somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অসম্ভবের বিজ্ঞান - মিচিও কাকু {দুই}

১৩ ই জুন, ২০১৫ রাত ১১:২২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কাকুর ভনিতা, তাঁর মুখেই শুনুন:
‘অসম্ভব ’ আসলে আপেক্ষিক

পদার্থবিদ হিসেবে আমি এটি শিখেছি, ‘অসম্ভব’ প্রায়শই একটি আপেক্ষিক বিষয়। আমার মনে আছে, স্কুলে একদিন আমাদের শিক্ষক পৃথিবীর মানচিত্রের কাছে গিয়ে দক্ষিণ আমেরিকা আর আফ্রিকা মহাদেশ দেখালেন। তিনি বললেন, এই দুই মহাদেশের সীমারেখা কেমন অদ্ভুত না! যেন খাপে খাপে মিলে যাবে! এরপর উনি মন্তব্য করলেন, কোনো কোনো বিজ্ঞানী মনে করেন যে একসময় এই দুই মহাদেশ একত্রে ছিল। কি বোকার মত ভাবনা, তাই না? এমন কোন দানবীয় শক্তি আছে যা এতবড় দুই মহাদেশকে এতদূরে নিয়ে যাবে? তাই সেদিন ক্লাসের শেষ কথা ছিল, অমন ভাবনা অসম্ভব। কিন্তু এখন আমরা জানি, প্লেট টেকটনিক এর কারণে কিভাবে মহাদেশগুলো এক অন্যের থেকে দূরে সরে গেছে এবং এখনও কিভাবে তা কাজ করছে।

সে বছরের শেষের দিকের কথা। আমরা ডাইনোসর সম্বন্ধে লেখাপড়া করছিলাম। শিক্ষক বললেন, লাখ লাখ বছর দুনিয়া কাঁপিয়ে বেড়িয়ে ডাইনোসরেরা হঠাৎ কোন যাদুমন্ত্রে পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে গেল? তিনি যোগ করলেন, কোনো কোনো জীবাশ্মবিদ মনে করেন, উল্কাপাতের কারণে এরা নির্বংশ হয়েছিল। কিন্তু তা তো অসম্ভব, এমন কথা তো বিজ্ঞান কল্পকাহিনীর খোরাক। আমরা এখন জানি, ৫৬ মিলিয়ন বছর আগে প্রায় ৬ মাইল লম্বা উল্কাপাতের কারণে ডাইনোসরের বিলুপ্তি ঘটে, সেসঙ্গে আরো বহু কিছু। আমার নিজের জীবদ্দশায় বিজ্ঞানের অনেক কিছুই পরিবর্তন হতে দেখলাম। তাহলে আমরা যদি ভাবি, আমরা একদিন মূহুর্তের মধ্যে নিজেকে টেলিপোর্ট করে কয়েক আলোকবর্ষ দূরে যেতে পারব, তাহলে কি ভুল হবে?

সাধারণভাবে এমন ভাবনা বর্তমানের পদার্থবিদের কাছে অসম্ভব বলে মনে হবে। তবে কয়েক শতাব্দি পরে কি এসব সম্ভব হবে? কিংবা কয়েক সহস্রাব্দ পরে? নাকি কয়েখ লাখ বছর পরে? অন্যভাবে বলা যাক, আমরা যদি ভবিষ্যতে গিয়ে আমাদের চেয়ে অনেক উন্নত সভ্যতার অধিকারী মানবজাতির দেখা পেতাম, তাহলে তাদের নিত্যদিনের বিষয়গুলিই কি আমাদের কাছে জাদুর মত মনে হবে না?

