দিল্লীর মন্ত্রী পাড়ায় ঢুকে চমকে গেলাম, একি এই রাস্তার নাম ও মিন্টো রোড !!! ঘটনা কি , আমাদের ঢাকার মিন্টো আর এই মিন্টো কি একই ব্যক্তি । কনফিউজ হয়ে গেলাম। ঢাকর মিন্টো সাহেবকে আমি ভাবতাম আমাদেরই কেউ হবেন হয়ত, কিন্তু কে সে তা আর খোজ নেয়া হয়নি কখনো । এইবার যে নিতে হয় , কে এই মিন্টো সাহেব । গুগলের দ্বারস্হ হওয়া ছাড়াতো আর উপায় নেই । গুগল জানাল বঙ্গভঙ্গের সময় এই লর্ড মিন্টো সাহেব ছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারতবর্ষের বস ।
আগ্রা থেকে বাস যাত্রা শেষ দিল্লী পৌঁছাতে রাত আট টা বেজে গেল, নেমেই টের পেলাম দিল্লীর কনকনে ঠান্ডা । পুরোনো দিল্লীর আরাকান শাহ রোডে আগে থেকে বুক করা হোটেল খুজে পেতে খুব বেশি কষ্ট হয়নি । রাতের খবার হোটেলে না খেয়ে ভাবলাম আশে পাশে একটু খোজ নিয়ে দেখি কি পাওয়া যায় । খুজে পেতে এক বিরানীর দোকানে গিয়ে হাজির হলাম । আহ , সুগন্ধেই মন ভরে গেল অর্ধেক । প্লেট হিসেবে নয় , তার বিরানী বিক্রি করছে কেজি দরে !!! প্রতি প্লেটে হাফ কেজি করে নিয়ে আমরা খেতে বসে গেলাম। বাসমতি চালের বিরানী , চমতকার ছিল টেস্ট , ফলে আসার দিন আবার সে দোকানে গিয়ে আরেকবার খেয়ে এসেছিলাম ।
দিল্লীর সিংহাসন সব সময়েই যার দাম অপরিসীম , যার ফলে যুগে যুগে সকল যুদ্ধবাজ নেতার পা পড়েছিল এই দিল্লীতে । খোদ তৈমুর লং (শৈশবে পায়ে তীর বিদ্ধ হওয়ায় যে খুড়িয়ে চলত , ফলে ইউরোপীয়ানরা তাকে ডাকত তৈমুর দা লেম , আমরা যাকে বানিয়ে দিয়েছি তৈমুর লং !!!) ও হাত বাড়িয়েছিল এই দিল্লীতে । আর শেষমেষ পাকাপাকি ভাবে এই দিল্লীতে স্হায়ী হয়েছিল তার বংশোদ্ভুত বাবরের প্রতিষ্ঠিত মোঘল সাম্রাজ্য ।
সকালে হোটেল এর লবিতেই টের পেলাম দিল্লীর ঠান্ডা কাকে বলে । সেখান থেকে একটা গাড়ি ঠিক করে নিলাম, যেটা পরবর্তী তিন দিন আমাদের সঙ্গী হয়ে রইল । গাড়ি চালক পান্ডে জি, উত্তর প্রদেশের বাসিন্দা , সারাক্ষন পান মসলা চিবানে থাকেন আর স্বল্পভাষী । যোগী আদিত্য নাথের ইউপি কেমন চলছে বলাতে স্বগোতক্তি করে উথলেন, মসজিদ মন্দিরে মানুষ পাবেননা , কিন্তু মসজিদ মন্দির নিয়ে মারামারি করার সময় লোকের অভাব হবেনা !!! সমগ্র উপমহাদেশটাকে যেন এক লাইনেই পরিচয় করিয়ে দিলেন তিনি । অফিসিয়াল কাজ শেষে দুপুরের পর থেকে শুরু হল আমাদের দিল্লী পরিক্রমন ।
