somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

এম. এ. সামাদের গল্প : ক্লেদাক্ত সময়ের পরিশীলিত বয়ান

২৪ শে এপ্রিল, ২০১১ সকাল ৮:২৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

গল্প শোনার আগ্রহ মানুষের চিরন্তন। শৈশবে মা-বাবা, দাদা-দাদি, নানা-নানির কাছে গল্প শুনতে শুনতে গল্পের প্রতি যে আগ্রহ ও ভালোবাসা জš§ায় তা থেকে যায় জীবনের শেষ দিনটিতেও। এই ভালোবাসা কখনো মøান হয় না, চিড় ধরে নাÑচিরভাস্বর। অশীতিপর বৃদ্ধও গল্পের গন্ধ পেলে নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হন।
কখন থেকে গল্প লেখার সূত্রপাত তা সঠিকভাবে বলা না গেলেও কখন থেকে গল্প বলা হচ্ছেÑবলা যায় খুব সহজেই। সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকে কিংবা তারও আগ থেকেই শুরু হয়েছে গল্প বলা। বলা শোনা। গল্প বলা এবং শোনার যে আনন্দ মূলত তা থেকেই সূচনা ঘটেছে গল্প লেখার। একই গল্প যাতে দীর্ঘদিন যাবত অনেক মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারে সে জন্যই গল্প লেখার আয়োজন। বলাবাহুল্য পৃথিবীজুড়ে গল্পসাহিত্য দারুণ জনপ্রিয়। সেটা প্রেমের গল্পই হোক, রূপকথার গল্পই হোক, ভূতের গল্প গল্পই হোক বা রহস্য গল্প...।
গল্প লেখার, গল্প পাঠের এই বানের মধ্যে ছোট-বড় সবার এখনো গল্প বলার, গল্প শোনার প্রতি ঝোঁক আছে। তবে অধিকাংশ মানুষ বলার চেয়ে শুনতেই বেশি পছন্দ করে। আজো বাংলার নিভৃত পল্লী কিংবা হাইরাইজ বিল্ডিংয়ে বড়দের কাছ থেকে শিশুরা গল্প শোনেÑএক দেশে ছিলো এক...। ‘আধুনিক’ অভিভাবকরা হয়তো ঠাকুর মার ঝুলির বদলে সুপারম্যান, হ্যারি পটার বা এ জাতীয় গল্প শোনান।
শিশুদের সচরাচর রূপকথার গল্প, নীতিকথামূলক বা কৌতুকধর্মী গল্প শোনানো হয়। এসব গল্প শুনতে শুনতেই বড় হয় শিশুরা। বড় হয়ে আরো নতুন নতুন, বিভিন্ন রকম গল্পের সাথে তার পরিচিত ঘটে। কেউ কেউ চলে যায় খুব গভীরে...।
গল্পের ফর্ম বা আঙ্গিক অনেক রকম। একেক গল্পকারের গল্প বলার ভঙ্গি একেক রকম। কেউ কেউ সচেতনভাবেই চেষ্টা করেন নিজস্ব একটা কণ্ঠস্বর বিনির্মাণের।
নিরীক্ষা কিংবা গল্পের ব্যাকরণের ধার না ধেরেও কেউ কেউ গল্প লেখেন। প-িতের ভ্রƒকুটি কিংবা কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে। অনেকটা কথা বলার মতোÑযেন গল্প লেখা হচ্ছে না, বলা হচ্ছে। পাঠক তথা শ্রোতা বসে আছেন কথক তথা লেখকের সামনে। সে রকমই একটা গল্পের বই শনিবারের ছুটি। এম. এ. সামাদ’র লেখা শনিবারের ছুটি বইটিতে স্থান পেয়েছে মোট ৫৩টি গল্প। খুবই সাদামাটাভাবে দিনপঞ্জিকার আদলে লেখা এ গল্পগুলো হয়ে উঠেছে আনন্দ-বেদনা, জীবনজিজ্ঞাসা, যাপিতজীবনের নানা রকম ক্লেদ, অপ্রাপ্তি-অপূর্ণতা, জেনারেশন গ্যাপ, নাগরিক জীবনের সংকট ইত্যাদির অসামান্য সম্মিলন। মানুষের মনের অন্দরে খুব সহজেই উঁকি মারার দুর্লভ গুণ রয়েছে লেখকের। তাঁর প্রাজ্ঞ চোখে অনেককিছু ধরা