১
পাহাড় এর সরু আর আঁকাবাঁকা পথ ধরে কল্প হাটছিল। আজ এত কঠিন একটা পরীক্ষা ছিল, সারা রাত জেগে প্রস্তুতি নিয়ে একেবারেই ক্লান্ত সে। তাই হাঁটার গতি কিছু টা স্থির। মাথার ওপর রোদ আছে বেশ। আর মিনিট পাঁচেক পর অরুন চাচার চা এর দোকান। একবার সেখানে বিশ্রাম নিয়ে নেবে কি না ভাবল কল্প। রাস্তার এমন দূরঅবস্থা, কোন গাড়ী করে যে বাড়ি ফিরবে সে উপায় নেই।
কল্প হাটতে লাগল। হঠাৎ, বাঁ দিকে তাকিয়ে কল্প চমকে গেল।
কল্প'র পা এর এক অংশ থেকে শুরু হয়ে বেশ খানিক দূর পর্যন্ত কি
অদ্ভুত আকৃতির আধো এক ধরনের জিনিস মাটিতে পড়ে আছে। কখন এসে পড়লো এটা, কল্প কিছুই জানে না। কিছু বুঝতেই পারে নি সে।
কি না কি এক জিনিস, কার ই বা এটা, কিছুই তো জানে না কল্প। বিনা কারনে অন্যের কিছু , নিজের না করে, আর না ভেবে সামনে আগানোই ভাল। কল্প পাশ কাটিয়ে সামনে এগিয়ে গেলেই হবে। এক পা দুই পা সামনে দিয়ে এগোতেই, কল্প লক্ষ্য করলো, এই অদ্ভুত আকৃতি থেকে কোনভাবেই সে পাশ কাটাতে পারছে না।
আশ্চর্য কান্ড !
দেখে মনে হচ্চে, জিনিসটি যেন মাটিতে শুয়ে আছে। কল্প একটু অবাক হল। আশে পাশে তাকিয়ে দেখল, কেউ আছে কি না, কেউ কোন রকম মজা করার চেষ্টা করছে কি না তার সাথে। নাহ ! কাউ কে তো দেখলো না।
কল্প অবাক হল। কি এই জিনিস !
হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখবে, এই ভেবে, হাঁটু গেড়ে বসলো। বসা মাত্র, সারা শরীরে শিহরণ বয়ে গেল তার। এত আরো আশ্চর্য ঘটনা। কল্প'র ধারণা ছিল, জিনিসটার কোন গতি নেই । কিন্তু অবাক করা ব্যাপার, কল্প বসা মাত্র, অন্য এক আকৃতি নিয়ে নিলো । কল্প'র মনে হল, এই অদ্ভুত জিনিসটি কি তাকে কিছু বলতে চাইছে !
খানিকটা ঘাবড়ে গেল কল্প। আশে পাশে এখন না হয় কেউ নেই, কিন্তু আর কিছু পথ পরে তো জনকোলাহল এর মাঝেই যাবে সে। তখন মানুশ এই অদ্ভুত আকৃতি তার সাথে দেখলে কি হবে, কি ভাববে ! কি জবাব দেবে সে সবাই কে।
মহা মুশকিল এ পড়া গেলো তো !
কল্প সামনে আগালো আরো ধীর গতিতে ...
২
অরুন চাচার দোকানে এসে বসলো কল্প। চাচা দোকানের পেছনে কিছু একটা ধোয়ার কাজ করছেন। কল্প চিন্তিত ভঙ্গিতে, মাটিতে সেই অদ্ভুত আকৃতিটির দিকে তাকিয়ে আছে। অরুন চাচা এসে কল্প কে দেখে জিজ্ঞেস করলো,
- কি খবর, বাবাজী ! শরীর টা কি ভাল নয় , নাকি ?
কল্প বুঝল , চাচা, আকৃতিটা কে খেয়াল করেনি। কল্প আর নিজে থেকে কিছু বলল না।
- না, চাচা। তেমন কিছু না। রাত জেগেছি, তাই এমন দেখাচ্ছে।
-হুম ... চা করে দেবো তোমাকে ?
- দাও, চাচা।
কথা শেষ করে, কল্প চাচার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে, মাটির দিকে তাকালো আর সাথে সাথে লাফিয়ে উঠে গেল।
অরুন চাচা, জিজ্ঞেস করলেন, " কি হল বাবা। সাপ খোপ দেখলে নাকি !!!"
