রফিক, আট বছরের ছোট্ট এই ছেলেটার মাঝে জীবনবোধ প্রবল । সারা দিন ফুটপাতের ধারে পানবিড়ির দোকানদারী করে । এক হাতে অদ্ভুদ দক্ষতায় পান সাজায়, অন্য হাতে একটা চিকন দড়ি ধরা থাকে । দড়ির অপরপ্রান্তে আধ হাত সাইজের কাপড়ের পোটলা ঝোলানো । পোটলাটাকে প্রতি মিনিটে দশবার দোলায়, নিখুত হিসেব । এই হিসেবের কোন হেরফের হয় না । পোটলার মাঝে আবছা ছোট একটা মুখ প্রায়শই উঁকি ঝুঁকি মারতে দেখা যায়, মুখটা ওর ছোট বোনের । সারাদিন ঘুমোয়, কখন খায় দায় কে জানে । বাড়িতে বড় আপার ছমাস বয়েসী মেয়েটা সারাটাদিন নাঁকি সুরে কাঁদে । এর দেখি ট্যা প্যা কিচ্ছু নাই । রফিককে জিঙাস করলে হাসে, হাসতে হাসতেই বলে, "ভাইজান গরীবের মাইয়্যা, বড় হইয়া যহন চুপ কইরা থাকতি হবি, সেই জন্যি এক্ষণ থাইক্যা প্রাকটিছ করতাছে" । এরপর আর কিছু বলার থাকে না, আমার ও বলার নাই ।
গত ছমাসের আমার বৈকাল কার্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশ রফিকের দোকানে ঠায় বসে থাকা । আর ওর কায়দা-কানুন চোখে চোখে দেখে রাখা । কাজটা কেন, কিজন্যে করছি সে সমন্ধে আমার পরিষ্কার কোন ধারণা নাই । থাকলে দেয়ার একটা চেষ্টা করা যেত । যেহেতু নাই তাই দেয়া যাচ্ছে না । তবে অপরিষ্কার একটা ধারণা দেয়া যেতে পারে, "রফিকের কর্মকান্ড বহুমাত্রিকভাবে আকর্ষক, ওর দোকানদারী, বোনকে মনুষ্যকরন (এর থেকে ভাল কোন শব্দ খুজে পেলাম না, যদিও এই পদ্ধতিতে ওর বোনকে অংশগ্রহণ করতে দেখা যাবে কিনা তা নিয়ে আমি যথেষ্ট শংকিত) , ঝিমাতে ঝিমাতে মাছি তাড়ানো আর অন্যহাতে নিয়ম মেনে বোনকে দোলানো । বেকার মানুষের আকর্ষণ ধরে রাখতে এই কারনগুলো যথেষ্ট পরিণত ।
মনুষ্যকরণ পদ্ধতি নিয়ে আমার নিজস্ব কিছু অভিমত রয়েছে । বেকার মানুষদের সকল বিষয়ে কিছু না কিছু অভিমত থাকেই, আমারো আছে । এই অভিমতগুলো হল আমার অলস মষ্তিষ্কের কিছু কাজ করার প্রচেষ্টা মাত্র ।
ক্লাশে প্রায়শই আব্দুল আজিজ স্যার ঙানগম্ভির লেকচার ঝাড়তেন, "শিক্ষা মানুষের অন্তরকে প্রজ্জলিত করে, আলোকিত করে তোলে । শিক্ষিত মানুষ মাত্রই আলোকিত অংশ, প্রশংনীয় স্থান" এই বলেই তাকে অযথাই চশমা খুলে কাঁচ পরিষ্কার করতে দেখা যেত আর মুখে থাকত অদ্ভুদ একটা হাসির রেখা । আমার পাশে বসে মতিন হা করে সব গিলত । আজীজ স্যার চলে যাওয়ার পর তাকে দেদারছে পড়তে দেখা যেত । কথা বলতে গেলেই নাক মুখ কুঁচকে আরো জোরে জোরে পড়তো, ভাবখানা এমন যে একদিনেই পুরো সমাজ আলোকিত করে তুলবে । স্যারের কথাটা তখন সদাসত্য মনে করলেও এখন চিরন্তন মিথ্যা বলে মনে হয় । সত্য হলে মাস্টার্স পাশ করে বেকার বসে থাকা লাগত না । আলোকিত অংশের আলো দেখিয়ে কোথাও না কোথাও কিছু একটা হয়ে যেত ।
সেই মতিনের সাথেই একদিন ফুটপাতে দেখা, হন্তদন্ত হয়ে ছেলেকে নিয়ে স্কুলে ছুটছে । আমি দেখামাত্রই পাশে সরে পড়লাম । বেকার হয়ে এই এক ঝামেলা হয়েছে, পরিচিত কারো সামনে পড়তে ইচ্ছে হয় না, প্রচুর অস্বস্তি হয় । তবে কিভাবে যেন মতিন দেখতে পেল । আমার ধারণা ছিল আমি ভাল মুখ লুকোতে পারি । উটপাখির মত বালিতে মুখ না গুজলেও সহজে মানুষের ভিড়ে মিশে যেতে পারি । সেই ধারনা ভুল প্রমাণ করে দিয়ে মতিন আমাকে খুজে নিল, "আরি তুই বাদশা না ?"
