বিশ্বের ৩৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশও আছে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে কৃষি বিজ্ঞানীদের চেষ্টার কমতি নেই। সেরা জাতের বীজ উদ্ভাবন, রোগ-বালাই প্রতিরোধ, খরা, বন্যা ইত্যাদি দুর্যোগ সহনশীল ও উচ্চ ফলনশীল ফসল আবিষ্কারের চেষ্টা চলছে নিরন্তর। বিশ্ব বিবেককে ভাবিয়ে তুলেছে আজকের জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা। পাশাপাশি শিল্পকারখানা আর বসতবাড়ি নির্মাণে গ্রাস করছে আবাদি জমি। প্রতিদিন দেশে প্রায় ৩২০ হেক্টর কৃষি জমি চলে যাচ্ছে অ-কৃষি কর্মকাণ্ডে। যাতে করে ১৫ লক্ষ মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা হারাচ্ছে। দু'তিন ফসলি জমিতে মাটি ভরাট করে গড়ে উঠছে ঘরবাড়ি ও শিল্পকারখানা । বর্তমানে আধুনিক প্রযুক্তির ফলে ফসল উৎপাদন ব্যবস্থা প্রশংসার দাবীদার হলেও ১৫ কোটি মানুষের মধ্যে প্রায় ১ কোটি লোক দিনে তিনবেলা খেতে পারে না। তারা নীরব দুর্ভিক্ষের শিকার।
প্রতিনিয়ত তৈরি হচ্ছে বাসগৃহ-দালানকোঠা, রাস্তাঘাট, ব্রীজ-কালভার্ট। নগরায়নের ছোবলে কৃষি বিষাক্রান্ত হয়ে উঠছে। কোথাও আবাসন ও শিল্পকারখানা। মানুষসৃষ্ট এই বিপর্যয় এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ -এ দুটোই আমাদের আগামীর খাদ্য সংকটকে ক্রমান্বয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় নিয়ে চলেছে। তিন ফসলি জমি হারিয়ে যাচ্ছে। ভূমি জরিপ বিভাগের তথ্য মতে ১৯৭১ সালে আমাদের আবাদি জমির পরিমাণ ছিল ২ কোটি ১৭ লাখ হেক্টর। যা ১৯৮৬ সালে এসে দাঁড়ায় মাত্র ৮১ লাখ ৫৮ হাজার হেক্টরে এবং ২০০৩ সালে কমে দাঁড়ায় ৭০ লাখ ৮৭ হাজার হেক্টরে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল ৭ কোটি ৯০ লাখ। ২০০০ সালে ১৩ কোটি এবং বর্তমানে ১৫ কোটিতে এসে দাঁড়িয়েছে। অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, গত ২০ বছরে গ্রামাঞ্চলে জনসংখ্যা বেড়েছে ২ কোটি ৬০ লাখ। এর মধ্যে ২ কোটি ৪০ লাখই নিরঙ্কুশ দরিদ্র। বর্তমানে মোট জনসংখ্যা ১১ কোটিই গ্রামে বাস করে।
দেশের কৃষি জমি মৌলিকভাবে উৎকৃষ্টমানের, তবে বর্তমানে এর মান নানাস্থানে নানাভাবে কমছে। জনপ্রতি আবাদি জমির পরিমাণ পৃথিবীর অন্যান্য জনবহুল ও কৃষি প্রধান দেশের চেয়ে কম। কৃষি জমি কমে গেলে অবশিষ্ট জমির উপর চাপ বাড়তে থাকে। রাস্তাঘাট, আবাসন ও শিল্পকারখানার ফলে কৃষি জমি দিন দিন অকৃষি খাতে চলে যাচ্ছে। এতে বন্যার পানি নিষ্কাশনের পথে অন্তরায় সৃষ্টি হচ্ছে। ফসলি জমি জলাবদ্ধতার শিকার হচ্ছে। কৃষক হচ্ছে আর্থিকভাক্ষে ক্ষতিগ্রস্থ। এতে ভূমিক্ষয় বৃদ্ধি পাচ্ছে, জমির উর্বরা শক্তি কমবার এবং রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার বেড়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে। সব মিলিয়ে কৃষি জমি কমে চলেছে এবং অবশিষ্ট জমির উপর চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে স্বাভাবিকভাবেই।
