"অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা" -১
মেজর (অবঃ) এম এ জলিল
মুক্তিযুদ্ধের ৯ নাম্বার সেক্টর কমান্ডার
উনি "অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা" বইতে কি লিখেছেন তা লিখিত হইল । পৃষ্টা ২০-২৩ ।
আওয়ামীলীগের ৬ দফা দাবীভিত্তিক নির্বাচনে ব্যাপক বিজয় লাভ সমগ্র জাতিকেই উৎসাহিত এবং অনুপ্রাণিত করেছিল । ১৯৭০ সনের সেই নির্বাচনী ফলাফল বাঙালী জাতীয়তাবাদের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ বলে প্রতীয়মান হয়েছিল আমার কাছে । সেদিন আওয়ামীলীগের বিজয় জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছিল । আওয়ামীলীগের আদর্শে বিশ্বাসী নয় এবং আওয়ামীলীগ বহির্ভুত এদেশের বুদ্ধিজীবি, আমলা, সেনাবাহিনী, পুলিশ, ইপিআর, আনসারসহ সাধারণ জনগনও আওয়ামী লীগের বিজয়ে অভূতপূর্ব উল্লসিত হয়েছিল । সে মুহূর্তে আওয়ামী লীগ অতি সার্থকভাবেই জাতীয়তাবাদী চেতনার ধারণ এবং লালন করেছিল । স্কুল-কলেজ-ভার্সিটিতে, ক্ষেতে-খামারে, অফিস-আদালতে, হাটে, ঘাটে, মাঠে, নদীতে-সাগরে এমনকি বিদেশ-বিভুঁয়ে বসবাসরত প্রত্যেকটি বাঙালীর বুক জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বেলিত আলোড়িত হয়ে উঠেছিল ।
আমরা বিহারী নই, আমরা নই পান্ঞ্জাবী, আমাদের পরিচয় 'আমরা বাঙালী' এই চেতনাবোধে জাগরিত হয়ে উঠেছিল বাঙালীর মন ও প্রাণ । এর ব্যতিক্রম ছিল কেবল তারাই, যারা '৭০-এর সেই ঐতিহাসিক নির্বাচে আওয়ামী লীগ বিরোধী ভূমিকায় লিপ্ত হয়ে শোচনীয় পরাজয় বরণ করেছিল । তারা আওয়ামী লীগের বিজয়ে খুশি তো হতে পারেইনি, বরং শন্কিত ও বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিল । তখন থেকেই তাদের তাদেরমনে এ ধারণা বদ্ধমূল হয়ে ওঠে যে, নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অভূতপূর্ব বিজয়ের পেছনে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের কারসাজি ছিল । অনেকে এ কথাও প্রমাণ করতে চেয়েছে যে, ১৯৪৭ সনে ভারত বিভক্তির সময় যে সকল হিন্দরা পুর্ববঙ্গ ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে স্হায়ীভাবে বসবাসের জন্য চলে গিয়েছিল তাদের বেশ একটা বর্ডার পাড়ি দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে শেখ মুজিবের পক্ষে ভোট প্রদান করার জন্য চলে আসে । এটা সত্য কি মিথ্যা তা জানা নেই । স্বাধীনতার এত বছর পরে ঐ ধরনের একতি অভিযোগ শুনতে অনেকের কাছেই আজগুবি মনে হলেও, ব্যাপারটি আজ পযর্ন্ত তলিয়ে দেখা হয়নি, কিংবা দেখার তাকিদও বোধ করেনি কেউ। আদৌ এমনটি হয়েছিল কি না । হলে তা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই হয়েছিল, না পূর্ব পরিকল্পিত? এ ধরনের পরিকল্পনার পেছনে উদ্দেশ্য কি ছিল - শুধুই কেবল আওয়ামী লীগের বিজয়কে নিশ্চিত করা না আরো সুদূরপ্রসারী কিছূ? এটা কি তবে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতেরই মগজের খেলা ছিল, না আওয়ামী নেতৃত্বও এ সম্পর্কে ছিল সম্পূর্ণ ওয়াকিফহাল?