কাজু বাদাম দিয়ে রান্না করা রুই মাছ ভুনা খেয়ে বের হয়ে পরলাম পুরান দিল্লীর পথে । সেখানেও ব্যাটারি চালিত রিক্সার জয়জয়কার, দিল্লীর বিখ্যাত মসলা মার্কেট । পাইকারি মসলা মার্কেট , আমাদের পুরান ঢাকার চকবাজার কিংবা চট্রগ্রামের খাতুন গঞ্জ ও আসলে কোন অংশে এর থেকে কম নয় ,কেবল প্রচারনার কারনেই মনে হয় এটার এত নাম ডাক , মসলার ব্যাপক কালেকশন থাকলেও দাম খুব একটা কম মনে হলোনা । কাশ্মিরী জাফরান আর কাজু বাদাম দেখে কেনার লোভ সামলানো আসলে দায় । মানুষ গিজগিজ করছে চারপাশে, হাঁটা দায় । হাঁটতে হাঁটতে আমরা পেয়ে গেলাম ফতেহপুরী মসজিদ, সম্রাট শাহজাহানের স্ত্রী ফতেহপুরী এই মসজিদ বানিয়ে দিয়েছিলেন ।
চাঁদনী চক , আমি ভেবেছিলাম না জানি কি , ভাগ্যভাল পুরোটা ব্যাটারি রিক্সায় বসে ঘুরে দেখছি, হেঁটে দেখতে গেলে পরে নিজের উপর ই মেজাজ খারাপ হত । প্রিয়তমা কন্যা জাহানারার ডিজাইনে সম্রাট শাহজাহান এটা বানিয়েছিলেন ১৬৫০ সালে । তখনকার আমল থেকেই পাইকারি মার্কেট হিসেবে এটার নামডাক । মোঘলদের সকল রক্তাক্ত কর্মাকান্ডের সাক্ষীও এই চাঁদনীচক । ক্ষমতা দখল আর বিদ্রোহ কেন্দ্রীক মোঘল আমলে পরাজিতদের খন্ডিত মস্তক ঝুলিয়ে রাখা হত এই চাঁদনী চকে আবার একই সাথে নতুন বাদশাহের অভিষহেক যাত্রাও যেত এই চাঁদনী চকের উপর দিয়ে ।
চাঁদনীচকের উপর দিয়ে যাবার সময় আসলে আমি অপেক্ষায় ছিলাম কখন গিয়ে করিমসে পৌঁছাব । এত নামডাক যার শুনেছে আর তর সইছেনা । দিল্লী জামে মসজিদের এক নং গেটের উল্টাপাশেই ভারতের অন্যতম নামকরা এই রেস্তোরার অবস্হান । করিমসে না গেলে নিশ্চিত থাকতে পারেন আপনার দিল্লী ভ্রমন অসম্পূর্ণ থেকে গেল । এমন রুমালী রুটি আমি আর কোথাও খুজে পেলামনা এখনও , সেই সাথে কাবাব আর মোঘল ঘরানার রেসিপিতে রান্না করা নানা আইটেম । ভরপেট না বলে বলা চলে ভর গলা পর্যন্ত খেলাম ।
এমন খানা দানার পর নবাবী স্বাদের একটা পান মুখে দিয়ে ভাবলাম হেলেদুলে এই রাতেই ইন্ডিয়া গেট টা দেখে আসা যাক । বহু নাম ডাক শোনা এই ইন্ডিয়া গেট তো আসলে আমাদের শিখা অনির্বানের মতনই , ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের সকল শহীদের স্মরনে বানানো এই তোড়ন । বহু নাম ডাক শোনা এই জিনিস খুব একটা আকর্ষনীয় কিছু লাগলোনা, তবে ভরপেট খবার পর ঠান্ডা হাওয়ার দিল্লীতে ঘুরে বেড়াতে খারাপ ও লাগেনি ।
দিল্লীতে বসে বোম্বে টোস্ট দিয়ে শুরু হল আমাদের সকাল । এরপর পান্ডেজির চার চাকায় ভর করে বেড়িয়ে পড়লাম বাদশাদের স্মৃতিধন্য শহরে । ফিরোজ শাহ কোটলা স্টেডিয়াম কে পাশ কাটিয়ে আমাদের গন্তব্য মন্ত্রীপাড়ায় সফদরজং রোডের ইন্দিরা গান্ধী মিউজিয়ামে । এই পাড়া ও আশে পাশের সব রাস্তা এখন ও মোঘল বাদশাহদের নামে নামাঙ্কিত । প্রধানমন্ত্রী হবার পরেও ইন্দিরা প্রধানমন্ত্রী ভবনে না থেকে