রান্দা, ওয়াফা আর নাদিয়ার করুণ পরিনতির পর রাজকুমারী সুলতানা একদমই ভেঙ্গে পড়লো। জীবনের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে অনেকটা মৃতপ্রায় মানুষের মত সে দিন কাটাতে লাগলো। তাদের বাসার কাজের মেয়েগুলি তার মনের অবস্থা কিছুটা বুঝতে পেরেছিল, কারণ সুলতানা আর সারা ছিল ওদের প্রতি সব সময় সংবেদনশীল এবং ওদের বিপদে আপদে উদ্বেগ প্রকাশ করতো। ফিলিপিনো কাজের মেয়ে মারসি সুলতানার মনকে শান্ত করার জন্য ওদের দেশের মানুষের গল্প বলা শুরু করলো।
একদিন মারসি বললো যে ওর জীবনের লক্ষ্য হোল টাকা জমিয়ে সে দেশে গিয়ে সেবিকার প্রশিক্ষন নিবে। এরপর আবার সৌদি আরবে এসে সেবিকার চাকরী করবে। ফিলিপাইনের মেয়েদের সারা বিশ্বে সেবিকা হিসাবে অনেক সুনাম আছে এবং এটা ফিলিপিনোদের কাছে একটা সম্মানজনক পেশা। মারসির তখনকার বেতন ছিল মাসে ২০০ ডলার কিন্তু সেবিকা হলে সে কমপক্ষে ১০০০ ডলার পাবে। এই টাকা দিয়ে সে তার পুরো পরিবারের ভরণপোষণ করতে পারবে। মারসির মুখেই সুলতানা প্রথম গৃহ কর্মীর উপর নির্যাতন সম্পর্কে জানতে পারে। মারসির ভাষ্য অনুযায়ী সুলতানাদের বাসাতে কেউ নির্যাতন করে না তবে সুলতানার বাবার দ্বিতীয় স্ত্রীর নির্যাতনের গল্প সে বর্ণনা করে। ঐ মহিলা প্রতিদিন তার কাজের মেয়েদেরকে প্রহার করে। একটা পাকিস্তানি মেয়েকে ঐ মহিলা সিঁড়ি থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিলো। ফলে মেয়েটার মাথায় ভিতর গভীর ক্ষত সৃষ্টি হয়। সিঁড়ি থেকে পড়ার পরও মহিলা মেয়েটিকে লাত্থি দিতে থাকে। পরে রাজপ্রাসাদের ডাক্তারকে দিয়ে তৈরি মিথ্যা রিপোর্টে উল্লেখ করা হয় যে মেয়েটি পরে গিয়ে ব্যথা পেয়েছে। অবশেষে তার দুই মাসের বেতন না দিয়ে মাত্র ১৫ ডলার হাতে দিয়ে তাকে দেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়। মারসি সুলতানাকে বলে যে আপনাদের বাসার কাছেই একটা প্রাসাদে মেয়েদের উপর নির্যাতন হয় যদিও আপনি তা জানেন না।
মারসি তার বাল্যকালের বান্ধবী মেডেলিনের গল্পও বলে। অভাবের তাড়নায় মেডেলিন ১৯ বছর বয়সে ফিলিপাইন থেকে গৃহকর্মী হিসাবে রিয়াদে আসে। তার কয়েক মাস পরে মারসিও রিয়াদে আসে গৃহকর্মী হিসাবে। প্রথমে সে তার বান্ধবীর সাথে ফোনে কথা বলে জানতে পারে যে সে খুব খারাপ অবস্থায় আছে। সৌদি আরবে নির্যাতিত গৃহ কর্মী যদি কোনভাবে পুলিশে অভিযোগ করতে পারে সে ক্ষেত্রেও পুলিশ সাধারণত গৃহকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় না। পুলিশ সবলের পক্ষ নেয় আর দুর্বল গৃহকর্মীকে গৃহকর্তার ইচ্ছা অনুযায়ী এবং পরিস্থিতি নিজেদের মত বিবেচনা করে হয় জেলে পাঠায় বা দেশে পাঠিয়ে দেয়।
