেই, তা কিন্তু একেবারেই নয়। থাক সে সব কথা ...আসল কথায় আসি। আজ প্রথম বার এর মত যখন পা রাখলাম বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে, ওমনি কাঠগোলাপ গাছ এর নিচ থেকে একজন আমাকে হাত নেড়ে ডাকতে লাগলেন, কি যে সম্বোধন করে আমায় ডাকলেন, সেটা আমি বলতে পারবো না, আমার খুব লজ্জা করছে লিখতে। আমি একটু ইতস্তত বোধ করতে লাগলাম এবং এগিয়ে গেলাম ওদিকে । চারজন ছেলে আর একজন মেয়ে বসে ছিলেন সেখানে, সবাই কেমন রুক্ষ দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে, আমার ভয় হতে লাগলো, ওদের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই, আচমকা একজন প্রশ্ন করে বসলেন,
-কোন ব্যাচ ?
-জী ...ফার্স্ট ইয়ার, ফার্স্ট সেমিস্টার
-হাতে কি?
-জী, ... এটা আমার ইয়ে ... মানে ...
সবাই এক সাথে হাসি শুরু করলো, যেন আমি নিতান্তই কোন হাসির কথা বলে ফেলেছি। আমার ভয় এর সাথে ধীরে ধীরে রাগ জমতে শুরু করলো । তারা ঠিক আমার মত করে কথা বলতে লাগলো। “ ইয়ে...মানে ......জী ... ‘,বলা মাত্রই আবার হাসির রোল পড়ে গেল। একজন রুগ্ন মত ছেলে, আমার হাত থেকে তোমাকে নিয়ে নিলেন, আমি বুঝতে পারছিলাম না, কি করা উচিত ...। সে তোমাকে খুলে পড়তে শুরু করবে, এর মাঝে অন্য একজন বলে ঊঠলেন, “ডীন আসছে, ছেড়ে দে ওকে “ আর সাথে সাথে তারা চলে গেল, সেখান থেকে। আমি হাফ ছেড়ে বাঁচলাম । খুজে খুজে আমার স্টুডিও তে গিয়ে বসলাম, যেখানে আমার সমবয়সী কয়েকজন কে পেলাম, বেশ কয়েকজন এর সাথে পরিচয় হল, যেমন, সুহারতো, নন্দিতা, মিলি, আশফাক, রিক্ত, তিন্তি । ওদের সাথে কথা বলার এক পর্যায় রিক্ত’র কাছ থেকে জানলাম, সকালে যারা আমাকে ডাকছিল আর যাদের হাসি, আমার কাছে খুব অপমান জনক লাগছিল, তারা আসলে এই অনুষদ এর ছাত্র। আমাদের সিনিওর; যাদের একটি বিশেষ প্রক্রিয়া আছে নতুন ছাত্র দের সাথে পরিচিত হবার, যাকে বলে র্যাগিং,তারা যা বলবে ঠিক উত্তর দিতে পারলে পাস, আর না পারলে ব্যপক লাঞ্চনা সহ্য করতে হবে । রিক্ত’র কথা শুনে আমার ভয় তখন আতঙ্কে পরিণত । প্রথম দিন এর ক্লাস শেষে যখন বের হলাম, তারা আমাকে আবারো ডেকে পাঠালেন, ঠিক একি ঊপায়ে । আমি আবারো ইতস্তত বোধ করতে লাগলাম , কিন্তু তবুও তাদের সামনে গিয়ে দাড়ালাম, এবার আমার সাথে আমার আরো ৩ জন ব্যাচমেট রইলো _ তিন্তি,মাইশা,সুহারতো আর আমি ।
আমরা সিনিওর ভাইয়া আর আপুদের সামনে এসে দাড়াতেই, একজন আপু আমাকে জিজ্ঞেস করলেন-
-নাম?
-জি...নুসাইবা ।
-জি, নুসাইবা? ??? হা হা হা ... । এই সবাই ওকে ‘জি’ বলেই ডাকবি, কেমন?
-জি ...মানে... আ...
-কি? ‘জি’ এর পরে আবার ‘মানে’ আছে নাকি? গান শুনাও দেখি একটা ...
-জি,...আমি তো গান গাইতে পারি না ।
-ছি ! ছি ! গান গাইতে পারো না, আর আর্কিটেকচার এ পড়তে এসেছো ?
