somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বুকের ভেতর মৃত নদী (পর্ব আট)

১২ ই সেপ্টেম্বর, ২০২০ রাত ৮:৪২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



আগের পর্ব


দশ
শায়লা বেগম খুব বিপদে পড়েছেন। স্বামীর মৃত্যুর পর শত রকমের বিপদ থেকে বাঁচিয়ে পাখির ছানার মত করে মেয়েদুটিকে মানুষ করছেন তিনি।বড় মেয়ের পড়াশোনা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে।এখন তাকে বিয়ে দিয়ে নতুন জীবনের পথে এগিয়ে দেবেন এমনটাই ইচ্ছা ছিল। কিন্ত এমন কিছু হবে উনি ভাবতে পারেননি।

তুষার ছেলেটির বাবার আসল পেশা জানার পর থেকে তার মন অত্যন্ত খারাপ।অফিসার তিনি নন।তিনি দশম শ্রেনীর বেশি পড়াশোনা করতে পারেননি। জীবিকার জন্য ছোট পদের একটা চাকুরী করেন।সরকারি চাকুরী এটা ঠিক।তাই বলে এমন পরিবারে মেয়ে দেয়া যায় না।

শায়লা বেগম অনেক উচ্চ বংশীয় শিক্ষিত পরিবারের মেয়ে।তার স্বামীও তাই।শ্রাবনীর নানা চাকরিসূত্রে এই এলাকায় পরিবার নিয়ে অনেক বছর ছিলেন।অফিসার হিসাবে তার দারুন সুনাম ছিল।তার ছেলে মেয়ের সকলেই এখানেই স্কুল-কলেজে গেছে,সবার সাথে মিশেছে,সবার সম্মান আর ভালোবাসা পেয়েছে। যদিও শ্রাবণীর দাদুবাড়ি গ্রামে তবুও তাদের পরিবারের মানুষকে সাত গ্রামের লোক এক নামে চেনে।জমিজমা অনেক ছিল একসময়। সেসব এখন তেমন নেই কিন্তু সম্মান আছে।আশেপাশের গ্রামগুলোতে শালিস বিচারের জন্য লোকে শ্রাবণীর দাদাকে নিয়ে যেতেন।তার বিচারের ফয়সালা সবাই মেনে নিত।শায়লা বেগমের শ্বশুর শ্বাশুড়ি গত হয়েছেন আগেই,এর বছর দুয়েকের মধ্যেই শ্রাবণীর বাবাও অকালে গত হলেন।তারপর কত কষ্ট করেই না তিনি এই মেয়েটিকে উচ্চ শিক্ষা দিয়েছেন।শায়লা বেগম নিজেও স্থানীয় কলেজে শিক্ষকতা করেন।তার নিজের সন্মানও কম নয় এই এলাকায়।

শ্রাবণীর বাবার মৃত্যুর পর তিনি একদম অকূল পাথারে পরেননি এই চাকরিটা ছিল বলেই।সবদিক ভেবে স্বামীর পৈত্রিক বাড়িতেই থেকে গিয়েছিলেন তিনি।কলেজটাও কাছে হয় এখান থেকে তাছাড়া শ্রাবণীর সামনে তখন এইচএসসি পরীক্ষা।দুইটি রুমের অসমাপ্ত বিল্ডিং বাড়িতে একটি টিনএজ মেয়ে আর একটি সাত বছরের শিশু সন্তানকে নিয়ে কতগুলো দুঃসহ রাত যে তিনি পার করেছেন তা শুধু তিনিই জানেন। মানুষজন ভরা জমজমাট বাড়ি কয়েক বছরের ব্যবধানে প্রায় জনশূন্য হয়ে পড়েছে। শ্রাবণীর বাবা ছিলেন শক্তিশালী সাহসী ধরনের মানুষ।তার অবর্তমানে ছোট মেয়ে দুটিকে নিয়ে অরক্ষিত বাড়িতে থাকা যে কতটা চ্যালেঞ্জ এর বিষয় ছিল তা আর কেও উপলব্ধি করতে পারেনি।