কল্প বলল, "না চাচা, ইয়ে... "
চাচা, বুঝলেন, সারা রাত পরিশ্রম করাতে, কল্প সত্তিই বেশ ক্লান্ত। পিঠে হাত বুলিয়ে, চা এর কাপটা হাতে দিয়ে তিনি কল্প কে বললেন,
"এই নাও, চা খাও। তারপর বাড়ি গিয়ে একটু বিশ্রাম নাও। আহারে, কত পরিশ্রম করো তোমরা "
কল্প চা এর কাপটি হাতে নিলো । চুমুক দিতে দিতে ভাবল, কি আশ্চর্য একটু আগেও সে চেষ্টা করছিল, সেই অদ্ভুত আকৃতি থেকে পাশ কাটাতে, পারলো না, আর এখন নিজে থেকেই নেই ! হচ্ছে টা কি তার সাথে !!
যাই হোক, কল্প এই অদ্ভুত জিনিস থেকে রক্ষা পেলো, কেউ তাকে এর সাথে দেখার আগেই। এই তো বেশ হল ।
কল্প আরাম করে চা খেতে লাগলো ।
৩
বৃষ্টির ছাঁটে জানালার পাশে থাকা টেবিলের বই পত্র সব ভিজে যাচ্ছে। কল্প'র মা -রাহনুমা বেগম , পাশের ঘর থেকে এসে জানালা আটকালো। কল্প শুয়ে আছে বিছানায় বাইরের দিকে তাকিয়ে। মা কখন এসে জানালা আটকে দিয়েছে, সেটা কল্প খেয়ালই করল না।
কল্প'র পাশে গিয়ে বসলেন ,ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
- কি রে ! হয়েছে কি তোর ? বাড়ী ফিরে তো কোন খাবার মুখেই নিলি না, সারা রাত জেগেছিস, কিন্তু ঘুম এর তো কোন নামি নেই তোর চোখে। বৃষ্টির পানি তে সমস্ত ঘর ভিজে যাচ্ছে তাও তোড় হুশ নেই। কি রে ...এই কল্প, কল্প !!
- জী,মা।
- কি হয়েছে তোর ?
-কিছুই তো না, মা।
-আমার কাছে লুকোচ্ছিস ?
-না, মা। তেমন কিছু না।
কল্প'র মা উঠে দাঁড়ালেন ।
- ঠিক আছে। একটু ঘুমিয়ে নে। এই দেখ, আবার রোদ হয়ে গেলো।
কল্প উঠে বসলে, খেয়াল করলো। ঘরের মেঝে তে আবার সেই অদ্ভুত আকৃতি । কল্প আঁতকে উঠল । মা বলে চিৎকার করতেই, রাহনুমা বেগম ফিরে তাকালেন।
- কি রে কল্প, কি হল !
-মা !! ওই দেখো, মেঝে তে, ওটা আজ সারাদিন আমার পিছু করেছে। আমি অনেক চেষ্টা করেছি, কিন্তু কিছু তে আমার পিছু ছাড়লো না। মা, আমার খুব ভয় করছে মা।
ছেলের কথা শুনে রাহনুমা বেগম হাসলেন ।
-বোকা ছেলে বলে কি দেখো। এটা তো তোর ছায়া । সবারই থাকে। কেউ কেউ খুব গুরুত্ব দিয়ে দেখে, আবার কেউ কেউ দেখেও না দেখার মত করে থাকে।
ছায়া দেখে ভয় পাচ্ছিস তুই ?
তিনি আবার হাসলেন ।
- মা, তুমি হাসছো ! ছায়া কেন এমন হয় মা ?
- হ্যা, হাসছি। ছায়া দেখে তুই ভয় পাচ্ছিস তাই। ছায়া হল, তোর নিজের প্রতিচ্ছবি, মানে, তুই নিজেই। আর তুই তোর নিজেকে দেখে ভয় পাচ্ছিস, তাই হাসছি কল্প ।
- হুম ...
