somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জরাথ্রুষ্টবাদঃ পারস্যর বা মধ্য এশিয়ার প্রথম একেশ্বররবাদী ধর্ম

২২ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০ বিকাল ৫:৩০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



রহস্যময় জরাথ্রুষ্ট। গ্রীক উপাখ্যানেও তার নাম আছে, জরাথ্রুষ্ট নামের অনেক অর্থ আছে, প্রাচীন পার্সিয়াবাসী তারা নামের অর্থ করেছিল “উটের পিঠে আরোহী বার্তা বাহক”। পার্সিয়ার এই ধর্ম প্রচারককে নিয়ে জোহান ষ্ট্রস ছবি তৈরী করেছেন। ষ্ট্যানলি কুবরিক “আ স্পেস অব অডিসি”তে দেখিয়েছেন জরাথ্রুষ্টের দর্শন বা মতবাদ।


Freddie Mercury, the legendary lead singer of Queen, drew inspiration from the Zoroastrian faith of his Persian family (Credit: Alamy)

কুইন” ব্যান্ড গ্রুপের লিজেন্ডারি সিংগার ফ্রেডি মারকুরি জরাথ্রুষ্ট্রবাদ দ্ধারা প্রভাবিত হয়েছিল। কোথাও কোথাও দেখেছি “মাজদা” গাড়ী কোম্পানীর নাম ও জরাথ্রুষ্ট ঈশ্বর আহুর মাজদা থেকে এসেছে। জরাথ্রুষ্টবাদের কিছু লেখা দেখলাম নেটে তাতে আমার কাছে কোন কোন ক্ষে্ত্রে মনে হয়েছে, এরা না বুজেই অনেকাংশে পুরা ব্যাপারটা গোঝামিল দিয়ে ফেলছে। পিথাগোরাস থেকে ভলতেয়ার, রাফায়েল এরা সহ অনেকেই জরাথ্রুষ্টবাদ দ্ধারা প্রভাবিত হয়ে ছিল।



পারস্য এবং মধ্য এশিয়ার জানামতে প্রথম ধর্ম প্রচারক জরাথ্রুষ্ট আদর্শে বিশ্বাসীরা বলে তাদের নবী জরাথ্রুষ্ট পৃথিবীতে আসেন আলেকজান্ডারের ২৫৮ বছর আগে, এর অর্থ দাড়ায় আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেট পার্সেপোলিস ধ্বংস করেছিল খ্রিষ্টপূর্ব ৩৩০ শতাব্দীতে, তাহলে হিসাব করলে পাওয়া যায় জরাথ্রুষ্ট পৃথিবীতে আসে খ্রিষ্টপূর্ব ৫৮৮ শতাব্দীতে

ঠিক একই সময় আকামেনিস সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সাইরাস দ্যা গ্রেট জন্ম গ্রহন করেছিলেন। তার জন্ম সময় খ্রিষ্টপূর্ব ৫৯০ থেকে ৫৮০ শতাব্দীর কোন এক সময়। জরাথ্রুষ্ট ধর্ম বিশ্বাসে প্রথম ব্যাক্তি ছিলেন রাজা বিশ্বথাপা। তিনি ছিলেন দারিউস দ্যা গ্রেটের বাবা। সাইরাস এবং দারিউসের শাসনামলে প্রধান গভর্নর ছিলেন বিশ্বাথাপা। কিন্তু এখানে আমরা জানি যে, দারিউসের দাদা এবং পিতামহ সবাই এক এবং একমাত্র ঈশ্বর “আহুর মাজদার নির্দেশে চলতেন। সেটাও আলেজান্ডারের পারস্য দখলের ২৫৮ বছর আগে। হয়তোবা এরও আগে।