ছোট থেকেই শ্রাবণী দেখতে গোলগাল পুতুলের মত ছিল।বড় হয়ে উঠতে উঠতেই বহু লোকের নজর পরে গেল মেয়েটির উপর।অনেক উটকো যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছে তাকে রাস্তাঘাটে। এলাকার ছেলেছোকরাদের যন্ত্রণায় কিশোরী বয়সেই অনেকটা গৃহবন্দী হয়ে গিয়েছিল মেয়েটা।পড়ালেখা ভালবাসে তাই পড়ালেখাই করত বেশিরভাগ সময়।শ্রাবণীর বাবা নিজের পৈত্রিক ভিটা ছেড়ে শহরে যেতে চান না।তাদের দুজনের জন্য অবশ্য চাকরির সুবিধা হয় এই বাড়িতে থাকলে।তাই পড়াশোনায় ভাল হওয়া সত্ত্বেও মাধ্যমিকে শ্রাবণীকে গ্রামের স্কুলে এনে ভর্তি করেছিলেন।মেয়েটি মোটেও চালাকচতুর নয়।তাছাড়া ছেলেরা যেভাবে পেছনে লাগে,একা একা শহরের স্কুলে আসা যাওয়া করতে গিয়ে যদি কোনো বিপদ হয়!এইসব ভেবেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তারা।এলাকায় সবাই তাদের চেনে।ছেলেছোকরাগুলো শ্রাবণীর বাবাকে ভীষণ ভয় পায়।আসেপাশে ঘুরাঘুরি করা ছাড়া শ্রাবণীর তেমন কোনো ক্ষতি করার সাহস এরা পাবেনা।তবে গ্রামের স্কুলে দিলেও অনেক টাকা দিয়ে ভাল প্রাইভেট টিউটর রেখেছিলেন তিনি মেয়ের জন্য।নিজের বেতনের বেশিরভাগই তিনি নিজের মেয়ের জন্য খরচ করতেন।তার ইচ্ছা ছিল গ্রাম থেকে পড়াশোনা করেই মেয়ে ভাল রেজাল্ট করবে।


হয়েছিলোও তাই। এসএসসিতে শ্রাবণী তার স্কুল থেকে প্রথম জিপিএ ফাইভ অর্জন করে।দুই তিন বছর আগে গ্রেডিং সিস্টেম চালু হলেও জিপিএ ফাইভ তখন ঢালাওভাবে দেয়া হতোনা।স্কুল তো বটেই আসেপাশের দশ বিশ গ্রামে জিপিএ ফাইভ পাওয়া কোনো শিক্ষার্থী ছিলনা শ্রাবণীর আগে।শ্রাবণীর বাবা খুশিতে আধামন মিষ্টি কিনে তখনি বিলিয়ে দিয়েছিলেন গ্রামের ঘরে ঘরে।


মেয়েটির এইচএসসিতেও অত্যাধিক ভালো ফল করার কথা কিন্ত দুইমাস আগে বাবার মৃত্যু হওয়ায় সেই টার্গেট পূর্ণ হয়নি।পূর্ন হয়নি ডাক্তার হওয়ার স্বপ্নটিও।হবে কিভাবে?পদে পদে যার এত বাধা সে কিভাবে পারবে সকল বাধা ছিন্ন করতে?মেয়ে পড়াশোনায় ভাল তাই আত্মীয়দের হিংসা,তাকে থামানোর জন্য শত চেষ্টা। অনেকেই বলেছে তখনি মেয়েকে বিয়ে দিতে।এইটুকু মেয়ে।আঠারো পরেছে কি পরেনি তাকে বিয়ে দেয়া!শায়লা বেগম শক্ত হয়ে থেকেছেন।শ্রাবণী বাবা বেঁচে থাকতেও অনেক বিয়ের প্রস্তাব এসেছে কিন্ত তারা পাত্তা দেননি।এত ছোট মেয়েকে কেনই বা বিয়ে দেবেন?মেয়েকি কি তাদের ঘাড়ের বোঝা?

