somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

শের শায়রী
অমরত্বের লোভ কখনো আমাকে পায়না। মানব জীবনের নশ্বরতা নিয়েই আমার সুখ। লিখি নিজের জানার আনন্দে, তাতে কেউ যদি পড়ে সেটা অনেক বড় পাওয়া। কৃতজ্ঞতা জানানো ছাড়া আর কিছুই নেই।

আর্যদের উৎপত্তি এবং ভারতীয় এবং জার্মান আর্যদের সুলুক সন্ধানে

১২ ই জানুয়ারি, ২০২০ রাত ৮:১৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


The 4th edition of Meyers Konversationslexikon (Leipzig, 1885–1890) shows the Caucasian race (in various shades of grayish blue-green) as comprising Aryans,Semites, and Hamites. Aryans are further subdivided into European Aryans and Indo-Aryans (the term "Indo-Aryans" was then used to describe those now called "Indo-Iranians").

আর্য নিয়ে আমার কৌতুহল অনেক আগে থেকেই। আর্য মানে কি? এটা নিয়েও মত ভেদ আছে, ভারতীয় হিন্দু শাস্ত্রজ্ঞদের মতে সংস্কৃত ভাষায় লিখিত প্রাচীন শ্লোক অনুসারে “সর্বে গত্যর্থাঃ জ্ঞানার্থাঃ প্রাপ্ত্যর্থাশ্চ” - সমূদায় গমনার্থক জ্ঞানার্থক ও প্রাপ্ত্যর্থক। সুতরাং, যারা জ্ঞানশীল অথবা যারা (শাস্ত্রসীমায়) গমন করেন কিংবা যারা (শাস্ত্রের পার) প্রাপ্ত হন, তারাই আর্য। সোজা বাংলায় যারা সদ্ববংশজাত তারাই আর্য।

কিন্তু বিশেষজ্ঞরা এই ব্যাপারে ভিন্ন মত দেন, তারা বলেন, আর্যগণ প্রথমে পশুপালন করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। তারা দলবদ্ধ হয়ে অনেকগুলো পশু সাথে নিয়ে ঘাস আচ্ছাদিত অঞ্চল বা প্রদেশে গমন করতেন। পরে সে স্থানের ঘাস পশু খাদ্য হিসেবে নিঃশেষিত হলে তারা পুনরায় অন্য অঞ্চল বা প্রদেশে যেতেন। এভাবে তারা প্রতিনিয়ত এক স্থান থেকে অন্য স্থানে গমন করতেন বলে আর্য (অর্থাৎ গমনশীল) নামে পরিচিত হয়েছেন। পরবর্তী সময়ে আর্যগণ নিরন্তর এরূপ স্থান পরিবর্তন খুবই কষ্টদায়ক বিবেচনায় এনে এক স্থানে অবস্থানের উপর গুরুত্ব আরোপ করে এবং এ সমস্যা সমাধানের উপায় বের করার চেষ্টা চালায়। উপায় হিসেবে কৃষিকাজকেই তারা অধিক গুরুত্ব দিয়ে ফসল উৎপাদনে নিযুক্ত হয়। এজন্যই তারা আর্য (অর্থাৎ কৃষিজীবি) নামে প্রসিদ্ধ হন। শেষোক্ত পক্ষের মতবাদে আর্য শব্দের অর্থ দাঁড়ায় কৃষিকর্মকারী।


Adolf Hitler - The Rise of Evil

হিটলারের নাৎসি পার্টি ‘আর্য' শব্দটিকে জার্মান শব্দ ‘এহরে' এর অর্থের সমতুল্য ধরতেন, যার মানে সম্মান। এর সুবাদে ‘আর্য’ শব্দটির অর্থ সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ। জাতিগত বিশুদ্ধতায় বিশ্বাসী হিটলার আর্যকে ‘বিশুদ্ধ জার্মান জাতি' হিসেবে ঘোষণা করার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন। কেননা তার মতে, বিশ্বে আর্য জাতির মানুষদের রক্তই সবচেয়ে বেশি পবিত্র। হিটলারের মতে, আর্যরা লম্বা, ফর্সা এবং নীল চোখের অধিকারী ছিলেন। তিনি দাবি করেন, আর্যরা নর্ডিক হলেও তারা মূলত জার্মানির অধিবাসীই ছিলেন। উল্লেখ্য, নর্ডিক বলতে মূলত নরওয়ে, সুইডেন, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড ও আইসল্যান্ডের অধিবাসীদের বোঝানো হয়। অবশ্য মাঝে মাঝে জার্মানির কিছু অংশও নর্ডিকের অন্তর্ভুক্ত ধরা হয়।