কিন্তু আধুনিক ঐতিহাসিকরা এব্যাপারে একমত জরাথ্রুষ্টের জন্ম তার ধর্ম প্রচার সব কিছুই পারস্য থেকে আগত। তেহরানের প্রাচীন নগরী “রাহাজ” থেকে এর প্রসার ঘটে, আবার এমন ধারনাও করা হয় ইরানের উত্তর পশ্চিমের নগরী “মেডেয়া” থেকেও এর উৎপত্তি হতে পারে। আফগানিস্থানের মানুষজনের প্রাচীন গাথা অনুযায়ী জরাথ্রুষ্ট “বালাক” নগরীতে তার ধর্ম প্রচার করতেন। আবার সোভিয়েট ইতিহাসবেত্তাদের মতে তিনি ছিলেন কাজাখস্থানের অধিবাসী। মুলতঃ জরাথ্রুষ্টের ধর্ম প্রচার নিয়ে ধর্ম নিয়ে গবেষনাকারীরা আজো অধিকাংশ ব্যাক্তিবর্গই কোথা থেকে এই ধর্মের উৎপত্তি হয়েছিল তা নিয়ে যে সব যুক্তি এবং তথ্য প্রমান হাজির করে তার প্রায় সবই অনুমান নির্ভর বা বিকৃত তথ্যের।

জরাথ্রুষ্ট ওই পৌত্তলিক সময়ের সাপেক্ষে যখন প্যাগান বা বিভিন্ন দেব দেবীর মুর্তিপুজা করছিলো তখন এক বিপ্লবী ধর্ম প্রচার করেছিলেন যার মুল বক্তব্য ছিল ঈশ্বর এক এবং অদ্বিতীয়। প্রচলিত ধর্ম যুগের পর যুগ কালের পর কাল মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়েছে, মানুষের হৃদয়ে এই কথা এমনভাবে গেথে গিয়েছিল যে এমন কি তার অনুসারীরা যতক্ষন তার আদর্শের এবং দর্শনের কথা লিখে না রেখেছে ততদিন মুখে মুখেই প্রচারিত হচ্ছিল। স্বভাবতঃই তার কিছু কিছু অংশ বিকৃত হয়ে গিয়েছিল, সেই বিকৃতিটুকু কতখানি, আজ আর তা নির্নয় করা সম্ভব না। জরাথ্রুষ্ট ধর্মের সংকলিত ধর্মগ্রন্থ যা গ্রীক এবং রোমান ভাষায় লিখিত ছিল তার নব্বই ভাগই হারিয়ে গেছে।



জরাথ্রুষ্টবাদীরা বলে তাদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থের বহু পান্ডুলিপি আলেকজান্ডার যখন পারস্য দখল করে তখন পুড়িয়ে দেয়। এখানে একটা রহস্যময় ব্যাপার হল ইরানিরা কিভাবে তাদের এই ধর্মগ্রন্থ হারিয়ে ফেলে তার কোন সদুত্তর মেলে না, যেখানে ইহুদীরা কয়েক হাজার বছর ব্যাপী তাদের ধর্মগ্রন্থ সংরক্ষিত রাখে এত ঝড় ঝাপটার পরো, একই কথা খাটে খ্রিষ্টানদের বাইবেল সন্মন্ধ্যেও, যুগে যুগে বিভিন্ন সময় এই ধর্ম দুটোর শুরুর দিকে অনেক অত্যাচার হবার পরো তারা তাদের সংকলিত ধর্মগ্রন্থের প্রাচীন রূপ যদিও পরিবর্ধিত বা পরিমার্জিত তবুও সংরক্ষনে রেখেছিল। পারস্যের রাজা সাইরাসের সময় সেদেশে লেখনির কোন উপকরন ছিল না, কিন্তু সম্রাটের নির্দেশে পাথরের গায়ে খোদাইলিপি ছিল।

আলেকজান্ডারের পারস্য বিজয় করার পর জরাথ্রুষ্টবাদ ধ্বংসের দ্বার প্রান্তে উপনীত হয় এবং এক পর্যায়ে যেহেতু লিখিত আকারে কিছু না থাকায় পরবর্তী এক শতাব্দীতে এই ধর্ম এবং ধর্মের অনুসারীরা প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যায়, খুবই নগন্য কিছু মানুষ তাদের মুখে মুখে এই ধর্মের আলো টিম টিম করে জ্বালিয়ে রেখেছিল।