পড়েছে, যা কেউ কেউ মাইক্রোস্কোপ ব্যবহার করেও দেখতে পান না বা পাবেন না। সমালোচকরা ‘খুঁত’ ধরতে চাইলে নিরাশ হতে হবে না; তাঁর সব গল্প হয়তো গল্প হয়ে ওঠেনি। কাছাকাছি যায়নি প্রচলিত ঢঙের গল্পের। কোনো গল্প হয়তো সংবাদধর্মী, মন্তব্যধর্মী কিংবা বিশ্লেষণের মতো হয়েছে। তবু একথা নির্দ্বিধায় বলা, লেখার ক্ষেত্রে এম. এ সামাদ সৎ ছিলেন বলেই তাঁর রচিত বইটি হয়ে উঠেছে সুখপাঠ্য। আলগা প-িতি কিংবা কোনো বিষয়ে সবক দান করার চেষ্টা করেননি। এটাই হয়ে উঠেছে তাঁর গল্পের বড় একটি গুণ তথা বৈশিষ্ট্য। সবচেয়ে বড় কথা গল্পে চমক বা নতুনত্ব সৃষ্টি নামে কোনো কল্পকল্পিত গল্প রচনা করতে হয়নি তাকে। ঘটনা ও চরিত্রগুলো বাস্তব। আমাদের চারপাশের মানুষ। এদের প্রত্যেকের বাস্তব অস্তিত্ব রয়েছে। এক সম্পাদক বলেছিলেন, দৈনন্দিন জীবনের অনুজ্জ্বল ঘটনাগুলোই সত্যিকারের গল্প। এ কথার সত্যতা কিংবা বাস্তব প্রয়োগ বোঝা যায় এম. এ. সামাদ’র কুশলী কলমে লেখা গল্পগুলোয়।
প্রায় সব গল্পই তাঁর জীবনের। ব্যক্তিগত জীবনের ‘ন্যাতানো’ আখ্যান। আত্মকথনের ভঙ্গিতে লেখা। কিছু গল্প মানবজীবনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম দিকের অনুপম বিশ্লেষণাত্মক। এরকমই একটা গল্প বিপদের দিনে। বাংলাদেশের সব শ্রেণীর মানুষেরই বিপদ নিত্যসঙ্গী। পার্থক্য হচ্ছেÑকেউ এ ‘সঙ্গী’টির দেখা বেশি পান আর কেউ একটু কম। বিপদের দিনে স্বভাবত মানুষ মুষড়ে পড়ে, ভেঙে পড়ে। এসময় অবিবেচক পাড়াপ্রতিবেশী এবং নিকটাত্মীয়রা পরিস্থিতি অনুধাবন না করে উল্টো বিপদে পড়া মানুষটিকেই দোষারোপ করে। এতে সেই মানুষটির মনে অপরাধবোধ জš§ায় সে আরো ভেঙে পড়ে। হারিয়ে ফেলে মানসিক শক্তি। অ্যাক্সিডেন্ট করে যখন কারো সন্তান মারা যায় তখন মানুষের মনের যে অবস্থা হয় তা এক কথায় অবর্ণনীয়। এ অবস্থায় যদি কোনো আত্মীয় বা দর্শনার্থী বলে বসে, আপনি ওকে ওই কাজে পাঠাতে গেলেন কেন, না পাঠালে তো এমনটা হতো না! স্বাভাবিকভাবেই শোকগ্রস্ত মানুষটির শোক আরো বেশি বাড়বে। মানুষের এই অসচেতনতা, সান্ত¡নার বদলে তারা নিজের অজান্তেই বাড়িয়ে দিয়ে যায় শোকগ্রস্তের শোক। অথচ হওয়া উচিত ছিলো উল্টোটা। তাহলে তুলনামূলক সহজে মানুষ ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি অর্জন করতে পারতো। বাস্তব এ সমস্যার প্রতি আলোকপাত করে লেখক এম. এ. সামাদ প্রমাণ করেছেন নিজের সংবেদনশীলতা। পাশাপাশি পরোক্ষভাবে পাঠকদেরও সচেতন করে তুলতে চেয়েছেন। তাঁর এই পজিটিভ দৃষ্টিভঙ্গি প্রশংসাযোগ্য।
চিকিৎসাবিজ্ঞানে পড়াশোনা যারা করেন, তাদের প্রায় সবাইকেই কঙ্কালের মুখোমুখি হতে হয়। এনাটমি ক্লাসে। এ ক্লাসে শিক্ষক শিক্ষার্থীদের কঙ্কালের বিভিন্ন অংশে অঙ্গুলি দ্বারা বুঝিয়ে দেন মানুষের শারীরিক গঠন, শরীর নামের কারখানা কীভাবে কাজ করে তা। কিন্তু শিক্ষক বা শিক্ষার্থী কেউই কি ভেবে দেখেন এ কঙ্কাল তথা লাশটি কার? কোত্থেকে এলো, কীভাবে এলো? এ কঙ্কালের প্রকৃত ‘মালিক’ কে ছিলো। এটা কি কোনো বাস্তুহারার লাশ নাকি জীবনযুদ্ধে পরাজিত মানুষের দুর্ঘটনায় পড়া লাশ? লেখক খুব চমৎকারভাবে এ প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেনÑ
বাংলার পথে-প্রান্তরে এরকম বেওয়ারিশ লাশের কি কোনো হিসেব আছে? তবে, কঙ্কালটি যারই হোক না কেন, এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়Ñএটি কোনো ভাগ্যবানের লাশ নয়, উঁচুতলার মানুষের লাশ নয়।
আসলেই তাই। সীমাহীন দারিদ্র্যের এই দেশে সম্পদের যে অসম বণ্টন তা এক কথায় লজ্জাজনক। কখনো কখনো বিপজ্জনকও বটে। কেউ প্রাসাদোপম বাড়িতে সুখনিদ্রা যায় আবার কারো বা নিদ্রাভঙ্গ হয় সে প্রাসাদের ছাদ থেকে গড়িয়ে পড়া পানির কারণে। বস্তি এবং রাজপ্রাসাদতুল্য বিল্ডিংয়ের কী নির্লজ্জ সহাবস্থান! দারিদ্র্যকে কি কঠোরভাবে উপহাস করা হচ্ছে। দারিদ্র্যদীর্ণ এদেশে বেঁচে থাকাই সংবেদনশীল মানুষের জন্য লজ্জার।
বইয়ের সূচনা গল্প শেষ মুহূর্ত। বাঙালি জীবনে শেষ মুহূর্ত যে কত গুরুত্বপূর্ণ তা সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে এ গল্পে। সময়ের কাজ আমরা সময়ে করতে পারি না। শেষ মুহূর্তে এসে সচেতনতা বেড়ে যায়। শেষ মুহূর্তের জন্য অনেক সময়ই টান-টান উত্তেজনা নিয়ে অপেক্ষা করতে হয়। যেমনÑসিনেমার শেষ দৃশ্য, নির্বাচনী ফলাফল ঘোষণার মুহূর্ত, শেষ বিদায়, শেষ নিঃশ্বাস, শেষ কথা ইত্যাদি।
প্রকৃতির প্রতিশোধ সময়ের আবর্তনে মানুষের যে ডাবল স্ট্যান্ডার্ড চরিত্র প্রকাশ পায়Ñতার গল্প। প্রায় প্রতিটি মানুষই ডাবল স্ট্যান্ডার্ড তথা এক সাথে সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী দুটি ধারা বহন করে চলেছে। কোনো কাজে অন্য কেউ অর্থাৎ গার্জিয়ান শ্রেণীর কেউ বাধা দিলে সঙ্গত কারণেই মানুষ বিরক্ত হয়। ভাবে এটাই তো স্বাভাবিক। এতে বাধা দেয়ার কী আছে! কেউ কেউ পরিকল্পনা করে ফেলে, যে যে কাজের জন্য সে বাবা-মা, আত্মীয়স্বজন কর্তৃক বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বড় হলে তার সন্তানদের ক্ষেত্রে সে এমনটি করবে না। আইনকানুন ‘শিথিল’ করবে। শেষপর্যন্ত তা আর হয়ে উঠে না। কোনো তরুণ-তরুণী হয়তো দীর্ঘদিন প্রেম করেছে। এবার বিয়ে করতে চায়। কিন্তু অবধারিতভাবে দু পরিবার থেকেই বাধা আসবে। এটা গার্জিয়ানদের গোঁয়ার্তুমি বা উটকো খবরদারি মনে করে প্রেমিক জুটি। কালের আবর্তে, সময়ের ফেরে তারাই যখন আবার বাবা-মা হয়, তাদের সন্তানরাও অনুরূপ কা- ঘটায়Ñতখন বাধার দেয়াল হয়ে দাঁড়ায় তারাই! এই যে দ্বিমুখী মানবচরিত্র তা হয়তো অনিবার্য। চিরকাল এমনটা হতেই থাকবে। সারা জীবন মানুষ এক মতে বা এক আদর্শে থাকতে পারে না। সময়ের সাথে সাথে তার চিন্তাচেতনার পরিবর্তন ঘটে। বলা যায় এটা প্রকৃতির অমোঘ এক বিধান।