স্বাধীনতার ১৭ বছর পরেও আমার মত একজন সাধারন লড়াকু মক্তিযোদ্ধারমনে এ প্রশ্নগুলো নিভৃতে উঁকি-ঝুঁকি মারে এ কারণেই যে, ২৫ শে মার্চের সেই ভয়াল রাতএর হিংস্র ছোবলের সাথে সাথেই পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসী এবং পূর্ব পাকিস্তানে নির্বাচিত আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যবর্গ কি করে পাকিস্তানের শত্রু হিসাবে পরিচিত ভারতের মাটিতে আশ্রয় গ্রহণের জন্য ছুটে যেতে পারল? কোন সাহসে কিংবা কোন আস্হার উপর ভর করেই বা তারা দলে দলে ভারতের মাটিতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল? তাহলে কি গোটা ব্যাপারটাই ছিল পূর্ব পরিকল্পিত? তাহলে কি স্বাধীনতা বিরোধী বলে পরিচিত ইসলামপন্হী দলগুলোর শন্কা এবং অনুমান সত্য ছিল? তাদের শন্কা এবং অনুমান যদি সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে দেশপ্রেমিক কারা? আমরা মুক্তিযোদ্ধারা না রাজাকার-আলবদর হিসাবে পরিচিত তারা? এ প্রশ্নের মীমাংসা আমার হাতে নু, সত্যের উদঘাটনই কেবল এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর নির্ধারন করবে । উত্তর যা-ই হোক, একজন মুক্তিযোদ্ধা- আমিই সাচ্চা দেশপ্রেমিক । অন্যায়কে আমি ঘৃনা করব । নির্যাতিত মানবতার পাশে আমি দাঁড়িয়েছি বলে আমি গর্বিত । আমার গর্ব খাটো করার অধিকার কারো নেই । ষড়যন্ত্রের কালোহাত আমি দেখিনি, আমি দেখেছি গণহত্যা । তাই রুখে দাঁড়িয়েছি হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে ।
কারো পূর্ব পরিকল্পনা খতিয়ে দেখার সময় আমার ছিল না । আমার সম্মুখে ছিল দায়িত্ব, আমি তা কেবল পালন করেছি । যুদ্ধের মাধ্যমে মানবতার সেবা কতটুকু হয়েছে জানি না, তবে অপরাধীদের মোকাবিলা আমি সক্ষমভাবেই করেছি । তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসী হিসাবে আমি নিপীড়িত ছিলাম । সেনাবাহিনীতে আমাকে ভেতো বাঙালী বলে উপহাস ও কৌতুক করা হতো । '৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের পরে আমি ব্যাক্তিগতভাবে দারুণ উচ্ছসিত হয়েছিলাম । রাজনীতিতে আনুষ্টানিকভাবে হাতেখড়ি না থাকলে ও আমি চেতনাহীন ছিলাম না । বাঙালীর জীবনের দুংখ-কষ্ট আমাকে ভাবিয়ে তুলতো, বাঙালী-বিহারী, বাঙালী-পান্ঞ্জাবী দ্বন্দ্ব আমাকে পীড়া দিত । পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বৈষম্য আমাকে লান্ঞ্ছিত করতো । তাই '৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক বিজয়ের মধ্যে আমি খুঁজে পেয়েছিলাম আমার অবিকাশিত সত্তার মুক্তির প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত ।
