somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সাধু ভ্যালেন্টাইনস-এর সংগ্রাম চাপা পড়ে গেছে

১৪ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১১ বিকাল ৪:০১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সাধু ভ্যালেন্টাইনস-এর সংগ্রাম চাপা পড়ে গেছে

বহুজাতিকের পণ্য বাণিজ্যের ফাঁদে



যুদ্ধবাজ রোমান সম্রাট দ্বিতীয় কডিয়াস ২৭০ খ্রিস্টাব্দে রোমান তরুন যুবকদের যুদ্ধে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে সকল বিয়ে ও বাগদানকে বেআইনি এবং বাতিল ঘোষণা করে। সম্রাটের এই নিপীড়নমূলক আইনের বিরুদ্ধাচারণ করেই শহীদ হয়েছিলেন সেন্ট ভ্যালেন্টাইন। দৃষ্টি আরও গভীরে প্রবেশ করলে দেখা যাচ্ছে একজন সাধুর বিয়ের মত ইহজাগতিক বিষয় নিয়ে ভাবার কথা নয়। তবে ইতিহাস কিন্তু তা বলছে না। ইতিহাস বলছে মানুষ শুধু নিজের জন্য বাঁচে না। সেন্ট ভ্যালেন্টাইন তার বড় উদাহরণ। তবে আজকের যুগে ভ্যালাইন্টিন ডে মানে কপোতকপোতি হু আহা টাইপের ভালোবাসা আর আমি তুমি’র স্বপ্ন দেখা। ভ্যালেণ্টাইনের প্রতিরোধ সংগ্রাম থেকে যখন ব্যক্তি কেন্দ্রিক আমি তুমির ভালোবাসায় রুপান্তর করা গেছে তখনই কিন্তু আমি তুমির ওপর ভর করে কোটি কোটি টাকার পণ্য বিক্রির বাজারও নির্দিষ্ট করা গেছে। এই বাজার শুধু ইউরোপ বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি, তার গণ্ডি মহাদেশ থেকে মহাদেশ ছাড়িয়ে আমাদের মত হাড় হাভাতের দেশেও এসে পড়েছে। তবে ইতিহাস জ্ঞান মাত্রেই জানবেন যে, আবেগি বাঙ্গালি কিম্বা আদীবাসী বা মোটা দাগে বললে যা দাঁড়ায় তা হলো এই জনপদে মানুষের উৎসবের কোনো ঘাটতি কোনোকলে ছিলো বলে ইতিহাস স্যাক্ষ দেয় না। বারো মাসে তেরো পর্বনের দেশে ভ্যালেন্টাইনের কাছ থেকে আমাদের ভালোবাসা শিখতে হবে। এর থেকে আর দু:খের অপমানের কি আছে। আর যখন সেই ভালোবাসা শুধুমাত্র আমি’, ‘তুমি’-এর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে তখন ভ্যালান্টিনের জন্যও কি নিদারুন অপমানের!


দিবসের অর্থনীতির রাজনীতি

যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালেন্ডারে শুধু দিবসের ছড়াছড়ি। ক্যালেন্ডারের প্রায় প্রতিটি দিনই একটি করে দিবসের নাম। আর এই দিবসগুলোর পৃষ্টপোশকতার জন্যও রয়েছে বহুজাতিক কোম্পানীর প থেকে ব্যাপক পরিমান বাজেট। এরকম একটি ডে হলো হিস্টি ডে, যার স্পন্সর করেছে ‘হিস্টরি চ্যানেল’। হাজার তরুন তরুনীর হ্র“দয়ের দিবস ‘ভ্যালেন্টাইনস ডে’-এর স্পন্সর করে ‘হল মাকর্’, ‘আর্চিস’, ‘ডিজনিল্যান্ড’ ইত্যাদি কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো। এইসব বহুজাতিক কোম্পানীগুলো ‘ফ্রেন্ডশিপ ডে’ নামক একটি দিনেরও জনক। যতো নতুন নতুন দিবস ঘোষণা করা যাবে ততো ব্যবসা। শুধুমাত্র ভ্যালেন্টাইনের দিন ১০ কোটির ওপরে হল মার্ক কিম্বা আর্চিসের কার্ডের ব্যবসার হিসাব নিকাশ করতে গেলে অংকের সংখ্যায় সেটা বলা কঠিন। একটি নতুন দিবস ঘোষণা দেয়ার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসম্যানদের রিতিমত ঘুষ দেয় বহুজাতিক কোম্পানীগুলো। আর এতো এতো কেলেঙ্কারি ঘটিয়ে একটি দিবস ঘোষণার চেষ্টা কেন? এই প্রশ্নের উত্তর নিচের পরিসংখ্যানের দিকে একটু তাকালেই বোঝা যাবে। যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইবিজওয়ার্ল্ড-এর হিসাব মতে ভ্যালেন্টাইন ডে উপলে দেশটিতে ৭৮৬ কোটি ৩৫ আখ ডলার শুধু ডিনারের পেছনেই ব্যয় হয়েছে। ভ্রমনের পেছনে ২শ’কোটি ১০ লাখ ডলার, গ্রিটিং কার্ডের পেছনে ৭৭ কোটি ৪০লাখ ডলার, জামাকাপড় কেনার পেছনে ১১ কোটি ৬ লাখ ৯০ হাজার ডলার, ক্যান্ডি বা চকোলেটের জন্য ২৪৯ কোটি ৯৩ লাখ ডলার, জুয়েলারির পেছনে ১৩৭ কোটি ১৮ লাখ ডলার, ফুলের জন্য ১৪২ কোটি ৫০লাখ ডলার ব্যয় হয়েছে। এই তালিকার সঙ্গে আরও কিছু ব্যবসার খতিয়ান পাঠক নিজেই যুক্ত করতে পারেন, তাহলো এই ব্যবসাগুলো করতে গিয়ে আরও শত শত আয় ব্যায়ের খাতগুলো। এতো গেলো যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসার জিসেবে নিকেশ, পাঠক একবার আন্দাজ করুনতো সারা বিশ্বে এই ব্যবসার পরিমান কত হতে পারে।

