somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ভালোবাসা ফিকে হয়না!!... শুভ্র নীল

২৫ শে এপ্রিল, ২০১৪ রাত ১:৩৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আজ অনেকদিন পর পায়চারি এই স্মৃতিবহুল পুরনো মফস্বল শহরে সৈকতের। অনেকটাই উদ্দেশ্যহীন, বিক্ষিপ্তভাবে। এই শহরের অলি-গলি, ইট-কাঠ, পাথর আর প্রতিটা কোণে কোণে ছড়িয়ে রয়েছে অনেক স্মৃতি, অনেক চাপা কষ্ট, দীর্ঘশ্বাস। যৌবনের একেবারে শুরুর দিনগুলো, উত্তাল দিনগুলো, আবেগের শুরুর দিনগুলো কেটেছে এই শহরেই। জীবন চক্রের এই নিষ্ঠুর পদচারনায় হারিয়ে গেছে অনেক কিছুই সৈকতের। আজ থেকে সাত বছর আগেই তাকে এই শহরের মায়া কাটিয়ে যেতে হয়েছিল যান্ত্রিক নগরে যেখানে প্রতিনিয়ত তার কোমল মনের অনুভূতিগুলো নিষ্পেষিত হতো যান্ত্রিকতার নিদারুণ হস্তক্ষেপে। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে হয়তো নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে ধীরে ধীরে, নিজের লক্ষগুলোও আলোর মুখ দেখেছে অনেকাংশেই। মা-বাবার স্বপ্নও পূরণ হয়েছে বলতে গেলে। কিন্তু জীবনের কিছু মধুর স্মৃতি, কিছু আবেগময় মুহূর্ত, এই মফস্বলের কথা মাঝে মাঝে খুব নাড়া দেয়। শিক্ষাজীবনের উজ্জ্বল দিন পেরিয়ে আজ সৈকত অনেক বড় সরকারি কর্মকর্তা, বিসিএস অফিসার। ঢাকা শহরেও বাসা নেয়া হয় তাদের ভাইবোনদের লেখাপড়ার সুবিধার জন্য। মা-বাবা পায়ই আসা-যাওয়া করত। সে হিসেবে এই মফস্বলে সেভাবে আসা হতোনা খুব একটা।

কাল ই এসেছেসে সে অনেকদিন পর। ফরিদপুর থেকে দীর্ঘ ভ্রমণের পর আজ অনেকটাই ক্লান্ত। এই সকালে ফিরে আজ মোটামুটি সারাদিনই ঘুমিয়েছে। ভাবল যে দু-একজন বন্ধু আছে এখনো এই শহরে তাদের পরে ডাকবে, আড্ডা দিবে, তাদের সাথে মধুর কিছু সময় কাটাবে। তার আগে ক্লান্তিটা দূর করা দরকার। মাঝে মাঝে একা একা হাটা, ঘোরাফেরাকে টাকেও উপভোগ করে। সন্ধ্যার এই সময়টায় তাই আর বসে নেই। একরাশ ক্লান্তি আর কিছুটা ঘুম ভাব নিয়েই বেরিয়ে পরল। অনেকদিনের চেনা স্মৃতিময় এই শহরে। আবছা কালো সন্ধ্যা, কানে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকের শব্দ আর জোনাক জ্বলা সময় সে যেন হারিয়ে গেলো তার আগের সেই বারো বছর আগের সময়টাতেই। কিছুটা নস্টালজিক হয়ে পড়ে সে। কলেজ রোডের সেই পথ ধরে যেন সাত-আট বছর আগের সৈকতই হেটে যাচ্ছে। এই ঝিঁঝিঁ পোকা, জোনাকও যেন আজ একটু বেশি বেশি করছে! পুকুর পেরিয়েই হঠাৎ এসে দাঁড়াল স্নেহকুঞ্জ নামের এই বাসাটার সামনে। কিছুটা নীরবতা ভর করে টার মনে। কিছুক্ষণ চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইল দ্বিতীয় তলার ডান পাশের সেই বেলকনি টাতে। সেই আবছা আলো, পাশে জোনাক জ্বলা, ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, সন্ধ্যার মৃদু দখিনা হাওয়া এই ফাগুন দিনে সবই আছে। কিন্তু সেই মেয়েটা! মেয়েটা নেই...। যাকে দেখার জন্য, যার সাথে ইশারায় কথা বলার জন্য, যার একটা চিরকুট পাওয়ার জন্য, যাকে একটা চিরকুট দেয়ার জন্য ঠাই দাঁড়িয়ে ছিল কত সন্ধ্যা। যার সাথে একদিন দেখা না হলে, কথা না হলে কিছুই ভালো লাগত না তার। আজ এই সৈকত যেন সাত বছর আগের সৈকতই। দাঁড়িয়ে আছে স্নেহা কে দেখবে বলে। এই সুন্দর সন্ধ্যায় স্নেহার কাজল চোখে জোনাক জ্বলা দেখবে বলে, এই ক্ষণে স্নেহার কোমল সুন্দর মুখে হাজার ফুটন্ত ফুলের ভালোবাসার রুপ দেখবে বলে। এই জোনাক আর ফুলের আবহে কেটে যাবে সন্ধ্যার এই আবছা আঁধার। ঐ আকাশের মিটিমিটি তারার সাথে ঝলমলিয়ে হেসে উঠা একটা মুখপানে তাকিয়ে বলবে ভালোবাসি, অনেক ভালোবাসি তোমায়। কিছুটা আবেগ কাজ করছিল তার মন জুড়ে। ভুলেই গেলো যে সে আজকের সৈকত। দাঁড়িয়ে অপেক্ষা যেন সেই প্রিয় মুখটার জন্য। কখন আসবে সে। অবশ্যই আসবে।