শায়লা বেগম স্বামীর মৃত্যুর পর রাত বিরাতে বাড়ির আসেপাশে লোকজনের চলাচল টের পেয়েছেন।যার ভয়ে লোকে উঠানে পা ফেলতে সাহস পেত না তার অবর্তমানে কতকিছুই তো ঘটতে পারে।লোকজন নেই এতবড় বাড়িটা শূন্য তার উপর কোনো দেয়াল প্রাচীর নেই।যেকোনো দিক থেকেই লোকের আনাগোনা হতে পারে।বাড়ি কমপ্লিট হয়নি।দুইটি রুমের সাথে লম্বা ডাইনিং রুম,তার শেষ প্রান্তে বাথরুম। ডাইনিংটা তখনকার জন্য গ্রিল দিয়ে ঘেরা ছিল তাই দেখাতো বারান্দার মত।খারাপ লোকের ভয়ে তিনি সন্ধ্যা হলেই সব জানালা আটকে দিতেন।শ্রাবণী রাত জেগে পড়ত কিন্ত বেশি রাতে বাথরুমে যেতে দিতেন না।থাকুক গ্রিল কিন্ত কেউ যদি ভয় দেখায় বা কিছু ছুড়ে দেয়।যদি এসিডই মারে তখন কি করতে পারবেন তিনি?


শ্রাবণীর চাচাদের কাছে তখন অনেকবার আর্জি করেছেন একটা প্রাচীর তোলার ব্যবস্থা করার।তারা আমলে নেয়নি এমনকি শায়লা বেগমের নিজের খরচেও প্রাচীর তুলতে দেন নি।গ্রামের নিয়মিত লোডশেডিং আর অসহ্য গরমের মধ্য দুটি মেয়েকে নিয়ে জানালা দরজা আটকে গরমে সেদ্ধ হয়েছেন তিনি।মেয়ের পরীক্ষা শেষ করে তাকে বাড়ির বাইরে রেখে কোচিং করিয়েছেন।

ভাল বিশ্ববিদ্যালয়ে তাকে ভর্তি করেছেন সকলের অমতে।শ্রাবনীর চাচা ফুফুরা কেউ এতটুকু সাহায্যও করেনি পড়াশোনার কাজে।শ্রাবণীকে কোচিং-এ নেয়া,নানা যায়গায় ঘুরেঘুরে পরীক্ষা দেওয়ানো সবই করেছে তার নানাবাড়ির লোকেরা।

এভাবে তিল তিল করে গড়ে তোলা মেয়েটিকে যদি একটা ভাল ঘরে তুলে দিতে না পারেন তবে শায়লা বেগমের শ্বশুর বাড়ির লোকেরা হাতে তালি দেবে।হিংসুটে পাড়া প্রতিবেশীরাও আনন্দ উল্লাস করবে।এলাকায় সব ছেলেকে ছাড়িয়েও যে মেয়ে যোগ্যতা অর্জন করেছে তার পতন হলে খারাপ লোকগুলো তো আনন্দ করবেই।পরিবার যেমনি হোক ছেলেটা যদি ভাল হয় তাও তো শান্তনা থাকে।কিন্ত কেমন মানসিকতার ছেলে নিছক বন্ধুত্ব করার জন্য নিজের বাবার মিথ্যা পরিচয় দেয়?এই ছেলের মধ্যে নিশ্চয়ই অসততা রয়েছে।এই ছেলে কি ভালো হতে পারে?এতটুকু বয়েসেই এসব শিখল কোথা থেকে ছেলেটা?


বাড়ি ফেরার পর থেকেই শ্রাবনীকে বড্ড মনমরা দেখাচ্ছিল।একরাতে নিজে থেকেই ছেলেটির ব্যাপারে সব খুলে বলল।তারপর থেকে খুব চুপচাপ থাকছে মেয়েটা।বই সামনে নিয়ে বসে আছে কিন্ত পড়ছে না।শায়লা বেগম বোঝেন,নিজের সাথে চরম বোঝাপড়া করার চেষ্টা করে চলেছে মেয়েটা।সে ভাল করেই জানে এমন পরিবারে তার বিয়ে দেয়া সম্ভব হবেনা।মেয়েটির কষ্টের জীবনে নতুন অধ্যায় যেন যুক্ত হলো এবার।শ্রাবণী একবার খালি জিজ্ঞাসা করেছে সে এখন কি করবে?শায়লা বেগম উত্তরটাও দিতে পারেন নি ঠিক করে।একবার বলেছেন যার যার পথ দেখাই ভাল হবে এখন। কারন ঐ পরিবারে তুমি মানিয়ে নিতে পারবে না।তোমার পরিবারেও ছেলেটি মানিয়ে নিতে পারবে না।