-জি,... ইয়ে মানে,... মানে ...
-আরে, জি এর বাচ্চা! চুপ কর! একটা কাজ করতে পারবি?
-জি ...কি কাজ ?
-ঐ যে সামনে,ঐ কলাম এর পাশে যে ছেলেটি বসে আছে, তাকে গিয়ে বলতে হবে,
‘আমি তোমাকে ভালবাসি” ... পারবি?
- জি???!! আমি তো ...
- জি বলছেরে ... ( আবারো হাসি’র শব্দে চারিদিক কেপে ঊঠলো )
- না,আপু... আমি আসলে ... বলছিলাম যে ...
- কি? এত বড় বেয়াদবী? আমাকে না বলছিস তুই? এই শিক্ষা পেয়েছিস? বেয়াদবি করার শিক্ষা !?
- আপু, আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন। আমি আসলে ...
- কিসের ভুল বুঝাবুঝি ? যা বললাম, তা কর। না হলে আজ আর বাড়ি ফিরা লাগবে না। ঠিকাছে?
আমি বুঝলাম, কি বিপদেই না আমি পরেছি, চিনি না জানি না, একজন কে হুট করে বলে বসবো, আমি তাকে ভালবাসি? এ আবার কেমন কথা ? এদিকে, বাসায় ফিরতে দেরি হয়ে যাচ্ছে । বুঝতে পারছিলাম না, কি করে নিজেকে এই বিপদ থেকে রেহাই দিব।
আমি বার বার ছেলেটির দিকে তাকাচ্ছি, কি যেন একটা লিখছে সে, হাতে পেন্সিল, চুল গুলো উশকো খুশকো, দুনিয়ার কোন কিছু তেই যেন তার কিছু আসে যায় না। আমি এক পা আগাতেই, আবার দুই পা পেছনে সরে আসলাম, আর ওমনি সেই আপু আমাকে আরো উচ্চস্বরে একটা ধমক দিয়ে বসলেন।
কোন উপায় না পেয়ে, আমি সেই ছেলেটির সামনে গিয়ে দাড়ালাম, দেখলাম সে আসলে, কিছু একটা আকছে। আরেক হাতে সিগারেট । একবার ঘড়ির দিকে তাকালাম, হঠাৎ করে বাসায় যাবার দেরি হচ্ছে, এই ভেবে, ঝামেলা দ্রুত শেষ হবে, ভাবলাম না-ছেলেটি কি ভাববে ... আমি বলেই ফেললাম,
“ আমি তোমাকে ভালবাসি “, উত্তরে ছেলেটি বলল... ‘তো, আমার তাতে কি?’ ছেলেটি বিরক্ত হয়ে সেখান থেকে ঊঠে চলে গেল।
আমি দাঁড়িয়ে রইলাম আর আমার চোখ থেকে পানি পরতে লাগলো । আমি স্পষ্ট শুনছিলাম অপাশ থেকে ওরা সবাই হাসছিল আমাকে নিয়ে, আমার চোখ থেকে যেন পানি পরা থামতেই চাইছে না, মনে হচ্ছিল, মাটি ভেদ করে আমি নিচে চলে যাই । ঠিক এমন সময়, সেই সিনিওর আপুটি হাসতে হাসতে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন, চোখ মুছে দিয়ে বললেন, ‘ থাক, আর কাঁদতে হবে না । তুমি পরীহ্মায় পাশ... আমরা তোমার সাথে মজা করছিলাম। কিছু মনে করো না’ । তথহ্মনে আমার চোখের পানি, বন্যার জলে পরিণত । কিছুতেই যেন থামতে চাইছে না, আপু আমার চোখ মুছে দিলেন। এবং খুব নরম স্বরে আমার সাথে কথা বলা শুরু করলেন।
-আমার নাম অধরা । এবার থিসিস করছি। তুমি কিছু মনে করো না, আমরা তোমাকে বরণ করে নিচ্ছিলাম, বলতে পারো এটা এক ধরনের technique, junior দের সাথে খুব দ্রুত পরিচিত হওয়ার। আবার এক ধরনের তিক্ত অভিজ্ঞতাও বলতে পারো,যেটা তোমার মনে দাগ কাটবে আর অনেক বছর পর যখন তুমি নিজের অজান্তে ভাববে,... একা একাই হেসে ঊঠবে। এসো তোমাকে বাকি দের সাথে পরিচয় করিয়ে দেই ......