২ মাস পরে মারসি প্রাসাদের এক ড্রাইভার, যাকে সে ভালবাসে, তার সাহায্যে লুকিয়ে মেডেলিনের বাসায় যেতে সমর্থ হয়। মেডিলিন মারসিকে বলে যে ঐ বাসায় আরও দুইজন কাজের মেয়ে ছিল যাদের বয়স ছিল আনুমানিক ২৫ বছর। একজন শ্রীলঙ্কার আর আরেকজন বাংলাদেশের। যখন সে প্রথম আসে তখন ঐ পরিবারের কর্তা, কর্ত্রী আর দুই ছেলে গেছে মক্কাতে ওমরা/ হজের জন্য। একজন বৃদ্ধা (সম্ভবত দাদি) বাসায় ছিলেন। শ্রীলঙ্কার মেয়েটি কাজ কম করে আর বেশীরভাগ সময় সাজগোজ করাতে ব্যয় করে। শ্রীলঙ্কার মেয়েটি মেডেলিনকে বলে যে বাড়ির কর্তা তাকে সবচেয়ে বেশী ভালবাসে। কর্তা তাকে বলেছে যে মক্কা থেকে ফিরে সোনার নেকলেস কিনে দিবে। মেয়েটি মেডিলিনের শরীরের বিভিন্ন স্পর্শকাতর অঙ্গ হাত দিয়ে পরখ করে আর বলে যে কর্তা তাকে পছন্দ করবে না, তবে কর্তার দুই ছেলের পছন্দ হবে। এই পরিবারটি মধ্যবিত্ত অবস্থা থেকে হঠাৎ বড়লোক হয়েছে। বছরে ৪ বার কর্তা আর দুই পুত্র ব্যাংককের পতিতালয়গুলিতে যায়। বৃদ্ধা মহিলা (দাদী) মেডেলিনকে বলে যে তার কাজ হোল দুই টিনেজ নাতির যৌন চাহিদা মেটানো। একদিন অন্তর অন্তর এক এক জনকে সেবা দিতে হবে। কিন্তু পরে ব্যাপারটাতে গৃহকর্তা হস্তক্ষেপ ক'রে তার ছেলেদের বলে যে মেয়েটি তার পছন্দ হয়েছে তাই তার ভোগের চাহিদা শেষ হলে তারা এই মেয়েকে পরবর্তীতে ভোগ করতে পারবে।
এইভাবে প্রতি রাতে নিপীড়ন চলতে লাগলো মেডেলিনের উপর। তার নিপীড়নের অভিযোগ শোনার কেউ নেই। শ্রীলঙ্কার মেয়েটা ঈর্ষার কারণে তাকে সাহায্য করতে নারাজ। বাসার অন্যান্য কর্মচারীরা চাকরীর ভয়ে কিছু বলে না। ঘরের কর্ত্রী, দাদি এরা মনে করে এই মেয়েকে আনাই হয়েছে কর্তা আর তার পুত্রদের যৌন চাহিদা মিটানোর জন্য। মেডিলিন কয়েকবার পালানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে। সে ছাদ থেকে রাস্তায় চিরকুট নিক্ষেপ করে সাহায্যের চেষ্টা করেছিল। প্রতিবেশী সউদিরা সেটা পেয়ে গৃহকর্তাকে জানালেও কোন কাজ হয় নি। বরং এই কাজের জন্য মেডেলিনকে প্রহার করা হয়।
এইসব কাহিনী শুনে আসার পর মারসি ফিলিপাইন দুতাবাসে ফোন করে সাহায্যের জন্য। তারা জানায় যে এরকম অভিযোগ প্রায়ই তারা পায়। কিন্তু তাদের করার কিছু নেই কারণ ফিলিপাইন রাষ্ট্রটি প্রবাসীদের আয়ের উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। মারসিকে অনেকে বলে যে পুলিশে অভিযোগ করলে ফল উলটা হবে। কারণ পুলিশ গৃহকর্তার কথা আমলে নিবে। সে ক্ষেত্রে মেডেলিনের আরও করুণ পরিণতি হতে পারে। মারসি