somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পহেলি ঝাঁকি ও তারপর : ভারতের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির সিকি শতাব্দী

১৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৭ রাত ১:১৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১৯৯২ সালের ৬ডিসেম্বর ভারতের ধর্ম নিরপেক্ষতার চরিত্র সম্পর্কে এক মৌলিক প্রশ্ন উঠে পড়ে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের মধ্য দিয়ে। মসজিদ ধ্বংসের সঙ্গেই স্লোগান উঠেছিল “ইয়ে তো পহেলি ঝাঁকি হ্যয়/ অব তো কাশী মথুরা বাকী হ্যয়”। এরপর দ্রুত গতিতে বদলাতে থাকে ভারতের রাজনীতি। একদিকে নব্য উদারবাদ, অন্যদিকে আগ্রাসী হিন্দুত্ববাদ এর দাপট বাড়তে থাকে এবং ভারতীয় রাজনীতির দক্ষিণমুখী অভিযাত্রা প্রবলভাবে এগোতে থাকে। মোদি যোগীদের জমানায় সেই গতি এখন ভয়ংকর এবং ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রের সৌধগুলিকে সে একের পর এক আক্রমণ করেই যাচ্ছে।

ইতিহাসের দিকে নজর

বাবরি মসজিদ তৈরি হয়েছিল প্রথম মুঘল সম্রাট বাবরের নির্দেশে, ১৫২৭ সালে। উত্তরপ্রদেশের অযোধ্যার রামকোট পাহাড়ের ওপর তৈরি এই মসজিদকে ১৯৪০ সালের আগে পর্যন্ত বলা হত ‘মসজিদ ই জনমস্থান’। একে ঘিরে বিতর্ক দীর্ঘদিন ধরেই দানা বাঁধে। অনেকে মনে করেন এখানে একটি মন্দির ছিল এবং সেই মন্দির ভেঙে বাবরের নিযুক্ত অযোধ্যার প্রশাসক মীর বাকী এই মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। বাবরের আত্মজীবনী বাবরনামাতে এই ঘটনার কোনও উল্লেখ নেই তবে বাবরের সমকালীন সময়ের ঐতিহাসিক নথি ‘তারিখ ই বাবরি’তে বলা হয়েছে বাবরের সেনারা চান্দেরীতে অনেক হিন্দু মন্দির ধ্বংস করে। অন্যদিকে ঐতিহাসিক ও পুরাতত্ত্ববিদদের অনেকেই সেখানে কোনও মন্দির ভাঙার প্রমাণ নেই বলে মত প্রকাশ করেছেন। আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া উত্তরপ্রদেশের এলহাবাদ হাইকোর্ট এর লক্ষনৌ বেঞ্চ এর নির্দেশে বাবড়ি মসজিদ এলাকায় একটি সমীক্ষা চালায়। তারা দশম শতাব্দী নাগাদ তৈরি এক হিন্দু মন্দিরের অস্তিত্বের সম্ভাবনার কথা তাদের রিপোর্টে বলে। এর আগে আর্কিওলজিকাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার পক্ষ থেকে ১৯৭৫-৭৬ সাল নাগাদ করা বি বি লাল এর নেতৃত্বাধীন পুরাতাত্ত্বিক সমীক্ষার রিপোর্টেও এরকম মত প্রকাশ করা হয়েছিল।

বাবরি মসজিদকে ঘিরে স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই কিছু উত্তেজনা তৈরি হয়। ১৯৪৯ সালের ২৩ ডিসেম্বর এই মসজিদে রাতের অন্ধকারে রেখে দেওয়া হয় রামলালার মূর্তি। প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহরু এই ঘটনাকে এক বিপদজনক সঙ্কেত বলেই মনে করেছিলেন এবং উত্তরপ্রদেশের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী গোবিন্দবল্লভ পন্থকে বলেছিলেন ওই মূর্তি ওখান থেকে সরিয়ে নিতে। ফৈজাবাদের ডেপুটি কমিশনার কে কে নায়ার অবশ্য এই কাজ করতে সম্মত হন নি এবং মূর্তিটি সেখানেই থেকে যায়। একজন পুরোহিত সেখানে বছরে একবার পুজোর অনুমতি পান। রাজীব গান্ধী তাঁর প্রধানমন্ত্রীত্বকালে এই স্থিতাবস্থায় প্রথম পরিবর্তন আনেন। তিনি রাম জন্মভূমি বাবরি মসজিদের তালা খুলে সেখানে হিন্দুদের সর্বজনীন পুজোর অধিকার দেন। এই ঘটনার এক মাস আগে শাহ বানু মামলায় তিনি আদালতের রায়কে বিশেষ আইন বলে উলটে দিয়ে মুসলিম শরিয়ত এর নির্দেশ চালু করেছিলেন। এ নিয়ে দেশ জোড়া আলোড়ন তৈরি হয়। রাম জন্মভূমি বাবরি মসজিদ এর বিতর্কিত সৌধের তালা খুলে হিন্দুদের পুজোর অধিকার দিয়ে তিনি এর ক্ষতিপূরণ করতে চাইলেন এবং স্থিতাবস্থা ভেঙে বিতর্কের নতুন অধ্যায়ের জন্ম দিলেন।

