জীবন সঙ্গী বা সঙ্গিনীর মধ্যে মিল খুঁজতে খুঁজতে জামার রং, কাপড়ের ধরণ পর্যন্ত গড়ায়। শুরু হয় হয়তো কাছাকাছি বয়স, একই দেশ, একই গ্রাম/পৈত্রিক/মাতৃক এলাকা, একই লাইনের চাকরি, একই ধর্ম, একই শহরে বড় হওয়া, একই গান ভালোবাসা, একই ধরণের বই ভালোবাসা, একই আদর্শ, এরকম অনেক 'একই', যাতে 'কমন প্লাটফর্ম' পাওয়া যায়, যাতে পুরা পৃথিবী ভেসে গেলেও দুই জন মানুষ একই তরীতে উঠে দিব্যি বেঁচে থাকে একজন আরেকজনকে নিয়ে। এখন কিছু কিছু মিল আছে যেগুলো বেশির ভাগ মানুষের ক্ষেত্রে দারুণ কাজ করে। যেমন এক ভাষা বলতে, একই খাবার ভালোবাসা, এগুলো সমাজের বেশির ভাগ মানুষের দৈনন্দিন সুখের জন্য ভীষণ রকমের গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সবার কাছে না। সমাজের মানুষ জন হই চই করে যখন নিজেরা এক ধরণের 'একই প্লাটফর্মে' অভ্যস্ত থাকে কিন্তু কেউ সাহস দেখিয়ে ফেলে তার চেয়েও ভিন্ন কিছু করে ফেলার, যেমন--বয়সে বড় কোন মেয়েকে বিয়ে করা, সিলেটের ছেলে হয়ে ময়মনসিংহের মেয়ে বিয়ে করা, হিন্দু হয়ে মুসলিম কাউকে বিয়ে করা।
সমস্যা হচ্ছে, মানুষ বুঝতে পারে না, যেই দু্ইজন স্রোতের বিপরীতে গিয়ে বিয়ে করতে চাচ্ছে, তারা নিজেদের একটা ছোট্ট নৌকা খুঁজে নিয়েছে। ইউনিভার্সিটিতে একই সাবজেক্টে পড়া, একই গান শোনা, একই খাবার খাওয়া, দিনের ৯৫% কাজ এক ভাবে করা দুইজন মানুষ যখন ১০০% সময় এক সাথে কাটাতে গিয়ে বিয়ে করতে চায়, তখন বাবা মায়ের টনক নড়ে, আরে হিন্দু মুসলমানের বিয়ে ক্যামনে হয়!
ভুল বুঝাবুঝি না হওয়ার জন্য আগেই ডিসক্লেইমার দিচ্ছি--আমার ধর্ম আমার কাছে সব কিছু। কুরআনে যেখানে বলা হয়েছে, মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে আল্লাহর ইবাদত করার জন্য, সেখানে আল্লাহর ইচ্ছার উপরে নিজের ইচ্ছা থাকাকে আমার কাছে ঔদ্ধত্য আর বোকামি মনে হয়। এক দিনে পাঁচবার নামাজ, অন্তত: একবার কুরআন পড়া, বাইরে যাওয়ার সময় পোশাক আশাকে সীল ছাপ্পড় আর খাওয়ার সময় সাবধানতা--এগুলো আমাকে খুব আলাদা করে দেয় অন্য ধর্মের যে কোন মানুষের থেকে, এমনকি নিজ ধর্মের এমন মানুষদের থেকে যারা ধর্মের অনুশাসনের চেয়ে নিজের বিচার বুদ্ধির উপর আস্থা বেশি রাখেন। আমি টাকা জমাতে পারলে ইউরোপে বেড়াতে যাওয়ার চেয়ে মক্কায় ঢু মারতে ভালোবাসব অনেক বেশি। তাই আমার বা আমার মত মানুষেরা, যারা ধর্মের অনুশাসন মেনে চলতে চান, তারা অন্য