ব্লাক স্কিন হোয়াইট মাস্ক বইটি ১৯৫২ সালে প্রকাশিত হয়, বইটি আমার পড়া সবচেয়ে চমকপ্রদ বই,এই কারনে যে বর্ন বৈষম্যর মতো জটিল বিষয় বইটিতে খুবই পরিস্কার এবং সহজ ভাবে ব্যাখা করা হয়েছে । আমি সাহিত্যর ছাত্র নই , বা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোর্সের এসাইনমেন্ট অপশন হিসেবে স্যার কখনও সাহিত্য সংশ্লিষ্ট বই এর নাম উল্লেখ করেন নি। তাই এ ধরনের বই কিভাবে রিভিউ করতে হয় তা জানি না, তবে ব্লগে অনেক অভিজ্ঞজন আছেন ,তাই বইটি সর্ম্পকে আরও ভাল করে জানার ইচ্ছে থেকেই এই রিভিউ পোষ্ট ।
বইটিতে লেখক মূলত ব্যাখা করেছেন, কালো মানুষেরা কিভাবে ধীরে ধীরে সাদা মানুষদের বা সাম্রাজ্যবাদ আধিপত্য ভাবধারাকে নিজেদের মধ্যে ধারন করেছে বা করতে বাধ্য হয়েছে। বইটিতে ফ্রান্জ ফনো দেখিয়েছেন, যে কিভাবে কালো মানুষদের মধ্যে সাদা মানুষেরা সুকৌশলে সাম্রাজ্যবাদ ভাবধারা প্রতিষ্ঠিত করে এবং দেখিয়েছেন যখন মানুষ একটি ভূল বিশ্বাসকে খুবই শক্ত করে আকড়ে ধরে তখন সেই বিশ্বাস এর বিরুদ্ধে কেউ যদি কিছু বলে, যদি কোন প্রমান হাজির করে তখন তারা সেটি গ্রহন করে না, কারন সাদা মানুষেরা প্রভূ হিসেবে তাদের প্রমান করার জন্য কালোদের ভাষার উচ্চারন এবং সংস্কৃতির মধ্যে সুকৌশলে একটি ‘দাস প্রথা’ বিশ্বাস স্হাপন করে। এই পুরো প্রক্রিয়াটিকে লেখক ব্যাখা করেছেন এক প্রকার মানুষিক ব্যধির আর্ভিভাব হিসেবে, একজন সুস্থ স্বভাবিক মানুষকে কিভাবে ধীরে ধীরে অসুস্থ করা যায় বা এক প্রকার মানুষিক ব্যধিতে আক্রান্ত করা যায়।
লেখক নিজে যেহেতু একজন চিকিৎসক তাই তিনি এই ব্যধির নামকরন করেন ”প্রতিক্রিয়াজাত মনোবিপর্যয়“ অর্থাৎ দুটি সাংঘর্সিক বিশ্বাস মানুষ যদি একই সময় ধারন করলে তার মধ্যে যে অস্বাভাবিক আচারন পরিলক্ষিত হয়। নিজের মত করে যদি বলি যে মার খেতে খেতে যখন মানুষ প্রতিরোধের ব্রত হারিয়ে ফেলে তখন মানুষ মানষিক ভারসাম্য হারিয়ে এই রোগে আক্রান্ত হয়। বইটিতে ফ্রান্জ ফানোঁ আলজেরিয়ার মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে লিখেছেন, আমি এর সাথে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়ের সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে কেন বাংলার মানুষ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি তার মিল খুজে পাই। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসের অভিজ্ঞতা বাংলার মানুষের মধ্যে এক ধরনের মানসিক পঙ্গুত্ব সৃষ্টি করেছিল, তাই নিজেদের সামরিক বাহিনীর দ্বারা নির্যাতনের বিরুদ্ধে বাংলার মানুষ প্রতিরোধের ব্রত হারিয়ে ফেলে। ফ্রান্জ ফানোঁ বইটিতে লিখেছেন আলজেরিয়ার যুদ্ধ একদিন শেষ হবে কিন্তু ফরাসিরা যে আলজেরিয়া পেছনে রেখে যাবে সেই আলজেরিয়ার মানসিক পঙ্গু মানুষেরা ঠিক কবে ঘুরে দাড়াতে পারবে তা কেবল অনিশ্চিত ভবিষ্যৎই বলতে পারে।