বিশ্ব হিন্দু পরিষদ এর তালা খোলার দাবি সংক্রান্ত আন্দোলন এই ঘটনার প্রেক্ষিতে নতুন উচ্চতায় পৌঁছল। তারা এবার দাবি করল নতুন মন্দির নির্মাণের। করসেবকদের আন্দোলন শুরু হল। ১৯৮৯ এর নির্বাচনে রাম মন্দির আন্দোলনের আবেগকে কাজে লাগিয়ে বিজেপি ব্যাপক সাফল্য পেল এবং ১৯৯২ সালে আদবাণী অযোধ্যায় রাম মন্দির নির্মাণের লক্ষ্যে গুজরাট থেকে শুরু করলেন তার রথযাত্রা। ডিসেম্বর মাসে লক্ষাধিক করসেবক জড়ো হলেন অযোধ্যায় এবং ৬ ডিসেম্বর প্রকাশ্য দিবালোকে ভেঙে দেওয়া হল বাবরি মসজিদ।

এখনো মিলল না বিচার

এই ধ্বংসকাণ্ডের কয়েকটি নির্দিষ্ট দিককে খতিয়ে দেখার জন্য তৈরি করা হয় লিবারহান কমিশন। এর মধ্যে ছিল –

১) ধ্বংসের ঘটনা পরাম্পরাকে খতিয়ে দেখা
২) এই ঘটনায় উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী, অন্যান্য মন্ত্রীবর্গ, উত্তর প্রদেশ সরকারের কর্তাব্যক্তি এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থার কর্তাদের এই ঘটনার পেছনে দায় দায়িত্ব
৩) উত্তরপ্রদেশ সরকারের তরফে নিরাপত্তা ব্যবস্থায় কোনও খামতি ছিল কীনা
৪) সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনাগুলি
৫) সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয়।

কমিশন সতেরো বছর পর যে রিপোর্ট পেশ করে তাতে আটষট্টি জনকে এই ঘটনার জন্য বিভিন্ন মাত্রায় দায়ী করা হয়। বাবরি ধ্বংস কর সেবকদের স্বতঃস্ফূর্ত আবেগের বহিঃপ্রকাশ – বিজেপির করে আসা এই ধারাবাহিক দাবিকে উড়িয়ে দিয়ে কমিশন বলে এটি ধ্বংসলীলা ছিল এক সুপরিকল্পিত চক্রান্ত। এই ঘটনায় বিজেপির সর্বোচ্চ পর্যায়ের নেতৃত্বের দায়ের কথা কমিশন বলে, যার মধ্যে ছিলেন এল কে আদবাণী, অটল বিহারী বাজপেয়ী, মুরলী মনহোর যোশী এবং বিশেষ করে উত্তর প্রদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী কল্যাণ সিংহ। সঙ্ঘ পরিবার এর বিভিন্ন শাখা, বিশেষত তার মুখ্য সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘ ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদকে এই ধ্বংসকাণ্ডের জন্য প্রধানভাবে দায়ী করা হয়।