নিজে মন্ত্রী থাকাকালীন যে বাড়িতে থাকতেন সেখানেই রয়ে গিয়েছিলেন । নিষেধ সত্ত্বেও প্রতিদিন সকালে হাঁটতে বের হতেন, অফিসেও যেতেন হেঁটে , আর সেটাই কাল হল তার, নিজ বাড়ির ফটকেই জীবন প্রদীপ নিভে গিয়েছিল । তার ব্যবহৃত জিনিসপত্তর আর ছবি দিয়ে সাজানো এই মিউজিয়াম । নেহেরু জেলে থাকাকলীন যে শাড়ি বুনেছিলেন সেটা পড়েই ইন্দিরা বিয়ের পিঁড়িতে বসে ছিলেন , আছে রাজীবের বোমায় ক্ষতবিক্ষত পোশাক । নিহত হবার স্হানটি কাঁচ দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে , রক্তের ছিটা এখন দৃশ্যমান, সেখানে দাঁড়িয়ে ইতিহাসের পরতে না হারিয়ে আসলে উপায় নেই ।
২৪০ ফিটের কুতুব মিনার দেখে কিছুক্ষন বিষ্ময়াভূত না হয়ে উপায় নেই , ১১৯৯ সালে যার নির্মান কাজ শুরু হয়েছিল । ভারতের সভচেয়ে প্রাচীন সংরক্ষিত স্তম্ভ এটা , কুতুব উদ্দীন আইবেক দিল্লী সালতানাতের প্রতিষ্ঠাতা যা স্হাপনের কাজ শুরু করেছিলেন , পরবর্তীতে তার জামাতা শামসুদ্দীন ইলতুতমিশ এটা সমাপ্ত করেছিলেন । হাজার বছর আগে কি করে সম্ভব হয়েছিল এমন জিনিস বানানো ভাবলেই অবাক লাগবে , পরো মিনার জুড়ে কুরআনের ক্যালিগ্রাফি আর এর বানানোর ইতিহাস খোদায় করা আছে । একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে বের হবার পথে পাবেন লাইব্রেরি , চাইলে কিনে নিতে পারেন দিল্লীর নানা ইতিহাস- সংঘাত, বিদ্রোহ , রাজ্য জয়, বিলাস বেসন, প্রেম , রক্ত বন্যা কি নেই তাতে !!! দিল্লী শহরের পরতে পরতে ইতিহাসের নিপূন ছাপ , চোখ মেলে কান পাতলেই শোনা যেতে পারে দরবারের ঘোষনা - আসিতেছেন শাহানশাহ................।
শীতকাল ঘোরাঘুরির জন্য আমার খুব একটা পছন্দ না, দিনের দৈর্ঘ্য খুবই কম বলে , তাড়াহুড়ো করে তাই পরের গন্তব্য লোটাস টেম্পলের পানে ছুটলাম ,গাড়িতে বসেই লাঞ্চ তাও পড়ন্ত বিকেলে বলা চলে । লোটাস টেম্পল, বাহাই সম্প্রদায়ের উপাসনালয়, যেখানে সকলেরই প্রবেশ উন্মুক্ত । দৃষ্টিনন্দন এই স্হাপনা বাইরে থেকে চমতকার ভিউ , যদিও রাতের বেলার ভিউটা দেখার ইচ্ছাপূরন হলোনা ! সেখান থেকে কোনাট প্লেসে এসে ভাবলাম এবার কিছুক্ষন হেঁটে হেঁটে দিল্লী ঘুরা যেতে পারে । নানারকম ব্র্যান্ডের শোরুম আর কফি শপে ভর্তি , চোখের সামনে স্টার বাকস পরে যাওয়ায় না ঢুকলে কেমন লাগে ভেবে ঢুকে পড়লাম । অফিস ফেরত লোকজন কফি নিয়ে ল্যাপটপ খুলে নানারকম আলাপ জমিয়েছে , শুনে মনে হচ্ছে তার বেশিরভাগই অফিস রিলেটেডই । বেসরকারি কামলাদের স্বর্গ প্রাপ্তি যে সহজ হবে , তা নিয়ে কৌতুকটা আসলে সব দেশের জন্যই সত্যি
