সুপ্তির প্রায়ই মনে হয় ১০ বছর আগে ফিরে যেতে, আজ হয় তো তাকে এই যন্ত্রণাময় জীবন বয়ে বেড়াতে হত না।
রাফির সাথে প্রথম যেদিন পরিচয় হয় তখন ১৪/১৫ বছরের টিন এইজ সুপ্তির কাছে জীবন মানে রঙীন স্বপ্ন গাঁথা এক সবুজ মাঠ যেখানে শুধু এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে দৌড়ে ছোটাছুটি করতে মন চায়। রাফি তখন ইন্জিনিয়ারিং ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র আর সুপ্তি ক্লাস নাইনে। প্রাইভেট পড়াতো রাফি, রাফির কথা বলা, তাকিয়ে থাকা, কোন অংক না পারলে ভ্রকুচকে তাকানো, হাসি দিলে একটা অতিরিক্ত দাঁত বের হয়ে যাওয়া সবই মুগ্ধ করতো সুপ্তিকে।
রাফি প্রায়ই মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতো, কি দেখছেন ভাইয়া বললে অমনি রাফি একগাল হেসে বলতো তোমার মাথায় উকুন। সুপ্তি রেগে খুনসুটি করতো। মাঝে মাঝে পড়া ফাঁকি দিলে রাফি খুব সুন্দর করে বুঝিয়ে দিতো কেন ঠিকমত পড়াশুনা করা উচিত। সুন্দর জীবনের গোছানো স্বপ্ন দেখাতো, এত সুন্দর করে সব কিছু বলতো সুপ্তি কখন যে রাফির কথায় হারিয়ে যেতো এক দিগন্ত বিস্তৃত খোলা শ্যামল সবুজ মাঠে যেখানে শুধু তারা দুজন আর কেউ না, মাঠের পাশে ছোট্ট পুকুরের স্বচ্ছ পানিতে নিজেদের দেখা।
ক্লাস টেনে পড়ার সময় সুপ্তির জন্মদিন, বাসার সবাই ভুলে গেছে। সুপ্তির প্রচন্ড মনখারাপ, রাফি পড়াতে আসলো সুপ্তি ছুটি চাইলো। রাফি বলল, কেন পড়বে না। সুপ্তি কিছু বলল না খালি বলল মন খারাপ। কিন্তু কেন রাফি বারবার জিজ্ঞেস করল কিন্তু সুপ্তি কোন জবাব দিলো না। রাফি তখন পকেট থেকে ২টা আধা মুষড়ে পড়া গোলাপ বের করে সুপ্তিকে উইশ করলো। সুপ্তির আনন্দে চোখে পানি চলে আসলো।
এসএসসি পরীক্ষার শেষে সুপ্তির মন খারাপ লাগতে লাগলো। অনেকদিন দেখে না রাফি ভাইয়াকে ভাবতে ভাবতে এক গোধুলিবেলায় বাসার পাশের রাস্তা দিয়ে হাটছিল সুপ্তি। একটা বাচ্চা ছেলে একটা চিঠি দিয়ে দৌঁড়ে চলে যায়। কে দিয়েছে তা শোনার সময়ও পায় না। চিঠি খুলতে গিয়ে বুকের মধ্যে এক অজানা ভয়, চিঠিটা খুলে পুরোটা এক নিশ্বাসে পড়ে ফেলে সুপ্তি। কিন্তু কোথাও লেখকের নাম লেখা নেই। চিঠির পুনশ্চে শুধু এটাই লেখা, যদি তোমার এই চিঠি ভাল লাগে তবেই আগামীকাল বিকালে স্কুলের পাশের মাঠে দাঁড়িও আমি আসবো আর ভাল না লাগলে এসো না।