অধরা আপু কে শুরুতে যতটা ভয় লাগছিইল, এখন আর তা লাগছে না। মনের ভেতর কেমন যেন একটা আস্থা’র জায়গা তৈরি হতে লাগলো আপু’র জন্য । আপু আমাকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন, কিন্তু আমি ওই ছেলেটিকে খুজছিলাম,... অদ্ভুত একটা অনুভুতি হচ্ছিল আমার ভেতরে । সম্পূর্ণ ঘটনা আবার মনে করতেই আমি নিজের অজান্তেই হাস্তে শুরু করলাম ।
প্রিয় ডায়রি, আজকের দিনটা আমার জন্যে খুব স্মরণীয় হয়ে থাকবে, যা আমি শুধুমাত্র তোমার সাথে share করলাম।
আচ্ছা, আমি ওই ছেলেটি কে কেন খুজছিলাম বলতো?
- নুসাইবা
অরুদ্র, ডায়রীটা বন্ধ করে দিল। মাথাটা খুব ব্যথা করছে তার। এক কাপ চা খেতে পারলে, মন্দ হত না । এখনো দেড় ঘণ্টা লাগবে ফেরি টার্মিনালে পৌঁছাতে ; তার আগে কোথাও চা পাওয়া যাবে না । চোখ জোড়া বন্ধ করে রাখলে, মন্দ হবে না ।
২.
জুরি শেষ হওয়া মাত্র, নুসাইবা অরুদ্র’র ফোনে চেষ্টা করতে লাগলো, কিন্ত বার বার বন্ধ আসছে । এরকম তো হবার কথা ছিল না, অরুদ্র তো এততা দায়িত্বজ্ঞান নয়, তবে কি অরুদ্র ভুলে গেল নুসাইবা’র দেয়া কথা ? এক দৌড়ে পাচতলার জুরি রুম থেকে নিচে নেমে এল, নিচে এসে রফিক ভাই কে দেখে একটু আশ্বস্ত হল, এই ভেবে যে, এবার জানা যাবে অরুদ্র কোথায় ,...
-রফিক ভাই !
-কিরে নুসা? তোর জুরি শুনলাম বেশ ভাল হয়েছে? বলেছিলাম তো যে ভালই হবে ? এবার যা, বাসায় গিয়ে তৈরি হয়ে নে, আজকে না তোদের ফ্লাইট?
-তা না হয় গেলাম,ভাইয়া । অরুদ্র কোথায়? ওর সব কিছু গোছানো হয়ে গেছে তো ? এখনও ফেরেনি বুঝি ? দেখো না, সেই কখন থেকে ফোনে চেষ্টা করে যাচ্ছি, কিন্তু বার বার বন্ধ পাচ্ছি । বাসায় গিয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়লো নাকি ?
- সে কি ? এখনও এসে পৌছায় নি? তাহলে, বোধ হয় আবার এক ম্যারাথন ঘুম দিয়েছে । নুসা, তুই মানুষও খুজে বের করেছিস একজন ।
নুসা আর রফিক একসাথে হেসে ঊঠলো, কিন্তু হাসির মাঝেও নুসা’র মনের ভেতর টা কেমন এক অজানা আতংকে
আতকে উঠলো ।
রফিক বাসার দিকে রওনা দিল, অরুদ্র’র খোজে। রফিক নিজের মনে ভাবতে লাগলো, অরুদ্র আর নুসাইবা’র কথা । দুজনে যে অসম্বভ প্রতিভাবান তাতে কারো কোন প্রকার সন্দেহ নেই, তাই এত বড় একটা সুযোগ পেল । আমেরিকা’র বেশ নামকরা একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্কলারশিপ পেয়েছে । দুজনের পরিবারই,ওদের সম্পকের ব্যাপারটা বেশ ভাল করেই জানে, তবে নুসাইবা’র পরিবার অরুদ্র কে স্বামী হিসেবে পছন্দ করে না। ছেলেটা অনেক একরোখা, কিছুটা উদাসিনও বটে । সমাজের কোন কিছুর প্রতি তার কোন আগ্রহ নেই, নিজেই নিজের সমাজ সে ।
নুসাইবা’র বাবা বলেন, “ যে ছেলের নুন্যতম সমাজবোধ নেই, সে আমার মেয়ের সাথে ঘর বাধার স্বপ্ন কি করে দেখে ? ওর মত একটা ছেলে’র সাথে তোমার সম্পর্ক হলে, সমাজে মুখ দেখাবো কি করে? ” উত্তরে নুসাইবা যা বলেছিল, বাবা হিসেবে কারোই সেটা মেনে নেয়ার কথা না । নুসা’র কথা গুলো ছিল এরকম-