সন্ধ্যার পর এই গলিটা কিছুটা নীরবই থাকে। হঠাৎ একটা রিক্সার বেল শুনে ঘোর কাটে তার। স্নেহকুঞ্জ এর সামনে রিক্সাটা থামে। একজন সুন্দরী মহিলার সাথে একজন হ্যান্ডসাম যুবক। সাথে তাদের তিন-চার বছরের একটা ফুটফুটে বাচ্চা। রিক্সা থামতেই সবাই নেমে পড়ে। যুবক টা রিক্সাওয়ালা কে ভাড়া দিচ্ছিল আর বাচ্চা কোলে মহিলাটা সৈকতকে দেখে বলল-
-কে ওখানে?
-আ...... মি...।
কণ্ঠটা একে অপরের খুব পরিচিত মনে হয়। দুজনই খুব অবাক হয়। এগিয়ে আসে মহিলাটা। এসেই খুবই অবাক হয় সৈকত কে দেখে। অবাক কণ্ঠেই জিজ্ঞাসা-
- সৈকত ভাইয়া, তু......মি...।
অনেকটা অবাক, অপ্রস্তুত কণ্ঠে জবাব সৈকতের-
- হুম....... আ......মি.... স্নেহা............।
- হুম......... তুমি করছিলে ওখানে?
কিছুটা স্বাভাবিক হাসি হেসে জিজ্ঞাসা স্নেহার। পাশের যুবকটাও এগিয়ে আসে। অনেকটা অবাক হয়েই বলে-
যুঃ কি স্নেহা? চেনো নাকি ওনাকে? কে উনি?
স্নেঃ হুম...। সৈকত ভাইয়া। চল তোমার সাথে পরিচয় করিয়ে দেই। এই হল সৈকত ভাই, মস্ত বড় বিসিএস অফিসার। উকিল পাড়ায় ওনাদের বাসা।
যুঃ ও...... উনি সেই সৈকত!
স্নেঃ সৈকত ভাই, আমার হাজবেন্ড।
হাত বাড়িয়ে হাসিমুখে সৈকত বলে – নাইস টু মিট ইউ।
যুবক টা বলে উঠে- আপনার কথা স্নেহার কথা অনেক শুনেছি। অনেক মজার মজার কথা। কিছুটা কৌতুক আর তাচ্ছিল্য ভরা কণ্ঠ যেন। বাচ্চাটা তাদের কথা যেন মন দিয়ে শুনছিল। সৈকত বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে তাকে কোলে তুলে নিল। একটু আদরও করে দিল। নিজের মধ্যে একটা শিহরণ কাজ করে উঠল তার। মনে মনে ভাবল- এইরকম একটা ফুটফুটে বাচ্চাসহ হয়তো আমিই থাকতে পারতাম স্নেহার পাশে, আমার ভালোলাগা-ভালোবাসার মানুষের সাথে। বাচ্চাটা মুখের দিকে তাকিয়ে আধো আধো বুলিতে বলে উঠে-
- তোমার নাম কি? তোমার মন খারাপ?
- না, বাবু......। আমি সৈকত। তুমি......?
- অ...নি......ক।
স্নেহা অনিক কে একটু আদর করে দিতে বলে। অনিকও তাই করে। সৈকতও অনিক কে আদর করে দেয়। এইরকম আদর স্নেহার কাছ থেকেও তো পেতে পারত, এইরকম একটা মিষ্টি অনিক ও তাদের হতে পারত। ভালোবাসার স্বর্গ রচনা করতে পারত ছোট্ট সংসার টাতে। হঠাৎ স্নেহা বলল-
- কি করছিলে একা একা, সৈকত ভাই? কবে এসেছ? কতদিন পর তোমার সাথে দেখা।
- এইতো, আজ সকালেই আসলাম। এই একটু এইদিক দিয়ে হাঁটছিলাম। তোমার কথা মনে পড়ে গেলো।
- আর কতদিন একা থাকবে? এবার ভাবি-টাবি আনো। সবই তো হল......।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সৈকত বিড়বিড় করে বলে- আরো যে কতদিন? মানুষ কি চায় আর কিই পায়?
- আরে, একটা সুন্দরী বউ ঘরে আনো। দেখবে সবকিছুই সুন্দর।