Behistun Inscription - Vici.org

কিন্তু এই কাল্পনিক তত্ত্বের ফানুস ফুটো হয়ে যায় ইরান থেকে বেহিস্তান শিলালিপি আবিষ্কৃত হওয়ার পর।যীশুর জন্মের প্রায় ৪৮৬ বছর আগে উৎকীর্ণ এই লেখতে পারস্য সম্রাট দারায়ুস নিজকে দাবী করেন-‘’ A Persian, a son of a Persian and an Aryan of Aryan Descent’’ হিসেবে। ব্যাস এরপরই ঐতিহাসিক মহলে তীব্র আলোড়নের সৃষ্টি হল এবং আর্য জাতির সাথে সম্পৃক্ত দেহসৌষ্ঠব সংক্রান্ত তত্ত্ব এক লহমায় বাতিলের খাতায় চলে গেল।


The True Aryans: Who Were They Really and How Were Their Origins

হিন্দু আর্য এবং জার্মান আর্যদের মাঝে সংজ্ঞাগত মিল খুজে পাওয়া যায়, দেখুন উভয়েই “আর্য”দের উচ্চ বংশীয় বলে সংজ্ঞায়িত করেন। ম্যাক্সমুলার, স্যার উইলিয়াম জোন্স প্রভৃতি পন্ডিতের মতে আর্য একটি ভাষাগোষ্ঠীর নাম। যারা আর্য ভাষায় কথা বলে তারাই আর্য জাতির অন্তর্ভুক্ত বলে বিবেচিত।


Filippo Sassetti – Wikipedia

ফিলিপ্পো স্যাসেটি নামক ফ্লোরেন্সের একজন বণিক গোয়াতে পাঁচবছর অবস্থানের (১৭৮৩-১৭৮৮ খ্রিঃ) পর প্রথম সংস্কৃতের সঙ্গে ইউরোপের প্রধান কয়েকটি ভাষার সাদৃশ্যের কথা ঘোষণা করেন। ১৭৮৬ খ্রিস্টাব্দে এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গলে প্রদত্ত তাঁর বক্তৃতায় তিনি বলেন যে, একই উৎস থেকে উৎপত্তির কারণে এ সাদৃশ্য। তাঁর মতে, গ্রিক, ল্যাটিন, গথিক, কেল্টিক, সংস্কৃত, পারসিক, জার্মান ইত্যাদি একই উৎস থেকে উদ্ভুত। এ ভাষাগুলো পন্ডিতদের কাছে ইন্দো-ইউরোপীয় বা ইন্দো-জার্মান ভাষা রূপে পরিচিত। ভাষাগত সাদৃশ্যের কারণে প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে যে, এই আর্য ভাষা যে জাতিগোষ্ঠী ব্যবহার করতো তাদের আদি বাসভূমি কোথায় ছিল? এ সম্পর্কে পন্ডিতগণ বিভিন্ন মতামত ব্যক্ত করেছেন। একদল পন্ডিত মনে করেন যে, আর্যরা আদিতে ভারতবাসী ছিল। পরবর্তীকালে তারা ভারতের বাইরে পশ্চিম এশিয়া ও ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। অন্যদের মতে, আর্যরা বাইরে থেকে এসে ভারতে বসতি স্থাপন করেছিল। যাঁরা মনে করেন যে আর্যদের আদি বাসভূমি ছিল ভারতবর্ষ, তাঁরা নিম্ন লিখিত যুক্তি দেখানোর চেষ্টা করেছেন :