ইট ভাটার সংখ্যা বাড়ছে এবং সে কারণেও নষ্ট হচ্ছে আবাদি জমি। ইট ভাটার জন্য সাধারণত ব্যবহার করা হয় আবাদি জমির উপরের উর্বর মাটি। যে মাটি কৃষি আবাদের জন্য খুবই উপযোগী। একবার আবাদি জমির উপরের মাটি কেটে নিয়ে গেলে অন্তত ১৫ বছর সময় লাগে তা আগের অবস্থায় ফিরে আসতে। এর ফলে উৎপাদন হয় ব্যাহত।
নদী ভাঙ্গনেও কৃষক হারাচ্ছে আবাদি জমি।
কলকারখানার দুষিত বর্জ্যরে কারণে কারখানা-সংলগ্ন আবাদি জমির উর্বরা শক্তি ও ফসল উৎপাদন ব্যবস্থা হ্রাস পাচ্ছে। কৃষক বাধ্য হয়ে তার জমি অন্যের কাছে বিক্রি করে দিচ্ছে। সেখানে আবারও গড়ে উঠছে কলকারখানা।
২০০৫-০৬ সালে ফসলি জমির পরিমাণ ছিল ৭৮.০৯ লাখ হেক্টর এবং দেশের ভূমির ৫৩ ভাগ আবাদি, ৪ভাগ পতিত জমি এবং আবাদযোগ্য অনাবাদি জমির পরিমাণ ২ ভাগ। ফসলের নিবিড়তা ১৭৭% ধরে হিসেব করা হয় যে, মোট ১৩৭.৪৩ লাখ হেক্টর জমি ছিল ফসলের আবাদি ভূমি।
ধানের মনোকালচার, রাসায়নিক সার ব্যবহার এবং জমির অর্গানিক উপাদান হ্রাসের কারণে ভূমি উর্বতা কমছে। এছাড়া রয়েছে ভূমির অসম বন্টন। বিবিএস (বাংলাদেশ পরিসংখ্যান অধিদফতর) -এর উপাত্ত অনুযায়ী বাংলাদেশে ৪৫% পরিবার ভূমিহীন। এক্ষেত্রে ভূমি ব্যবহার নীতি, শস্য উৎপাদনের নিরিখে ম্যাপিং এবং ভূমি প্রশাসনে পল্লী দারিদ্র বিমোচন গুরুত্ব পাওয়া সবিশেষ প্রয়োজন। সরকারি নীতিমালায় খাসজমি ও পানির উৎপাদনমুখী ব্যবহার প্রাধান্য পেতে পারে। বাংলাদেশে ৩০টি কৃষি ইকোলজিক্যাল জোন আছে। যেখানে বিভিন্ন ধরনের ফসল উৎপাদিত হয়। ভূমির যথোপযুক্ত ব্যবহারের উদ্দেশ্যে ভূমি মন্ত্রণালয় কর্তৃক টেকসই ভূমি ব্যবস্থাপনা (যা ১৯টি উপকূলীয় এবং ২টি সমতল জেলার জন্য করা হয়েছে), পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় কর্তৃক উপকূলীয় ইকোসিস্টেম স্টাডি এবং ঝজউও কর্তৃক প্রণীত খাদ্য নিরাপত্তার নীতিসমূহ বাস্তবায়ন করা গেলে ভূমির আরও উৎপাদনমুখী ব্যবহার সম্ভব। মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইন্সটিটিউট ৫০টি উপজেলার ভূমি ব্যবহারের নির্দেশিকা হালনাগাদ করেছে এবং ভূমি ম্যাপিংসহ ৪০টি উপজেলার জন্য নির্দেশিকা প্রকাশ করেছে। আগামী ৫ বছরে তারা ৪৬০ উপজেলার জন্য এ ধরনের নির্দেশিকা হালনাগাদ করার কথা।
কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রদর্শনী খামার এবং কৃষকের জমির উৎপাদনের ব্যবধান খুবই বেশি। বাংলাদেশে অন্যান্য দেশের তুলনায় ফসল, পশুপালন, মৎস্য সকল ক্ষেত্রেই উৎপাদনের হার কম। বাংলাদেশে চাউলের উৎপাদন হার চীন, ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়ার তুলনায় যথাক্রমে ৪৫%, ২০% ও ২৫% কম। বাংলাদেশের মোট জমির পরিমাণ ১৪৮.৪০ লক্ষ হেক্টর যার মধ্যে আবাদি জমির পরিমাণ ৮২.৯০ লক্ষ হেক্টর, পতিত জমি ৭.৩০ লক্ষ হেক্টর এবং বনের পরিমাণ ২৫.৯৭ লক্ষ হেক্টর। উল্লেখ্য, দেশের ৮০.৩১ লক্ষ হেক্টর নীট ফসলি জমির মধ্যে এক ফসলি, দু'ফসলি এবং তিন ফসলি জমির পরিমাণ যথাক্রমে ৩৫. ৮০%, ৫১.৪৫% এবং ১২.৭৫%। এক ফসলি জমিকে দু'তিন ফসলি জমিতে রূপান্তরের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি সম্ভব যা দেশের মোট ২৪৫.২০ লক্ষ মে. টন খাদ্য শস্যের চাহিদা পূরণে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে। (তথ্যসূত্র : বিবিএস ২০০৭)
অধিক ফসল-অধিক উৎপাদন-আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন। এটি একটি সুত্র হিসেবে ধরে এগুতে হবে বাংলাদেশ-কে। খাদ্যশস্য, অর্থকরী ফসল ও অন্যান্য রবিশস্য উৎপাদনের মাধ্যমে দেশ স্বনির্ভর হতে পারে। বাংলাদেশে প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা থেকে দারিদ্র নিরসন কৌশল পত্র সর্বত্রই খাদ্য নিরাপত্তার কথা বলা হয়েছে। চার ধরনের ফসল যেমন- ধান, ডাল, ভোজ্য তেল এবং মশলা নিয়ে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা সংস্থা রাজস্ব বাজেট যে কর্মসূচি হাতে নিয়েছে তা ২০১১ সালের ভেতর বাস্তবায়ন হওয়ার কথা। তাতে উৎপাদন ৮.৫% থেকে ২৫% এ বৃদ্ধি পাবে। বাংলাদেশে সেচ ব্যবস্থার কার্যকারিতা এবং দক্ষতা বৃদ্ধিরও সুযোগ আছে। দক্ষিণ এশিয়ায় সেচ ব্যবস্থার কার্যকারিতার দিকে বাংলাদেশ রয়েছে পেছনের কাতারে। এটি ভারতে ৪৯%, পাকিস্তানে ৪৯%, নেপালে ৫৮%, মায়ানমারে ৩৯% এবং বাংলাদেশে ৩০ %। বর্তমানে বাংলাদেশে তা ৪০%। সারফেস ওয়াটার এবং কৃষি খামারে পানি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে তা অনেক বাড়ানোর সুযোগ আছে। পানি সম্পদ, কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ, বিএডিসি, বরেন্দ্র বহুমুখী কর্তৃপক্ষ চলমান প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলে ২০০৬ সালে সেচাধীন ৫৪ লাখ হেক্টর থেকে ২০১১ সালে ৬৫ লাখ হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা দেয়া সম্ভব হবে।
খাদ্য নিরাপত্তার প্রশ্নে কৃষি কিংবা খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধিই যখন মূল প্রস্তাবনা, তখন বছরে ৮০ হাজার হেক্টর জমি অর্থাৎ ১% হারে আবাদি জমি হারানোর পরিণতি কি হতে পারে- তা সহজেই অনুমেয়।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে মার্চ, ২০০৯ দুপুর ১:০৩