মাসের ২২ তারিখ। লেখায় ভুলগুলো বেড়েই চলেছে ক্রমশ। যদিও টাইপরাইটার হিসেবে মতিন সাহেবের এই চাকরিটা নতুন না, আর এই যন্ত্রটির সাথেও তার সম্পর্ক অনেক পুরোনো। আজ থেকে প্রাই ৯ বছর আগে এই বীমা আপিসের টাইপরাইটার হিসেবে জয়েন করেন। তখন অবিবাহিত টগবগে তরুন মতিন … নিজের বেতনটা খরচ করতেন একজন স্বাধীন মানুষের মতই। সিগারেটের নেশাটা যেন সে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছিলেন। দিনে অল্প কয়েক্টা সিগারেট খেলেও ব্যান্সন ছাড়া তার হাতে দেখা যায়নি কখনো। আড্ডা বাজ তেমন না হলেও যেদিন তিনি আড্ডা জমাতেন রাতের খাবারটা খেতে মেসের সকলেরই অনেক রাত হতো। টাইপরাইটারের এই চাকরিটা প্রায় বিনা প্রতিদন্ডিতায় পেয়েছিলেন তিনি … তার লেখার গতির জন্য। তারপর অনেক জল বয়ে গেছে… মতিন সাহেবের মাতা গত হয়েছেন, গ্রামের জমিগুলো অবৈধভাবে দখল করেছেন তার আপন মামারা। নির্ঝঞ্জাট মতিন তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যাবস্থাও নিয়ে পারেননি। বিয়ে করেছেন তিনি, একটা ফুটফুটে বাচ্চাও আছে। তিনটা মুখের সংসার, তবু মাসের শেষের দিনগুলা যেন নরকসম হয়ে ওঠে মতিন সাহেবের কাছে। ৭০০০ টাকা এই শহরে পরিবার সহ চলার জন্য কতটা অপ্রতুল সেটা ভেবেই হয়ত তার বহু বিশ্বস্ত আংগুল গুলো টাইপমেশিনের ভুল শব্দে টোকা দিচ্ছে … বেঈমানী করছে তার অভিজ্ঞতা।
মাসের শেষের এই দিন গুলোতে মতিন সাহেবের পরিচিত অভ্যেসগুলোও কিছুটা পরিবর্তন হয়। যেমন , রিক্সার বদলে আপিসের পাশের এদো গলিটা ধরে নাকে রুমাল দিয়ে ৩০ মিনিট হেটে বাসাই পৌছানো , বেন্সন সিগারেটের পেকেটে স্টার সিগারেট রাখা, এমন কি ধর্মতলার লালুর চায়ের দোকানটাও সুকৌশলে তিনি এড়িয়ে যেতেন পাছে বন্ধুরা যদি ধরে বসে। মতিন সাহেব তার অফিসের কলিগ রফিক সাহেবের থেকে যে তিনি ১৫০০ টাকা এ মাসে ধার নিয়েছেন সে খবরটা স্ত্রীকে জানান নি। গহনার অভাবে তার স্ত্রী সব রকমের দাওয়াত প্রত্যাক্ষান করে চলেছে। স্বামীর সাথে অসাধারন একটা বোঝাপাড়া থাকাতে মেয়েটা আবদার করেনা তেমন। তাই মতিন সাহেবের ইচ্ছে হয়েছে কিছু সিটি গোল্ডের গহনা কিনে তাকে স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসার জানান দিবেন। যদিও এমন ধার কর্য তাকে প্রতি মাসেই করা লাগে… গহনা কেনাটা এমাসের অজুহাত মাত্র।আবার বাচ্চাটা এখন ও কৌটার দুধ খায় , এর সাথে আপোষ করা চলে না। এসব ভাবতে ভাবতে লেখার ভুলটা প্রতি মাসে হতেই থাকছে তার এই চাকরির বয়ষ্কালে। যেন মতিন সাহেবের দক্ষ হাতটাও বাস্তবতার সামনে ক্রন্দরত শিশুর মত আচরন করছে।
তবে মাসের শেষ দু’একটা দিন খুব ভাল ভাল সপ্ন দেখে কাটান মতিন । স্বপ্ন দেখেন মাসের ১ তারিখের্। স্বপ্ন দেখেন বেতন ওঠানোর জন্য ব্যাংকের লাইনে দাঁড়িয়ে ব্যাংক কর্মকর্তার ধীর গতিতে হাত চালানোর জন্য তিনি মেকি অভিমান করছেন। স্বপ্ন দেখেন আপিসের এদো গলিটা এড়িয়ে একা একটি ট্যাক্সিতে চেপে বাড়ি ফেরার। স্বপ্ন দেখেন দোকানের ফ্লুরোসেন্ট বাল্বের নিচে রাখা সবচেয়ে বড় চিকেনটা প্যাক করে স্ত্রীর জন্য বাসায় নিয়ে যাবার্। হইত এমাসে তার ছেড়া শাড়ির ও এক্টা বিহিত করে যাবে … আপিসের পাশে একটা দোকানে ম্যাজেন্ডা রং এর এক্টা শাড়ি দেখেই রেখেছেন তিনি। স্বপ্নের চিরচারিত ধর্মটা একটা সময় মতিন সাহেবের জন্যও সত্যি হয় … শত স্বপ্নের মাঝে তিনি এটাও ভোলেন না যে , মাসের ২২ তারিখ আবার ঘুরে আসবে। আবার সেই টানাটানির জীবন। মতিন মাঝে মাঝে ভাবেন যে , ক্যালেন্ডারের পাতা কে তিনি কেয়ার কর্বেন না , কিন্তু তার টাইপরাইটারটারের ভুলগুলো ঠিকি তাকে মনে করিয়ে দেয়… অগ্রাহ্য করতে পারেন না তিনি। … আজ ২১, আজ ২২ … … আজ ২৫ …