somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ভাষার মৃত্যু

০৯ ই মার্চ, ২০১২ রাত ১০:৩৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

"Genocide, the physical extinction of a people is universally condemned, but ethnocide, the destruction of peoples' way of life is not only not condemned, it's universally - in many quarters - celebrated as part of a development strategy."-Cultural anthropologist Wade Davis

ভাষার মৃত্যু মানে কোন ভাষায় কথা বলা শেষ ব্যক্তির মৃত্যু। কোন ভাষায় কথা বলা শেষ ব্যক্তির মৃত্যুদেহ কবরে শোয়ানোর সাথে সাথে ঐ ভাষাটিরও শেষকৃত্য হয়ে যায়, মুছে যায় হাজার বছরের জমানো তথ্য ও অভিজ্ঞতা।

প্রত্যেকটি ভাষাতেই রয়েছে মানুষের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের বিশাল সম্ভার। কিন্তু পৃথিবীতে যতগুলো ভাষা রয়েছে তার বেশিরভাগেরই লিখিত রূপ নেই এবং এসব ভাষাগুলোর জ্ঞান-ভাণ্ডারও তাই অলিখিত যা ঐ ভাষাভাষী মানুষদের স্মৃতি ও তাদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক আচারাদির মধ্যে হাজার হাজার বছর ধরে বেঁচে থাকে। কোন এলাকার মানুষের ভাষা ঐ স্থানের উদ্ভিদ, প্রাণি, পোকা-মাকড়, মানুষ ও প্রকৃতির গল্প, আবহাওয়ার গতিবিধি, রোগ-ব্যাধি, সামাজিক প্যাটার্ন, গান, কৌতুক, প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকার কৌশল, যুদ্ধ-শান্তির কৌশল, ব্যবসাদির ধরন ও কৌশলসহ মানুষের প্রয়োজনীয় যাবতীয় বিষয়কেই ধারন করে।

ধারনা করা হয় যে pre-colonial সময়ে পৃথিবীতে প্রায় ২০ হাজার ভাষা ছিল, বর্তমানে ৬-৭ হাজারে নেমে এসেছে এবং আরো ত্রিশ বছর পরে যা ৩০০০ এর বেশি থাকবে না। গড়ে প্রতিমাসে প্রায় ২টি ভাষার মৃত্যু ঘটছে।একটি ভাষার মৃত্যু মানে একটি জ্ঞান-ভাণ্ডারের মৃত্যু। বিশ্বায়ন কিংবা ব্যবসা অথবা সভ্যতার নামে রেইন ফরেস্টসহ অনেক বনে বসবাসরত অনেক গোষ্ঠিই আজ বিলুপ্ত; একইসাথে বিলুপ্ত তাদের হাজার বছর ধরে বেঁচে থাকার অভিজ্ঞতাও। আমাদের আর কোনদিনই জানা হবে না সেইসব বিলুপ্ত গোষ্ঠির মানুষেরা প্রকৃতির কীসব উপাদানকে ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করত, কীভাবে তারা প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করে রোগ-শোকের হাত থেকে হাজার বছর ধরে টিকে ছিল।

