২০০১ সালের কথা, আমি কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমার স্কুলের লেখার বোর্ড গুলো ছিল ব্ল্যাকবোর্ড, কিন্তু কলেজের বোর্ডগুলো হোয়াইট বোর্ড। দেখতে ভালোই লাগে। কিন্তু বিধি বাম, স্যাররা বোর্ডে যাই লিখে আমি পেছনের বেঞ্চি থেকে কিছুই দেখিনা, মনে হয় স্যারেরা বোর্ডে লিখার অভিনয় করে, আসলে কিছুই লিখে না। কিন্তু আমার পাশে বসা বন্ধুরা আবার স্যারের অদৃশ্য লেখা সবই দেখে দেখে লিখে ফেলছে আর আমি কিছুই দেখছি না, পাশের বন্ধুর খাতা দেখে লিখছি। হায়! তারপর একদিন ডাক্তারের কাছে চোখ দেখিয়ে জানলাম আমার চোখেই সমস্যা, দূরের জিনিস আমি কম দেখছি।
পরদিন আমি চশমার গ্লাস লাগিয়ে চশমা চোখে প্রথম আবিষ্কার করলাম নিচের মেঝে স্বাভাবিকের চেয়ে হঠাৎ উপরে উঠে গেছে! হালকা বিভ্রান্ত হয়ে দোকানের বাইরে তাকিয়ে তো আমি হতভম্ব! রাস্তার ওপাড়ের দোকানের সাইন বোর্ডের লিখাগুলো সব স্পষ্ট! এতদূরের লেখাও যে পড়া যায়, তা আমার ধারণারই বাইরে ছিল। আমি চিৎকার করে আমার মা’কে বললাম “আম্মা আমি ঐ দোকানের লেখা গুলো পড়তে পারছি, আমি সত্যি পড়তে পারছি!!!”
আমাদের জানার কত ভূল থাকতে পারে, তাই না! যে জিনিস সম্পর্কে কিছুই জানিনা, সে জিনিস নিয়ে মন্তব্য করে ফেলি অবলীলায়। অথচ এ বিষয়ে জ্ঞান থাকা তো দূর, অনুমান করাও যে আমার জন্য অসম্ভব। যেমন: কুয়ার ব্যাঙ। তার কাছে আকাশের আকার তো ঐ কুয়ার ব্যাসের সমানই। বাইরের এই সুবিশাল আকাশ সম্পর্কে তার কোন ধারণাই নেই।
আমাদের ও একই অবস্থা। যে বিষয়ে আমরা জানিনা, সে বিষয়ে জানার চেষ্টা ও খুব কম করি, কিংবা অনেক ক্ষেত্রে আমাদের জানার মধ্যে যে ভুল আছে তাই জানিনা, হয়তো কখনো কখনো ধারণা ও করতে পারি না। কিন্তু অভিজ্ঞ মন্তব্য দিয়ে বসে থাকি।
যেমন ধরা যাক গতপরশু দিনের রাজাশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হত্যার ঘটনাতে ফেসবুক পেজে অনেককেই খুশি হতে দেখেছি। অনেকেই মন্তব্য করেছে ইসলাম ধর্ম রক্ষার জন্যে এটি করা হয়েছে, ভবিষ্যতেও চলবে। কিন্তু এভাবে ইসলাম রক্ষার আবরণ দেওয়া কি ঠিক হল? কিভাবে এরকম কাপুরুষোচিত হত্যাকে ইসলাম ধর্ম রক্ষার নামে জায়েজ করা যায়! ইসলাম ধর্ম কি কখনো কাপুরুষের মতো পেছন থেকে হামলা করাকে প্রশ্রয় দেয়? হত্যা করাকে কোথায় ইসলাম ধর্ম প্রশ্রয় দিয়েছে? শান্তির ধর্ম ইসলামের নাম ব্যবহার করে এসব ঘটনা যারা ঘটাচ্ছে, তারা যে আদতে ইসলামেরই ক্ষতি করছে, তাতো নিশ্চিত ভাবেই বলা যায়। আজকে মুসলমানদের মৌলবাদী হিসেবে, ‘জঙ্গী’ হিসেবে বিশ্বব্যাপী ট্যাগ লাগানোর পেছনে তো এই কূপমণ্ডূকদের এসব কর্মকান্ডই দায়ী।
ক’দিন আগে প্রথমে রাজিব হায়দারকে নাস্তিকতার নামে খুন করা হলেও ফারুকী সাহেবদের মতোন উলামা মাশায়েখদেরও আমরা এ তালিকায় দেখেছি। আর তারপরে আশরাফুল আলম ও শফিউল ইসলামকে হত্যা কেবল এই ভ্রান্ত গোষ্ঠীর ইসলামের খোলস পরে ইসলামের নীতি-নির্দেশনার অবমাননা করারই ইঙ্গিত দেয়। আর এর বিরুদ্ধে প্রতিটি সচেতন মানুষের নিজ নিজ জায়গা থেকে যদি এখনি প্রতিরোধ/প্রতিবাদ করা না হয়, তবে সে তালিকায় যে আপনি-আমি কখনো চলে আসবো না তার নিশ্চয়তা কি দেবে?
এ প্রসঙ্গে জার্মান ধর্ম যাজক মারটিন নিমলা’র বিখ্যাত উদ্ধৃতির কথা মনে পড়ছেঃ
“প্রথমে তারা নাৎসি কমিউনিস্টদের ধরে নিয়ে যায়,
আমি চুপ ছিলাম;
কারণ আমি কমিউনিস্ট না।
তারপর তারা সামাজিক গণতন্ত্রীদের ধরে নিয়ে যায়,
আমি চুপ ছিলাম;
কারণ আমি সামাজিক ডেমোক্র্যাট না।
তারপর তারা শ্রমিক সংগঠকদের ধরে নিয়ে যায়,
আমি চুপ ছিলাম;
কারণ আমি ট্রেড ইউনিয়নে যুক্ত না।
তারপর তারা ইহুদিদের জন্য আসেন,
আমি চুপ ছিলাম;
কারণ আমি ইহুদী না।
তারপর তারা আমার জন্য আসেন,
আমার জন্য কথা বলতে আর কেউ বাকি ছিলনা।”
এখন সিদ্ধান্ত আপনার, তালিকাতে আপনার নাম আসার জন্য অপেক্ষা করবেন নাকি রুখে দাঁড়িয়ে নিজেকে ও ইসলামকে সমুন্নত রাখবেন।