“বাবা, অরুদ্র আমার সাথে ঘর বাধার স্বপ্ন কোথায় দেখলো ? আমরা সারা সময় একসাথেই থাকি, আমার চাওয়া-পাওয়া, সুখ-বেদনা, অরুদ্র যতটা বুঝে, বাবা হিসেবে তোমার আরো বেশি বোঝা জরুরী ছিল। আর সমাজবোধ? সেটা আবার কি? সমাজবোধ বলতে কি তোমার “সমাজ” নামক দামী পোষাক এর আড়ালে নোংরামি করে বেড়ানো ? তাই যদি হয়, তবে অরুদ্র ঢেড় ভাল । সাধারন এবং বাস্তববাদী ।“
-নুসা ...। তুমি বোধহয় একতূ বাড়াবাড়ি করে ফেলছো । এর পরিণতি ভাল হবে না ।
-আমার তোমাকে জানানো প্রয়োজন ছিল, তাই জানাচ্ছি, আগামি পড়শু আমাদের ফ্লাইট । আমারা এদেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছি । তোমার সমাজের কাছে মুখ দেখাতে তোমার আর অসুবিধা হবে না, খুব একটা ।
-I wish, you will not show me your face further . You may leave now.
সেদিন নুসা’র সাথে রফিকও সেখানে ছিল, তাই ঘটনাটা তার জানা। খুব কাদছিল নুসা। সেদিন এর পর নুসা’র সাথে তার বাবা’র আর কথা বা দেখা হয়নি । অরুদ্র সব কিছু জানার পর খুব হালকা ভাবে নেয়ার ভাব করলেও, রফিক জানে, ওর ভেতরের অবস্থা । সেই ছোটবেলা থেকে চেনে সে অরুদ্র কে । হয়তো এসব ভেবেই ঘরে চুপটি করে বসে আছে ।
“তুমি চিন্তা করো না নুসা, আমি ওকে দেখছি ও কোথায় আছে” -রফিক হাটতে লাগল;কিন্তু ঘরে পৌছে যদি অরুদ্র কে না পাওয়া যায়? তবে কি জবাব দেবে সে নুসা কে? রফিক ভাবতে থাকে ......
রফিক কে চলে যেতে দেখে, নুসাইবা অনুষদের ভেতরে আসে ।আজ তার জুরি ছিল, একজন স্থাপত্যে’র ছাত্র হিসেবে, সবার সুপ্ত বাসনা থাকে, থিসিস এর জুরি অনেক ভাল হবে, কাজের আলোচনা-সমালোচনা থাকবে ।
অনেক হাত তালি পড়বে। এসব কিছু ছিল নুসাইবা’র জুরি তে। তার থেকেও বড় ব্যাপার, আজকের দিনটা নুসাইবা’র জন্য বিশেষ ।আজ তার স্বপ্ন পূরণের দিন, সবথেকে বেশী যে মানুষটি কে সে ভালবাসে, তার হাত ধরে সে আজ নতুন একটি জীবন শুরু করতে যাচ্ছে । এর থেকে আনন্দের আর কি হতে পারে ... তাছাড়া, অরুদ্র কে আরেকটা খুশির সংবাদ দিতে হবে । নুসা’র বাবা ওদের সম্পর্ক মেনে নিয়েছেন, আজ রাতে উনি নিজের উদ্যগে দুজন কে airport নামিয়র দিয়ে আসবেন । ওদের দুজনকে এক সাথে শুভ কামনা জানাবেন । ভাবতেই নুসা’র শরীর জুড়ে আনন্দের স্রোত বয়ে গেল । নুসা আবার জুরী রুমে প্রবেশ করলো। দুপুরের খাবার বিরতি চলছে,
নুসা’র মনে হল, এ সময়টা কাজে লাগানো যাক। নুসা’র থিসিস প্রজেক্ট সফল করতে, যে কয়জন সিনিওর জুনিওর বন্ধুদের অবদান ছিল, তাদের সবাইকে নিয়ে কোথাও খেতে গেলে কেমন হয়? কে জানে, আবার কবে সে ফিরবে, আবার কবে এই পুরোন, চির চেনা পথে হাটবে, আবার কবে হাসবে- কাঁদবে ...এই একই মানুশ গুলোর সাথে ?
