একটি দেশকে এক করার জন্য এগারো জনের মনোবল ও একাগ্রতায় যথেষ্ট। সেটি অনেক আগেই পরীক্ষিত ছিল তবে গতকাল তা আবারও প্রমাণিত হল। বাংলাদেশ ক্রিকেট দল ছোট ছোট অনেক সফলতার পথ পাড়ি দিয়ে আজ যখন একটি বড় সফলতা অর্জন করল তখন দেশের বাসিন্দারা আনন্দের জোয়ারে ভাসতেই পারে। এটা আমাদের মৌলিক অধিকারের একটি। কিন্তু এরপরেও অনেকে এই ব্যপারটাকে সহজভাবে নিতে পারছে না। তারা ভাবছে এটা নিয়ে এত লাফালাফি করার কি আছে? বিশ্বকাপে এরকম কত অঘটনইতো ঘটে! কেনিয়ার মত দলওতো বিশ্বকাপে সেমিফাইনালে খেলেছে। তাহলে এ আর এমন কি? বাংলাদেশতো তাও মাত্র কোয়ার্টার ফাইনালে উঠেছে। এমনতো না যে বিশ্বকাপ ফাইনাল জিতে গেছে! আয়ারল্যান্ডও-তো অনেক ভাল খেলছে- তারা কি এত লাফালাফি করছে?
১৯৯৭ সালে যখন বাংলাদেশ কেনিয়াকে আইসিসি ট্রফির ফাইনালে হারিয়ে পরবর্তী ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপে প্রথম অংশগ্রহনের যোগ্যতা অর্জন করেছিল তখন থেকে একটি আবেগের দানা বাঁধা শুরু হয়েছিল। সেই আবেগ আজ ইস্পাতের চেয়েও মজবুত। সেই আইসিসি ট্রফির আগে বাংলাদেশ নামটি ক্রিকেটের আর দশটি দেশের নামের মতই লাগতো। তখন বাংলাদেশের নামটি আয়ারল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, নেদারল্যান্ড, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র এই দেশগুলোর নামের পাশেই থাকতো। প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বীতা হতো এই দেশগুলোর সাথে। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে এখন বাংলাদেশ নামটি আর তাদের পাশে মানায় না। কেমন যেন ফ্যাকাশে মনে হয়। তাদের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বীতামুলক খেলা আর হয়ই না। এখন বাংলাদেশ দলটি প্রবল গর্জনে লড়াই করে ক্রিকেটের জনক ইংলিশদের সাথে এবং তাদেরকে হারিয়ে বিদায় করে দেয় তাদেরই স্বপ্ন আইসিসি ক্রিকেট বিশ্বকাপের প্রথম পর্ব থেকেই। ১৯৯৭ থেকে ২০১৫ এই আঠারো বছরে এক এক করে পেছনে ফেলে এসেছে জিম্বাবুয়ে, কেনিয়া, আয়ারল্যান্ড, স্কটল্যান্ডের মত দলগুলোকে। অর্জন করেছে এক এক করে সব স্বপ্নের আরাধনা, হারিয়েছে সবগুলো বড় দলকেই এবং লড়াই চালাচ্ছে সমান তালেই।
১৯৯৭ সালের আইসিসি ট্রফির পয়েন্ট টেবিল।
মনে প্রশ্ন থেকে যায়, এমন কি জাদুর বলে এতো শক্তি, এতো সুনাম, এতো খ্যাতি অর্জন করছে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দল? উত্তর খুঁজতে গিয়ে দেখা মেলে - এক সমুদ্র-সমান বিশ্বাস, আস্থা, ভরসা এবং ভালোবাসা আছে এই দলটির পাশে। আস্ত একটি দেশ মুহূর্তেই হাসতে পারে, কাঁদতে পারে তাদের সাথে। এগারো জনের এই দলটির সাথে! এতো আবেগ-ভালবাসা জড়িয়ে আছে ক্রিকেটের সাথে তা ষোল কোটি মানুষের এই দেশে না আসলে কেউ কেউ হয়ত'বা বিশ্বাস-ই করতে চাইবে না। তাই এখানে জিতলে মিছিল হয়, হারলে শুধু নীরবতায় পড়ে রয়!