(ক) আর্যদের প্রাচীনতম গ্রন্থ বেদ ভারতে রচিত হয়েছিল। বেদে সপ্তসিন্ধু অঞ্চলের উল্লেখ রয়েছে। বৈদিক সাহিত্যে যে সকল গাছ ও পশু-পাখির উল্লেখ আছে তা ভারতের এই অঞ্চলে দেখা যায়।

(খ) যারা দেশ ত্যাগ করে অন্য দেশে গিয়ে বসবাস করে তারা তাদের আদি বাসভূমির কথা স্মরণ করে। কিন্তু বৈদিক সাহিত্যে সপ্তসিন্ধু ছাড়া অন্য কোন দেশের নাম পাওয়া যায় না।

(গ) পারগিটারের মতে, উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে আর্যদের অভিপ্রয়াণের কোন প্রমাণ ভারতের ইতিহাসে নেই, বরং উত্তর-পশ্চিম হতে আর্যদের ভারতের বাইরে যাওয়া সম্ভব। ঋগ্বেদের নদী স্তোত্রে যে নদীগুলোর উল্লেখ আছে তা গঙ্গা দিয়ে শুরু হয়ে উত্তর-পশ্চিমে সরস্বতী দিয়ে শেষ হয়েছে। এই নদী স্তোত্র থেকে ধারণা করা যেতে পারে যে আর্যরা পূর্ব থেকে উত্তর-পশ্চিমে গিয়েছিল।

(ঘ) আর্যরা বহিরাগত হলে তাদের আদি বাসভূমিতে বেদের মত কোন গ্রন্থ রচিত হয়নি কেন? এসব যুক্তির মাধ্যমে কিছু ঐতিহাসিক দাবী করেন যে, আর্যদের আদি বাসভূমি ছিল ভারতবর্ষ।

কিন্তু কোনো কোনো পন্ডিত এ মতের বিপক্ষে বেশ কিছু যুক্তি দেখিয়েছেন। তাঁদের যুক্তিগুলো নিম্নরূপঃ

(ক) বেদে উল্লেখিত গাছপালা ও পশুপাখির নাম থেকে নিশ্চিতভাবে বলা যায় না যে সপ্তসিন্ধু অঞ্চলই ছিল আর্যদের আদি বাসভূমি। ভারতে প্রবেশ করে প্রমে তারা ঐ অঞ্চলে বসতি স্থাপন করায় ঐ এলাকার গাছপালা ও পশুপাখির সঙ্গে তাদের প্রথম পরিচয় ঘটে। এ কারণেই এগুলোর নাম উল্লেখ করা হয়েছে। বেদও রচিত হয়েছিল ঐ এলাকাতেই।

(খ) এমনও হতে পারে যে দীর্ঘকাল সপ্তসিন্ধু অঞ্চলে বাস করার ফলে আর্যরা তাদের আদি বাসভূমির সব স্মৃতি হারিয়ে ফেলেছিল বলেই বেদে তার উল্লেখ পাওয়া যায় না।

(গ) নদী স্তোত্র দিয়ে আর্যদের উত্তর-পশ্চিম ভারত থেকে বাইরে অভিপ্রয়াণ প্রমাণ করা যায় না। বৈদিক সাহিত্যে ৩৯ টি নদীর নাম পাওয়া যায়। তার মধ্যে ঋগ্বেদই পাওয়া যায় ২৫টি নদীর নাম, কিন্তু গঙ্গা নদীর নাম শুধুমাত্র একবার উল্লেখিত হয়েছে। আর্যরা ভারতের আদিবাসী হলে এবং পূর্ব থেকে পশ্চিমে অভিপ্রয়াণ ঘটে থাকলে গঙ্গা নদীর সাথে তাদের নিবিড় সম্পর্ক থাকার কথা এবং সে ক্ষেত্রে গঙ্গার নাম বারবার উল্লেখিত হওয়া উচিৎ ছিল।