এই সুযোগে, কিছুটা সময় কাটানো যাবে তাদের সাথে, কিছু ভালো লাগা- ভালবাসার মুহূর্ত বন্দি করা যাবে নিজের মাঝে।
যেমনি ভাবা, তেমনি কাজ ... সবাই কে জোগার করে ফেললো, নুসা। সবাই মিলে, পুরোন ঢাকাতে এসে পৌছলো তারা । মোটামুটি সবাই আছে এখানে, নেই শুধু রফিক ভাই আর অরুদ্র । নুসা ভাবলো, যাক ওদের জন্যে special treat হবে, কারণ ওরা দুজনেই খুব special. ভাবতে ভাবতে মুচকি হেসে দিল নুসা ... এমন সময় থার্ড ইয়ার এর শুভ্র বলে উঠলো _
দেখ ! দেখ ! নুসা আপু’র হাসি যেন আর থামতেই চাইছে না ।
হিমেল ঃ তা আর থামবে কেন, একঈ দিনে কত কিছু পেলো আজ নিসা আপু, দেখতে হবে না?
টিয়োসা ঃ তোদের যে কথা, আমার তো মনে হয় নুসা আপু, আরুদ্র ভাইয়ের কথা ভেবে মুচকি মুচকি হাসছে, তাই না আপু ?
নুসাইবা ঃ মারবো এক থাপ্পড় । খুব পাকা পাকা কথা সবার না রে?
হিমেল ঃ আচ্ছা আপু, তোমরা যে আজ চলে যাচ্ছ, আমাদের কথা তোমাদের মনে পড়বে তো ? যোগাযোগ রাখবে তো ?
নুসাইবা ঃ এত প্রশ্ন একসাথে ? হা... হা । কেন মনে থাকবে না তোদের কথা? আজকে এতদূর যে এলাম, তোদের সাহায্য ছাড়া কোনদিন সম্ভব হত? অনেক করেছিস আমার জন্যে, ...অরুদ্র’র জন্যে । এসব কথা থাক, চল আমরা খাবার খেয়ে নেই, ফিরতে হবে তো আবার ।
নুসাইবা খেয়াল করলো, কি প্রাঞ্জল ওর এই বন্ধু গুলো, বেশি দিনের পরিচয় না এদের সাথে, অথচ এই অল্প কয়েকদিনে, সবাই সবার কত কাছের মানুশে পরিণত হয়েছে । সবাই সবাইকে কত কাছ থেকে জানে, চেনে, ...
এই মানুশ গুলোকে ছাড়া দিন কাটানো খুব কঠিন হয়ে যাবে । নুসা’র চোখ ছল ছল করতে লাগলো । রফিক ভাই এখনো ফোন করলেন না , অরুদ্র’র কি হল ? এত সময় পার হয়ে গেল, কিন্তু একবারো নুসা কে ফোন করলো না।
৩.
ঘড়িতে সময় তখন ৭টা । অরুদ্র তখন ঢাকা ছাড়িয়ে মাওয়া ফেরী টার্মিনাল । অরুদ্র কি মনে করে, ফোন টা সুইচ অন করলো আর সাথে সাথে স্ক্রিনে নুসাইবা আর অরুদ্র’র হাস্যজ্জল ছবি দেখতে পেল । অরুদ্র’র চোখে শুধু নুসাইবা’র প্রাণশক্তিতে ভরপুর হাসি টা চোখে পড়লো । সাথে সাথে অরুদ্র’র মনে হল, কিছুতেই সম্ভব হবে না এটা, নুসাইবা কে ছেড়ে সে কি করে থাকবে । অরুদ্র আবার ঘড়ীতে দেখলো, ফ্লাইটের এখনো ৬ ঘণ্টার মত বাকি আছে । এখনই তার মানে তাকে নামতে হবে বাস থেকে । নুসাইবা কে সে হারাতে পারে না, কিছুতেই না । যেমন টা ভাবা, তেমনি সে বাস থেকে নেমে গেল । অরুদ্র ঢাকা’র পথে হাটা শুরু করলো, এখান থেকে কোন গাড়ি পাওয়া মুশকিল হয়ে যাবে ; তাই বলে থেমে থাকলে তো আর নুসাইবা কে পাওয়া যাবে না । যা করার খুব জলদি করতে হবে । আচ্ছা, নুসাইবা যখন প্রশ্ন করবে, অরুদ্র কোথায় ছিল, কেন আসেনি তার জুরিতে, ফোনটাই বা সুইচ অফ কেন ছিল ; কি উত্তর দিবে অরুদ্র ....?