১৯৭১ সালে যখন শেখমুজিব এই দেশটিকে স্বাধীন করার জন্য পরিকল্পনা করছিলেন তখন এই জনসমুদ্র তার সাথে ছিল, হাল ধরেছিল এবং বিশ্বাস করেছিল একটি সুন্দর-শ্যমল স্বাধীন বাংলাদেশ তারা পাবে। এই বিশ্বাস, এই আস্থা এখন দিন দিন মলিন হয়ে যাচ্ছে, ফিকে হয়ে যাচ্ছে। এখন তারা বিশ্বাস করতে ভয় পায় সরকার এবং বিরোধী উভয় দলকেই। তারা ভাবে সরকারে যারা যাবে তারা হবে ক্ষমতালোভী ও স্বার্থান্বেষী। ক্ষমতার স্বাদ ধরে রাখতে এরা নাছোড়-বান্দা হয়ে কাজ করবে এবং চুপি চুপি ক্ষমতা বাড়ানোর ছক করবে। যদি কেউ বিরোধ করে তবে তাকে চুপ করাবে। সেটা যুক্তি দিয়ে হোক আর শক্তি দিয়েই হোক। আর বিরোধী যিনিই হবেন তিনি হবেন হিতাহিত জ্ঞানশূন্য এক নেতা। যার নেতৃত্বে নিজের ঘরেই হামলা করবে, নিজের ভাইকেই শত্রু বলবে, নিজেদের মধেই হিংস্রতার সৃষ্টি করবে একদল মানুষরুপী রোবট। এদের নিজস্ব কোন ভাবনা নেই, এদের ব্যক্তিত্ব বলতে কিছু নেই, এরা যুক্তিতে বিশ্বাসী না, ভালো-মন্দ কিছু বুঝে না! শুধু একটা ব্যপারই বুঝে এমন করলে ক্ষমতা পাবো। এরা নির্বোধের মত পশু হয়ে মানুষ হত্যা করতে জানে। নিজের ঘরে শৃঙ্খলতা না থাকলে, আপন ভাই আগুনে পুড়ে মরলে, কিংবা নিজেরই সন্তান স্কুলে যেতে না পারলে এদের কিছু যায় আসে না। এরা চায় ক্ষমতায় যেতে সেটা যেকোনো প্রকারে হোক। ধ্বংস, অনিষ্টতা এবং অনিশ্চয়তায় এরা মহীয়ান হয়ে নেতার আদেশ পালন করে। সরকারের বিরোধ করে নৃশংস পন্থায়।
গতকাল বাংলাদেশ ক্রিকেট দল যেমন ষোলকোটি মানুষের আস্থা নিয়ে মাশরাফির নেতৃত্বে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তাদের নির্দিষ্ট কাজে এবং দিনশেষে তাদের কর্ম দিয়ে অর্জিত বিজয় ও সুনাম ছড়িয়ে দিয়েছে পৃথিবীময়। অর্জন করেছে আরও বিশ্বাস, আরও আস্থা।
ঠিক তাদেরই মত করেইতো ষোলকোটি মানুষের আস্থা নিয়েই সরকার গঠন করে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দরা। স্বাধীনতার চুয়াল্লিশটি বছর পেরিয়ে গেলেও এখনও কিন্তু তারা অর্জন করতে পারেনি সেই বিশ্বাস, বরং হারিয়েছে সেই আস্থা। উন্নতির সোপান পেছনে রেখে তারা এগিয়ে যাচ্ছে অনিশ্চয়তার পথে, অন্ধকারের পথে!
হয়ত'বা আবারও কোনো এক দৈববলে সমাপ্ত হবে এবারের অবরোধ-হরতাল কর্মসূচি। শান্ত হবে এই দেশ। তবে মনে এখনও প্রশ্নটা থেকে যায়, কোন জাদুর বলে সবার মাঝে পরিবর্তনটা আসবে? যেমনটা এসেছে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলে। কখন সবাই বুঝবে, সবাই সবার ভালো চাইবে, ভালো না-ই চাক অন্তত ক্ষতিটা চাইবে না। এক হয়ে সবাই নিজেকে উন্নত করবে, লড়াই করবে নিজেই নিজের সাথে। নিজেকে পরিবর্তনের মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
মাশরাফিদের এই বিজয় হোক রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দদের জন্য অনুপ্রেরনার উৎস। আপাতত এই আশাটায় করছে ষোল কোটি হৃদয়!