(ঘ)ঋগ্বেদের মত কোন গ্রন্থ অন্য কোন দেশে রচিত হয়নি বলেই বলা যায় না যে ভারতই ছিল আর্যদের আদি বাসভূমি। এমনও হতে পারে যে ভারতে আসার আগে বেদের মত গ্রন্থ রচনা করার মত বুদ্ধিবৃত্তিক ও সামাজিক উন্নয়ন তাদের ঘটেনি।

(ঙ) তাছাড়া বলা যায় যে ভারতবর্ষ আর্যদের আদি বাসভূমি হলে তারা ভারত ত্যাগের আগেই গোটা ভারতবর্ষে আর্য বসতি ও সংস্কৃতি বিস্তার করতো। কিন্তু উত্তর ভারতের বেশ কিছু এলাকা এবং দক্ষিণ ভারত ছিল আর্য সংস্কৃতির বাইরে।

(চ) সংস্কৃত ভাষায় তালব্য বর্ণের (ন, ং, ৎ) প্রাধান্য দেখা যায় যা ইউরোপীয় অন্য কোন ইন্দো- ইউরোপীয় ভাষায় নেই। পন্ডিতেরা মনে করেন যে, ইউরোপ থেকে ভারতে আসার পর দ্রাবিড় ভাষার প্রভাবে এরকম হয়েছে।

(ছ) বৈদিক সাহিত্যে সিংহের উল্লেখ থাকলেও বাঘ ও হাতির উল্লেখ নেই। আর্যরা ভারতের আদিবাসী হলে ভারতের এই দুটি প্রাণীর নামের উল্লেখ বৈদিক সাহিত্যে অবশ্যই থাকা উচিৎ ছিল।

এসব যুক্তির বলে পন্ডিতেরা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন যে আর্যদের আদি বাসভূমি ছিল ভারতের বাইরে।

অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন যে, আর্যরা ইউরোপ থেকে ভারতে এসেছিল। তাঁদের যুক্তিগুলো নিম্নরূপঃ

(ক) আর্য ভাষাগোষ্ঠীর সাতটি ভাষার মধ্যে পাঁচটি এখনও ইউরোপের ভাষা, শুধু সংস্কৃত ও পারসিক ইউরোপের বাইরের।ইউরোপে গ্রিক, ল্যাটিন, জার্মান প্রভৃতি আর্য ভাষাগুলোর যে রকম ঘন সন্নিবেশ দেখা যায় ভারতে তা দেখা যায় না। ইউরোপে আর্য গোষ্ঠীভুক্ত ভাষার আধিক্যের কারণে পন্ডিতেরা মনে করেন যে, আদিতে আর্যরা ইউরোপেই বাস করতো।

(খ) বৈদিক সাহিত্যে ওক, উইলো, বার্চ ইত্যাদি গাছ এবং ঘোড়া, গাভী, ষাঁড়, শুকর প্রভৃতি জন্তুর উল্লেখ পাওয়া যায়। প্রাচ্য দেশের জন্তু হাতি, বাঘ, উট ইত্যাদির কোনো উল্লেখ বৈদিক সাহিত্যে নেই।

(গ) অধ্যাপক গাইলস মনে করেন যে, আর্যদের আদি বাসভূমি ছিল দক্ষিণ পূর্ব ইউরোপ। আদি ইন্দো- ইউরোপীয় ভাষায় সমুদ্রের কোন উল্লেখ না থাকায় ধরে নেওয়া যায় যে আর্যদের আদি বাসভূমি কোন দ্বীপে বা সমুদ্র তীরে ছিলনা। তারা যেসব গাছপালা ও পশুপাখির নাম উল্লেখ করেছে সেগুলো নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের।আর্যরা তখন স্থায়ীভাবে বসবাস এবং কৃষিকাজ শুরু করেছিল। তাদের গৃহপালিত পশুর মধ্যে গরু, ঘোড়া ও ভেড়ার জন্য ভিন্ন ভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক পরিবেশ প্রয়োজন ছিল। তাহলে মনে করতে হবে যে আর্যদের আদি বাসস্থান এমন একটি স্থানে ছিল যেখানে কৃষি ও চারণযোগ্য পরিবেশ কোনটিরই অভাব ছিলনা । সেখানে কৃষিযোগ্য জমি, ঘোড়ার জন্য বিস্তীর্ণ স্তেপ এবং ভেড়া চরানোর জন্য উঁচু জমিই সবই ছিল। এসবের দিকে লক্ষ রেখে ড. গাইলস বর্তমান অষ্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি অঞ্চলকেই আর্যদের আদি বাসভূমি হিসাবে চিহ্নিত করেছেন।