জরাথ্রুষ্টের অনুসারী এবং ধর্মপ্রচারক কাটির ছিল মনিবাদের প্রবক্তা মনির ঘোরতর শত্রু, এখানে মনিকে নিয়ে কিছুটা না লিখলে অনেকেই মনিকে নিয়ে কিছুটা বিভ্রান্ত হয়ে যাবেন। মনিবাদ নিয়ে নিয়ে লিখতে গেলে ভিন্ন আর একটি পোষ্ট হয়ে যাবে, শুধু এটুকুই বলি “মনি অমর” নামে আর একজন ধর্ম প্রচারকের আবির্ভাব ঘটেছিল তাঁর সময়কাল ২১০-২৭৬ খ্রিস্টাব্দ। প্রফেট (!) মনি ২১৬ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন দক্ষিণ ব্যাবিলনে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। সে সময়টায় ব্যাবিলন ছিল পারসিক সাম্রাজের অন্তর্গত। তিনি ছিলেন মনিবাদ বা Manichaeism-এর প্রবক্তা (মনিকে নিয়ে অন্য কোন দিন পোষ্ট দেব)। তবে তার আগে অন্য কথা এই কাটিরও কিন্তু জরাথ্রুষ্ট ধর্মের কিছু ব্যাপার লিপিবদ্ধ করার চেষ্টা করছিলেন, আর এক ধর্ম প্রচারক তানসার ও এই ধর্মের তত্ত্বগুলো লিখিত আকারে আনার চেষ্টা করছিলেন। রাজা শাহের সময় তিনি এই কাজ করেন কিন্তু সেটা আলেকজান্ডারের পারস্য বিজয়ের ৬০০ বছর পর অর্থ্যাৎ তৃতীয় শতাব্দীর দিকে।

এই ঘটনার দিকে দৃষ্টি দিতে গিয়ে সোভিয়েট ধর্মতত্ত্ববিদ হায়াম সালোভিচ বলেন, “যখন পৃথিবীতে সব কিছু লিখিত আকারে গ্রহনের অলিখিত আইন পাশ হল, আনুষ্ঠানিক শিক্ষা পদ্ধতি চালু হল তখন থেকেই অলিখিত কোন ধর্মগ্রন্থের বানী মানুষের কাছে মনগড়া মনে হতে থাকে।” প্রাচীন সমাজের ধ্যান ধারনা সব কিছুর মুল্য হারিয়ে গেল, একজন মানুষ কতটা দেখছে তার ওপর না একজন মানুষ কতটা জানে সেভাবেই বিচার করা হল তাদের লিখিত বানী থেকে।


Yasna 28.1, Ahunavaiti Gatha (Bodleian MS J2)

যখন আভেস্থা সংকলিত হল, সে সময়ের মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত বিভিন্ন কবিতা বা শ্লোক গুলো থেকে। আভেস্তা (এখানে উল্লেখ্য “আভেস্তা” কিন্তু একটা ভাষা ঐতিহাসিকভাবে যা “জেন্দা” নামে পরিচিত যা প্রাচীন ইরানিয়ান ভাষা থেকে উদ্ভুদ্ধ, এখানে উল্লেখ্য যে সংস্কৃতি ভাষার সাথে এর অনেক মিল আছে, এনিয়ে পরে কোন এক দিন লিখব হয়ত) থেকে পার্সি ভাষায় লেখা হয়েছেঃ ‘তোমার মুক্তি জরাথ্রুষ্ট দর্শনের “মিথরাবাদে”’ আবার সেটাই সাংস্কৃতিতে এসে হলঃ “হে মানুষ তুমি মুক্তি পাবে জরাথ্রুষ্ট দর্শনে” এ থেকে আমি বুঝাতে চাচ্ছি যে মুল আভেস্থা যেটুকু টিকে আছে সেখান থেকে যখন অন্য ভাষায় রূপান্তরিত হল তখন অনেকটা পরিবর্তিত হয়ে গেল। আভেস্তা পাচ ভাগে বিভক্ত, গাথা, ইয়াসনা, ভিস্পরাত, ভেন্দিদাদ, ইয়াসহাত। এর বাইরে কুর্দ আবেস্তা ( ছোট আবেস্তা) বলে আর একটা ছোট গ্রন্থ আছে যেটা নির্দিষ্ট প্রার্থনার সময় পড়া হয়।



