ঢাকার একটা কলেজে ইন্টারমিডিয়েট সেকেন্ড ইয়ারে পড়ছে শুদ্ধ। আজ বছর দু’য়েক ধরে পরিবার থেকে বাইরে এসে পড়াশোনা করছে। ফাইনাল পরীক্ষা শেষ করে আজ গ্রামের বাড়ী ফেরার পালা। বাড়ীর কথা মনে পড়তেই মন খারাপ হয়ে গেল শুদ্ধ’র। বোনের কথা মনে পড়ছে খুব, ওর পিঠাপিঠি বোন। প্রতিদিন কলেজ শেষ করে মেসে ফিরলেই বোনের কথা মনে পড়ে শুদ্ধ’র। তখন প্রচন্ড একা-একা লাগে। নিঃসঙ্গতা আর বোনের স্মৃতি মনে পড়লে কেমন যেন সব ফাঁকা-ফাঁকা লাগে। সারাদিন কলেজের ব্যস্ততায় সব ভুলে থাকলে ও মেসে ফিরলেই সে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে। এমন ঝিম মেরে বসে থাকা যে সবার চোখে লাগে তা ও সে ভালই বুঝতে পারে। তাই স্বাভাবিক থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করে যায় শুদ্ধ।
কিন্তু তা কি করে সম্ভব! তার সব কিছুতেই যে তার বোনের স্মৃতি জড়িয়ে আছে। বোনকে খুজে পায় সে সব যায়গায়। আজ মাস তিনেক হয় তার বোন চলে গেছে না ছোয়ার দেশে, আর স্মৃতির সাথে যুদ্ধ ও চলছে তাই তিন মাস থেকে। বারে বারে কেবল ছোটবেলার একটা কবিতাই তার মাথায় ঘুড়পাক খায় -
বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ঐ
মাগো আমার শোলক বলা কাজলা দিদি কই?
পুকুর পাড়ে, নেবুর তলে, থোকায় থোকায় জোনাক জলে-
ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না, একলা জেগে রই;
মাগো আমার শোলক বলা কাজলা দিদি কই? ||
আজ বাড়ী ফিরে সে বোনকে দেখতে পাবেনা, ভাবতেই প্রচন্ড কষ্ট হয় শুদ্ধ’র। এরকম বাড়ী ফিরার দিনগুলো কতই না মধুর ছিল একটা সময়। তাকে এগিয়ে নেয়ার জন্য সকাল থেকেই রেলষ্টেশনে অপেক্ষা করতো তার বোন। ষ্টেশন থেকে বাড়ী ফেরার পথেই জানা হয়ে যেতো গ্রামের কোথায়
কি হচ্ছে, কোন পাখী কোথায় ডিম পেড়েছে, ফুটবল টূর্ণামেন্টে কারা জিতেছে, কার বিয়ে হয়েছে, কে নতুন জমি কিনেছে, কার জমিতে বেশি ধান হচ্ছে, আজ
মা কি রান্না করেছে- সব। অথচ আজ কেউ নেই কোন খবর দেবার।
বৃষ্টির দিনে বোনের সঙ্গ ছিল ভীষণ মজার। কি অদ্ভুত, আজ ও বষ্টি হচ্ছে, বর্ষার প্রথম বষ্টি। একটা সময় ছিল যখন বর্ষা মানেই ছিল অনেক মজার মজার দিন। শুদ্ধদের বাড়ীর পাশেই ছিল বিশাল এক পুকুর। বৃষ্টি বেশি হলেই পুকুরের পানি বেড়ে গ্রামের পথে উঠে যেত। আর পুকুর থেকে বের হয়ে পড়তো ঝাকে ঝাকে মাছ। শুদ্ধ ছোটবেলাতে বোনের সঙ্গে কতো যে মাছ ধরেছে সে পুকুরে, কখনো জাল পেতে, আবার কখনো বা বড়শি পেতে। সারাদিন পুকুরের পানিতে দাপাদাপি করেছে, পুকুরে সাঁতার শিখেছে বোনের হাত ধরে।তারপর দুপুরে বাড়ী ফিরে মায়ের হাতের ডিম ভুনা আর পাতলা খিচুরি খেয়ে বৃষ্টির দিনগুলোকে উদযাপন করেছে।
