আমি যখন ক্লাস সিক্সে পড়ি তখন আমাদের স্কুলে একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়েছিল। এটা ১৯৮৪ সালের ঘটনা। আমাদের স্কুলের নাম ছিল রাইফেলস পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ। এখন সেই স্কুলের নাম বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ পাবলিক কলেজ। এটা ঢাকার বিজিবির (তৎকালীন বাংলাদেশ রাইফেলস) সদর দপ্তর পিলখানার ভিতরে ৫ নাম্বার গেটের (হাজারীবাগের কাছে) পাশে অবস্থিত।
আমাদের নার্গিস ম্যাডামের আহবানে সেই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে একটা দলীয় নাচে আমাকে অংশ নিতে হয়। ম্যাডাম আগে থেকেই আমাকে পছন্দ করতেন। একদিন ম্যাডাম ক্লাস শেষে আমাকে বললেন যে আগামী কাল সকালে নার্সারি ক্লাসের বড় রুমে এসে আমার সাথে দেখা করবে। পরের দিন ম্যাডামের কথা মত সেই ক্লাসে গেলাম। দেখি আরও কিছু ছেলেমেয়ে জড়ো হয়েছে। আমি ক্লাস সিক্সে, বাকিরা কেউ ক্লাস ফাইভ, ফোর, থ্রি, টু এবং ওয়ানের বাচ্চা। এই দলে আমি ছিলাম সবার বড়। ক্লাস ফাইভের একটা ছেলে ছিল।
ম্যাডামের পরিচালনায় ঐ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সুকুমার রায়ের ‘অবাক জলপান’ নামের একটা গল্পকে এবং রবীন্দ্রনাথের ‘সামান্য ক্ষতি’ নামের একটা কবিতাকে নাটিকায় রূপ দেয়া হয়। বারবার শোনার কারণে এই নাটিকা দুটির কিছু সংলাপ এখনও আমার মনে আছে। যেমন ‘বরকে কি তোমরা বরকন্দাজ বল’ কিংবা ‘মহিষী একি ব্যবহার, গৃহ জ্বালাইয়া অভাগা প্রজার’। ‘সামান্য ক্ষতি’ নাটিকার মহিষী হয়েছিলেন ক্লাস সেভেনে পড়া একটা আপু। ক্লাস সেভেনে পড়লেও দেখতে বড় মেয়েদের মত লাগতো। রানীর মত অপূর্ব সুন্দর ছিলেন তখনই। আর রাজা হয়েছিলেন ক্লাস ইলেভেনের একটা ভাইয়া। উনিও বেশ লম্বা এবং সুদর্শন ছিলেন। দেখতে রাজার মতই লাগতো যখন রাজার পোশাক পড়তেন। এছাড়া বিখ্যাত বিদেশী রুপকথা ‘সিনডেরেলা’র একটা গান ‘Lavender's Blue’ গানটা দলীয় নাচ সহ উপস্থাপন করা হয়। এই দলীয় নাচে আমি সহ আরও ছেলেমেয়ে অংশ নেয়। এই গানের দৃশ্যটা ‘সিন্দেরেলা’ সিনেমাতে এভাবে আছে।
এই নাচের জন্য একটা করে ছেলে আর একটা করে মেয়েকে নিয়ে অনেকগুলি জুটি তৈরি করা হয়। জুটিগুলি গানের সাথে তাল মিলিয়ে একজন আরেকজনের কোমর ধরে, হাত ধরে, গায়ে গা মিলিয়ে বল ড্যান্স করবে। ম্যাডামের নির্দেশনায় বল ড্যান্স আমরা শিখে ফেললাম কয়েকদিনের মধ্যেই। আমারটা ভালো হত তাই ম্যাডাম অনেক সময় আমাকে দিয়ে অন্য জুটির মেয়েদেরকেও শিখাতেন। আমার সাথে ক্লাস ফোরের একটা মেয়েকে জুটি হিসাবে দেয়া হোল। মনে করি মেয়েটার নাম ‘স্নিগ্ধা’। আসল নামের সাথে এই ছদ্ম নামের একটা যোগসূত্র আছে। কেউ বলতে পারলে তাকে জিনিয়াস উপাধি দিব। স্নিগ্ধা আমাদের পাশের বিল্ডিংয়ে থাকতো। এই নাচের আগে ওকে অবশ্য ভালোভাবে চিনতাম না। রিহারসাল প্রায় ২/৩ মাস চলেছিল। তারচেয়ে বেশীও হতে পারে। এই নাচ যখন মঞ্চে প্রদর্শন করা হবে তার আগে আমার মা অনেক খোঁজাখুঁজি করে মার্কেট থেকে জিনসের প্যান্ট আর সাদা ফুল শার্ট কিনে দিয়েছিলেন। বাকিরাও যার যার মত কিনেছিল। এটাই নাচের পোশাক ছিল ছেলেদের জন্য । এছাড়া ‘বো’ টাই ছিল গলায়।