বলেছেন বটে তবুও ভাবনা আসে, শুধুমাত্র বাবার পেশার কারনেই কি এতদিনের চেনা একজনকে বাতিল করে দেয়া যায়?সবাই তো মানুষ!পরিবেশ পরিস্থিতির জন্য একেকজন মানুষের একেকরকম অবস্থা হয়।তিনি শুনেছেন তুষারের দাদা অনেক আগেই মারা গিয়েছেন।তাই বড় ছেলেটি বাদে অন্য কেও খুব বেশিদূর পড়তে পারেনি।যে কারো এমন অবস্থা হতে পারে।তবে তুষার ছেলেটি এসব লুকালো কেন?যে নিজের পিতার পরিচয় অস্বীকার করে সে দুনিয়ায় যে কাওকে অস্বীকার করতে পারবে।

শায়লা বেগম জানেন তার কঠিন হওয়া দরকার।কিন্ত পুরোপুরি কঠিন হতে তিনি পারছেন না।এটি এমন এক সমস্যা যা নিজের ভাইবোনদের কাছেও বলা যায় না।অবশেষে তিনি খুব বিশ্বাসভাজন একজনের সাহায্য নিলেন।শ্রাবণীর কাছ থেকে তুষারে ফোন নাম্বার নিয়ে লোকটি তাকে ফোন দিল।তুষার অনেক কথার সাথে এই কথাটিও বলল সে সত্যিই শ্রাবণীকে পছন্দ করে এবং বিয়ে করতে চায়। অনেক চিন্তা করে শ্রাবণীর মা ভাবলেন যদি ছেলেটি ভাল চাকুরী করে সততার সাথে ভাল জীবন গড়তে পারে তবে তিনি ভেবে দেখবেন মেয়েকে দেয়া যায় কিনা।তবে বাবাকে নিয়ে যে মিথ্যাচারীতা করে সে কি ভাল জীবনসঙ্গী হতে পারবে?শায়লা বেগমের এ ব্যাপারে সন্দেহ থেকেই গেল।


এগারো

শ্রাবণীর বিশ্বাস ভেঙ্গেছে, তার মন ভেঙ্গেছে,তার ভালোবাসাও ভেঙ্গেছে।
মিথ্যা।
তার প্রচন্ড অপছন্দ এই মিথ্যা।
পরিবার নিয়ে মিথ্যা বলা তো নিজেকে নিয়ে মিথ্যা বলার সামিল।

একজন মিথ্যাবাদী তার প্রিয়জন হতে পারেনা।সে আর এই সম্পর্ক রাখবে না।
বান্ধবীদের কাছে একবার সে বলেছিল ,তুষারের অনেক সমস্যা আছে কিন্ত তার বড় গুন সে আমার সাথে সত্য কথা বলে।সেই কথাটা এত নিদারুণ ভাবে ভুল প্রমানিত হবে শ্রাবণী তা ভাবে নি।

সে মনে মনে নিজেকে গুটিয়ে নেয়।তুষার ফোন দেয়।শ্রাবণী কথা বলতে চায় না।তুষারের ভাবভঙ্গির মধ্যে কোনো জড়তা নেই।তার ভাব দেখে মনে হয় কিছু হয়নি,সব স্বাভাবিক আছে।শ্রাবণী এটাতেও খুব অবাক হয়।মানুষ এমনটা পারে কিভাবে?