ধর্মের মানুষদের খুব ভালো বন্ধু বা সহকর্মী হিসেবে পেতে পারে, কিন্তু জীবন সঙ্গী কিছুতেই না। যেখানে আমি মন প্রান দিয়ে বিশ্বাস করছি আল্লাহর কথা জেনে বুঝে অমান্য করা ভীষণ অপরাধ, আল্লাহর কথা না মানলে মারা যাওয়ার পর ভয়াবহ সব পরিণতি হবে, সেখানে আমি যেই মানুষটাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি, তার কাজ কর্মে এর বিপরীত কিছু দেখলে কষ্ট তো পাবই, কখনও মুখে নিষেধ করব, কখনও অভিমান করব, কখনও রাগও করব। জীবন সঙ্গীর সাথে চিন্তা ভাবনায় এত বড় বৈপরিত্য থাকলে এক সাথে সুখে থাকা যায় না।
কিন্তু, বাবা মায়েরা যখন নিজেরা শুধু ঈদ/পূজা ছাড়া ধর্মের কাছ ধার ঘেষেন না, তখন ছেলেমেয়েরা অন্য ধর্মের কারও হাত ধরলে সেখানে 'সমাজ গেল, জাত গেল, মান সম্মান ধূলোয় লুটিয়ে গেল' করে। ব্যাপারটা যে কি চরম রকমের যুক্তিহীন, সেটা মানুষ কেন বুঝে না, আমি জানি না।
শুধু মিল থাকলেই সব সময় সুখ আসে না, সেরকম উদাহরণও প্রচুর। তা না হলে একই জাতি বা একই ধর্মের মানুষদের মধ্যে বিয়ে হলে তালাক ব্যাপারটা থাকতো না। একই সাথে স্কুল কলেজ পড়া বন্ধু বান্ধবেরা বিয়ে করার পরে টের পায়, সারা জীবন এক ছাদের নিচে কাটানো সম্ভব না। দিনের পর দিন গান, প্রিয় খাবার আর চিন্তা ভাবনায় অসাধারন মিল পেয়ে এক সাথে থাকা শুরু করার পরে হাঁপিয়ে উঠে। ভাবছিলাম, এমন কেন হয়?
দেখলাম, মিল আর ভালোবাসার পাশাপাশি ভীষণ রকমের গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে, মানুষটাকে শ্রদ্ধা করতে পারা।
অনেক আগে একটা মুভ্যি দেখেছিলাম, বাবা মা সবার মতের বিপরীতে গিয়ে ডাক্তার রাণী মুখার্জী বিয়ে করেছিল পাড়ার কারিজমেটিক একটা ফাও ফাও ঘুরে বেড়ানো বেকার ছেলেকে। বিয়ের কয়েক মাস পরে প্রাথমিক মুগ্ধতা কেটে যাওয়ার পর শুধু ঝগড়া হতো। যেদিন যেদিন ঝগড়া হতো, রাণী সেই দিনগুলোতে ক্যালেন্ডারে লাল দাগ দিয়ে রাখত। মাস শেষে দেখা যেত শুধুই লাল।
স্কুল জীবনে দেখা মুভ্যিটা কিন্তু আমাকে খুব ভাবিয়েছিল। কি মিষ্টি রোমান্টিকতা আর দুষ্টুমিতে ভরা একটা সম্পর্ক এরকম হয়ে গেল কেন? ভেবে দেখলাম, মেয়েটা ছেলেটাকে শ্রদ্ধা করতে পারছে না। সে নিজে প্রতিদিন হাসপাতালে খেটে এসে বাসায় এসে দেখে স্বামী দিব্যি ঘুমাচ্ছে, ও প্রতিদিন নতুন দায়িত্ব নিচ্ছে ঘাড়ে, কিন্তু স্বামী সেই আগের ক্যারিজমেটিক বেকার ছেলেই, আর কিছু না। শ্রদ্ধা আসবে কোথা থেকে?