এই প্রশ্নের জবাবে সুন্দরভাবে "না" বলে কেটে পড়া যায় । অনেকবার আমাকে কেটে পড়তেও দেখা গেছে । সেদিন ধর্মতলার সামনে আজিজ স্যারের সাথে দেখা । দাড়ি পেকে সাদা, হাতে বেতের লাঠি নিয়ে ঠুকঠুকিয়ে হাটছেন । "তুমি বাদশা না ?" আমি খুব সুন্দরভাবে না বলে চলে এলাম । স্যার বিভ্রান্ত হয়ে গেলেন, চোখেমুখে অস্বস্তির ছায়া নিয়ে এদিক সেদিক তাকাতে লাগলেন । ভাবখানা এমন যেন বালির ঢিবি খুজে পেলে তাতে গিয়ে মুখ গুজবেন । এক কালের নাপছন্দের ছাত্রকে মনে রেখে আমাকেও বিভ্রান্তিতে ফেলে দিলেন, সেদিন আর কোথাও যাওয়া হয় নি আমার । উটপাখির মত বালিশে মুখ গুজে সারাদিন বাড়িতে পড়ে ছিলাম । মতিনকেও খুব সুন্দরভাবে না বলে পেছনফিরে হাটতে লাগলাম, মনে মনে বেশ পুলকিত । মতিন বিভ্রান্ত হয়ে গেল, কিন্তু অতটাও না যতটা হওয়া উচিৎ । ক সেকন্ড পর পেছন পেছন ছুটে এল ।
"তুই বাদশা, আমি ঠিক চিনেছি তুই বাদশা । বাবু দেখ দেখ এই তোর বাদশা আংকেল"
আমি দেখার মত কোন মানুষ না, অতি সাধারণ চেহারা । বাচ্চারা সাধারণত আমাকে যমের মত ভয় পায় । বড়আপা তো প্রায় মেয়েকে এই বলে চুপ করায়, "ওলে আমার ময়না লে, কাদে না কাদলে বাদশা মামা দলবে" । অদ্ভুদভাবে ওর মেয়েও চুপ মেরে যায় । কিন্তু বাবুর সেরকম কোন লক্ষণ নেই, সে আগ্রহভরে আমার দিকে চেয়ে আছে । অনেকটা বাচ্চারা যেভাবে টম এন্ড জেরী দেখে সেভাবে । মতিন আহত স্বরে জিঙাসা করল, "তুই এরকম করলি কেন ?"