Kyrgyz Steppe

অধ্যাপক ব্র্যান্ডেস্টাইন মনে করেন যে, উরাল পর্বতের দক্ষিণে কিরঘিজ স্তেপ অঞ্চলই ছিল আর্যদের আদি বাস ভূমি । এ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার জন্য তিনি শব্দতত্ত্বের সাহায্য নিয়েছেন। তাঁর মতে, প্রথম দিকের ইন্দো - ইউরোপীয় শব্দাবলীতে কোন পর্বতমালার পাদদেশে বিস্তীর্ণ স্তেপ ভূমিতে আর্যদের আদি বাসভূমির ইঙ্গিত পাওয়া যায়। পরবর্তীকালের ইন্দো-ইউরোপীয় শব্দাবলীতে সম্পূর্ণ ভিন্নতর ধরনের জমি, গাছপালা এবং জীবজন্তুর সন্ধান পাওয়া যায়। সেখানে শুষ্ক স্তেপভূমির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শব্দাবলীর পরিবর্তে জলাভূমির স্পষ্ট ইঙ্গিতবাহী শব্দাবলী পাওয়া যায়। বর্তমানে অধিকাংশ পন্ডিতই ব্র্যান্ডেস্টাইনের মতের সমর্থক এবং তাঁরা মনে করেন যে, কিরঘিজ অঞ্চলই আর্যদের আদি বাসভূমি।


Rigveda in Sanskrit, India early 19th century. ( Public Domain ) Sanskrit is a standardized dialect of Old Indo-Aryan.

আর্যদের আদি বাসভূমি সম্পর্কে পন্ডিতগণ বিভিন্ন মতামত ব্যক্ত করেছেন। তবে বর্তমানে অধ্যাপক ব্র্যান্ডেস্টাইনের মতানুসারে অধিকাংশ পন্ডিতই মনে করেন যে, ওরাল পর্বতের দক্ষিণে কিরঘিজ স্তেপ অঞ্চলই ছিল আর্যদের আদি বাসভূমি। বেদ হচ্ছে আর্যদের প্রাচীনতম সাহিত্য, যা প্রথমে লিখিত আকারে ছিল না। অনেক পরে বেদ লিপিবদ্ধ করা হয়। চারটি বেদের মধ্যে প্রাচীনতম হচ্ছে ঋগ্বেদ। আর্যদের ভারতে বসতি স্থাপন ও বিস্তার সম্পর্কে ঋগ্বেদ ও পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে কিছু তথ্য পাওয়া যায়। সাধারণত পন্ডিতগণ মনে করেন আর্যরা ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে হিন্দুকুশ পর্বতের গিরিপথ দিয়ে ভারতে প্রবেশ করে প্রথমে আফগানিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম ভারতে বসতি স্থাপন করে। এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে তারা ‘সপ্তসিন্ধু' নামে আখ্যা দিয়েছিল। পরবর্তীতে তারা পূর্ব ভারতের দিকে অগ্রসর হয়ে তাদের বসতি বিস্তার করে। দক্ষিণ ভারতে আর্য সভ্যতা বিস্তার সম্পর্কে সঠিক বিবরণ পাওয়া যায় না।