আমার পরিচিত একজন হিজাবী মেয়ে প্রায়ে পনের বছর আগে বিয়ে করেছিল গড়পরতা প্র্যাকটিসের একজন ছেলেকে। সব দিক দিয়ে দারুণ সুন্দর জুটি। কিন্তু ছেলেটা মেয়েটাকে নিয়ে কোথাও যাওয়ার সময় মটর সাইকেলে করে অর্ধেক পথ নিয়ে গিয়ে বলত, তুমি বোরখা খুলো, না হলে নিয়ে যাব না বন্ধুদের সামনে। কখনও অনুনয়, কখনও স্বামী-অধিকার খাটিয়ে নির্দেশ, কখনও ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইলিং, কখনও নি:শব্দ ধর্মঘট। মেয়েটা বিচ্ছিরি রকমের মানসিক কষ্টে পড়ে গেল। এক দিক দিয়ে স্বামীকে ভীষণ ভালোবাসে, অন্য দিক দিয়ে আল্লাহকেও। কাকে ছেড়ে কাকে ধরে?
শেষ মেষ অনেকগুলো বছর পরে ছেলেটা মেয়েটা ধর্মপরায়নতা মেনে নিয়েছিল। খুব পছন্দ না করলেও, অন্তত: হিজাব নিয়ে এখন আর কিছু বলে না বউকে। কিন্তু, এই পর্যায়ে আসতে অনেকগুলো বছর লেগে গিয়েছিল, এবং মেয়েটাকে অন্তত: খুব বুঝদার হতে হয়েছে। কখনও কখনও চোখের পানি নাকের পানি মিশিয়ে হিজাব খুলেই ফেলতো!
আবার এরকমও দেখেছি, স্বামী গান পছন্দ করে, কিন্তু বউ কানে আঙ্গুল দিয়ে রাখে, গান শোনা পাপ তাই। স্বামী বেচারা খুব প্রিয় প্রিয় গানগুলো জীবন সঙ্গিনীর সাথে ভাগাভাগি করতে পারে না। আস্তে আস্তে দূরে সরতে সরতে কয়েক বছর পরে দেখা গেল স্বামী সারা রাত টিভি দেখতে দেখতে সোফাতেই ঘুমিয়ে পড়ে, বউ বেডরুমে। দিনের পর দিন শুধু প্রয়োজনীয় কথা ছাড়া আর কোন কথা নেই।
এই উদাহরনগুলো ছোটবেলা থেকে সামনে ছিল বলে খুব ভাবিয়েছে। বুঝেছি, একজনের কাছে একটা জিনিসের গুরুত্ব এক নম্বরে থাকলে, অন্য জনের কাছে সেটা যদি একেবারেই অর্থবহ না হয়, তাহলে এক সাথে থাকা খুব কঠিন। এক নম্বরের জায়গায় দুই তিন নম্বরে থাকলেও হয়, শ্রদ্ধা ভাগ বাটোয়ারা করে থাকা যায় এক সাথে, ভালোবাসা দিয়ে। কিন্তু যেখানে স্বামী ভীষণ বিব্রতবোধ করছে বউয়ের ধর্মপরায়নতা নিয়ে, ধর্মপরায়ন বউ নিয়ে গর্ব দূরে থাক, হীনমন্য বোধ করছে, সেখানে, অন্য দিক দিয়ে এক সাথে ধরে রাখার অনেক কিছু না থাকলে, তৃপ্তিতে আর সুখে থাকা অসম্ভবের কাছাকাছি।
আমার খুব কাছের একজন আত্মীয়ের স্ত্রী আইরিশ এবং ক্যাথলিক। ধর্ম, সংস্কৃতি সব কিছু দুইজনের পুরাপুরি আলাদা। বিয়ের পঁচিশ বছর পরেও ওনার স্ত্রী প্রতি রবিবারে চার্চে যান। অথচ উনি নিজে উমরাহ করেছেন, হজ্জ্ব করেছেন, রোজা রাখেন, দৈনিক নামাযের অন্তত: চেষ্টাটুকু করেন। এত এত অমিল, অথচ এই মানুষটাই পুরাপুরি আত্মবিশ্বাস নিয়ে আমাকে বলেছিলেন, 'আমি বাংলাদেশের গ্রামে বড় হওয়া ছেলে আর ও আয়ারল্যান্ডের কোন কোণার মেয়ে, কিন্তু পঁচিশ বছর ধরে আমি ওঁর সাথে আছি, এবং আমি তোমাকে বলছি, আমি ওঁকে নিয়ে ভীষণ রকমের সুখী। ওকে নিয়ে আমার এক বিন্দু আক্ষেপও নেই'।