ট্রেনের জানালা দিয়ে হঠাৎ বাইরে চোখ যায় শুদ্ধ’র। একটা বাইশ-তেইশ বছরের মেয়ে গ্রামের ছোট একটি রেলষ্টেশনে দাঁড়িয়ে ট্রেনের যাত্রীদের হাত
নেড়ে বিদায় জানাচ্ছে। মেয়েটির পেছনের চা স্টলের কাস্টোমারদের নির্লিপ্ততাই জানান দিচ্ছে মেয়েটি সুস্থ নয়। এরকমটি প্রতিদিনই দেখে অভ্যস্ত তারা । কিন্তু অদ্ভুত মায়াময়ী এই মেয়েটিকে দেখেই শুদ্ধ ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়, তার কেমন যেন ধাক্কা মতোন লাগে। এমন মমতা মাখানো একটা চেহারার লাবণ্যতা রোদ-বৃষ্টির কাছে হার মানার কি কারণ থাকতে পারে ভেবেই শুদ্ধ’র অস্থির লাগে। হয়তো এই মেয়েটির ও একটা পরিবার ছিল। বাবা-মায়ের আদরের মেয়ে ছিল হয়তো; যার কলিজার টুকরো একটা ছোট
ভাই ছিল। ভাইটি হয়তো হারিয়ে গেছে না ছোয়ার দেশে, যাকে মেয়েটি খুজে ফিরে এই ট্রেন যাত্রীদের ভীড়ে, লাখো ভাইদের ভীড়ে, যাকে সে বিদায় জানায় অশেষ মমতায়। হয়তো আশায় আছে কোন একদিন ভাইটি ট্রেন
থামিয়ে নেমে বলবে “কিরে বুবু কেমন আছিস? জ়ানিস তোকে এতোদিন না দেখে না আমার কলিজাটা শুধো পুড়তো। তাই আমি ফিরে এসেছি তোর জন্যে।”
হয়তো মেয়েটি বাস্তবতাকে মেনে না নেয়ার দলে। তাই হয়তো লোকে মেয়েটিকে পাগল ভাবে। কি অদ্ভুত এসব নিয়ম-কানুন! যারা সব কিছুকে সহজে মেনে নিয়ে এগিয়ে যায়, লোকে তাদেরই পিঠ চাপড়ে দেয়। শুদ্ধ ও তাদের দলেই থাকতে চায়। তাই অস্থিরতাকে আড়াল করে হাসি-হাসি মুখ
রাখার চেষ্টা করে যায় সে। মেয়েটির সাথে নিজের মিল খুজে পেয়ে শুদ্ধ’র কেমন যেন অস্থির লাগে। বোনকে নিয়েই সে ভাবতে থাকে। বোন ছাড়া যে সব অর্থহীন মনে হয় তার। তাই আজ আর নৌকা ভাসানো হয় না, হয় না বৃষ্টিতে ভিজে গরুর বাছুর খুজতে বের হওয়া, আমের ভর্তা নিয়ে কাড়াকাড়ি ও হয় না, শিলা বৃষ্টির দিনেও হয়না কারো সাথে শিলা ছুড়াছুড়ি । শুদ্ধ’র কান্না পেতে থাকে। নিজেকে সে বোঝানোর চেষ্টা করে যে সে পুরুষ মানুষ, শক্ত
ধরনের পুরুষ। আর তখনই সে পরিষ্কার বুঝতে পারে আদতে সে শক্ত নয়, বোন হারানো এক অভিমানী ভাই সে; যে সারাদিন শক্তের অভিনয় করে রাতে বোনকে ফিরে পাবার স্বপ্ন দেখে। পরের রাতে ও একই স্ব্প্ন দেখে, তার পরের রাতেও, এবং তার পরের রাতেও। শুদ্ধ ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে। সে কি বৃষ্টি দেখছে নাকি অদৃশ্যে কিছু খুজছে তা তার জানা নেই। কাগজের নৌকা বানিয়ে পানিতে ভাসানো দিনগুলোতে ফিরে যেতে সেএক ধরনের তীব্র তৃষ্ণা বোধ করে, বোনের সঙ্গ পেতে তীব্র অভিমানে তার গলাটা ধরে আসে, নাকের ফুটো দু’টো তার ফুলে-ফুলে উঠে। তবু সে দাতেঁ-দাঁত চেপে থাকে। তার মাথায় ঘুড়তে থাকে-
মাগো আমার শোলক বলা কাজলা দিদি কই?
মাগো আমার শোলক বলা কাজলা দিদি কই? ||