গত শতাব্দিতে বিজ্ঞানের অগ্রগতি, বিশেষত কোয়ান্টাম তত্ত্ব ও সাধারণ আপেক্ষিকতা, আমাদেরকে অনেক অসম্ভবের সম্ভাব্যতার ব্যাখ্যা দেয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। আমরা এখন মোটমুটি অনুমান করতে পারি, কতদিন পরে কোনো কোনো অসম্ভব সম্ভবে পরিণত হতে পারে। জুল ভার্ন ১৮৬৩ সালে ‘বিংশ শতাব্দিতে প্যারিস’ নামে একটি বই লিখেছিলেন, কিন্তু পান্ডুলিপিটি এতদিন অজ্ঞাত ছিল। এই ১৯৯৪ সালে তাঁর নাতির নাতি সেটি খুঁজে পেয়ে এটি প্রকাশ করলেন। সেখানে জুল ভার্ন ১৯৬০ সালের প্যারিসের জীবনযাত্রা তুলে ধরেছেন। সেখানে দেখা যায়, ফ্যাক্স মেশিন, বিশ্বব্যাপী যোগাযোগ নেটওয়ার্ক, কাঁচের অট্টালিকা, গ্যাস চালিত গাড়ি আর উচ্চ গতির ভাসমান ট্রেন। এগুলোর কোনোটিই সেই ১৮৬৩ সালে মানুষের কল্পনায় সম্ভবপর ছিল না। তবে জুল ভার্ন বিজ্ঞানীদের সাথেই সময় কাটাতেন, আলাপ আলোচনায় নিশ্চয় অনেক ধারণা পেয়েছিলেন

ঊনবিংশ শতাব্দিতে ফিরে গেলে দেখা যাবে, বিশ্বখ্যাত অনেক বিজ্ঞানীই জুল ভার্নের মত না ভেবে ঠিক উল্টোটা ভাবতেন। লর্ড কেলভিন (যাঁর নামে পরম তাপমাত্রা পরিমাপের কেলভিন স্কেলের নামকরণ করা হয়েছে এবং আইজাক নিউটনের পাশেই যিনি সমাহিত) ঘোষনা দিয়েছিলেন, বাতাসের চেয়ে ভারি কোনো যন্ত্র কখনোই উড়তে পারবে না, বিমানের কল্পনা কেবলই এক বুজরুকি ভাবনা। তিনি ভাবতেন, এক্স-রে হলো ধোঁকাবাজি, আর রেডিওর কোনো ভবিষ্যত নেই। লর্ড রাদারফোর্ড, অণুর নিউক্লিয়াসের জনক, আণবিক বোমা তৈরির স্বপ্নকে গালগল্প বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। রসায়নবিদরা পরশপাথরের সম্ভাব্যতাকে অসম্ভব বলে হেসেছেন কারণ ধাতুর কোনো পরির্বতন হতে পারে বলে তারা স্বীকার করতেন না। বর্তমানে অ্যাটম স্ম্যাশার এর মাধ্যমে তামার অণুকে সোনার অণুতে পরিবর্তন করা সম্ভব। আর, এ যুগের টেলিভিশন, কস্পিউটার ও ইন্টারনেটের কথা ভাবুন, কেবল গত শতাব্দিতেই এসব তো বিজ্ঞানীদের কাছে অলীক কল্পনা ছিল। উনবিংশ শতাব্দিতে বর্তমানের প্রযুক্তি সম্পর্কে এমন ভাবনা স্বাভাবিক ছিল- কারণ পদার্থবিদ্যার তত্ত্ব এবং বিজ্ঞান তখন ততটা এগোয়নি।

অসম্ভবের পাঠ

মজার ব্যাপার হলো, মানুষ যখন অসম্ভবকে বোঝার চেষ্টায় মনপ্রাণ সঁপে দিয়েছে, তখন সেটি সম্ভব করা না গেলেও অনেক ক্ষেত্রেই বিজ্ঞানের অজানা ক্ষেত্র উন্মোচিত হয়েছে। পদার্থবিদরা ‘জ্বালানীবিহীন বিরামহীন ঘূর্ণন যন্ত্র’ উদ্ভাবনে প্রচুর সময়, শ্রম, অর্থ ব্যয়ের পর যখন ভাবলেন, না, এমন যন্ত্র পদার্থবিদ্যায় সম্ভবপর নয়, তখন কিন্তু অন্য দুয়ার খুলে গেল। তখন তাঁরা শক্তি সংরক্ষণ ও তাপগতিবিদ্যার তিন নীতির দিকে এগোলেন। এভাবে একটি ব্যর্থ প্রয়াসের ফলাফল হিসেবে আমরা তাপগতিবিদ্যার মাধ্যমে বাষ্পীয় ইঞ্জিন পেলাম, যার ফলশ্রুতিতে যান্ত্রিক সভ্যতার গোড়াপত্তন ঘটলো, এলো শিল্প বিপ্লব।