বইটির এক এক অধ্যায়ে এক এক বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে, তাই সবগুলো অধ্যায় নিয়ে আলোচনা করতে গেলে পোষ্টটি একটি ঢাউস সাইজের লেখা হয়ে যাবে। তাই যে অধ্যায়টি আমার সবচেয়ে ভাল লেগেছে সেই ‘দ্বিতীয় অধ্যায়’ নিয়ে শুধু আলোচনা করছি। কেননা এখানে কিছুটা প্রেমের কথা আছে। দুইটি উপন্যাস নিয়ে একানে আলোচনা করা হয়েছে, দেখানো হয়েছে তখনকার কালো সাহিত্যিকরা কিভাবে সাদা প্রভূদের দালাল হয়ে গিয়েছিলেন। এটির সাথে আমাদের বর্তমান সাহিত্যিকদেরও তুলনা করা যায়। কেননা আমাদের দেশের অধিকাংশ সাহিত্যিক সাম্রাজ্যবাদ ভাবধারার কাছে নতি স্বীকার করেছে। দ্বিতীয় অধ্যায়ে ফ্রান্জ ফনো সমালোচনা করেছেন সেই সব সাহিত্যিকদের যারা প্রভূর পুরুষ অর্থাৎ সাদা পুরুষের সাথে কালো মেয়ের প্রেম দেখিয়েছেন,এসব উপন্যাসের কালো নায়িকারা বলে যে তারা আর কোনদিন কোন কালো ছেলেকে বিয়ে করবে না, বা প্রভূর দেশের ছেলে ছাড়া আর বিয়ে করবে না। তখনকার এইসব তথাকথিত সাম্রাজ্যবাদের দালাল সাহিত্যিকদের ফ্রান্জ ফনো তুলোধুনো সমালোচনা করেছেন। বাংলাদেশেও এধরনের প্রচুর সাহিত্যিক রয়েছেন ,কিন্তু কেউ তাদের সমালোচনা করার সাহস পাচ্ছেন না।
সাম্রাজ্যবাদের দালাল সাহিত্যিকদের উদ্দেশ্যে ফ্রান্জ ফনো বলেছেন যে একটি কালো মেয়ের সাদা ছেলের প্রেমে পড়া অসম্ভব নয়, কিন্তু তারা এই প্রেমের একটা প্রতীকি তাৎপর্য তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন,যেন সাদা মানুষেরা কোন প্রভূশক্তি নয়, কালোদের তারা দাস মনে করে না। এবং এই প্রেমের অলংকারের মাধ্যমে মূল সত্যটিকে অস্বীকার করা হচ্ছে। ” ব্লাক স্কিন হোয়াইট মাস্ক “ উপন্যাসটির সাথে আমি আমাদের সমাজের বর্তমান পেক্ষাপটের মিল খুজে পাই, তৃতীয় বিশ্ব বলে আমাদেরকে পরাধীন বুঝানো হচ্ছে, বাংলাদেশের সাথে পশ্চিমা বিশ্বের সম্পর্ক হচ্ছে প্রভূ ও ভৃত্যের সম্পর্ক এই কঠিন সত্যটি আমাদের তথাকথিত গ্রন্থকারেরা তাদের গ্রন্থে নানা কথার অলংকারে ঢাকবার চেষ্টা করেছেন।
১৯৫২ সনে লেখা হলেও আজকের পেক্ষাপটে বইটিকে অন্তত আমার কাছে খুবই প্রসঙ্গিক মনে হয়েছে। তাই বাংলাদেশে সাম্রাজ্যবাদের দোসর জগৎ শেঠদের প্রতাপ দেখে ফ্রান্জ ফেনোর কথাগুলো আমার কাছ বিমূর্ত হয়ে উঠেছে “ আমি কালো মানুষ, আমি এই পৃথিবীর এটমিক বিক্রিয়ার ফসল, আমি করুনা, আমি পৃথিবীর বুকে আমার পরিচয় হরিয়েছি, আমি কোন অভিশাপের কারনে কালো নই, আমি কালো কারন আমার চামড়া প্রভূদের সকল অপকর্ম ধারন করেছে, আমি পৃথিবীর বুকে সত্যিকারের সূর্যের রশ্নি ধারন করেছি বলেই আমি কালো মানুষ “।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা মার্চ, ২০১৭ সকাল ১১:৪৯