আমি প্রশ্নটা সাগ্রহে এড়িয়ে গেলাম, "কেমন আছিস মতিন ?" প্রশ্নের বদলে উল্টো প্রশ্ন । প্রশ্নে প্রশ্নে কাটকাটি ।
"ভাল রে" মতিনের গলায় আলগা একটা আহ্লাদ চলে এসেছে । বেশ বোঝা যাচ্ছে শুধু ভাল নয়, অনেক বেশী ভাল আছে সে ।
"শোন দশমিনিটের জন্যে এখানে দাড়া । তোর সাথে আমার জরুরী কথা আছে । আমি বাবুকে স্কুলে দিয়ে এই আসছি । প্লিজ দাড়া"
আমি হাসিমুখে উত্তর দিলাম, "যা তুই আমি আছি" ।
মতিন পেছন ফিরে বাবুকে কোলে তুলে ছুট লাগাল । বাবু পেছন ফিরে মুখে একটা আংগুল পুড়ে একইরকম আগ্রহ ভরে আমাকে দেখতে লাগল । এখানে আর দাড়ানোর কোন মানে হয় না । সুখী মানুষের সুখগল্প বেকার মানুষের সহ্য হয় না, অসহ্য লাগে । আমিও এর ব্যাতিক্রম নই । শুধু যে অসহ্য লাগে তা নয়, তার সাথে সাথে আমার প্রচন্ড বিরক্তও লাগে ।
দুদিন ধরে কবিরের মেসে পড়ে আছি । ছেলেটা হাসিমুখে আমাকে খাওয়াচ্ছে দাওয়াচ্ছে, নিজের বেড ছেড়ে ঘুমোতে দিচ্ছে । বেকার মানুষের একজন একস্ট্রা অর্ডিনারি বন্ধু থাকে, যে সবসময় হাসিমুখে পাশে দাড়িয়ে থাকে । কবিরও আমার সেইরকম একজন বন্ধু । আজ অবশ্য বাড়ি যাওয়া যেতে পারে, তার আগে অতি অবশ্যই রফিকের দোকান থেকে ঘুরে আসতে হবে ।
"ভাইজান এট্টু খানাপিনার ব্যাবস্থা করছি" খুশি খুশি মুখ রফিকের "বইনটার নাম রাখমু, আপনে একটা ভালা নাম রাইখ্যা দেন"
আমি চায়ের কাপ পাশে নামিয়ে রাখি । নাম রাখা অতীব শক্ত কাজ ।
দেখা গেল নাম রাখার পর, বাচ্চার বাবা অথবা মায়ের পছন্দ হল না, তখন অযথাই ক্যাচাল লেগে যেতে পারে । আবার বড় হয়ে যার নাম রাখা হয়েছে তার নিজের পছন্দ না হলে শাপ শাপান্ত করতে পারে । এখানে অবশ্য শুধু রফিকের পছন্দ হলেই চলবে । যদ্দূর জানি ওর আশে পাশে, আগানে বাগানে ওর কোন আত্মীয়-স্বজন নেই ।
"এক কাজ কর "পুতুল" রাখ । সামনে মোছাঃ লাগায় নিবি, পেছনে আক্তার অথবা বেগম লাগায় নিলেই চলবে । না হলে খালি "পুতুল" রাখবি । নামটা কিন্তু মন্দ না, কি বলিস ?"
রফিকের মুখে রক্ত সরে গেছে, "ভাইজান ভেতরে আহেন" । ওর কথামত ভেতরে ঢুকি, কোনমতে জায়গা আটে আমার । রফিক ঝাপ নামায় । কোথথেকে একটা টর্চ জ্বালিয়ে পোটলাটাতে আলো ফেলে, "এই দেহেন ভাইজান আমার বোনডিও সত্য সত্যই পুতুল । দেহেন দেহেন নাইড়া দেহেন ।"
আমি নেড়ে চেড়ে ভাল করে দেখি । প্লাষ্টিকের পুতুল, মুখে মুচকি হাসি, চুলগুলো ইংরেজি মুভির নায়িকাদের মত লাল ।
"ভাইজান, মায়ে বইনডারে জন্ম দিল হাসপাতালে । সারা রাইত চক্ষের পাতা এক করি নাই । বইনডারে যহন দেহে, হেয় তহন কানতাছে । আমারে দেইখাই চোখ মেইলা হাতডা বাড়ায় দিল । জানেন ভাইজান চুক্ষু দুইটা ইয়া বড় বড় । মায়ের লাহান সুন্দর হইছে । দেইখা আমার কইলজাডা জুরাইলো । আমি বাহিরথন আইসা ফাকা বেডে শুইয়া পড়ছি । ঘুম ভাঙতে বইনের কাছে আবাড় গেইলাম । দেহি মা একলা শুইয়া রইছে । মুহে আঁচল চাপা, কানতাছে । আর একজন মহিলা কোলে টোপলা লইলা চইলা