স্নেহার বরও হাসি দিয়ে সায় দেয় স্নেহার সাথে। স্নেহা তাকে বাসায় আসতে বলে। সে জানাল আরেকদিন আসবে। জানতে পারল স্নেহারা কিছুদিন থাকবে আর সেও তো কিছুদিন আছে। সবাইকে বিদায় জানালো। স্নেহারাও বাসায় ঢুকছিল। হাত নাড়ছিলো ছোট্ট অনিক। আর স্নেহার হাত টা শক্ত করে ধরা তার বরের হাতে। সৈকত অনেক বার তাকালেও স্নেহা তাকাল না। মনের কোণে হুহু করে উঠল। ওদের এক একেকটা পদক্ষেপ যেন ভালোবাসার উদ্যানে নির্মম কুঠারাঘাত। ভাবতে লাগলো এই স্নেহা তো সেই স্নেহা নয়, তার ভালোবাসার স্নেহা নয়। একটু এগিয়ে গিয়ে উঠে নির্জন আরেকটা রাস্তায়। চারপাশে এক অদ্ভুত আঁধার, এই আঁধার আজ টার মন-প্রান জুড়ে। আকাশের অর্ধচন্দ্র টা যেন তার দিকে তাকিয়ে উপহাসের মুচকি হাসি হাসছে। সাত-আট বছর আগের সেই হাসিটা, সেই মুখটা, সেই ভালোবাসা টাকেই যেন খুঁজছে দূর আকাশের তারায় তারায়। অতি সুন্দরী স্নেহাকে তার বাবা-মা তুলে দেয় বিদেশ ফেরত বড়লোক বরের হাতে। ভালবাসাটাও যেন রঙ হারিয়ে ফিকে হয়ে গেলো নিমিষেই। স্নেহাও খুব সহজে সৈকত কে ভুলে মেনে নেয় সবকিছু। সৈকতের মনে আজ বড় প্রশ্ন- কি ছিল তাহলে স্নেহার মনে? কি চেয়েছিল স্নেহা তার কাছে? ভাবনা গভীর হতে থাকে। রাতের এই আঁধারে যেন তার ভাবনা গুলো আলোর মুখ খুঁজে ফিরছিল। এক পর্যায়ে ফোন আসে মায়ের-
-কইরে তুই? বাসায় আয়। সবাই তোর জন্য বসে আছে।
- এইতো মা, আসছি......।