এই রিহারসালের ফাঁকে ফাঁকে আমরা সবাই গল্প গুজব করতাম। ধীরে ধীরে ‘স্নিগ্ধার প্রতি একটা ভীষণ টান অনুভব করা শুরু করলাম। স্নিগ্ধাও যে আমার প্রতি একটা ভালোবাসা অনুভব করছে এটা আমি তার আচরণে বুঝতে পারলাম। আমি একটু লাজুক ছিলাম তখন । এখন অবশ্য জীবনের ঘাত প্রতিঘাতে লজ্জা শরম কমে গেছে। তাই ঐ সময়ে কখনই এই ভালালাগার অনুভূতি তাকে সরাসরি বলতে পারি নাই। সেও মুখ ফুটে কিছু না বললেও আচরণের মাধ্যমে তার ভালোবাসার অনুভূতি প্রকাশ করতো। তবে রিহার্সালের সময় অনেক হাসি ঠাট্টা আর গল্প করতাম দুজনে । নাচের মধ্যেও কথা থামতো না আমাদের। ওর ক্লাসে আমার ছোট ভাই পড়তো। ওর ক্লাসে গেলে সে আমাকে অনেক সময় তার টিফিন সাধতো।
স্নিগ্ধা আর আমি একই স্কুল মাইক্রোবাসে যাতায়াত করতাম। পিছনে বসতো মেয়েরা। আমার চেয়ে বড় কয়েকটা আপু ছিল। তারাও বুঝতো কিছু একটা চলছে আমাদের দুজনের মধ্যে। তারাও মাইক্রবাসের মধ্যে আমাদেরকে নিয়ে টিপ্পনী কাটতো আকারে ইঙ্গিতে । আমার বাসার পরে হোল স্নিগ্ধাদের বাসা। আমার বাসার সামনে মাইক্রোবাস আসলে স্নিগ্ধা প্রায়ই উচু গলায় ড্রাইভারকে বলত ‘আঙ্কেল এখানে থামাবেন না’।
নাচের অনুষ্ঠানটা সুন্দরভাবেই হয়েছিল। এই নাচের অনুষ্ঠান শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও আমাদের মধ্যে চোখে চোখে ভালোবাসা চলত দূর থেকে। একই স্কুলে পড়তাম তাই টিফিন টাইমে চোখাচোখি হত। নাচের অনুষ্ঠান শেষ তাই কথা বলতে উভয়েরই লজ্জা লাগতো। কারণ আগে কথা বলার একটা অসিলা ছিল এখন সেটা নেই। কিন্তু কোন অদৃশ্য টানে আমরা একে অন্যের কাছে থাকার চেষ্টা করতাম সব সময় । বিকালে সে আমাদের বাসার কাছে চলে আসত খেলার ছলে। পুরোটাই হৃদয়ের নিখাদ ভালোবাসা। কারণ প্রেমের শারীরিক ব্যাপারটা আমাদের কেউই তখন বুঝতাম না। আমিও স্নিগ্ধাদের বাসার আসে পাশে ঘুরঘুর করতাম বিভিন্ন অসিলায়। বাসার সামনে একসাথে কুতুকুত খেলতাম মাঝে মাঝে সবার সাথে। স্নিগ্ধা স্কুলে কোন কারণে না আসলে আমার সেই দিনটাই মাটি হয়ে যেত। স্কুলে যাওয়া আমার জন্য একটা আনন্দের ব্যাপার হয়ে গিয়েছিল। অথচ আগে স্কুল ফাঁকি দেয়ার প্রবণতা ছিল আমার মধ্যে।
কিশোর বয়সে বছর খানেক এই মধুর সময় আমার জীবনে এসেছিল। তারপরে আমি স্কুল পরিবর্তন করে অনেক দূরে অন্য স্কুলে চলে যাই। তারপর থেকে আর স্নিগ্ধার সাথে যোগাযোগ নাই। ছোট ছিলাম, মোবাইল ইন্টারনেটও ছিল না তাই যোগাযোগ করার সুযোগও ছিল না। অনেক বছর পরে অন্যের মুখে শুনেছি সে বিয়ে করেছে। কিন্তু ঠিকানা দিতে পারেনি কেউ। পরবর্তী সময়ে অনেক দিন আমি তাকে ফেইসবুকে খোঁজার চেষ্টা করেছি কিন্তু ব্যর্থ হয়েছি । স্নিগ্ধাকে খুজেছি তার সাথে প্রেম করার উদ্দেশ্যে না শুধু কৌতূহল থেকে। স্নিগ্ধা কেমন আছে সেটা তার মুখ থেকে শোনার জন্য। তার সাথে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক যদি চালিয়ে যেতে পারতাম তাহলে কতই না ভালো হত। যদিও আমাদের এই সমাজে এটা একটা সমস্যা হতে পারে। আমার স্ত্রীকে এই কাহিনী বলেছি। সে শুনে খুব মজা পায় আর হাসে।
আমার আর স্নিগ্ধার এই ভালোবাসা বা প্রেম ছিল নিখাদ আর হৃদয় নিঃসৃত। শৈশবের এই প্রেমকে পৃথিবীর কোন পঙ্কিলতা স্পর্শ করতে পারেনি। তাইতো এত বছর পরেও এই মধুর প্রেমের স্মৃতি আমাকে নস্টালজিক করে।
ছবি - jonathanolley.co.uk এবং মাগুরা নিউজ
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই মে, ২০২৩ দুপুর ২:১৭