- ভয় পাস না। জানিস মজার বিষয় । সময়ের সাথে সব পালটায়। অনেক কিছু চলেও যায়। কিন্তু, ছায়া হল এমন এক সঙ্গী , যে কিন্তু কখনো তোকে ছেড়ে যাবে না। জীবনের প্রতি পদে পদে তোর সাথে থাকবে। তুই যদি কখন একা একা চলিস, তোর ছায়া তোকে সঙ্গ দিবে। তোর বন্ধু হবে।
এমন এক বন্ধু যার সাথে তুই চাইলেও সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারবি না ।
কল্প মৃদু হাসলো ।
মেঝের দিকে তাকিয়ে, কল্প দেখল, সত্যি তো। এই যে অদ্ভুত আকৃতি , এটা তো অর নিজেরই প্রতিচ্ছবি। কল্প হাত নাড়ালো, সাথে সাথে ছায়ার আকৃতি পাল্টে গেলো। কল্প'র এক রকমের আনন্দ হতে লাগলও।
কল্প বেশ ভাল সময় কাটাতে লাগলো তার নিজের ছায়ার সাথে। মনে হল, এ তো অনেক দিনের পরিচিত তার। এতদিন কেন সে খেয়াল করলো তার নিজেকে এভাবে।
সত্যি, এ এক নতুন ধরনের আত্মপোলব্ধি।
৪
অনেক বছর পর, কল্প নিজেকে আবিষ্কার করলো একটি সাদা চাদরে মুরানো অবস্থায়। মনে হচ্ছে, কেউ তাকে জোড় করে শুয়ে থাকতে বাধ্য করে রেখেছে। ক্লপ'র ভাল লাগলো না। সে উঠে বসলো । আশে পাশে অনেক মানুশ, কিন্তু কারো কোন কথা নেই,শব্দ নেই, সবার চোখের পাতা ভারী হয়ে আছে।
কল্প'র উঠে বসা তে, কারো কিছু তেমন পরিবর্তন হল না।
কল্প, কিছু মনে করলো না। শুধু ভাবল , কেন তাকে এতক্ষণ জোড় করে শুইয়ে রাখা হল ।
উঠে দাঁড়াতেই, মেঝে তে চোখ পড়লো তার। ক্লপ'র নিজের চোখ কে বিশ্বাস
হল না, যেখানে সে শুয়ে ছিল, ঠিক একি জায়গায় একই রকম করে রাখা আরেকটি মানুশের দেহ। সাদা কাপড়ে মুড়ানো। যদিও চেহারা দেখতে পারছে না।
কল্প'র বিশ্বাস হল না। এ কি করে সম্ভব।
কল্প মেঝে তে থাকা দেহ টীর থেকে একটু দূরে গিয়ে দাড়ালো। না, দেহটির চেহারা তাকে দেখতে হবে। কাছে গিয়ে, চেহারা থেকে কাপড় সরিয়ে কল্প স্তব্ধ হয়ে গেল।
এত কল্প নিজে। এটা তো কল্প'র শরীর । মৃত শরীর ।
আশে পাশে সবাই কল্প'র পরিচিত । সবার মুখে গাম্ভীর্য। সবাই কেমন নিস্তব্ধ। কেউ কল্প কে দেখতে পাচ্ছে না, যা দেখতে পাচ্ছে, সেটা হল তার মৃত শরীর ।
কল্প দুরে সরে এলো। বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই মাথার উপর কড়া রোদ এর উপস্থিতি টের পেলো। হঠাৎ মনে এক রকম আনন্দের বেগ পেল। আনন্দে উচ্ছসিত হয়ে নিচে মেঝে তে তাকালো কল্প।
কিন্তু ,
সে তো নেই । আশে পাশে সব দিকে খুজলো। তার তো থাকার কথা ছিল । সে তো তার সব সময় এর সঙ্গী। ছায়া সঙ্গী। তার তো কল্প কে ছেড়ে যাবার কথা ছিল না।
এই প্রথম কল্প শূন্য অনুভব করলো । ধীরে ধীরে শুন্যের অসীমতায় কল্প হারিয়ে যেতে লাগলো ...
কল্প মৃত , কিন্তু বুকের বা দিক টায় কেমন চিন চিন ব্যাথা করে যাচ্ছে ...
কল্প'র বারবার শুধু মনে হল,
ছায়া সঙ্গী ছাড়া, সে তো শূন্য। নিঃস !!
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ বিকাল ৩:৫৯