কমিশন উত্তর প্রদেশের তৎকালীন বিজেপি সরকারের মুখ্যমন্ত্রী কল্যাণ সিংকে কড়া ভাষায় অভিযুক্ত করে। সঙ্ঘ পরিবার যা যা চেয়েছিল কল্যাণ সিং এর সরকার তাই তাই করেছে বলে কমিশন মন্তব্য করে। পরিকল্পিতভাবে সরিয়ে দেওয়া হয় সেই সমস্ত আধিকারিকদের যারা সঙ্ঘের কার্যকলাপে বাধাস্বরূপ ছিলেন। নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে ইচ্ছাকৃতভাবে ঢিলেঢালা করে তোলা হয়। তারা হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্ট এর কাছেও মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেয়। কলরাজ মিশ্র, উমা ভারতী, গোবিন্দাচার্য, শঙ্কর সিং বাঘেলা, বিনয় কাটিয়ার, সাক্ষী মহারাজ প্রমুখ বিজেপি নেতাদেরও কমিশন এই ঘটনার জন্য প্রত্যক্ষভাবে দায়ী করে। কমিশন অবশ্য নরসীমা রাও এর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সরকারকে এই ঘটনার জন্য দায়ী বলে মনে করে নি, যা খানিকটা অবাক করার মতো ব্যাপার।

স্বাধীন ভারতের ইতিহাসের অন্যতম প্রধান কলঙ্কজনক অধ্যায়টি সংঘটনের জন্য যারা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে দোষী তাদের কারোরই শাস্তি হয় নি এই রিপোর্ট প্রকাশের এত বছর পরেও। কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন দ্বিতীয় ইউ পি এ সরকার দোষীদের শাস্তিদানের যথেষ্ট উদ্যোগ নেয় নি। আর কেন্দ্রের বর্তমান বিজেপি সরকার কোনও উদ্যোগ নেওয়া দূরে থাক, দেশ জুড়ে নতুন করে অসহিষ্ণুতার বাতাবরণ তৈরি করে চলেছে। বাবরি ধ্বংসের পঁচিশ বছরটিকে আর এস এস শৌর্য দিবস হিসেবে দেশজুড়ে সাড়ম্বরে পালন করছে।

বহুত্ববাদী যুক্তিবাদী সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতি ক্রমাগত আঘাত

সাম্প্রতিক সময়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সহ বিজেপির একাধিক নেতা মন্ত্রী যে সমস্ত মন্তব্য করেছেন তার কোনটি ভারতের বহুত্ববাদী সংস্কৃতিকে যেমন বিপদগ্রস্থ করেছে, কোনটি আবার বস্তুবাদী বিজ্ঞানসম্মত আধুনিক চিন্তা ও জ্ঞান বিজ্ঞানের মূলে সজোরে কুঠারাঘাত করেছে। যেমন কিছুদিন আগেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেন প্লাস্টিক সার্জারির কৃৎকৌশল প্রাচীন ভারতীয়দের অবশ্যই জানা ছিল। আর জানা যে ছিল তার অকাট্য প্রমাণ হিসেবে তিনি সাক্ষী মানেন পুরাণ কাহিনিকে, যেখানে রয়েছে গণেশের মাথা কাটা যাবার পর সেখানে হাতির মাথা বসানোর প্রসঙ্গ। প্রায় একই রকম হাস্যকর অথচ ভয়ংকর বার্তা এল ভারতের ইতিহাস পঠন পাঠনে যাকে কর্তাব্যক্তির পদে বসানো হয়েছে সেই দীননাথ বাত্রার এক কীর্তিতে। গুজরাটে ছাত্রছাত্রীদের জন্য অবশ্যপাঠ্য ‘তেজোময় ভারত’ নামক একটি বই তিনি লিখেছেন। এই ‘তেজোময় ভারতে’র ছত্রে ছত্রে বিস্তর মণিমাণিক্য ছড়ানো আছে। সেগুলির মধ্য দিয়ে শ্রীবাত্রার প্রতিপাদ্য: আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বহু জ্ঞান এবং উদ্ভাবনই প্রাচীন ভারতে— দুই সহস্রাব্দ বা তারও বেশি আগে— জানা ছিল। তিনটি নজির। এক, ঋগ্বেদে ‘অনশ্ব রথ’-এর উল্লেখ আছে, এতদ্দ্বারা প্রমাণিত হল যে, বৈদিক যুগে ভারতে মোটরগাড়ি ছিল। হক কথা; যে রথ অশ্বে টানে না, মোটরগাড়ি ছাড়া তা আর কী বা হতে পারে? সে গাড়ির কী ব্র্যান্ড, কোন মডেল, সে কথা অবশ্য ইতিহাসস্রষ্টা বলেননি, অ্যাম্বাসাডরই হবে মনে হয়। দুই, গান্ধারীর গর্ভজাত মাংসপিণ্ড থেকে দুর্যোধনাদি একশো সন্তানের জন্মের বৃত্তান্ত তো জানি, কিন্তু কখনও ভেবেছি কি যে, এই কাহিনি প্রমাণ করে, দু’হাজার বছর আগে ভারতে স্টেম সেল রিসার্চ কোন শিখরে পৌঁছেছিল? তিন, টেলিভিশন আবিষ্কৃত হয়েছে বিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে নয়, মহাভারতের যুগে, না হলে ধৃতরাষ্ট্র হস্তিনাপুরীতে বসে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের ধারাবিবরণী শুনলেন কী করে? ‘সঞ্জয় উবাচ’ মানেই হল গিয়ে লাইভ টেলিকাস্ট।

চিকিৎসাবিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জগতে প্রধানমন্ত্রী ও ‘ইতিহাসবিদ’ এর পদাঙ্ক অনুসরণ করেই বিবর্তন বিজ্ঞানে তার নিজস্ব অবদান রাখতে এগিয়ে এলেন কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী সাধ্বী নিরঞ্জন জ্যোতি। তার বয়ান অনুসারে সমস্ত ভারতীয়রাই হল রামজাদা। এক্ষেত্রে অবশ্য তিনি ধর্মীয় পার্থক্য করেন নি। মুসলিম ও খ্রীষ্টানরাও যে রামজাদা তা নিশ্চিত করে বলেছেন। তবে যারা এটা মানবে না, তার মতে তারা অতি অবশ্যই ‘হারামজাদা’।

তবে এইসব জ্ঞানগম্যি বিতরণের থেকেও অনেক বেশি আলোড়ন তৈরি হয়েছিল বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের তরফে একটি সরকারী সিদ্ধান্তের ভাবনা সামনে আসার পর। সুষমা জানিয়েছেন গীতাকে জাতীয় গ্রন্থের মর্যাদা দেওয়ার কথা হচ্ছে। যেদিন নরেন্দ্র মোদী ওবামাকে গীতা উপহার দিয়েছেন সেদিন থেকেই নাকি প্রকারান্তরে গীতা এই ‘মর্যাদা’ পেয়ে গেছে, এখন আনুষ্ঠানিক ঘোষণাটুকুই যা বাকী। পরবর্তীকালে এই নিয়ে সরকার আর বেশি না এগোলেও এসে গেছে তাজমহল বিতর্ক। বলা হচ্ছে বাবরি মসজিদের মতো তাজমহলের জগৎ বিখ্যাত স্থাপত্যটির ওখানেও আসলে হিন্দু মন্দিরই ছিল, পরে তার জায়গাতেই নাকি তাজ নির্মিত হয়েছে। এই উন্মত্ততার জোয়ারে উত্তরপ্রদেশের যোগী সরকার তাজকে বাদ দিয়ে দিয়েছিল রাজ্যের পর্যটন কেন্দ্রের তালিকা থেকেই।

স্বৈরতন্ত্রের অশ্বক্ষুরধ্বনি

দেশের নানা গোষ্ঠীর ওপর লাগাতার হামলা নামিয়ে আনার অজস্র ঘটনা আমরা এই সময়ে পরপর প্রত্যক্ষ করেছি। মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই গো রক্ষার নামে সংখ্যালঘুদের ওপর দেশের নানা প্রান্তে শুরু হয় সংগঠিত হামলা। উত্তরপ্রদেশে আখলাক হত্যার মধ্যে দিয়ে শুরু হয় এটা। তারপর একের পর এক ঘটনা ঘটতে থাকে। রাস্তায়, পাড়ায়, ট্রেনের কামরায় অতর্কিত হামলায় খুন করা হতে থাকে মুসলিম যুবক এমনকী কিশোরদের। হামলা নামে দলিতদের ওপরেও। খুন করা হয় পানসারে, কালবুর্গি বা গৌরী লঙ্কেশের মত যুক্তিবাদী লেখক সাংবাদিকদেরও।

