প্রাচীনকালে এক বাদশা ছিল। তাঁর কোনো সন্তানাদি ছিল না। অনেক চেষ্টা তদবির করেও কিছুতেই কিছু হলো না। শেষ পর্যন্ত মানত করলো: যদি একটা ছেলে সন্তানের বাবা হয় তাহলে পানির একটা হাউজকে মধু দিয়ে পূর্ণ করবে এবং আরেকটা হাউজকে পূর্ণ করবে তেল দিয়ে। যত ফকির গরিব আছে সবাই যত খুশি খাবে দাবে এবং নিয়ে যাবে। খোদার হুকুমে তার মানত কবুল হলো এবং সে একটা ছেলে সন্তানের বাবা হলো। বাদশার আনন্দ তো আর ধরে না। কী করবে না করবে ভেবে কূল পাচ্ছিল না। ছেলেকে ধাইমাদের কাছে দিয়ে দিলো ভালো করে লালন পালন করার জন্য। তার খেলাধুলার জন্য যত রকমের খেলনা দরকার ছিল সবই সংগ্রহ করে দিলো। সন্তান ঠিকঠাকমতো আদর যত্নে বেড়ে উঠলো।
এভাবে দিন যেতে যেতে শাহজাদা আঠারো বছর বয়সে উপনীত হলো। একদিন বাদশা প্রাসাদের ভেতর পায়চারি করছিল। হঠাৎ তার দৃষ্টি পড়লো ছেলের ওপর। কেমন লম্বা চওড়া এবং স্মার্ট লাগছে ছেলেকে। তাঁর মনে পড়ে গেল মানতের কথা। মনে মনে বললো: আমি তো মানত করে এই সন্তানের বাবা হয়েছিলাম। কিন্তু সেই মানতের কথা বেমালুম ভুলে বসে আছি। বাদশা তাড়াতাড়ি আদেশ দিলো প্রাসাদের বাইরে বিশাল দুটি হাউজ বানানোর জন্য। বাদশার আদেশে হাউজ বানানো হলো এবং হাউজ দুটোর একটিতে মধু ঢালা হলো। মধুতে পরিপূর্ণ হয়ে গেল হাউজ। আরেকটি হাউজ ভর্তি করা হলো তেল দিয়ে। তারপর ঢাক ঢোল পিটিয়ে ঘোষণা করে দেওয়া হলো: ‘বাদশা দুটি হাউজ ভর্তি করে মধু আর তেল রেখেছেন। যার যত দরকার খেয়েদেয়ে নিয়েও আসুন’।
এই ঘোষণার পর সবাই বাদশার প্রাসাদের সামনে এসে যার যত খুশি খেয়েদেয়ে নিয়েও গেল। একদিন এক বৃদ্ধ মহিলা এলো হাউজের কাছে। সে তার বাটিটা হাউজে ফেলার সময় বাদশার ছেলে ওই বৃদ্ধাকে দেখতে পেল। বৃদ্ধার পিঠ কুঁজো গিয়েছিল। এ বয়সের বৃদ্ধা একটু বেঁকে যাওয়ায় শাহজাদা তাকে দেখে হেসে দিলো। সে মজা করার জন্য ধনুকে একটি পাথর জুড়ে ছুঁড়ে মারলো। ওই পাথর গিয়ে আঘাত করলো বুড়ির বাটিতে। বাটিটা ভেঙে গেল এবং বাটির তেল ছিটকে পড়ে গেল। বুড়ি মাথা উঁচিয়ে বাদশার ছেলেকে দেখতে পেয়ে বললো: আমার মন সায় দিচ্ছে নো তোমাকে তিরস্কার করি, বদদোয়া দিই। কেননা তুমি বাদশার একমাত্র সন্তান। তবে তুমি নারঙ্গি কন্যার ফাঁদের যন্ত্রণা ভোগ করবে।
শাহজাদা এরকম নাম শুনে থমকে গেল। নারঙ্গি কন্যা আবার কে! তার যন্ত্রণা কেন ভোগ করতে হবে তাকে! এসব ভাবছিল। কিছুই বুঝে উঠতে না পেরে সে বুড়িকে জিজ্ঞেস করলো: নারঙ্গি কন্যা কে আমি তো তাকে চিনি না। তুমি আমাকে একটু বলবে?
বুড়ি বললো: আমি তার সম্পর্কে কিছুই জানি না। যাও, যারা জানে তাদেরকে জিজ্ঞেস করো।
বুড়ির জবাব শুনে শাহজাদা হন্তদন্ত হয়ে দৌড়ে গেল তার মায়ের কাছে। মাকে জিজ্ঞেস করলো: নারঙ্গি কন্যা কে মা!