যাইতেছে । মারে জিগাইলাম, "মা বইন কই ?" মায় কিছু কয় না, থির পইড়া আছে । ওদিহে দেহি মহিলাডার পোটলাথন কে জানি কান্দে । আমি চিন্না ফালাইলাম ঐডাই আমার বইন । ছুট দিলাম, জানেন ভাইজান মহিলাডা আরো জোরে ছুটে । ছুটতে ছুটতে একটা গাড়ির থন উইঠা চইল্লা গেল । গাড়ির পেছন পেছন ছুইটা ছুইটা চিল্লাইলাম, "আম্মাগো মোর বইনডারে দিয়া যান, মোর বইনডারে নিইয়া যাইয়েন না, ও আম্মা" কানে হুনলোই না ভাইজান, চইল্লা গেল । দৌড়াইতে দৌড়াইতে পইড়া গেলাম । দেহি একডা ভাঙা পুতুল পইড়া আছে । ঐডারে তুইল্লা চইলা আইছি, আর ফিররা যাই নাই । যে বাপ মায়ে পেডের মাইয়ারে ধইরা রাহতে পারে না, তার মুহে থু । একদলা থুথু ফেলে রফিক । আর যেই বাপ মায়ে মাইনষের মাইয়া তুইলা লইয়া যায় তার মুহে ডাবল থু । আর থু ফেলে না রফিক । হয়ত থু দিতে দিতে তার মুখের থুতু শেষ হয়ে গেছে ।
বাইরে ঝমঝম বৃষ্টি হচ্ছে । আমি রফিককে বললাম, "ভিজবি নাকি ?"
"না ভাইজান ভিজলে জ্বর সর্দি হইব, আমার কিছু হইলে বইনডারে দেখব কেডা ? ওয় আবার আমার হাতের দুলুনি না পাইলে ঘুমাইতে চায় না"
"ও, থাক তাইলে"
"জ্বে ভাইজান"
আমি বেড়িয়ে আসি, প্রবল বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে একদম বাড়ির দরজায় । মা দরজা খুলে দেন, চোখ মুখ নির্বিকার । পররাই নাকি দুধের মাছি হয়, আপন কখনোই নয় । রক্তের মানুষও যে তাই হয় এদের না দেখলে কেউ বুঝবে না । আমার সব সহ্য হয়ে গেছে, আমাদের সহ্য করতে হয় ।
রাত দুটো তিনটে হবে, প্রচন্ড জ্বর উঠেছে, বাড়ির সবাই ঘুমে । সেই সন্ধ্যায় বৃষ্টিতে ভিজে এসে যে ঘুমিয়েছি এই উঠলাম । বড়আপা গভীর ঘুমুচ্ছে, কাল মনে হয় দুলাভাই নিতে আসবে । আমি পুতুলকে কোলে তুলে নিলাম, বড়আপার মেয়ে, ঠিক মেয়ে নয় পৌষ্য সন্তান । এ রফিকের বোন, হাসপাতালের মহিলাটাই বড়পা । কোলে নেওয়ার সাথে সাথে পুতুল আড়মোড়া ভাঙল । জ্বর শরীরের উষ্মতা পেয়েছে মনে হয় । চুপ মেরে গেছে, অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম মেয়েটার চোখদুটো হাসছে ।
দেয়ালঘড়িতে পাঁচটা বাজছে. পুতুলকে রফিকের পোটলা দোলনাতে রেখে ভাঙা পুতুল তুলে এনেছি । রফিক ঘুমের মাঝেও নিয়ম মেনে পোটলা দোলাচ্ছে । পুতুলও আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়ল । কোন ট্যা প্যা নেই, কে বলবে এই সেই কাঁদুনে মেয়ে ! বড়আপার পাশে প্লাষ্টিকের পুতুলটাকে শুইয়ে দিয়ে ঘরে চলে এলাম । জ্বরটা বোধহয় বাড়ছে । বড়পার ঘরে মৃদ্যু ওয়্যা ওয়্যা শব্দ । বড়পার হাত লেগেছে বোধহয় । চাইনিজ পুতুলের কলকব্জা ভাঙলেও সাউন্ড সিস্টেম ঠিক আছে দেখছি । জ্বরের প্রোকোপ মনে হয় আরো বাড়ছে, ঘোরের মাঝে চলে যাচ্ছি । ওদিকে বড়পা ঘুমের ঘোরে পুতুলকে থামাচ্ছে, "এরকম করে না সোনা, নাহলে বাদশা মামা ধলবে, ওলে লে লে" ।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে জানুয়ারি, ২০১৬ সকাল ৯:২৮