সুপ্তি কি করবে ভাবতে লাগলো। কেবলই মনে হতে লাগলো রাফি ভাইয়া থাকলে কি বলতো। পরেরদিন অনেকটা সঙ্কোচেই সুপ্তি সেখানে অপেক্ষা করতে লাগলো। দূর থেকে রাফি ভাইয়ার মত কাকে যেন আসতে দেখলো সুপ্তির কান্না পেতে লাগলো, ভাইয়া কি ভাববে এটা ভেবেই। কাছে এসে রাফি যখন তার ভালবাসার কথা সুপ্তিকে বলল সুপ্তির মনে হল স্বগটাই যেন তার হাতে আজ।
এভাবেই কেটে গেল ২বছর। সুপ্তি এইচএসসি পাশ করলো অনেক ভাল রেজাল্ট নিয়ে রাফি তখন ফাইন্যাল ইয়ারে। সুপ্তিও ইন্জিনিয়ারিং এ ভর্তি হল। রাফি তখন সদ্য বেকার। ভাল জব খুঁজে বেড়াচ্ছে ছোটখাট একটা জব পেয়েছে কেবল একটা সিমেন্ট ফ্যাক্টরীতে। সুপ্তির মা ততদিনে আন্দাজ করতে পেরেছেন মেয়ে মনে হয় প্রেম করছে রাফির সাথে। মায়েরা সবসময়ই খুবই পজেসিভ থাকে মেয়ের ব্যাপারে তাও যদি হয় সুন্দরী আর ভাল ছাত্রী। সুপ্তির মা সুপ্তিকে কন্ট্রোল করতে চাইলেন। হিতে বিপরীত হল। সুপ্তি বিয়ে করে ফেলল।
টানাটানির সংসার সুপ্তির শুরু হল। স্বচ্ছল পরিবারের মেয়ে সুপ্তির জন্য রাফির মত নিম্নবিত্ত ছেলের সাথে খাপ খাওয়ানো কতটা কষ্টের এটা সুপ্তি টের পেল বিয়ের পরই। নিজের পড়াশুনার ফাঁকে ফাঁকে সুপ্তি টুকটাক টিউশানীও শুরু করল। এভাবেই ৩বছর কেটে গেল। রাফি আবুল খায়ের গ্রুপে ভাল একটা জব পেল। নতুন জব পাবার পরপরই রাফি বদলে যেতে লাগল। কিছু জিজ্ঞেস করলে রাফি ক্ষেপে যায়। সুপ্তি প্রথম প্রথম ভাবল হয়তো কাজের চাপ বেশি বা অফিসের টেনশানে রাফি এমন করছে। ওদিকে রাফির বেপরোয়া ভাব বেড়েই চলেছে। রাফির বন্ধুদের কাছে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলো অফিসের এক কলিগের সাথে রাফির সর্ম্পকের কথা। এভাবে আর চলতে দেয়া যায় না, সুপ্তি সম্পর্কের ইতি টানতে চাইলো। কিন্তু এরই মাঝে সুপ্তি নিজের মধ্যে আরেকটা প্রাণের অস্তিত্ব অনুভব করল। ফোর্থ ইয়ার সুপ্তির মেয়ে আনোখির জন্ম হল। রাফি কথা দিয়েছিল সে এই সর্ম্পক মিটিয়ে ফেলবে। সে তার কথা রেখেছে। সে এখন অন্য আরেক মেয়ের সাথে সর্ম্পক তৈরি করেছে। সুপ্তি এখন আর কিছু বলে না রাফিকে এ ব্যাপারে। সুপ্তি শুধু মেয়ের মুখের দিকে চেয়ে সুপ্তি সব কিছু মেনে নিয়ে স্রোতের সাথে তাল মিলানোর ব্যর্থ চেষ্টা করেই চলেছে।
পাশ করার সাথে সাথেই সুপ্তি একটা ভাল জব পেয়েছে। এখন আর তাকে অন্যের মুখাপেক্ষীও থাকতে হচ্ছে না। বাইরে থেকে অনেকেই ভাবে সে খুবই সুখী। কিন্তু সে আসলেই ভাল নেই.....প্রায়ই ভাবে যদি পারতো সেই ১০বছর আগে ফিরে যেতে...সবকিছু হয়তো আজ তাহলে এভাবে শুরু হতো না...হয়তো তার ডায়রী টা আজ অন্যরকম হতো।