মা ভ্রু কুঁচকে ছেলের দিকে তাকিয়ে ভাবলো- ছেলে এটা কোত্থেকে শুনলো। ছেলেকে জিজ্ঞেস করতেই ছেলে সবকিছু খুলে বললো মাকে।
অবশেষে রানি বললো: বাবা! এরকম বলতে শুনেছি যে, অনেক দূরের এক শহরে নাকি একটা বাগান আছে। নারঙ্গি বাগান। ওই বাগানে নাকি সবচেয়ে উন্নতমানের কমলা এবং মাল্টা পাওয়া যায়। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো ওই কমলা থেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী কন্যার জন্ম হয়। কিন্তু শাহজাদা! এসব কথার কথা। কেননা; এ পর্যন্ত যে-ই ওই নারঙ্গি কন্যার খোঁজে গেছে সে আর ফিরে আসে নি, এসেছে তাদের মৃত্যুর খবর।
শাহজাদা বুড়ির কথায় থমকে গেলেও এখন মায়ের কথা শুনে নারঙ্গি কন্যার পিছু নেওয়ার জন্য কৌতূহলী হয়ে উঠলো। মাকে সে বললো: যে করেই হোক আমি যাবো এবং ওই কন্যাকে নিয়ে আসবো।
মা এখন অনুতাপ বোধ করতে লাগলো কেন সে ছেলেকে বলতে গেল। বললো: বাবা! এ কাজ খুবই ভয়ংকর। এ পর্যন্ত যারাই গেছে ফেরে নি। তোমার চেয়ে অনেক শক্তিশালী বীর পালোয়ানও গিয়ে আর ফিরে আসে নি। কিন্তু কিছুতেই কাজ হলো না। ছেলে মানলোই না।
নাছোড়বান্দা ছেলে নারঙ্গি কন্যার জন্য অস্থির হয়ে পড়লো। মা অগত্যা বাদশাকে গিয়ে ছেলের অবস্থার কথা জানালো। বাদশা ছেলেকে ডেকে যতভাবে সম্ভব বোঝানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু ছেলে বাবার কথা এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে আরেক কান দিয়ে বের করে দিলো। বাদশাহ চিন্তায় পড়ে গেল। এই ছেলেকে কীভাবে দমানো যাবে ভাবতে লাগলো। ছেলে যেহেতু যাবেই, তাই বাদশাহ বললো: ঠিক আছে, যাও! তবে তোমার সাথে কয়েকজন গোলামও নিয়ে যাও..।
কিন্তু ছেলে মানলো না। বললো একাই যাবে এবং নারঙ্গি কন্যাকে নিয়েই ফিরে আসবে।
বাদশাহ শেষ পর্যন্ত আস্তাবলরক্ষককে বললো দ্রুতগামী এবং সুঠামদেহী একটা ঘোড়া যেন ছেলেকে দেয়। একটা খোরজিন নিয়ে সফরে যা যা প্রয়োজন সবই দিলো তার ভেতর। সবকিছু ঠিকঠাকমতো নেওয়ার পর শাহজাদা রওনা হলো।
যেতে যেতে তাদের শহরের বাইরে অনেকটা দূরে যাবার পর শাহজাদা দেখতে পেল এক বৃদ্ধ লোককে। লোকটা তার সামনে এসে আবির্ভূত হলো। তাঁর চেহারা সুরত এককথায় নুরানি। শাহজাদা অবাক হয়ে গেল কী করে এই বৃদ্ধ সামনে এসে হাজির হলো। বৃদ্ধ শাহজাদার সামনে এসে বললো: যুবক! ভালো থেকো! কোথায় যাও!
শাহজাদা বললো: যাচ্ছি নারঙ্গি বাগানে। সেখানকার নারঙ্গি কন্যাকে নিয়ে আসবো।
বৃদ্ধ বললো: ভালো হয় তুমি এখান থেকেই ফিরে যাও নিজের কাজকর্মে। এই পথে বিপদের পর বিপদ আছে। জীবনটা ধ্বংস না করে ফিরে যাওয়াটাই ভালো।
শাহজাদা বললো: একথা অনেকেই বলেছে আমাকে। কিন্তু আমি যাবোই।
বৃদ্ধ বললো: ‘ঠিক আছে। আমার কথা যেহেতু শুনবেই না, তোমার সিদ্ধান্ত যেহেতু পাল্টাবেই না, তাহলে শোনো’।
এরপর বৃদ্ধ যা যা বললো শাহজাদাকে সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ওই বনে যাওয়ার জন্য। কিন্তু কী সেসব কথা।#
চলবে........।