আজকাল শ্রাবণীকে ভাবনায় পেয়েছে।সে বসেবসে আকাশপাতাল ভাবতে থাকে অবিরাম। মনের ভেতরে এক অব্যক্ত যন্ত্রণায় সে ছটফট করতে থাকে।তিন তিনটা বছর।এত্তগুলো প্রিয় স্মৃতি। এইসব ভুলে যেতে হবে?এত নির্ভরতার মানুষটিকে ছেড়ে দিতে হবে?সে তো তাহলে সম্পূর্ণ একা।আর দুই তিনমাস।তারপর তো হোস্টেলের আবাস ছাড়তে হবে।তখন একাএকা সব কিভাবে সামলাবে?

আচ্ছা তুষার এতবড় মিথ্যাটা বলতে গেল কেন?সব তো ঠিকই ছিল।
শ্রাবণী থমকে যায়।
সব কি আসলেই ঠিক ছিল?

কাগজ কলম গুছিয়ে নিয়ে সে একটা চিঠি লিখতে বসে।

প্রিয় তুমি,

বোঝা যায় ভালই আছ।কিন্ত একটা কথা কি জান?আমি ভাল নেই।তুমি আমার সাথে অনেক অন্যায় করেছ,আমি ক্ষমা করে দিয়েছি কিংবা অন্তত ক্ষমা করবার চেষ্টা করেছি।তবে তোমার এই অপরাধ আমি কখনো ক্ষমা করবো না।কখনোই না।তুমি আমার পরিবারের কাছে আমার মাথাটা নিচু করে দিয়েছ।তারা আর কখনোই আমার বুদ্ধি বিবেচনার উপর আস্থা রাখতে পারবে না।

আমার অনেক আত্মীয়স্বজন, চারপাশে অনেক মানুষ কিন্ত ভেতরে ভেতরে আমি মানুষটা খুবই একা।
আমার কোনো এমন বন্ধু ছিলনা যার সাথে মন খুলে কথা বলতে পারি।একজনের সাথেই আমি মন খুলে কথা বলতাম,তিনি আমার মা।আমার সবচেয়ে বড় আস্থার যায়গা।এরপর আমি তোমায় পেলাম।প্রথম প্রথম তোমায় গ্রহণ করতে পারিনি জানো?তবে দিনে দিনে আমি তোমাকে মায়ের পরের আস্থার জায়গাটা দিয়েছিলাম।মন উজার করে কথা বলতাম তোমার সাথে।চাইতাম তুমি আমাকে ভালো করে জেনে নাও,চিনে নাও।তুমি কি বোঝোনি আমি কতটা ভালোবাসার কাঙাল?

তোমার সাথে যখন সম্পর্ক হলো তখন একদিন তোমাকে আমি আমার বাবার মৃত্যুর দিনটির কথা বলছিলাম।তুমি ঠিক মনোযোগ দিয়ে শুনছিলে না।কথা শেষ করার আগেই একবার বলেছিলে চল এখন উঠি।আমি আহত হয়েছিলাম।থেমে গিয়েছিলাম।তুমি ছাড়া আর কাওকে আমি সেই দিনটির কথা খুলে বলিনি।আমিতো কাওকে আগ বাড়িয়ে এটাও বলিনা যে আমার বাবা নেই।সেদিন তোমাকেই একটু বলতে চেয়েছিলাম।

একদিন তুমি হঠাৎ করে বললে আমার পারফিউমটা তোমার ভাল লাগছে না।এটাও একদম শুরুর দিকের কথা। তখনো অতটা ক্লোজ হইনি,পরিচয়ের জড়তা কাটেনি।কথাটা শুনে আমি বেশ অবাক হয়েছিলাম।আমার পারফিউম সেন্স খুব ভাল।এটা আমি জানি কারন জীবনে অসংখ্যবার পারফিউমের প্রসংশা শুনেছি।আমি খুব হালকা,ফ্রেশ আর ফ্লোরাল পারফিউম ব্যবহার করি।আমার গায়ের নিজস্ব সুবাসের সাথে মিলিয়ে তা অন্যরকম সুন্দর এক আবহ তৈরি করে।তোমার কাছে সেই সুবাসটা এতটাই খারাপ লাগল যে সব ভদ্রতা ভুলে গিয়ে এমন কথা বলে ফেললে! অথচ তোমার সাথে বেড়াতে যাওয়ার আগে আমি যত্ন করে গা ধুয়ে ধোয়া কাচা কাপড় পরে যেতাম। তাই ঘাম আর পারফিউমের গন্ধ মিশে উৎকট কিছু তৈরি হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। এখন যখন তুমি বল যে আমার গন্ধটা মিস করো আমার সেই প্রথম দিনের কথাটাই খালি মনে পড়তে থাকে।