অনেক ঐতিহাসিকের মতে বেদের কিছু জায়গায় আবেস্তার সাথে আর্শ্চয্যজনক মিল খুজে পাওয়া গেছে, সে হিসাব করতে গেলে এটা হিসাবে রাখতে হবে যে ভারতীয় আর্যরা এসেছিল পারস্যর দিক থেকে। এবং সময়টা ছিল ১৫০০ থেকে ১২০০ খ্রিষ্ট পূর্বে। সে হিসাবে জরাথ্রুষ্টের আগমন আরো আগে মানে খ্রিষ্টপূর্ব ১২০০ সালের পূর্বে। সময়টা এমন যে তখন মধ্যপ্রাচ্যের অন্য প্রান্তে তখন মোজেসের ধর্ম এবং দর্শন নিয়ে তোলপাড় চলছে। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে তার আগমনের সময় কাল খ্রিষ্ট পূর্ব ১৭০০ থেকে ১৫০০ সাল নাগাদ। যখন আব্রাহাম নামক আর একজন মহামানব পৃথিবীর অন্য প্রান্তে এসেছিলেন। এনসাইক্লোপিডিয়া অব রিলিজিয়ন বলছে- “পূর্ব ইরানের গ্রাম্য সংস্কৃতিতে প্রোথিত জরাথ্রুষ্টবাদের শেকড়। ধর্মটি খ্রিস্টের জন্মের ১০০০ বছর আগে উৎপত্তি লাভ করে এবং পারসিক সাম্রাজ্যের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতিষ্ঠিত হয়।” (খণ্ড- ১৫, পৃষ্ঠা- ৫৮০)



বর্তমানে জরাথ্রুষ্টবাদীরা অগ্নির উপাসনা করে, আসলে জরাথ্রুষ্ট সত্যিই অগ্নির উপাসনা করত বলে কোন উল্লেখ্য নেই। তার মৌলিক দর্শন মধ্যপন্থা অনুসরন করত, উগ্রবাদীতা না, প্রচন্ড আত্ম ত্যাগী তিনি ছিলেন না, জরাথ্রুষ্ট তার অনুসারীদের উৎসাহ যোগাতেন তারা যেন এক ঈশ্বরের অনুসন্ধান করে। জরাথ্রুষ্ট বাদীদের মতে সে ৭৭ বছর জীবিত ছিল। তাকে অলৌকিক ভাবে জানান হয়েছিল তার মৃত্যু হবে ছুরিকাঘাতে আর এক ধর্মপ্রচারকের হাতে যার নাম কারাপান। এই কারাপান ছিল মুর্তি উপাসক, বলা হয়ে থাকে জরাথ্রুষ্টের মৃত্যুর পর কারাপানের বোধোদয় ঘটে এবং সে জারাথ্রুষ্টের ধর্ম প্রচার করে। জরাথ্রুষ্ট তার জীবদ্দশায় হামা (গাজা মাদক দ্রব্য) বন্ধ করে দিয়েছিলেন অথচ বর্তমান জরাথ্রুষ্টবাদীরা তার ধর্ম প্রার্থনার পূর্বে গাজা জাতীয় নিষিদ্ধ দ্রব্য সেবন করে। ইরানে জরাথ্রুষ্টবাদীদের যে নওরোজ উৎসব হয় তার শুরু হয় সাতটি জিনিষ দিয়ে। সে বর্ননা দিতে গেলে পোষ্ট অন্য দিকে যাবে তাই আপাতত সেদিকে না যাই।

জরাথ্রুষ্টবাদ নিয়ে আপনি যদি পড়াশুনা করেন তবে দেখবেন সে ধর্ম বিভিন্নভাবে অন্যান্য ধর্মে মিশে গেছে বা প্রভাবিত করেছে, সেগুলো নিয়ে আলোচনা এই পোষ্টে করব না কারন সেগুলো এত বিষদ একটা দুটো পোষ্টে তার ব্যাখ্যা দেয়া যাবে না। সময় সুযোগ পেলে অন্য কোন দিন এ নিয়ে আলাদা পোষ্ট দেব। জরাথ্রুষ্টবাদ নিয়ে কিছু বই সংগ্রহ করছি বিদেশী গবেষকদের সেখানে এই ধর্ম নিয়ে পড়তে গিয়ে দেখলাম বর্তমানে প্রচলিত জরাথ্রুষ্টবাদের সাথে মুল (আসলে মুলটাও যে কতটুকু মুল তা নিয়েও সন্দেহ আছে) জরাথ্রুষ্টবাদের অনেক পার্থক্য। ভালোই লাগছে পড়তে।


Friedrich Nietzsche, circa 1875.