বিকেলে ফিরতে হবে তাই অল্প সময়ে দিল্লী জামে মসজিদ আর লালকেল্লা দেখার জন্য সাত সকালেই বেড়িয়ে পরলাম । অনেক কিছুই আছে, কিন্তু এ দুটো না দেখলে আসলে পুরোটাই অসম্পূর্ণ থেকে যাবে । স্হাপত্যপ্রেমী শাহজাহানের বানানো জামে মসজিদ, মুল মসজিদ খুব বেশি বড় না হলেও সমানের লন সহ এই এলাকায় ২৫০০০ মানুষ একসাথে নামাজ পড়তে পারে । মসজিদের ছাদে উঠার লোভ সমালাতে পারলামনা (শৈশবে জুম আর নামায পড়তাম মসজিদের ছাদে বন্ধুরা সব একসাথে, নামায আর আড্ডা দুটায় চলত ) , সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলাম । দূরে রেডফোর্ড আর চারপাশে পুরাতন দিল্লী , রেডফোর্ড বাদ দিলে আমাদের পুরান ঢাকায় বলা চলে !! কিছুক্ষন পর এক লোক রশিদ বই হাতে নিয়ে হাজির , বলল ছাদে উঠতে হলে টিকেট কেটে উঠতে হয়, আপনাদের টিকেটতো কাটা হয়নি !!! কি আর করা, পড়েছি মোঘলের হাতে- খানা খেতে হবে একসাথে , এইভেবে রশিদ নিয়ে টাকা দিয়ে দিলাম । নামার সময় দেখলাম লেখা আছে উপরে উঠার জন্য টিকেট সংগ্রহ করুন !!!
ইন্ডিয়ার পর্যটন থেকে আয়ের সিংহভাগ আসলে শাহজাহান এর অবদান । তাজমহল থেকে রেড ফোর্ড তথা লাল কেল্লা সবই শাহজাহানের স্হাপত্যপ্রেমের নিদর্শন । তাজমহলের স্হপতি উস্তাদ আহমদ লাহোরির ডিজাইনে এটা বানানো হয় যখন শাহজাহআন তার রাজধানী আগ্রা থেকে শাহজাহানাবাদ তথা দিল্লীতে সরিয়ে আনলেন । যমুনা নদী একসময় পাশ দিয়ে বহমান থাকলেও কালের পরিক্রমায় তা এখন অনেকদূরে সরে গেছে । আর কোন মোঘল সম্রাজ্ঞীর নামে কোন প্রাসাদের অস্তিত্ত্ব না থাকলেও এখানে আছে মমতাজের জন্য বানানো মমতাজ মহল । মমতাজের জন্য শাহজাহানের ভালবাসা সম্ভবত পরিমাপযোগ্য নয় আসলে । আইপিলের মত জন্মনিয়ন্ত্রন সামগ্রী এভেইলএবল থাকলে হয়ত বেচারিকে চৌদ্দতম সন্তান জন্মদান করা লাগতোনা , আর অকালেও দুনিয়া ছেড়ে যাওয়া লাগতোনা । অবশ্য জীবিত মমতাজের উপস্হিতিতে পৃথিবীকে তাজমহলহীন হয়ে থাকতে হত !! প্যালেসগুলো ঘুরে দেখার মজা সম্ভবত এটা যে ক্ষনেক্ষনে আপনাকে শতশত বছর পূর্বে ফিরে যেতে হবে , আর সাথে যদি স্বল্পখরচের গাইড থাকে সে আপানকে চেস্টা করবে রংচঙা এক ঐতিহাসিক ভ্রমন উপহার দেয়ার ।
শব্দহীন ইন্দিরাগান্ধী এয়ারপোর্টে বসে আছি , মোঘলদের স্মৃতিকাতরতা থেকে বের হতে পারছিনা- বাবর, হুমায়ুন, জাহাঙ্গীর , শাহজাহান, আওরঙ্গজেব ........আরো বেশকিছুদিন এরা মাথায় ভর করে থাকবে বুঝে গেলাম ।
আরেকটা জিনিস , দিল্লীকা লাড্ডু বলে কিছু খুজে পেলামনা কোথাও !!!
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে অক্টোবর, ২০১৯ দুপুর ১:২৩