তুমি একদিন বলেছিলে মেয়েদের গায়ের শ্যামলা রং আর কোঁকড়া চুল তোমার বেশি পছন্দ।আমার গায়ের রং হলুদাভ ফরসা।অতটা রূপচর্চা করিনা তাই রোদেপোড়া ভাবটা চোখে পড়ে।আমার চুলগুলো ভীষণ নরম আর স্ট্রেইট।এগুলো এতটাই সিল্কি যে ক্লিপ আটকে থাকেনা,রাবার ব্যান্ড পিছলে যায়। ভালোকরে আষ্টেপৃষ্টে না বাঁধলে খোপা খুলে যায়।এদেশে শ্যামল মেয়েরাই সবচেয়ে মায়াময় এটা আমি মানি।কিন্ত এমন গায়ের রং আর স্ট্রেইট চুলের জন্য অনেকে হাজার হাজার টাকা খরচ করে।একেক জনের একেক রকম পছন্দ তবে জন্মের পর থেকে আমায় কেও অসুন্দর বলেছি। অথচ দেখ, তোমার কাছে প্রথমটায় প্রশংসা পেলাম না।আমায় দেখে ভাল না লাগলে সম্পর্ক করতে কেন এসেছিলে তুমি?

আমি চেহারা সাজগোজ ইত্যাদি নিয়ে তেমন মাথা ঘামাই না।অন্য লোকের কথা অতটা গায়ে মাখিনি জীবনে।কিন্ত তোমার কথাগুলো গায়ে লাগত খুব।তাই আমার গঠন নিয়ে করা তোমার মন্তব্য শুনে মন খারাপ করতাম,সেটাও লুকিয়ে লুকিয়ে।একপর্যায়ে দেখিয়েই মন খারাপ করেছি তবুও দেখতাম তুমি নির্বিকার। আমি জন্মগতভাবেই খুব ভদ্র তাই সামনাসামনি বলতে বাধত।কিন্ত সেদিন আর ধৈর্য্য থাকলো না যেদিন তুমি বলেছিলে-''তোমার হাসিটা সুন্দর না কিন্ত কি যেন আছে।''আমি অবাক তাকিয়ে বলেছিলাম কি বললে তুমি?তুমি আবারো বললে-'তোমার হাসিটাকে সুন্দর বলা যায় না কিন্ত কি যেন আছে।'

মিস্টার তুষার সেইদিনই আমি নিশ্চিত হলাম তোমার মাথায় বড় ধরনের সমস্যা আছে।প্রেমিকাকে কেউ অসুন্দর বলেনা।তার হাসি কেউ খারাপ বলেনা।তুমি যদি শুধু বলতে -'তোমার হাসিতে কি যেন আছে' তাহলেই আমি অনেক খুশি হয়ে যেতাম।আমার যা তোমার কাছে সুন্দর লাগেনা তা আমাকে বলে কি লাভ?আমি তো নিজে নিজেকে বানাইনি।অনেকেই আমার হাসিতে পাগল ছিল,অনেকে বলেছে মিষ্টি লাগে।তবে সেগুলো আমি পাত্তা দিইনি। আমি সারাজীবন চেয়েছি আমার নিজস্ব পুরুষটির চোখে প্রশংসা পেতে তার চোখে সুন্দর হতে।সেদিন তোমার সাথে কথা কাটাকাটি করেছিলাম।কি লজ্জার ব্যাপার!