প্রাচীন জরাথ্রুষ্টবাদ কে আধুনিক যুগে এক বিখ্যাত দার্শনিক পুর্নজীবন দিয়েছিলেন তিনি হলেন ফ্রেডরিখ উইলহেম নিৎশে। নিৎসে দর্শনের মুল বিষয় হচ্ছে “ভালো এবং মন্দের মৌলিক পার্থক্য”। নিৎসের আগে জার্মান দার্শনিক স্কোপেনহার কে জরাথ্রুষ্টবাদ ভীষন ভাবে প্রভাবিত করেছিল। সেই স্কোপেনহারের দর্শন পড়ে নিৎসের মনে প্রচন্ড আলোড়ন সৃষ্টি হল। তার মনে হল এ যেন তাকে উদ্দেশ্য করেই বলা হয়েছে। জরাথ্রুষ্টবাদ এবং স্কোপেনহারের দর্শন এবং মতবাদের মিল ঘটিয়ে তিনি লিখলেন “দ্য বার্থ অভ ট্রাজেডি”।

নিৎশে লোকালয় থেকে দূরে কোন জঙ্গলে থাকতেই পছন্দ করতেন। এখান থেকেই তিনি সত্যের অনুসন্ধান করেন। তিনি জরাথ্রুষ্ট দর্শনের প্রতিটি ছত্রে ছত্রে মুগ্ধ হতে থাকেন, এ দর্শনবাদ থেকে তিনি এ সিদ্ধান্তে উপনীত হন “জীবন বা বেচে থাকা খুব তুচ্ছ ব্যাপার, মানুষ কোন কিছুতেই সন্তুষ্ট না, অধিক লোভ লালসা এবং পার্থিব জগতের মোহ তাকে সত্য এবং ন্যায়ের পথ থেকে দূরে রাখে। আর যে মানুষ এই সব ত্যাগ করতে পারে সেই প্রকৃত ধার্মিক।" জরাথ্রুষ্ট ধর্মে এভাবেই ধর্ম প্রচার করা হয়েছে।



চার খন্ডে বিস্তৃত নিৎসের লেখা “দাজ স্পোক জরাথ্রুষ্ট” জরাথ্রুষ্টবাদ নিয়ে বিশদ আলোচনা আছে। তার কথাই ছিলঃ এক ঈশ্বরবাদী হও, সত্যকে মিথ্যার সহিত মিশিও না। ব্যাভিচার কোর না। জরাথ্রুষ্টের প্রকৃত শিক্ষা মানবতাবাদ – সেটা সবার জন্য অবশ্যাম্ভাবী। এই ধর্ম দর্শন মানতে অলৌকিক কিছু করে দেখাতে হয় না। বরং যে মানুষ সত্যের পথে থাকবে, ন্যায় বিচার করবে, হিংসা বিদ্বেষ থাকবে না, লোভী হবে না, সেই হবে প্রকৃত মানুষ। মানবতা, নৈতিকতা তৈরী হবে মানুষের কর্মের মাধ্যমে। এটাই হবে প্রকৃত ধর্ম। নিৎসে জরাথ্রুষ্ট ধর্মের দ্বিবিভাজন এর বিরোধিতা করেছিলেন যা প্রকারান্তে জরাথ্রুষ্টের একেশ্বরবাদীতাকে সমর্থন দেয়।

নিৎসের জরাথ্রুষ্ট দর্শন নিয়ে আশা রাখি সামনে বিস্তারিত আলোচনা করব এবং একই সাথে এই মতবাদের সাথে অন্যান্য কিছু ধর্মের সাদৃশ্য দেখানোর চেষ্টা করব। তবে সমস্যা হল আদি জরাথ্রুষ্টবাদের খুব অল্পই টিকে আছে, আর যা আছে তা এত বেশি পরিবর্তিত যে অনুমিত মুল বিশ্বাসের সাথে অনেক তফাৎ।