ফোনটা রেখেই বাসার দিকে ছুটল। সাথে একবুক দীর্ঘশ্বাস আর পড়ে থাকা হাজার স্মৃতি......। একদিন দিন শেষ হয়। সৈকতের চলে যাওয়ার সময় হয়। সৈকত চলে যায় আর এই মফস্বল শহরের অলিগলি তে জড়িয়ে থাকা স্মৃতির মাঝে তার ভালোবাসার কথাও উজ্জ্বল হয়ে জলে থাকবে। স্মৃতিময় কলেজ রোড, পুকুর, স্নেহকুঞ্জের স্নেহা নামের মিষ্টি ভালোবাসা, জোনাক, ঝিঁঝিঁ পোকা, আবছা আঁধার, বেলকনি, চাঁদ-তারা, সেই নির্জন পথ, দূরের গ্রাম কিছুই ভুলবে না সৈকত। স্মৃতির পাতায় পাতায় এগুলো যে একটা একটা ঝলমলে তারা, জ্বলন্ত নক্ষত্র।

- শুভ্র নীল
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে এপ্রিল, ২০১৪ রাত ১:৪৯
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অনির্বাণ শিখা

লিখেছেন নীলসাধু, ০৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



রাত ন’টার মত বাজে। আমি কি যেন লিখছি হঠাৎ আমার মেজো মেয়ে ছুটতে ছুটতে এসে বলল, বাবা একজন খুব বিখ্যাত মানুষ তোমাকে টেলিফোন করেছেন।

আমি দেখলাম আমার মেয়ের মুখ উত্তেজনায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

=ইয়াম্মি খুব টেস্ট=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:১৪



©কাজী ফাতেমা ছবি
সবুজ আমের কুচি কুচি
কাঁচা লংকা সাথে
ঝালে ঝুলে, সাথে চিনি
কচলে নরম হাতে....

মিষ্টি ঝালের সংমিশ্রনে
ভর্তা কি কয় তারে!
খেলে পরে একবার, খেতে
ইচ্ছে বারে বারে।

ভর্তার আস্বাদ লাগলো জিভে
ইয়াম্মি খুব টেস্ট
গ্রীষ্মের... ...বাকিটুকু পড়ুন

অণু থ্রিলারঃ পরিচয়

লিখেছেন আমি তুমি আমরা, ০৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৭


ছবিঃ Bing AI এর সাহায্যে প্রস্তুতকৃত

১৯৪৬ কিংবা ১৯৪৭ সাল।
দাবানলের মত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশে।
যে যেভাবে পারছে, নিরাপদ আশ্রয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। একটাই লক্ষ্য সবার-যদি কোনভাবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

পেইন্টেড লেডিস অফ সান ফ্রান্সিসকো - ছবি ব্লগ

লিখেছেন শোভন শামস, ০৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:১৯

"পেইন্টেড লেডিস অফ সান ফ্রান্সিসকো", কিংবা "পোস্টকার্ড রো" বা "সেভেন সিস্টারস" নামে পরিচিত, বাড়িগুলো। এটা সান ফ্রান্সিসকোর আলামো স্কোয়ার, স্টেইনার স্ট্রিটে অবস্থিত রঙিন ভিক্টোরিয়ান বাড়ির একটি সারি। বহু... ...বাকিটুকু পড়ুন

এশিয়ান র‍্যাংকিং এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান !!

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ০৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:২০

যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিক্ষা সাময়িকী 'টাইমস হায়ার এডুকেশন' ২০২৪ সালে এশিয়ার সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা প্রকাশ করেছে। এশিয়ার সেরা ৩০০ তালিকায় নেই দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়।তালিকায় ভারতের ৪০, পাকিস্তানের ১২টি, মালয়েশিয়ার ১১টি বিশ্ববিদ্যালয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×