মনেপড়ে তুষার? আমার পরীক্ষার মাঝে একদিন অনেক সেধে আমার নাস্তা খেতে নিচে নামালে। আমরা একজায়গায় বসে নাস্তা করছিলাম তখন একটি মেয়ে রিকশা নিয়ে আসছিল।তুমি দূর থেকে দেখেই আমাকে উঠতে বললে।আমি দেরি করছিলাম দেখে আমাকে ধমক দিয়ে, খারাপ ব্যবহার করে বললে -'বারবার উঠতে বলছি,সে যেন না দেখে এই জন্য।তাও উঠছ না।'এই মেয়েটি তো সেই মেয়েটিই ছিল আমার আগে যে তোমার প্রেমের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিল।সে দেখলে কি তুষার?তুমি কি আমাকে নিয়ে ঘুরতে লজ্জিত বোধ করতে?তুমি কি আমায় তোমার পাশে থাকার যোগ্য মনে করতে না?সেদিন খুব ঝগড়া করেছিলাম।সারারাত ঘুমাতে পারিনি ভাল করে পড়তেও পারিনি,জঘন্য একটা পরীক্ষা দিয়েছিলাম।

একবার সিনেমা দেখে ফেরার পথে বৃষ্টি নামল।তখন সন্ধ্যা ছাড়িয়েছে মাত্র।হোস্টেলের বাইরের মেহগনি বাগানের ঘোর অন্ধকারে হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে ভিজে যাচ্ছিলাম দুজনে।চারপাশে কোনো মানুষ ছিলনা।সেদিন কেন যেন একটা অন্যরকম আবেগ আর পাগলামি পেয়ে বসল আমাকে।ইচ্ছা করছিল তুমি আমাকে দুহাতে জড়িয়ে নাও আর আমি তোমার বুকে আশ্রয় নিই।বাইরের অঝোর পানির ধারার শীতলতার মধ্যে তোমার দেহের উষ্ণতার মাঝে কিছু সময় কাটাতে চেয়েছিলাম।তুমি আমার হাত ধরে ছিলে।তোমার হাতের কুসুম কুসুম উষ্ণতা খুব ভালো লাগছিলো। কিন্ত সেই মায়াময় মুহূর্তের মোহ কাটিয়ে তুমি আমার হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বললে রাতের খাবারের ব্যবস্থা করার জন্য তুমি চলে যাবে।আমি কাতর গলায় বলেছিলাম আর কিছুটাক্ষন থাক প্লিজ।তুমি বললে,না না দেরী করলে খাবার পাওয়া যাবে না।আমি আর একবার মিনতি করেছিল।তুমি শোনোনি,তুমি চলেই গিয়েছিলে।আর রিক্ত,আহত, অপমানিত হৃদয়ে আমি ফিরে এসেছিলাম নিজের রুমে।


জানো? এমন মায়াময় মূহুর্ত এক জোড়া মানব-মানবীর জীবনে একবারই আসে।কেউ কি তা হেলায় হারায়?আমাদের যদি বিয়েও হয় সেই সন্ধ্যার মতো আর একটা সন্ধ্যা কি আর কখনো ফিরে আসবে? আচ্ছা সেদিন কি হয়েছিলো তোমার?এমন করলে কেন?ছেলেদের হোস্টেলের আসেপাশের দোকানগুলো অনেক রাত পর্যন্ত খোলা থাকে আর তখনতো কেবল সন্ধ্যা নেমে রাতে গড়িয়েছে ।হোস্টেলের খাবার ফুরালেও সেখানে খাবার ঠিকই পেয়ে যেতে। অন্যসময় তো ছুঁয়ে দেয়ার একটা সুযোগও হারাতে চাওনা।কোনো বাঁধা মানতে চাওনা।তবে সেদিন কেন এভাবে চলে গেলে?হয়ত সেদিন মূহুর্তের মায়া তোমাকে স্পর্শ করেনি।তুমি বড্ড স্বার্থপর!