কাশ্মীরের রাজনৈতিক সমাধানের পরিবর্তে অস্ত্রের ঝনঝনানিকেই একমাত্র রাস্তা বলে মোদি সরকার প্রথম থেকেই স্থির করে নেয় এবং গোটা উপত্যকাকে এক যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করে রাখে মাসের পর মাস। গোটা কাশ্মীর উপত্যকাকেই শুধু এই সরকার যুদ্ধক্ষেত্র বানিয়ে তোলে নি, কাশ্মীরের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন – এই অভিযোগে গণতান্ত্রিক সমাজ, বিশেষ করে প্রগতিশীল ছাত্রসমাজকে নির্দিষ্টভাবে লক্ষ্যবস্তু বানানো হয়েছে।

বিশেষ করে মহিলারা এই সরকারের আগ্রাসী সামন্তি মানসিকতার দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন। একদিকে তাৎক্ষণিক তিন তালাকের নামে মুসলিম মেয়েদের মুক্ত করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হচ্ছে, তারই উল্টোদিকে দেশের সবচেয়ে বড় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর পদে বসানো হচ্ছে এমন একজনকে যিনি মুসলিম মহিলাদের কবর থেকে তুলে ধর্ষণ করার নিদান দেন। নারীদের ওপর পুরুষতান্ত্রিক নানা বিধিনিষেধ চাপানো, লাভ জেহাদের তকমা দিয়ে পছন্দের সঙ্গী বাছার ওপর বিধিনিষেধ যেমন থাকছে, তেমনি থাকছে জহরব্রতর মতো প্রথাকে মহিমান্বিত করা ও পদ্মাবতী সিনেমা নিয়ে শোরগোল পাকানো।

দেশের সমস্ত প্রতিষ্ঠানের গণতান্ত্রিক অধিকার ও স্বায়ত্তশাসনের ওপর বুলডোজার চালিয়ে এই সরকার একরঙা এক দেশ গড়ে তুলতে বদ্ধপরিকর হয়ে উঠেছে। উই অর আওয়ার নেশনহুড ডিফাইনড বইতে দ্বিতীয় সঙ্ঘচালক গোলওয়ালকর যে একঢালা ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুরাষ্ট্র গঠনের নির্দেশিকা তুলে ধরেছিলেন, তাকেই প্রয়োগ করতে উঠে পড়ে লেগেছে আর এস এস ও বিজেপি সরকার। আমাদের মনে পড়বে ভারতের অহিন্দুদের জন্য গোলওয়ালকর রেখেছিলেন তার স্পষ্ট নিদান। ‘সমস্ত অহিন্দুদের অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে হিন্দু সংস্কৃতি ও ভাষা, হিন্দু ধর্মকে শ্রদ্ধা করতে শিখতে হবে, হিন্দু জাতিরাষ্ট্রের জন্যই কেবল গৌরব করতে হবে, অন্য কোনও কিছুর (অর্থাৎ অন্য কোনও পুণ্যভূমির) জন্য নয়। এই দেশ এবং তার দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য সংস্কারগুলিকে অশ্রদ্ধা করা চলবে না বরং একে ভালোবাসতে হবে, শ্রদ্ধা করতে হবে। এককথায় হয় তাদের দেশ ছাড়তে হবে অথবা কোনও দাবি না রেখে হিন্দুজাতির অনুগত হয়ে থাকতে হবে। কোনও বিশেষ সুযোগ সুবিধা পাওয়া দূরে থাক, তাদের এমনকী নাগরিক অধিকারও থাকবে না’। ( উক্ত গ্রন্থ পৃ – ২৭)