Andronovo culture

দক্ষিন রাশিয়ার কাজাখস্তান থেকে আবিষ্কৃত ‘আন্দ্রনোভো সংস্কৃতি’র ক্ষেত্রে দেখা যায় যে,এই সভ্যতার অন্তর্গত পশুপালক গোষ্ঠী অশ্বের সাথে সুপরিচিত ছিল এবং এই অঞ্চল থেকে প্রাপ্ত গবাদিপশুর দেহাবশেষের মধ্যে আশি শতাংশই অশ্বের।এই তথ্যের ওপর ভিত্তি করে এলিনা কুজমিনা উল্লেখ করেছেন যে, পন্টিক-কাস্পিক অঞ্চল হল আর্য বা ইন্দো-ইউরোপীয় গোষ্ঠীর আদি বাসভূমি এবং এখান থেকেই একটি শাখা ইউরোপে চলে যায় ও আরকটি শাখা ইরানে চলে যায়।ইরানের শাখাটি থেকে ভেঙে আরেকটি শাখা আবার ভারতে প্রবেশ করে।ইউরোপে যে আর্যদের একটি শাখার অভিপ্রয়ান হয়েছিল তা নিয়ে কোন সন্দেহই নেই এবং পরবর্তীকালে হিটলারের সময়ে ‘জার্মানরা আর্য’ এই জাতীয় ধারনা গড়ে উঠেছিল।


A newly discovered Zoroastrian Avestan Yasna manuscript

সমস্যা হল আর্যদের যে শাখাটি ইরান বা তদানীন্তন পারস্যে প্রবেশ করেছিল তাদেরকে নিয়ে। প্রাচীন পার্সিদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ হল ‘আবেস্তা’ যার সাথে বৈদিক সাহিত্য সম্ভারের প্রচুর সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। তবে যেখানে ‘দেব’ শব্দটি বেদে অত্যন্ত পবিত্র সেখানে আবেস্তাতে ‘দেব’ শব্দতি নেতিবাচক অর্থ বহন করে এবং ‘অসুর’ সত্ত্বার প্রতি স্তুতি বর্ষিত হয়েছে।সর্বোপরি বৈদিক দেবতা বরুণের সম্বন্ধে আবেস্তা ঋণাত্বক মনোভাব প্রকাশ করেছে।সম্ভবত ইরানে প্রবেশের পর আর্যদের মধ্যে ধর্মীয় বিষয় নিয়ে দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছিল, তাই একটি গোষ্ঠী ভারতে চলে এসে ইরানীয় আর্যদের বিপরীত এক ধর্মীয় ব্যবস্থা পত্তন করে।যদিও এই বিষয়টি এতটা সরল নয়।কারণ বেদে অনার্য মুণ্ডারী ও দ্রাবিড় ভাষার প্রায় তিনশোটি শব্দের উল্লেখ পাওয়া যায়।তাই অনেকেই মনে করেন আর্যরা ভারতীয় এবং ভারত থেকেই তারা সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল। আবেস্তা ও ঋগ্বেদের সময়কাল প্রায় একই হওয়ায় এই প্রশ্নের সমাধান বেশ কঠিন।

আর্যরা খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দের দিকে ভারতবর্ষে আগমন করে। ক্রমে তারা এখানে গড়ে তোলে আর্যসভ্যতা। আর্যদের ধর্মগ্রন্থ বেদ (পৃথিবীর প্রাচীনতম গ্রন্থ) থেকে ভারতে তাদের জীবনযাত্রার বিভিন্ন দিক সম্পর্কে কিছু ধারণা লাভ করা যায়। বেদ চারভাগে বিভক্ত ঋক্, সাম, যজুর এবং অথর্ব। ঋগ্বেদের সম্ভাব্য রচনাকাল ১৫০০-৯০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে এবং অন্য তিনটি ৯০০-৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে রচিত হয়েছে বলে অনুমান করা হয়। বেদের রচনাকালের ওপর নির্ভর করে আর্যসভ্যতাকে দুভাগে ভাগ করা হয় ঋগ্বেদে বৈদিক যুগের সভ্যতা এবং পরবর্তী বৈদিক সভ্যতা। উভয় যুগের মধ্যে সময়ের ব্যবধান ছিল বিধায় আর্যদের জীবনচর্চায় সুস্পষ্ট পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। ঋগ্বেদের যুগে পাঞ্জাব ছিল আর্য সভ্যতার কেন্দ্রভূমি। কালক্রমে তারা ভারতের পূর্বদিকে বসতি বিস্তার করে এবং মধ্যদেশ তাদের কর্মকান্ডের কেন্দ্রে পরিণত হয়। আমরা বলতে পারি, ঋগ্বেদের বৈদিক যুগে আর্য সমাজ, ধর্ম, অর্থনীতি, রাজনীতি ক্রমে সুস্পষ্ট রূপ পরিগ্রহণ শুরু করে, তবে পরবর্তী বৈদিক যুগে তা সুসংহত ও সুসংঘবদ্ধ হয়ে ওঠে।