দিবসের সামাজিক রাজনীতি

পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় সমাজ থেকে ব্যক্তিকে বিচ্ছিন্ন করে তাকেই আবার সমাজের বিরুদ্ধে দাড় করিয়ে দেয়। ব্যক্তিকে ছুঠিয়ে দেয় নিরন্তর ভোগের দিকে। যার মধ্য ব্যক্তিকে হয়ে ওঠে পুঁজি পন্যে মুনাফা করার মেশিনে। এই মুনাফা যতো বৃদ্ধি পায় পুঁজিপতির হাত ততো শক্তিশালী হয় আর বিপরীতে ব্যক্তি হয়ে ওঠে আরও বিচ্ছিন্ন সত্ত্বা, একা, নিঃসঙ্গ মানুষ। এই সুযোগটিই আবার কাজে লাগায় পুঁজিপতিরা তাদের মুনাফা দ্বিগুন করার মওকা হিসেবে। পুঁজি তখন বিভিন্ন সামাজিক অনুসঙ্গ তৈরী করে ব্যক্তির একাকিত্ব ঘুচানোর জন্য। তৈরী হয় পর্ণ ব্যবসা, পর্ণ বাজার। পৃথিবীতে এই মূহুর্তে বৃহত আর্থিক খাতের অন্যতম হলো পর্ণ ব্যবসা। যে সামাজিক অভিঘাত থেকে ব্যক্তি একা নিঃসঙ্গ হয় সেই সমাজপতিরা আবার সেই সুযোগ নিয়ে ব্যবসা হাতিয়ে নেয়। একদিকে পরিবার, প্রেম, বিবাহ ভেঙ্গে পড়ছে পশ্চিমা ধনতান্ত্রিক দেশগুলো। আবার অন্যদিকে ভালোবাসার জন্য আলাদা দিবস তৈরী করে তাকে ভালোবাসার ফাঁদে ফেলে ব্যবসা করার পথ তৈরী করছে।

বিশ শতকের গোড়ার দিকে (১৯১০) জয়েস সি হলমার্ক যখন হলমার্ক নামের দোকান খুলে কার্ড ব্যাবসা শুরু করেন তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যৌথ পরিবারগুলো ভেঙে যাচ্ছে; গড়ে ওঠছে ব্যক্তির একাকি নিঃসঙ্গ জীবন। আলবেয়ার কামু রচিত ‘দ্য আউটসাইডার’-এর প্রধান চরিত্রের মত একটি একটি নিঃসঙ্গ চরিত্র তৈরি হওয়ার মধ্য দিয়ে হলমার্ক আর আর্চিসের বাজার বেড়ে যায় বহুগুনে। কারণ হলমার্ক তার কার্ড বিক্রির জন্য বিশেষ কৌশল অবলম্বন করেছিলো তা হলো মানুষের আবেগ অনুভুতি মর্মস্পর্শি করে কার্ডে প্রকাশ করা। আর এর মধ্য দিয়ে কার্ডের ওপর কবিতা, অনুভূতি ছাপা হতে শুরু হলো। নিঃসঙ্গ মানুষও হুড়মুড় করে কিনতে শুরু করলো। মানুষের ভালোবাসা বিক্রি করা শুরু করলো হলমার্ক।

অতিতের মত আজকের নাগরিক মানুষ ভালোবাসার প্রতি তীব্র আগ্রহ নিয়ে অপো করে না প্রিয়তমার জন্য। তবে ত্রে বিশেষ তারও ব্যতিক্রম আছে। পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা শেষ পযর্ন্ত ভালোবাসার মত কোমল অনুভূতিও ভোতা করে দিচ্ছে। আর এই সুযোগে ‘ডে’ নির্ভর ভালোবাসার প্রচলন শুরু হয়েছে। যার শ্রষ্টা বহুজাতিক কোম্পানীগুলো। যুদ্ধবাজ রোমান সম্রাট দ্বিতীয় কডিয়াসের স্বৈরাশাসনের আদেশের বিরুদ্ধে যে জীবন আত্ম উৎসর্গীত করেছিলেন সাধু ভ্যালেন্টাইন সম্মিলিত মানুষের ভালোবাসার প্রতি ভালোবাসা দেখিয়ে; সেই ভালোবাসা থেকে আজকের ভ্যালেন্টাইন কত দূরে? আমাদেরকে আরেকবার ভাবতে, এ জীবন কী শুধু বহুজাতিক কোম্পানীর মুনাফা আর পণ্যের খরিদ্দার হবো, নাকি আপন সত্বায় উজ্জ্বল হয়ে ভালোবেসে সংসারি অথবা গৃহহীন হবো।



(লেখাটি গত বছর ভ্যালেন্টাইন দিবসে লিখেছিলাম। এই লেখার হিসেবে নিকাশগুলো তাই গত বছরের দেয়া। তবে পত্রিকার সম্পাদকীয় নীতির কারণে শেষ পর্যন্ত আর ছাপার মুখ দেখিনি লেখাটি)
এ বিষয়ে আরও কিছু প্রয়োজনীয় লেখার লিংক
Click This Link
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×