মেডেলিনের মাকে চিঠি লিখে পরিস্থিতি জানায়। মেডেলিনের মা ফিলিপাইনে নিয়োগকারী এজেন্সি ও শহরের মেয়রের কাছে সাহায্যের জন্য যায়। কিন্তু তারা বলে যে তাদের কিছু করার নেই। অবশেষে ২ বছরের চুক্তি পূর্ণ করে মেডেলিন এই নির্যাতন থেকে মুক্তি পায়। পরে ঐ বাড়িতে তার জায়গায় আরও দুই জন মেয়ে নেয়া হয় যাদের বয়স তার চেয়েও কম ছিল। মারসির এতো প্রচেষ্টার পরও মেডেলিন তাকে ভুল বোঝে। সে ভাবে যে মারসি তার জন্য কিছু করে নি। মারসি পরে তাকে চিঠি লিখে সব কিছু জানায়। কিন্তু মেডেলিন তার উত্তর দেয়নি।
মারসির কাছে এই সব কাহিনী শুনে সুলতানা আর সহ্য করতে পারে না। সে মারসিকে যেতে বলে আর নিজে বালিশে মুখ গোঁজে। তার দেশের পুরুষদের এই সব জঘন্য কর্মকাণ্ডের কথা ভেবে ভেবে অনেক দিন পর্যন্ত তার মন ছিল বিষণ্ণ। পরে সে এই ব্যাপারে আরও জানার জন্য তার বান্ধবী ও পরিচিতজনদের কাছে খবর নেয়। আরও কিছু নির্মমতার কাহিনী সে জানতে পারে। শকুন্তলা নামে ভারতের একটা মেয়ের কথা সে জানতে পারে। এক সৌদি পরিবারের কাছে মাত্র ১৭০ ডলারে তাকে চিরদিনের জন্য বিক্রি করে দেয়া হয়, যখন তার বয়স ছিল মাত্র ১৩ বছর। মেডিলিনের মত তাকে প্রতি রাতে নির্যাতন করা হত। মেডিলিন চুক্তি শেষে মুক্তি পেলেও শকুন্তলার কোন মুক্তি নেই কারণ তাকে দাস হিসাবে কিনে আনা হয়েছে চিরদিনের জন্য।
এক সৌদি মা সুলতানাকে হাসতে হাসতে জানায় যে তার ছেলের যৌন ক্ষুধার জন্য মেয়ে প্রয়োজন তাই তারা থাইল্যান্ডের একটা মেয়েকে ভাড়ার চুক্তিতে এনেছে। সেই মা বলে যে সৌদি মেয়েদের পবিত্রতা রক্ষার জন্য এইভাবে সৌদি ছেলেদের মেয়ে জোগান দিতে পরিবারগুলি বাধ্য হয়। সে জোড় দিয়ে বলে যে, কার সাথে ঘুমাচ্ছে তা নিয়ে প্রাচ্যের মেয়েরা পরওয়া করে না। সুলতানার কাছে মনে হয় যে সৌদি আরবে মায়েদের কাছে ছেলে হোল রাজার মত। একদিন সুলতানা তার ভাই আলীকে জিজ্ঞেস করে, কেন সে এবং তার বাবা বছরে ৩ বার থাইল্যান্ড আর ফিলিপাইন যায়। আলী বলে যে এটা তোমার জানার দরকার নাই। তবে সুলতানা উত্তরটা জানে কারণ তার বান্ধবীদের ভাই ও বাবারাও অনুরুপ কাজ করে। ঐ দেশগুলিতে গেলে টাকা দিয়ে মেয়ে কেনা যায়।
সুলতানার বাবা তাকে বলেছে যে আর ছয় মাস পর তার বয়স যখন ১৬ হবে তখন তাকে বিয়ে দেয়া হবে। সুলতানা ভাবে আর ৬ মাস পর তার এই স্বাধীন জীবন আর থাকবে না। মাকড়শার জালে আটকা পরা একটা অসহায় পোকার মত নিজের জীবনের পরিণতির জন্য সে অপেক্ষা করতে থাকে যে জাল বুনে চলছে অন্য কেউ।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে অক্টোবর, ২০২০ দুপুর ২:১৫