The Origin of the Swastika - Oldest known Swastika found in Ukraine ca 10,000 BCE

আর্য বিতর্ক ইতিহাসের এমন এক অধ্যায় যা’র সঠিক সমাধানসূত্র নির্ণয় অত্যন্ত দুরহ, তবে অসম্ভব নয়।সর্বপ্রথম সীমাবদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গি অতিক্রম করে এই সমস্যাকে আরও বৃহত্তর প্রেক্ষিতে যুক্তি-সংগতভাবে বিশ্লেষণ করতে হবে। আর্যরা যে অভারতীয় এই বিষয়টি বেশ স্পষ্ট। সেক্ষেত্রে মধ্য এশিয়ায় এদের উৎস অনুসন্ধান করলে তা সফল হবে। আর্য সমস্যার সমাধানের সবচেয়ে কার্যকরী পদ্ধতি হল নিরবিছিন্ন অনুভূমিক উৎখনন, বিশেষত তুরস্ক, ইরান, ইরাক এই সকল অঞ্চলে আর্য সভ্যতার প্রচুর উপাদান এখনও লুক্কায়িত রয়েছে।এটা কোন কাল্পনিক অবতারনা নয়, সাম্প্রতিক কালে তুরস্কের গোবেকেলি টেপে অঞ্চলে আবিষ্কৃত প্রায় সাত হাজার বৎসরের প্রাচীন মন্দির ও ইউক্রেনে প্রাপ্ত স্বস্তিকা প্রতীক আর্য ইতিহাসকে এক নতুন আঙ্গিকে দেখার সুযোগ করে দিয়েছে। সর্বোপরি হরপ্পা সভ্যতায় আর্য প্রভাব খোঁজার প্রয়াস বৃথা।কারন বেদে ইন্দ্রকে ‘পুরন্দর’ রূপে অভিহিত করা হয়েছে,কারন তিনি ‘হরি-গুপয়’ এর যুদ্ধে পুর বা নগর ধ্বংস করেছিলেন;আর এই হরি-গুপয় হল হরপ্পা।হরপ্পার বেশ কিছু সাইটে প্রাপ্ত কঙ্কালগুলির আঘাত পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে অতর্কিত আক্রমণে এদের মৃত্যু হয়েছে।তাছাড়া অনেক জায়গায় কঙ্কালের স্তুপ পাওয়া গেছে,যা থেকে বোঝা যায় যে এগুলির রীতি মেনে সৎকার হয়নি।হরপ্পার পতনের পশ্চাতে যে বৈদেশিক আক্রমণকে দায়ী করা হয়,সেই আক্রমণকারীরা আর অন্য কেউ নয়,তারাই হল আর্য।সুতরাং আর্যরা বিদেশী এবং শুনতে খারাপ লাগলেও মেনে নিতেই হয় যে বৈদিক সভ্যতার জন্মদাতারা ভারতের সুপ্রাচীন নগর সভ্যতার নির্মম ধ্বংসকারী ছিল এবং তারা কোনদিনই নগর সভ্যতার নিরিখে প্রাচীন ভারতীয়দের সাথে পাল্লা দিতে পারেনি।

আমি আসলে আর্য উৎস মানে ভারতীয় এবং জার্মান দাবীদারদের মাঝে কোনটা ঠিক তা বের করার চেষ্টা করতে গিয়ে কিছু বই পত্র এবং অন্তর্জাল ঘেটে দেখি। বাস্তবতা হল এখনো এব্যাপারে কোন ডিসিশান পাওয়া যায়নি। আর্য দের উৎস নিয়ে নানা মুনির নানা মত। তবে অধিকাংশই এখন এক মত যে আর্যরা ভারতীয় উদ্ভুত না যা বর্তমান ভাবতীয়দের একটা বড় অংশ দাবী করে আসছে।