ভাবতে ভাবতে তার হাটার গতি বেড়ে গেল । দূরে একটা গাড়ি দেখা যাচ্ছে, এদিকেই আসছে , হয়তো সাহায্য চাওয়া যেতে পারে ।
রাত ৮ঃ০০ টা
নুসাইবা লালবাগ থানা থেকে বের হল । সাথে রফিক ভাই আর অধরা আপু আছে । অরুদ্র’র কোন খোজ না পেয়ে, পুলিশের সাহায্য নিতে এসেছিল, ওসি সাহেব বললেন, তারা ব্যপারটা দেখছেন , তার সাথে ওদের কে, বলে দিয়েছে, ঢাকার সব হাসপাতাল গুলোতে খোজ নিতে ।
রফিক ঃ নুসা, কি করবি এখন ?
নুসাইবা ঃ বুঝতে পারছি না ভাইয়া । কোথায় খুজবো এখন ওকে ?
অধরা ঃ তুই অস্থির হোস না, আমরা তো আছি , অরুদ্র কে অবশ্যই খুজে পাওয়া যাবে , এর আগেও তো সে কতবার এমন করেছে তাই না ?
রফিক ঃ এটা ঠিক বলেছো তুমি, অধরা আপু ।
নুসাইবা ঃ এর আগেও সে এমন করছে ঠিক, কিন্তু ৩-৪ ঘণ্টা পর ফিরে এসেছে । আজ কেন আসছে না ...
অধরা ঃ তুই এখন ডিপার্টমেন্ট এ চল, হাতঁ মুখ ধুয়ে, কিছু খেয়ে, এয়ারপোর্ট এ যাই আমরা, পুলিশ তো খোজার কাজ করছে ... । খবর একটা না একটা অবশ্যই পাওয়া যাবে ।
নুসাইবা ঃ তুমি বুঝতে পারছো না আপু, আমার মাঝে কি রকম একটা অনুভুতি কাজ করছে । আপু, অরুদ্র না আসলে ?
রফিক ঃ না আসলে, তুই একা চলে যাবি ।
নুসাইবা কিছু বললো না, তার শরীর জুড়ে যেন কোন স্থির স্রোত বয়ে যেতে লাগলো । পৃথিবী যেন তার স্বাভাবিক ঘূর্ণন বন্ধ করে দিয়েছে ।
অরুদ্র একটা গাড়ি পেয়েছে ঢাকা পৌছানোর , একটা প্রাইভেট কার । অরুদ্র বসেছে, ড্রাইভিং সিট এর পাশে । গাড়ী তে অরুদ্র ছাড়া আরো একজন লোক ছিলেন, যিনি গাড়ির মালিক এবং তিনি ড্রাইভ করছেন । ভদ্রলোক এর হাতে একটি জলন্ত সিগারেট । ভদ্রলোক একটা টান দিয়ে, সিগারেট টা এবার অরুদ্র কে দিলেন, এবং জিজ্ঞেস করলেন ,
- ঢাকায় কোথায় যাচ্ছেন ভাই ? জরুরি কোন কাজ নাকি ?
- আপাতত এয়ারপোর্ট এ পৌছাতে পারলেই হল ,...
- এয়ারপোর্ট ?