হিন্দুত্বের সাংগঠনিক নেটওয়ার্ক

বাবরি ধ্বংসের মধ্যে দিয়ে যে পহেলি ঝাঁকির স্লোগান উচ্চারিত হয়েছিল, আর বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছিল এরকম আরো অনেক ধাক্কা আসতে চলেছে, তার কিছু কিছু আমরা গত পঁচিশ বছরে এর মধ্যেই প্রত্যক্ষ করেছি। অবশ্যই আরো নতুন নতুন আঘাতের মধ্যে দিয়ে দেশটাকে নিজের মতো করে গড়ে পিটে নিতে চাইবে তারা। পুরদস্তুর এক হিন্দুরাষ্ট্র গড়ে তোলার জন্য সে ইতোমধ্যেই তৈরি করে ফেলেছে এক বিশাল সাংগঠনিক নেটওয়ার্ক। আর এস এস সর্বব্যাপী প্রভাব বিস্তারের জন্য বিভিন্ন মাত্রার সচলতা সম্পন্ন অনেকগুলি সংগঠন সমৃদ্ধ একটি বৃহৎ সঙ্ঘপরিবারের সে জন্ম দেয়। সঙ্ঘ পরিবারের অংশ বা প্রত্যক্ষ প্রভাবাধীন এমন সংগঠন এর তালিকাটি বিরাট এবং আগ্রহোদ্দীপক। শিক্ষার ক্ষেত্রে আর এস এস এর নিয়ন্ত্রণাধীন বিদ্যাভারতী বেসরকারি শিক্ষাক্ষেত্রে অন্যতম বৃহৎ শিক্ষা বিষয়ক সংগঠন। ১৩,০০০ শাখা, ৭৫,০০০ জন শিক্ষক ও ১৭ লক্ষ বিদ্যার্থীর এই বিশাল কর্মকাণ্ডর মাধ্যমে আর এস এস তার প্রভাবকে ভালোভাবেই ছড়াতে সক্ষম হয়। উপজাতিদের নিয়ে রয়েছে আর এস এস এর বনবাসী কল্যাণ আশ্রম, সাহিত্য সম্পর্কিত ভারতীয় সাহিত্য পরিষদ, বুদ্ধিজীবীদের সংগঠিত করার জন্য প্রজ্ঞা ভারতী আর দীনদয়াল গবেষণা কেন্দ্র, ইতিহাস সম্পর্কিত ভারতীয় ইতিহাস সংকলন যোজনা, শিক্ষকদের নিয়ে ভারতীয় শিক্ষক মণ্ডল আর অখিল ভারতীয় রাষ্ট্রীয় শৈক্ষিক মহাসঙ্ঘ, ভাষা বিষয়ে সংস্কৃতি ভারতী, সংস্কৃতি বিষয়ে সংস্কার ভারতী, বস্তি সম্পর্কিত ক্ষেত্রে সেবা ভারতী, হিন্দু সেবা প্রতিষ্ঠান, চিকিৎসা ক্ষেত্রে স্বামী বিবেকানন্দ মেডিক্যাল মিশন, ন্যাশানাল মেডিকোস, সমবায় সম্পর্কিত সমবায় ভারতী, গ্রাহকদের সংগঠন অখিল ভারতীয় গ্রাহক পঞ্চায়েত, মিডিয়া সংক্রান্ত ভারত প্রকাশন, সুরুচি প্রকাশন, জ্ঞানগঙ্গা প্রকাশন, লোকহিত প্রকাশন ইত্যাদি সহ আরো বেশ কিছু, বিজ্ঞান বিষয়ক বিজ্ঞান ভারতী, ধর্ম ও ধর্মান্তরীতকরণের জন্য বিবেকানন্দ কেন্দ্র, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, হিন্দু জাগরণ মঞ্চ, শিল্পপতিদের জন্য ভারত বিকাশ পরিষদ, যুবদের জন্য বজরং দল, ছাত্রদের জন্য অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ, অনাবাসী ভারতীয়দের জন্য ভারতীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ, ফ্রেন্ডস অব সোসাইটি ইন্টারন্যাশানাল, ট্রেড ইউনিয়ন ক্ষেত্রে ভারতীয় মজদুর সঙ্ঘ (বি এম এস), মহিলাদের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় সেবিকা সমিতি, অর্থনীতি ক্ষেত্রে স্বদেশি জাগরণ মঞ্চ।

পহেলি ঝাঁকির পঁচিশ বছর পর সে আরো শক্তিশালী হয়েছে। অর্থনৈতিক দক্ষিণপন্থা, সামাজিক দক্ষিণপন্থা ও রাজনৈতিক দক্ষিণপন্থাকে নজিরবিহীনভাবে সংহত করে দেশের কোণে কোণে ছড়িয়ে দিতে সমর্থ হয়েছে। নিজস্ব নেটওয়ার্ক ও রাষ্ট্রশক্তির যুগল সম্মিলনে সে গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে দাঁড়িয়েই তাকে ভেতর থেকে ধ্বংস করে দেওয়ার দিকে এগোচ্ছে আর তার কর্মীরা নির্দিষ্ট লক্ষ্যে কাজ করতে করতে আউড়ে যাচ্ছে এই স্লোগান – “এক ধাক্কা ঔর দো ...”।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৭ রাত ১:১৭
৪টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×