সত্য অনুসরণে আমার নিষ্টা থাকলেও প্রতিহিংসা অনল আমাকে অহরহ দমন করেছে । এ অনল আমি জ্বলতে দেখেছি প্রত্যেকটি সাধারণ বাঙালী বুকে । এই প্রতিহিংসার দাবানল বিষ্ফোরিত হলো আওয়ামী লীগের নির্বাচনী বিজয়ের মধ্য দিয়ে । বিহারী তাড়াও, পান্ঞ্জাবী তাড়াও এক কথায় অবাঙালী পূর্ব পাকিস্তান থেকে তাড়াও এই চেতনাটি অত্যন্ত স্বতঃস্ফূর্তভাবেই বিকশিত হতে লাগল । সত্তরে শেষ এবং একাত্তরের শুরুর সেই অগ্নিঝরা দিনগুলোতে পূর্ব পাকিস্তানের সংগ্রামী জনগণের মাঝে বিজাতীয়দের চরম ঘৃণা ও বিদ্বেষ পরিলক্ষিত হলেও ইসলাম ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ মোটেও পরিলক্ষিত হয়নি, অথবা ধর্মহীনতা আমাদের পেয়ে বসেনি । তৎকালীন সময়ে কট্রর আওয়ামী লীগার বলে পরিচিত নেতা-কর্মীদর মুখে 'ধর্মনিরপেক্ষতার' নাম গন্ধও শুনতে পাইনি । মুক্তিযোদ্ধে অংশগ্রহনকারী দামাল তরুণ-যুবকদের অধিকাংশই ছিল এদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানের সন্তান-সন্ততি । যুদ্ধের রক্তাক্ত ময়দানেও আমি মুক্তিযোদ্ধাদের দেখেছি বাকায়দা নামায পড়তে, দরুদ পাঠ করতে । তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের শাসককুল পবিত্র ইসলাম ধর্মকে বিভিন্ন সময়ে তাদের হীন স্বার্থে ব্যবহার করেছে বিধায় তাদের বিরুদ্ধে সচেতন জনগন সোচ্চার ছিল বটে, তবে প্রকাশ্যে পবিত্র ইসলাম ধর্মের প্রতি কোন মহলই ঘৃণা কিংবা বিদ্বেষ প্রদর্শন করেনি । ইসলাম ধর্মের বিষয়টি আমি এখানে এ কারণে উল্লেখ করেছি যে, আমাদের মুক্তযোদ্ধের পূর্বের ইসলাম এবং মুক্তিযুদ্ধের পরের ইসলাম- এর মধ্যে হঠাৎ করে এমন কি ঘটে গেল যাতে ইসলামের কথা শুনলেই কোন কোন মহল পাগলা কুকুরের মত খিঁচিয়ে উঠেন ।
যে দেশের শতকরা নব্বই জনেরও অধিক পবিত্র ইসলাম ধর্মের অনুসারী, সে দেশে এ করুন উন্মাদনার মধ্য দিয়ে ধর্মের নিকুচি করা কি আদৌ যুক্তিসম্মত? এই দুংখজনক এবং লজ্জাকর অধ্যায়ের জন্য দায়ী কে বা কারা? বাস্তবতার অস্বীকৃতিই প্রতিক্রিয়াশীলতানয় কি? অপরদিকে বাস্তবতার স্বীকৃতিই প্রগতির শর্ত এবং দাবী নয় কী? তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গর্ভেই বর্তমান বাংলাদেশ ভূমিষ্ট হয়েছে । সেই পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসীদের আচার-আচরণ, উৎসব-অনুষ্টান, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় এবং আধ্যাত্মিক মুল্যবোধ মুক্তিযুদ্ধের এক খোঁচায়ই কি বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে? এটা কি কারো খেয়াল-খুশির উপর নির্ভরশীল, না বাস্তব-নির্ভর? আমাদের বস্তুনিষ্ট বিশ্লেষণ, আমাদের জাতীয় জীবলকে সুষ্টুভাবে বিকশিত করতে সক্ষম । সত্যানুরাগই কেবল আমাদের মুক্তির দিশারী হতে পারে অন্যথায় আমাদের ধ্বংসের জন্য আমরাই যথেষ্ট । এ বিষয়ে অকিকতর আলোচনা পরবর্তী অধ্যায়সমূহে সন্নিবেশিত করা হবে ।
চলবে.....।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জুন, ২০১০ বিকাল ৫:৩৪