- জি ... আপনার কাছে খুব উপকৃত থাকবো, আজ যদি আপনি আমাকে সে জায়গা পর্যন্ত পৌছাতে সাহায্য করেন ।
- আপনি চিন্তা কইরেন না ভাই, আমি একটা কাজে বনাণী যাবো, একই তো পথ, আপনাকে না হয় নামিয়ে দিয়ে যাবো । ঘটনা টা কি ভাই বলেন তো, প্রেম ভালবাসার ব্যপার না তো ?
- প্রেম ভালবাসা কি না, জানি না। কিন্তু এত টুকু জানি, সময় মত পৌছাতে না পারলে, জীবন থেকে যে সেই একটা জিনিস হারিয়ে ফেলবো, যাকে কেবল নিজের বলে জানি ...
গাড়ী চালক ভদ্রলোক আরো কি কি যেন বলছিল, অরুদ্র’র কানে সে কথার শব্দ শুনতে পাচ্ছিলো ঠিক, কিন্তু ভাবছিল, নুসাইবা’র কথা । অরুদ্র ভেবে নিয়েছে, নুসাইবা কে তার প্রশ্নের উত্তর কিভাবে দেবে । নুসাইবা নিশ্চয়ই , অরুদ্র কে প্রথম দেখতেই হাউমাউ করে কেদে উঠবে, তারপর ২/১ টা চড় বসিয়ে দেয়া টা অসম্ভব কিছু হবে না । হয়তো কিছু জিজ্ঞেস করবে না, অরুদ্র তুমি কোথায় ছিলে, কেন গিয়েছিলে ? তবু অরুদ্র বলবে নুসাইবা কে –
“ ভেবেছিলাম, তোমার থেকে দূরে থাকাটা সব থেকে উত্তম হবে, তোমার জন্য । নুসাইবা, আমি না হয় ছন্নছাড়া,
ভবঘুরে ধরনের একটা ছেলে, তুমি তো সেই প্রথম থেকেই চিনো আমাকে, তাই বলে, আমার মত একটা ছেলে’র জন্যে তোমার নিজের পরিবার, সুখ, আনন্দ, সব কিছু ছেড়ে চলে যাবে ? আমার জন্যে তুমি এত বড় ভুল করবে , এটা ভেবে আমি নিজেকে হ্মমা করতে পারছিলাম না, তাই চলে গিয়েছিলাম, যেদিক দু চোখ যায় । কিন্তু অনেকটা পথ চলে যাবার পর আমার মনে হল, এটা আমি কি করছি !
নুসাইবা, আমি তোমার থেকে দূরে কি করে থাকবো ? ভুল তো সবাই করে, আর এই ভুল থেকে তোমার আমার অস্তিত্বের শুরু । ভুল তুমিও করছো, আমি ও । ভুলে ভুলে না হয় কাটা কাটি হয়ে গেল । তবু তুমি থাকো আমার সাথে, আমার পাশে, দুজনে মিলে না হয়, ভুলের একটা পাহাড় গড়ে তুলবো ; অনেক বছর পর যখন তোমার চোখে অনেক পাওয়ার এর চশমা আর আমার মাথার সমস্ত চুল পেকে সাদা ... তখন না হয়, দুজনে মিলে সেই ভুলের খাতা খুলবো, হিসেব করবো, কে বেশি ভুল করলো জীবনে, তুমি ? নাকি আমি ? ... ... কিন্তু নুসাইবা, সে পর্যন্ত তুমি আমার সাথে থাকো, আমার হাত ধরে ... কি থাকবে তো ? “
রাত ১০ঃ৩০
নুসাইবা এয়ারপোর্ট এর বাইরে দাঁড়ানো । সাথে রফিক, অধরা সহ বেশ কয়েকজন আছে ।নুসাইবা’র বাবা ও আছে।
রফিক, অধরা দুজনেই এখনো বেশ ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে,অরুদ্র কে খুজে বের করতে, সবাই সবার সর্বস্ব দিয়ে চেষ্টা করছে । নুসাইবা অস্থির চিত্তে এদিক ওদিক হাটা হাটি করছে, আর ২০ মিনিট পর চেক ইন । কিছুই বুঝতে পারছে না সে। নুসাইবা’র ইচ্ছা করছে, দৌড়ে সে এখান থেকে পালিয়ে যেতে। মনে মনে যেমন কষ্ট হচ্ছে, তেমন রাগ হচ্চে অরুদ্র’র ওপর । এমন একটা পরিস্থিতি আসবে, সেটা নুসাইবা কোনদিন ভাবেনি । নুসাইবা জন্যে এই মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নেয়া খুব কঠিন । অরুদ্র যদি এখনই চলে আসে, তবে সব সমসস্যার সমাধান হয়ে যাবে ।
নুসাইবা’র বাবা এগিয়ে আসলো তার দিকে ।
-নুসা, তোমাকে আমি অনেক স্বপ্ন নিয়ে বড় করেছি । তুমি জানো, তোমার মা মারা যাবার পর থেকে, তোমাকে কত যত্নে বড় করেছি । সবসময় তোমার সব রকম সিদ্ধান্ত আমি মেনে নিয়েছি । এমনকি তোমার সাথে অরুদ্র’র সম্পর্ক কে মেনে নিয়েছিলাম । কিন্তু ...