উনবিংশ শতাব্দির শেষে বিজ্ঞানীরা সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে পৃথিবীর বয়স বিলিয়ন বছর হওয়া ‘অসম্ভব’। লর্ড কেলভিন ঘোষণা দিয়েছিলেন, গলিত পৃথিবীর ঠান্ডা হতে কেবল ২০ থেকে ৪০ মিলিয়ন বছর লাগার কথা। তবে ভূতত্ত্ববিদ ও ডারউইনের ধারার জীববিজ্ঞানীরা পৃথিবীর বয়স কয়েক বিলিয়ন বছরের বলে মনে করতেন। পরবর্তীতে মাদাম কুরী ও অন্যান্যরা যখন পারমাণবিক শক্তির ব্যাখা দিলেন তখন বোঝা গেল পৃথিবীর কেন্দ্র তেজষ্ক্রিয় ক্ষয়ের দরুণ সৃষ্ট তাপের কারণে অনেক বিলিয়ন বছর ধরে গলিত অবস্থায় থাকবে।

১৯২০ ও ১৯৩০ এর দশকে আধুনিক রকেটের জনক রবার্ট গডার্ড তিক্ত সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছিলেন। অন্যরা ভাবতো, রকেট কখনো পৃথিবীর আকাশসীমার বাইরে যেতে পারবে না। ১৯২১ সালে নিউ ইয়র্ক টাইমস এর সম্পাদকেরা লিখলেন: “প্রফেসর গডার্ড ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়ার মাঝের সম্পর্কটি বোঝেন না। ..... হাই স্কুলে শেখানো বিজ্ঞানের সাধারণ জ্ঞানের ঘাটতি আছে তাঁর।” দুঃখের বিষয়, একজন রাষ্ট্রনায়ক তাঁর ‘অসম্ভব’কে সম্ভব মনে করলেন – আপনারা তো জানেন, হিটলারের ভি-২ রকেট কিভাবে লন্ডনকে প্রায় ধুলিস্মাৎ করে ফেলেছিল।

অসম্ভবের পাঠ মানব সভ্যতাকে যেকোনো সময় ভিন্ন পথে নিয়ে পারে। ১৯৩০ সালে এমনকি আইন্সটাইন নিজে আণবিক বোমা তৈরিকে ‘অসম্ভব’ ভেবেছিলেন। তাঁর সমীকরণ E = mc2 যদিও অণুর নিউক্লিয়াস থেকে শক্তি তৈরির ব্যাখ্যা দিচ্ছিল, কিন্তু তা বোমা বানানোর জন্য যথেষ্ট ছিল না। বিজ্ঞানী লিও সিলার্ড তখন ১৯১৪ সালে এইচ.জি. ওয়েলস এর লেখা ‘দ্য ওয়ার্ল্ড সেট ফ্রি’ বইটির কথা ভাবছিলেন। সেখানে বলা হয়েছিল ১৯৩৩ সালে কোনো এক পদার্থবিদ আণবিক বোমা তৈরি করবেন। সিলার্ড তখন চেইন রিঅ্যাকশনের মাধ্যমে শক্তির বর্ধনের কথা ভাবলেন। এরপর সিলার্ড প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট ও আইন্সটাইনের সাথে বেশ কয়েক দফা গোপন বৈঠকে বসলেন, আর সেসাথে পরীক্ষা চালালেন। এভাবে শুরু হলো ম্যানহাটান প্রজেক্ট- এরপর আসলো হিরোশিমা-নাগাশাকি।