বইয়ের নামগল্প শনিবারের ছুটি। গল্পে বিধৃত হয়েছে চাকরিজীবী এক মানুষের মুখাবয়বের ছিটেফোঁটা। চাকরি অনেক সময়ই মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতা নষ্ট করে দেয়। আক্রার বাজারে চাকরি বাঁচানোর তাগিদে মানুষকে বসের মন রক্ষার ‘কম্প্রোমাইজ’ করতে হয়। এ আনুগত্যটুকু দেখাতে গিয়ে চাকরীজীবী নামের প্রাণীটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে সমাজ থেকে, নিজ পরিবার থেকে। অফিসের বস হিসেবে লেখক তাঁর এক অধস্তন কর্মীকে অফিসে দেরি করে আসার জন্য বকেছেন। যদিও কর্মীটি বাস্তবিক কারণে দেরি করতে বাধ্য হয়েছে। যা লেখক পরে অবগত হয়েছেন। তাঁর অনুশোচনাটুকু ধরা পড়েছে এভাবেÑ
‘বস’ হিসেবে না হয় আমি ঠিকই করলাম, কিন্তু সেও যে একজন স্বামী এবং সন্তানের পিতা, তা কি আমি একটিবারও ভেবে দেখেছি? এদের জীবনের হাজারো দুঃখ এবং অভিশাপের মধ্যে এতটুকু আনন্দ কি আমরা সহ্য করতে পারি না? প্রতি শনিবার যুবকটির স্ত্রী হয়ত তার স্বামীর আগমনের প্রতীক্ষায় অধীর হয়ে থাকতো!
শেকড় গল্পে আছে শেকড়ে ফেরার জন্য একজন বয়স্ক মানুষের আকুতি আর হাহাকারের যুগপৎ মিশেল। শৈশব, গ্রামের বাড়ির মধুমাখা দিনগুলো তার সামনে ভেসে ওঠে একে। মায়ের বানিয়ে দেয়া পিঠা খাওয়া, অবারিত ধানক্ষেতের মাঝে বালকের অবাধ বিচরণ, বর্ষার বৃষ্টিতে ভেজা, মাছ শিকারÑসেলুলয়েডের ফিতার মতো ফিরে আসে একে একে। শৈশবের এই স্মৃতিটুকুই মানুষের জন্য সঞ্জীবনী সুধা। এক চিলতে অবকাশে মধুর আবেশ। এ এক চিরন্তন অনুভূতি। সর্বজনীন এর আবেদন।
একজন মুক্তিযোদ্ধা তারামন বিবি। পরবর্তীকালে রাষ্ট্রীয়ভাবে বীরপ্রতীক খেতাব পেয়েছেন। কুড়িগ্রাম জেলার এ লড়াকু নারী দীর্ঘদিন যাবত জানতেও পারেননি তিনি যে রাষ্ট্রীয় খেতাব পেয়েছে। যে পুরস্কার অনেক সম্মানের। গৌরবেরও। তারামন বিবি গল্পে উঠে এসেছে তারামন বিবির দুঃসহ দারিদ্র্য, তাকে নিয়ে করা ক্লেদাক্ত রাজনীতি। ব্যক্তি তারামন বিবির জন্য কেউ কিছু না করলেও তার মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়কে ব্যবহার করে সভামঞ্চে উপস্থাপন করা হয়েছে। তারামন বিবি উঠতে বাধ্য হয়েছেন রাজনৈতিক সভামঞ্চে। কিন্তু তারামন বিবির ভাগ্য পাল্টায় না, তারামন বিবিরা পাল্টান না। জীবনযাপনের গ্লানির পাশাপাশি জটিল ‘ক্ষয়রোগে’ও ভোগেন...।
উচ্চ মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদের সমস্যার গল্প ব্রোকেন ফ্যামিলি। বিত্তবৈভব যে সবসময় ভালো ফলাফল বয়ে আনে না, এ গল্প তা নতুন করে স্মরণ করিয়ে দেয়। পারিবারিক বন্ধনের শিথিলতার কারণে একটা শিশু যখন বড় হয় তখন খুব সহজেই সে সমাজবিরোধী কাজে জড়িয়ে পড়তে পারে। সহজতার কারণ তার মূল্যবোধ সঠিকভাবে তৈরি হয়নি। উপরন্তু নিঃসঙ্গতার কারণে তার ভিতর তৈরি হয়েছে উদ্ধত একটা ভাব। এর প্রধান কারণ কমিউনিকেশন গ্যাপ। এ প্রসঙ্গে লেখকের বিশ্লেষণÑ