- কিন্তু কি বাবা ? তুমি ওকে ভুল বুঝো না, আমি জানি অরুদ্র ফিরে আসবে । তুমি দেখো ...
-নুসাইবা, আমি জানি না, এটা তোমাদের কেমন ভালবাসা । আর এটাও জানি না, অরুদ্র ফিরবে কি না। তবে বাবা হিসেবে তোমার কাছে আমি এত টুকু চাইতে পারি, তুমি অরুদ্র’র জন্যে আজকের ফ্লাইট মিস করো না । আমি কথা দিচ্ছি তোমাকে, অরুদ্র কে খুজে পাওয়া মাত্র, আমি তাকে তোমার কাছে পাঠানোর সব রক্ম উদ্যোগ নিবো ।
- কিন্তু বাবা,...
নুসাইবা কিছু একটা বলতে বলতে থেমে গেল । তার চোখ জুড়ে টপ টপ করে পানি পরতে লাগলো । সব কিছু কেমন নিমেষে শেষ হয়ে গেল । অধরা, নুসাইবা কে জড়িয়ে ধরে বললো, তোর বাবা যা বলছেন , ঠিক বলছেন । রফিক ও একমত এই ব্যাপারে, তুই আর আপত্তি করিস না, তোর ফ্লাইটের সময় হয়ে আসছে । সবার থেকে বিদায় নিয়ে, ভেতরে চলে যা ।
নুসাইবা কোন কথা বললো না, তার হাতে অরুদ্র’র পাসপোর্ট আর টিকেট । কথা ছিল, এসব দরকারি জিনিস কখনো অরুদ্র ঠিক মত রাখতে পারবে না, তাই এগুলো থাকবে নুসাইবা’র কাছে। অরুদ্র কেবল, ছুটে বেড়াবে এদিক সেদিক । কিন্ত কোথায় অরুদ্র ?
রাত ১১ঃ ০০ টা
হঠাৎ বেশ ঝাঁকুনি দিয়ে গাড়ী থেমে গেল । অরুদ্র চোখ মেলে দেখলো, সে এয়ারপোট পৌছে গেছে । গাড়ী চাল্ক ভদ্রলোক বললেন,-“ ভাই, আমরা পৌছে গেছি । তাড়াতাড়ি যান, ভাবি কে থামান ।“
অরুদ্র গাড়ী থেকে নেমে গেলো । এক দৌড়ে এয়ারপোর্ট এর ভেতরে চলে আসলো । দুর থেকে অরুদ্র দেখতে পেলো, নুসাইবা গেট এর কাছাকাছি । দেখে মনে হচ্ছে সে চোখ মুছছে ... হাতে ট্রলি ব্যাগ । গেট এর দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে । অরুদ্র এগিয়ে আসতে গিয়ে, হঠাত কি মনে হল আর সে থেমে গেল ।
নুসাইবা কে কি সে ডাকবে ? নাহ, পিছন থেকে ডাকবে না। তবে ?
তবে নুসাইবা যদি একবার এদিক ফিরে তাকায়, তবে সে ফিরে যাবে নুসাইবা’র দিকে ... ... এখন শুধু নুসাইবা’র একবার ফিরে চাওয়ার অপেহ্মা । চাইবে নুসাইবা একবার এদিকে ?
নুসাইবা এগিয়ে যাচ্ছে গেট এর কাছে, অরুদ্র’র বুকের বামপাশে হঠাৎ খুব যন্ত্রনা করছে ।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৬ রাত ১২:১৬