ভারতীয় আর্যদের নিয়ে জানতে হলে আপনাকে ঋগ্বেদ সন্মন্ধ্যে পড়তে হবে, আমি ঋগ্বেদ পড়তেছি এই মুহুর্তে তার বিভিন্ন ব্যাখ্যা পড়ছি তাতে দেখতে পারছি ভারতীয় আর্যদের বিভিন্ন ইতিহাস, বেশ উৎসাহের সাথেই পড়ছি। হয়ত সামনে ভারতীয় আর্যদের নিয়ে লেখব। আমি ইতিহাসের ছাত্র না, কিন্তু ইতিহাস নিয়ে আমার অসীম কৌতুহল।

এলেখা লিখতে গিয়ে সায়ন দেবনাথ, এম ফিল, প্রথম বর্ষ প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এর একটা নিবন্ধ থেকে অনেক কিছু জানতে পারছি তার প্রতি কৃতজ্ঞতা তার লেখা থেকেই পোষ্টের বিভিন্ন জায়গায় উদ্ধৃতিও দিয়েছি।

হিটলার যেমন আর্যদের জার্মান বলে দাবী করছেন তেমনি কিছু ভারতীয় আর্যদের ভারতীয় বলে দাবী করছেন যা কোনমতেই ধোপে ঠেকে না, আমার সামান্য পড়াশুনা থেকে আমি যেটুকু উপলদ্ধি করছি তাতে আর্যদের উৎপত্তি মধ্য এশিয়ার কোন এক এক জায়গা থেকে হয়ত কিরগিজ স্তেপ বা নিকটস্থ কোথাও থেকে কিন্তু তাও এখনো শক্ত কোন ভিতের ওপর দাড়ায় নি।

রিলেটেড পোষ্টঃ ইতিহাসের হারিয়ে যাওয়া জাতি ( হিতাইত জাতি)

এবং ইতিহাসের হারিয়ে যাওয়া জাতি ( মিতান্নী জাতি)

সুত্রঃ R.C. Majumdar, The History and Culture of the Indian People (Vol-1), Vedic Age.
প্রভাতাংশু মাইতী, ভারত ইতিহাস পরিক্রমা, ১ম খন্ড।
রোমিলা থাপার, ভারতবর্ষের ইতিহাস।
Andronovo culture
আর্য রহস্যের অনুসন্ধান
আর্য ও হিন্দু
The Origin and History of the Aryans of Ancient India
The True Aryans: Who Were They Really and How Were Their Origins Corrupted?
Filippo Sassetti
bioRxiv/Screenshot It’s a long story. THE BURNING QUESTION(S) Who was here first? A new study explains the origins of ancient Indians

এছাড়া আরো অনেক।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই জানুয়ারি, ২০২০ রাত ২:০২
২২টি মন্তব্য ২২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিঃ ব্যাঙের বিয়েতে নামবে বৃষ্টি ...

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:০০



অনেক দিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল অনেক এই রকম যে চারিদিকে প্রচন্ড গরম। বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। ফসলের মাঠ পানি নেই খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশি ভাবনা ও একটা সত্য ঘটনা

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৭


আমার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে; আমি চলচ্চিত্রাভিনেতা। বাংলাদেশেই প্রায় ৩০০-র মত ছবিতে অভিনয় করেছি। আমি খুব বেছে বেছে ভাল গল্পের ভাল ছবিতে কাজ করার চেষ্টা করতাম। বাংলাদেশের প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না ********************

লিখেছেন মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৩৫

যখন প্রথম পড়তে শিখেছি তখন যেখানেই কোন লেখা পেতাম পড়ার চেষ্টা করতাম। সেই সময় দোকানে কোন কিছু কিনতে গেলে সেই দোকানের লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। সচরাচর দোকানে যে তিনটি বাক্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×