উপনিবেশবাদ ইউরোপীয় ভাষাগুলোকে পৃথিবীব্যাপি ছড়িয়ে দেয়, যার ফলে কত স্থানীয় ভাষার যে মৃত্যু ঘটে এবং এতে যে কত বিশাল পরিমাণ জ্ঞান পৃথিবী থেকে চিরতরে হারিয়ে যায় তার ইয়ত্তা নেই। ইসলামী জিহাদও উপনিবেশবাদের মত অনেক ভাষা তথা জ্ঞানের বিলুপ্তির অন্যতম কারণ। আরবের ক্ষুদ্র একটি জনগোষ্ঠির ভাষা আরবীকে ধর্মের নামে পুরো মধ্যপ্রাচ্যে এবং আফ্রিকার বৃহদাংশে চাপিয়ে দেয়া হয়। যার ফলে বিলুপ্ত হয়ে যায় ছোট-বড় অনেক জাতিগোষ্ঠির প্রতিষ্ঠিত ও অপ্রতিষ্ঠিত ভাষাগুলো। ১৯৪৭ পরবর্তী সময়ে আমাদের বাংলা ভাষার ওপরেও নেমে এসেছিল আরবির খড়গ। উর্দুকে যখন রাষ্ট্রভাষা করা গেল না তখন বাংলা ভাষার উপরে আরবি হরফের বোঝা চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। ধর্ম এমনই এক বিষয় যে ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মত বিদগ্ধ পণ্ডিতও বিভ্রান্ত হয়ে বাংলায় আরবি হরফের সমর্থন করেছিলেন। খাজা নাজিমুদ্দিনসহ বেশিরভাগ মুসলিম লীগ নেতা, গোলাম মোস্তফার মত ভ্রান্ত সাহিত্যিকরা এর পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন। তারা যদি সফল হতো তাহলেও হয়তো বাংলা ভাষা পশ্চিমবঙ্গের কল্যানে বেঁচে যেতো কিন্তু আমরা ৪৭ পূর্ববর্তী প্রায় সকল সাহিত্যকেই হারিয়ে ফেলতাম। হারিয়ে ফেলতাম বাঙালি সংস্কৃতি ও আমাদের প্রগতিশীলতা। হরফ সমস্যায় তখনকার সময়ের প্রায় সকল শিক্ষিত লোকও হয়ে যেত অশিক্ষিত।

মানুষ কর্তৃক প্রকৃতির পরিবর্তন দ্রুত পরিবেশের বিরূপ পরিবর্তন ঘটাচ্ছে যা ভবিষ্যত প্রজন্মকে পৃথিবীতে টিকে থাকার জন্য আরো বেশি সংগ্রামী করে তুলবে। টিকে থাকার সে সংগ্রাম যদি প্রাকৃতিক অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান থেকে জাত হয় তাহলে তা মানুষ এবং প্রকৃতি দু’দলের জন্য উপকারী হবে। দিনে দিনে ভাষার মৃত্যু আমাদেরকে সে জ্ঞান থেকে বঞ্চিত করছে। আমাদের উচিত মৃতপ্রায় ভাষাগুলো থেকে এখনই এ জ্ঞান সঞ্চিত করে লিপিবদ্ধ করা এবং প্রকৃতি নিয়ন্ত্রনে সে কৌশল অবলম্বন করা।

অদূর কিংবা সুদূর ভবিষ্যতে মানুষ বসবাসের জন্য অন্য কোন গ্রহ খুঁজে পেয়ে তাকে প্রস্তুত করতে পারবে কিনা তা আমরা এখনো জানি না। যদি না পারে তাহলে সূর্যের মৃত্যু পর্যন্ত মানুষকে এই পৃথিবীতেই বাঁচতে হবে। অন্তত সে পর্যন্ত বেঁচে থাকতে প্রকৃতিকে ব্যবহার করেই প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রন করতে শিখতে হবে। সেক্ষেত্রে আমাদের সাহায্য করতে পারে আদিবাসী সম্প্রদায় ও তাদের ভাষা।

সভ্যতার নামে গোটা আমেরিকার ক্ষুদ্র-বৃহত জাতিগোষ্ঠীগুলোর ভাষাগুলো আজ বিলুপ্ত। আমরা তাদের কাছ থেকে কতটুকু শিখতে পেরেছি? বোধ হয় এক সহস্রাংশও পারিনি; কারণ তাদেরকে আমরা মানুষই মনে করিনি। পশুদের কথা কেইবা শোনে! কেইবা তাদের জ্ঞানের গুরুত্ব দেয়!

ইন্টারনেট-বিশ্বায়ন-বানিজ্যের কবলে পড়ে একবিংশ শতাব্দীর শেষে ক'টা ভাষা টিকে থাকবে কে জানে!
৩টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×