এমন হাজারটা ছোটবড় আঘাত তোমার কাছে পেয়েছি।কোনোবার ক্ষমা করার চেষ্টা করেছি।কোনোবার চলে আসতে চেয়েছি সম্পর্ক ছেড়ে।কিন্ত প্রতিবার তুমি আটকেছ।ঘন্টার পর ঘন্টা হলের সামনে দাঁড়িয়ে থেকেছ।ফোন দিয়েছ।একেতাকে দিয়ে খবর পাঠিয়েছ।কষ্ট না দেয়ার প্রমিজ করেছ কিন্ত আবারো আঘাত দিয়েছ।তুমি নাছোড়বান্দার মত লেগে না থাকলে এসম্পর্ক কবেই ভেঙ্গে যেত।


একবার বলেছিলে ফোনে আমার কথা শুনতে তোমার ভাললাগেনা। খুব আঘাত পেয়েছিলাম মনে।অনেক ছেলেকেই দেখি প্রেমিকার সাথে কথা বলার জন্য বা তার কথা শোনার জন্য খুব আগ্রহী থাকে।অন্যরা বলে আমি সুন্দর করে কথা বলতে পারি।তোমার সাথে তো আমার নেকু নেকু ধরনের প্রেমের আলোচনা হতো না।তাতেও তোমার এত বিরক্তি? তোমার যখন কথা বলার জোয়ার আসতো তখন তো আমি ধৈর্য্য ধরে শুনতাম।এত অপছন্দই যদি ছিল তবে কেন ধরে রেখেছিলে আমাকে?ধরে রাখার জন্য এমন কাজ নেই যে তুমি করোনি।শুধু নিজের আচরন শুধরানো ছাড়া।যদি কিছুতেই মানতে না চাইতাম তবে বার বার বাচ্চার মা বলে ডাকতে।এই ডাকটাতে খুব দূর্বল হয়ে পড়তাম।

তুমি যখন সরি বলতে তখনো মনে হতো তা শুধু নিছক রাগ ভাঙ্গানোর জন্য বলছ মন থেকে বলছ না।আসলে তুমি আমার রাগও ভাঙ্গাতে না।ফোন দিয়ে এমন করে কথা বলতে যেন কিছুই হয়নি।এই যে এতগুলো ঘটনা।কোনোকিছুর জন্যই তুমি ক্ষমা প্রার্থনা করোনি।যদি করতে আমি ক্ষমা করতাম এবং ভুলে যেতাম।



সবকিছুর পরও তোমাকে উদ্ভট ভেবেছি,মাথা খারাপ ভেবেছি কিন্ত মিথ্যাবাদী ভাবিনি।বিশ্বাস করতাম তোমাকে।যে মানুষ প্রেমিকার কোন জিনিসটা ভাল লাগেনা সেটা সত্যি সত্যি মুখের উপর বলে দিতে পারে সে মিথ্যাচার করবে এটা কি ভাবা যায়?তুমিই বল তুষার তোমার বাবার চাকরি নিয়ে কি তোমার এতটাই হীনমন্যতা যে প্রেম করার জন্য মিথ্যা বলতে হলো?।তোমার কথায় আর পোশাকে অনেককিছুতেই আমার মনে হতো তুমি যতটা বলেছ ততটা স্টাব্লিশ ফ্যামিলি তোমাদের নয়।এজন্য বারবার নানা ভাবে জিজ্ঞাসা করতাম।প্রতিবারই তুমি মিথ্যা বলতে।সেইদিনও জিজ্ঞাসা করলাম।তুমি সত্যিটা বললে, তবে বললে তিন বছর পর!তোমার আগের কথা আর বাস্তবতার সত্যিকারের ব্যবধান এতটা হবে তা অবশ্য আমি ভাবিনি।

তুমি জানতে আমার পরিবারের কথা।আমরা কি চাই তাও জানতে।আমি কতটা সংগ্রাম করেছি সেটাও জানতে।তবে কেন এতবড় প্রতারণা আমার সাথে করলে?

তোমার বাবা যদি ভিক্ষাও করতেন তবুও তার পরিচয় দিতে তোমার দ্বিধা করার কথা নয়।কারন তুমি তার অন্নে প্রতিপালিত।যার মধ্যে নিজের পরিচয় নিয়ে এত হীন্যমন্যতা সে জীবনে কতদূর যেতে পারবে?এমন অসৎ লোককে ভালোবাসা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।এই অপরাধের জন্য তোমায় আমি কোনোদিন ক্ষমা করবো না।

ইতি
আমি





চলবে--

সর্বশেষ এডিট : ১২ ই সেপ্টেম্বর, ২০২০ রাত ৮:৪৩
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×