বর্তমানে জরাথ্রুষ্টবাদ যেভাবে পালিত হচ্ছে তাতে এই ধর্মকে যতটা না মহিমান্বিত করে, তার থেকে অনেক বেশী করে কৌতুহলী। যাতে মহিমা থাকে না থাকে উৎসুক্য। মানুষ জরাথ্রুষ্টবাদ বলতে যা বুজে তা হল তাদের মৃতদেহ সৎকারের অদ্ভুত পদ্ধতি এবং কিছু আদ্ভুত ধর্মীয় আচার আচরন যা সাধারনতঃ অন্য ধর্মাবলম্বীদের ক্ষেত্রে দেখা যায় না।


Zoroastrians worship in fire temples, such as this one in Yazd, Iran – they believe fire and water are the twin agents of purity and necessary for ritual cleansing (Credit: Alamy)

বর্তমানে আগুনের সাথে জরাথ্রুষ্টবাদীদের সম্পর্ক খুব নিবিড়, এত নিবিড় যে তাদের অগ্নিউপাসক ও বলা হয় অথচ সম্ভবতঃ অগ্নি উপাসনার এই ধারা জরাথ্রুষ্টের মৃত্যুর পর প্রচলিত হয়। জরাথুস্ত্রবাদের কিছু উপাসনাকেন্দ্র আবিষ্কৃত হয়েছে। নকশাগত দিক থেকে এগুলো টাওয়ার ও বর্গাকৃতির। চার দরজা বিশিষ্ট পবিত্র দেয়ালকে বলা হয় চাহারতাক। ইরান জুড়ে এর অসংখ্য নজির বিদ্যমান। পবিত্র আগুনের মধ্যে আবার বিস্তর ফারাক। যাজকদের জন্য আগুনের নাম ফারবাগ, যা প্রথমে খাওয়ারিজমে দেখা যায়, পরে ফারসে স্থানান্তরিত হয়। যোদ্ধাদের জন্য আগুন ছিল গুশনাস্প। তবুও ধর্মীয় একত্বতার প্রতীক এই আগুন। অন্যদিকে বুর্জেন-মিহর আগুন ছিলো কৃষকদের জন্য। এর বাইরেও আগুন দুইভাগে বিভক্ত। আদুরান বা গ্রাম্য আগুন এবং ভারহরান বা রাজকীয় আগুন।



এ রাজকীয় আগুনের দেখভাল যারা করতেন, তাদেরই পেশাগত পদবি ছিল এহরপাত। গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় অনুষ্ঠানে তার ভূমিকা থাকতো অনেকটা সহকারী যাজকের মতো। তার ওপরের পদবি হলো মোবেদ আর সর্বোচ্চ পদবি 'দস্তুর'। দস্তুরের কাজ প্রধান ধর্মযাজকের মতো, যার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মন্দিরের দায়িত্ব দেওয়া হয়। যাজকত্বের দায়িত্ব বংশানুক্রমিক। কিন্তু প্রত্যেককেই একটা নির্দিষ্ট শিক্ষা ও চর্চার ভেতর দিয়ে যেতে হতো। প্রত্যেক জরাথুস্ত্রবাদীর ৭ বা ১০ বছর বয়সে অভিষেক হয়। তখন তাকে 'সাদরে' (শার্ট) এবং 'কুস্তি' (কোমরবন্ধনী) দেওয়া হয়, যা তাকে পরতে হয় পরবর্তী জীবনভর। পায়দাব, নাহন ও বারেশনুম নামে তিন ধরনের পবিত্রতা পদ্ধতি আছে।