‘আমরা যারা পিতা-মাতা বা অন্যান্য অভিভাবক বলে নিজেদের দাবী করি, তারা বরাবরই সঠিক পথ নির্দেশ দিতে ব্যর্থ হলাম। আর এই ব্যর্থতাই তো আমাদের দেশের জন্য, জাতির জন্যে ডেকে আনলো বিপদ ও বিপথের সর্বনাশা ইংগিত।
এভাবে সমাজজীবনের পদে পদে লেখক আলোকপাত করেছেন। সমস্যাগুলো তুলে এনেছেন চোখের আলোয়। পাশাপাশি প্রতিকারের দিকেও ইঙ্গিত বিদ্যমান। তাঁর কলম চাবুকস্পৃষ্ট করে পাঠককে। মন ও মননে আলোড়ন, বিলোড়ন জাগায়। সত্যিকারের মানুষ হওয়ার প্রেরণা দেয়। এসব শাণিত কথার পরও যদি আমাদের ভোঁতা, মরচে পড়া বিবেকে আলপিনের ঘাই অনুভব না করি, নিজে সংশোধন না হইÑতাহলে বলতেই হয় লেখক আমাদের জন্য কিছু করতে পারেননি! তিনি কেবলই মনের আনন্দে গল্পই লিখেছেন, আর কিছু না।
তেপ্পান্নটি গল্পে রয়েছে তেপ্পান্ন রকমের স্বাদ, তেপান্ন রকম আবেদন। ঘুষ সংস্কৃতি নিয়ে, পীর-ফকিরদের অপতৎপরতা নিয়ে, বিভিন্ন অনুষ্ঠান-উৎসবে প্রেজেন্টেশন দেয়া এবং আরো অনেক বিষয়ে লেখক আলোকপাত করেছেন, ভেবেছেন তা এককথায় আমাদের জন্য অমূল্য এক দলিল। বিশেষ করে বাংলা ভাষাভাষীদের জন্য। যারা গল্পকে পড়াকে অলস মানুষের কাজ ভাবেন, তাদের জন্যও!
কথা হচ্ছে, কোনো গল্পের বই কি মানুষকে শিক্ষা দেয় বা শিক্ষা দেয়া-নেয়ার কাজে ব্যবহৃত হতে পারে? সাহিত্য কি আসলেই মানুষকে বলে দিতে পারেÑতুমি এটা করবে না, ওটা করবে, এটা খারাপ, ওটা ভালো? এটা শেখো, ওটা বর্জন করো...?
হ্যাঁ পারে। অন্তত এম. এ. সামাদ’র ক্ষেত্রে এ কথা প্রযোজ্য হলে দোষের কিছু নেই। তার গল্প শুধু গল্প নয়, গল্পকে ছাড়িয়ে আরো অনেক দূর চলে যাওয়া। কাছে থেকে এবং দূরে গিয়ে অšে¦ষণ করেছে সত্য ও সুন্দরের। জিজ্ঞাসা করেছে আরো গভীর থেকে গভীরতরভাবে। এই অনুসন্ধান কল্যাণের, শুভবোধের, সুচিন্তার, রুচিবোধের। সব গল্পে পাঠক আনন্দ যেমন পাবেন তেমনি বিবেকও প্রশ্নশীল হয়ে উঠবে। গল্পগুলো স্মরণ করিয়ে দেবে মানুষ হিসেবে ভূমিকা কথা। কী করার কথা, কী করা হচ্ছে। যা হওয়ার কথা, তা কি আসলেই হচ্ছে, হবে কিনাÑএসব।
সাহিত্যবোদ্ধাদের কেউ কেউ হয়তো এম. এ. সামাদ’র সব গল্পকে গল্প হিসেবে স্বীকৃতি দিতে চাইবেন না। বলবেন নিতান্তই স্মৃতিচারণ বা ব্যক্তিগত উপলব্ধি। সমালোচক হয়তো সত্য কথাই বলবেন কিন্তু সব সময় সব সত্যের তোয়াক্কা না করলেও চলে। একজন মানুষ সমাজকে, দেশকে এতো গভীরভাবে দেখেছেন, ভেবেছেন সত্যিকারের গল্পকার না হলে, নিখাঁদ শিল্পসত্তা না থাকলে তা কী করে সম্ভব? তাঁর এই বই টিকে থাক অনেক অনেক দিন। যুগ ছাড়িয়ে যুগান্তরে...।
বিভিন্ন সংস্করণে অধ্যাপক কবীর চৌধুরী ও সৈয়দ আলী আহসান বইটি সম্পর্কে যে ভূমিকা-মূল্যায়ন লিখেছেন তা পাঠককে বিষয়বস্তুকে বোধগম্য করতে ও বইটির ভেতরে প্রবেশ সহজ করবে।
শনিবারের চিঠি
লেখক : এম. এ. সামাদ
প্রকাশক : ফওজিয়া সামাদ
প্রচ্ছদ : জাভেদ, তৃতীয় মুদ্রণ : আগস্ট, ২০০৬
দাম : ২০০ টাকা। পৃষ্ঠা : ২১৬
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বারবাজারে মাটির নিচ থেকে উঠে আসা মসজিদ