পয়ষট্টি বছর বয়সেও ভীষণ হাসি খুশি মানুষটার উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস--বয়সের সাথে সাথে আসা স্বাভাবিক রোগগুলোও নেই। ওনার কথাটা পুরাপুরি বিশ্বাস করতে আমার একটুও কষ্ট হলো না।
ভেবে দেখলাম, এই দুইজন মানুষ এক সাথে সুখী, কারণ ওঁরা দুইজনই একজন আরেকজনের জীবন যাপনের ধরণকে শ্রদ্ধা করতে পারছে।
এতটুকু পড়ে কেউ যদি এই সিদ্ধান্ত টানেন যে শুধু নিজের মত করে ধর্ম পালন করলেই সুখের সংসার হবে, ধর্মের পুরাটুকু মেনে সেটাতে অন্যজনকে টানার চেষ্টা করা ভুল, তাহলে সিদ্ধান্তটা ভুল হবে। আমার পর্যবেক্ষন সেটা বলে না।
বরং, নিজের লিমিটেশন নিজের জানতে হবে। নিজেকে বুঝতে হবে, কোন জিনিসগুলো ভালোবাসতে পারবে, কোনগুলো শ্রদ্ধা করতে পারবে, কোনগুলো পারবে না।একটা ছেলের কাছে যদি ফর্সা=সৌন্দর্য্য হয়, কিন্তু মহৎ সাজতে গিয়ে কালো মেয়েকে বিয়ে করে, তাহলে সে নিজের এবং বউয়ের প্রতি চরম অবিচার করবে। যেই মেয়েটার কাছে পোশাক আশাক আর কথা বার্তার রুচিশীলতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সে জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল করবে যদি ধনী, পড়াশোনায় ভীষণ ভালো, চেহারা ছবিও ভালো কিন্তু 'খ্যাত' কাউকে বিয়ে করে বিয়ের পরে সব সাইজ করে ফেলার আশায়। প্রথম থেকেই শ্রদ্ধা বস্তুটা সম্পর্ক থেকে পুরাপুরি উহ্য থেকে যাবে। প্রাথমিক মুগ্ধতা কেটে যাওয়ার পরে আশাহত বুকের ক্ষত লুকিয়ে রেখে হুল ফুটানো কথা আর ক্রমাগত আক্ষেপে দুইজন নির্দোষ মানুষ শুধু কষ্টই পাবে, তৃপ্তি পাবে না। হ্যা, দুইজনই নির্দোষ, শুধু জীবনের দর্শনে আকাশ পাতাল তফাৎ!
ভালোবাসা অনুপস্থিতিতে শুধু শ্রদ্ধা নিয়ে থাকলে একটা শীতল দুরত্বে সম্পর্ক আটকে যাওয়ার সম্ভবনা প্রচুর। আর শ্রদ্ধা ছাড়া ভালোবাসা থাকলে, সেই ভালোবাসা উড়ে যাওয়ার সম্ভবনাও অনেক। তাই সবচেয়ে ভালো সমাধান হচ্ছে, ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা--এই দুইটার সুষম সমন্বয়!
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে অক্টোবর, ২০০৯ রাত ১১:৩০