আসলে অসম্ভবের পাঠ প্রায়শই নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেয়। পদার্থবিদেরা অনেক সময় টি. এইচ. হোয়াইট এর বই ‘দ্য ওয়ান্স অ্যান্ড ফিউচার কিং’ এর বিখ্যাত অনুশাসন “যা কিছু নিষিদ্ধ নয়, তাই অবশ্যম্ভাবী!” এর কথা স্মরণ করেন। পদার্থবিদ্যায় কোনো নীতি যদি নতুন কোনো প্রপঞ্চের বিরুদ্ধে না যায় তাহলে ধরে নেয়া যায় এর অস্তিত্ব সম্ভব। টি. এইচ. হোয়াইটের এই অনুশাসনের একটি অনুসিদ্ধান্ত হতে পারে: “যা কিছু অসম্ভব নয়, তাই অবশ্যম্ভাবী!”।

স্টিফেন হকিংয়ের কথাই ধরা যাক না কেন। তিনি পদার্থবিদ্যার একটি নতুন নিয়ম খূুজে বের করে প্রমাণ করার চেষ্টা করলেন যে সময় পরিভ্রমণ সম্ভব নয়। নতুন নিয়মটি আসলে সময় পরিভ্রমণের বিপক্ষে। তবে বেশ অনেক বছরের চেষ্টার পরেও তিনি এই নতুন নিয়মটি প্রমাণ করতে পারলেন না। অপর পক্ষে, পদার্থবিদরা এখন এটি প্রমাণ করেছেন যে, সময় পরিভ্রমণ যে সম্ভব না এমন নীতিটি বর্তমান সময়ের গণিতের সীমারেখার বাইরে। বর্তমানে পদার্থবিজ্ঞানে এমন নীতি নেই যা সুস্পষ্ঠভাবে সময় পরিভ্রমণের অস্তিত্বের বিরোধিতা করে।

এই বইয়ের উদ্দেশ্য হলো, বর্তমানে যেসব প্রযুক্তিকে ‘অসম্ভব’ ভাবা হয় তা আসলে ভবিষ্যতে নিত্যদিনের বিষয়ে পরিণত হবে কিনা তা বিচার করা।

১ম পর্ব এখানে: Click This Link
[চলবে]
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই জুন, ২০১৫ রাত ১১:২৮
৬টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বিসিএস দিতে না পেরে রাস্তায় গড়াগড়ি যুবকের

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৫৫

আমাদের দেশে সরকারি চাকরি কে বেশ সম্মান দেওয়া হয়। আমি যদি কোটি টাকার মালিক হলেও সুন্দরী মেয়ের বাপ আমাকে জামাই হিসেবে মেনে নিবে না। কিন্তু সেই বাপ আবার ২০... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। আমের খাট্টা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৪



তাতানো গরমে কাল দুপুরে কাচা আমের খাট্টা দেখে ব্যাপারটা স্বর্গীয় মনে হল । আহা কি স্বাদ তার । অন্যান্য জিনিসের মত কাচা আমের দাম বাড়াতে ভুল করেনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডাক্তার ডেথঃ হ্যারল্ড শিপম্যান

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:০৪



উপরওয়ালার পরে আমরা আমাদের জীবনের ডাক্তারদের উপর ভরশা করি । যারা অবিশ্বাসী তারা তো এক নম্বরেই ডাক্তারের ভরশা করে । এটা ছাড়া অবশ্য আমাদের আর কোন উপায়ই থাকে না... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ইতং বিতং কিচ্ছার একটা দিন!!!

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:০৩



এলার্ম এর যন্ত্রণায় প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গে আমার। পুরাপুরি সজাগ হওয়ার আগেই আমার প্রথম কাজ হয় মোবাইলের এলার্ম বন্ধ করা, আর স্ক্রীণে এক ঝলক ব্লগের চেহারা দেখা। পরে কিছু মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কে কাকে বিশ্বাস করবে?

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৩৯


করোনার সময় এক লোক ৯৯৯ এ ফোন করে সাহায্য চেয়েছিল। খবরটা স্থানীয় চেয়ারম্যানের কানে গেলে ওনি লোকটাকে ধরে এনে পিটিয়েছিলেন। কারণ, ৯৯৯ এ ফোন দেওয়ায় তার সম্মানহানি হয়েছে।

সমাজে এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×