পবিত্র অনুষ্ঠান ইয়াসনা মূলত পবিত্র আগুনের সামনে দাঁড়িয়ে আবেস্তার শ্লোক পাঠ করা ও আহুতি দেয়া। পবিত্র আগুনকে নিরন্তর প্রজ্বলিত অবস্থায় রাখা ও দিনে পাঁচবার উপাসনা করা অন্যতম প্রধান আচার। সুর্যোদয় থেকে দুপুরের মাঝে পালনীয় প্রার্থনাকে বলে “হাওয়ান”, দুপুর বেলা থেকে ৩ টা পর্যন্ত পালনীয় প্রার্থনাকে বলে “রাপিথিউন”, বেলা ৩ টা থেকে সুর্যাস্ত মধ্যবর্তী সময় পালনীয় প্রার্থনাকে বলে “উজেরিন”, সুর্যাস্ত থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত প্রার্থনাকে বলে “আইউইশ্রুথ্রুম” এবং মধ্যরাত থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত পালনীয় প্রার্থনাকে বলে “উশাহীন”।



মৃত্যুর পর লাশকে যথাযথভাবে গোসল করানো হয়। জরথ্রুস্টবাদীদের বিষ্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে মৃত্যুর পর মৃতদেহ সৎকার। শকুনেরা যেহেতু সবচেয়ে বেশী উচুঁতে উঠে সূর্যের কাছে যেতে পারে, তাই তারা নিজেদের মৃতদেহকে শকুন দিয়ে খাওয়ানো পবিত্র কর্ম মনে করে। মৃতদেহকে যাতে সহজে শকুনে খেতে পারে তার ব্যবস্থা করে তারা এবং মাংস শকুনে খাওয়ার পর মৃতের হাড়-মজ্জা ‘পবিত্র কুয়ায়’ ফেলে দেয়া হয়। তাদের বিশ্বাস, মরণের ৪র্থ দিনে ‘রুহ’ অহুর মাজদার কাছে বিচারের জন্যে পৌঁছে, এই ৪-দিন মৃতকে শকুন দিয়ে খাওয়ানো অত্যন্ত পূর্ণ কর্ম। কারো দেহ শকুনে না খেলে সেটা অবশ্যই অশুভ।



জরথ্রুস্টবাদিরা যেখানে বাস করে সেখানে সৎকারের ব্যাবস্থা স্বরূপ থাকার কথা মৃতকে শকুন দিয়ে খাওয়ানোর ব্যবস্থা। তবে ভারতে যেহেতু বর্তমানে সবচেয়ে বেশি এ ধর্মের লোক তাই, দক্ষিণ মুম্বাইর মালাবার হিলে ৫৭ একর অরণ্য-উদ্যানের মাঝে বিরাটাকার 'ডখমা' বা ‘টাওয়ার অব সাইলেন্স’ (নির্জনতার স্তম্ভ) নির্মাণ করা হয়েছে। ঐ পাহাড় চূড়ায় বিশাল আধার নির্মাণ করে সেই আধারের মাঝে পাথর বসিয়ে তার উপর মৃতদেহ রেখে আসে তারা। এ টাওয়ারে বা কাছাকাছি শকুনেরা বসে থাকে মৃতদেহটি খাবারের জন্যে। ৩-দিন খাওয়ার পর হাড়গোড়গুলো সংগ্রহ করে অন্যত্র কয়লা ও বালির মিশ্রণের মধ্যে রেখে দেওয়া হয়। এর নাম হাড়দানি (Ossuary ), এরপর যায় পবিত্র কুয়ায় (কবর?)।



এই লেখা লিখতে গিয়ে আমাকে "মিডিয়া পার্সিয়া এ্যান্ড ব্যাবিলন”, পল ক্রিসবাসজেকের “ইন সার্চ অভ জরাথ্রুষ্ট” সহ আরো দু তিনটি বই পড়তে হয়েছে। এর পাশাপাশি বিভিন্ন অন লাইন ফিচার যেমন The obscure religion that shape the west , Manichaeism: The Ancient Religion that Rivaled Christianity , Friedrich Nietzsche, Ahura Mazda, Zoroastrianism, The Last of the Zoroastrians , Zoroastrianism, জরাথুস্ত্রবাদ: একটি ধর্মের আখ্যান, History of Zoroastrianism, Avesta সহ আরো অনেক অন্তর্জাল নিবন্ধ দেখতে হয়েছে।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০ রাত ৩:২০
২১টি মন্তব্য ২২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×