লিখেছেন কামরুল ইসলাম মান্না, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৪০

ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার বারবাজার ইউনিয়নে মাটির নিচ থেকে মসজিদ পাওয়া গেছে। এরকম গল্প অনেকের কাছেই শুনেছিলাম। তারপর মনে হলো একদিন যেয়ে দেখি কি ঘটনা। চলে গেলাম বারবাজার। জানলাম আসল... ...বাকিটুকু পড়ুন

সৎ মানুষ দেশে নেই,ব্লগে আছে তো?

লিখেছেন শূন্য সারমর্ম, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:৪৮








আশেপাশে সৎ মানুষ কেমন দেখা যায়? উনারা তো নাকি একা থাকে, সময় সুযোগে সৃষ্টিকর্তা নিজের কাছে তুলে নেয় যা আমাদের ডেফিনিশনে তাড়াতাড়ি চলে যাওয়া বলে। আপনি জীবনে যতগুলো বসন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

পরিবর্তন অপরিহার্য গত দেড়যুগের যন্ত্রণা জাতির ঘাড়ে,ব্যবসায়ীরা কোথায় কোথায় অসহায় জানেন কি?

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:৫৭


রমজানে বেশিরভাগ ব্যবসায়ীকে বেপরোয়া হতে দেখা যায়। সবাই গালমন্দ ব্যবসায়ীকেই করেন। আপনি জানেন কি তাতে কোন ব্যবসায়ীই আপনার মুখের দিকেও তাকায় না? বরং মনে মনে একটা চরম গালিই দেয়! আপনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯

মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা বলতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

×