তাঁর কথা তাঁহাদের কথা ( ১ম পর্ব )
-----------------------------------------------
তাঁর সাথে আমার প্রথম দেখা অফিসের এলেভেটর থেকে বের হয়ে আসার সময়। দেখা হয়েছিল ঠিক সেটা বলা যায় না ।
সকালে অফিস আওয়ারে আমি অফিস ভবনের এলেভেটর থেকে বের হয়ে এসেছি । আর সে কালো কোটের সাইড পকেটের ভেতর দুই হাত ঢুকিয়ে ভাবলেশহীন মুখে দাঁড়িয়ে ছিল এলেভেটরে উঠার জন্য।
প্রথম দেখাতে তাঁকে খুব সাধারন বলেই মনে হয়েছিল।
সেদিন অফিসে ছিল আমার প্রথম দিন । তাই বেশ উত্তেজনা আর কিছুটা তাড়াহুড়াও ছিল আমার ভেতর ।
পনের তলা অফিস ভবনের দশ তলার এলেভেটর থেকে বের হওয়ার সময় তার সাথে শুধু চোখাচোখি হয়েছিল ওই সময়ে। সে অফিসেরই একটি কাজে বাইরে যাওয়ার জন্য নীচে নামার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ।
সে ছিলো নির্বিকার। প্রথম দেখায় আমার চোখে তাঁর কোন বিশেষত্ব ধরা পড়েনি।
নিউ জার্সির চেরিহিলের বানিজ্যিক এলাকায় অবস্থিত একটি গ্রুপ অব কোম্পানির আইটি সেক্টরে আমি এসিস্ট্যান্ট কিউ এ এনালিস্ট হিসেবে জয়েন করেছিলাম । সে ছিলো ঐ অফিসের কিউ এ এনালিস্ট।
বলা যায়, অফিসে সে অনেকটা আমার বস ছিলো । তাঁর কাছে আমার কাজগুলো জমা দিতে হতো । তবে কাজের শিডিউল বুঝে নিতে হতো না। ম্যানেজার আমাকে সব বুঝিয়ে দিতেন।
লাঞ্চের পর সকাল থেকে যতগুলো মডিউল টেস্ট করেছি সেগুলো একিউরেট হয়েছে কিনা তা চেক করার জন্য ম্যানেজারের কাছ থেকে মেইল পেলাম “অল টেস্ট মডিউল সেন্ড টু রিদোয়ান আহমেদ"। পাশে রিদওয়ান আহমেদের ইমেইল এডরেস।
ম্যানেজারের কথামত "রিদোয়ান আহমেদ" কে সব রিপোর্ট পাঠিয়ে পরের মডিউল টেস্টের জন্য মনযোগ দিয়েছি। প্রায় ঘন্টা খানেক পর রকিং চেয়ারের শব্দে ঘাড় ঘুরাতেই সকালের সেই চেনা মুখ ভরাট পৌরুষদীপ্ত কন্ঠে বলে উঠলো
“ প্রথম দিনেই খুব ভালো করেছেন— কংগ্রাস “
যেভাবে চেয়ার ঘুরিয়েছিলো সেভাবেই রকিং চেয়ারটা ঠেলে সোজা করে আবার নিজের কাজে মন দিলো।
ব্যাপারটা এতো তড়িৎ ঘটে গেলো যে আমার বোধগম্য হতে কিছুটা সময় নিলো। তাঁর পারফিউমের ঝাঁঝাল সুবাসে আচ্ছন্ন হয়ে কিছুক্ষণ তার দিকে চেয়ে রইলাম। এবার বেশ অবাক হলাম। সকালে এলেভেটর থেকে বের হয়ে প্রথমে তার সাথেই তো দেখা হয়েছিলো!
ঘুণাক্ষরেও তখন বুঝতে পারিনি যে দিনের ৮ ঘন্টা সময় তার সাথে পাশাপাশি চেয়ারে পার করবো।
তার ভরাট গলার ব্যাক্তিতসম্পন্ন কন্ঠ আমাকে আচ্ছন্ন করে দিলো। হয়ত আমার তাকিয়ে থাকাটা চোখে পড়ার মতন ছিল।
সে নিজের কম্পিউটার স্ক্রিনের দিকে চেয়ে কিবোর্ড চাপতে চাপতে বললো
“ এতো দেখলে আমি কমে যাবো, কাজে মনযোগ দেও। পরে কথা হবে”।
নিজের আচরণে লজ্জিত আমি শুধু বললাম “হুম”।
আগামী দুই সপ্তাহের বিভিন্ন কাজের সূচি ঠিক করতেই কখন বিকাল পাঁচটা বেজে গেলো টের পাইনি । ইনবক্সে ম্যানেজারের মেইল দেখতে পেয়ে চেক করি “ সাট ডাউন কম্পিউটার , গো হোম , টেক রেস্ট, কাম ব্যাক টুমরো মরনিং"।
"ওকে”---রিপ্লাই দিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকে খুঁজি মানে রিদওয়ানকে।
কি আজব মানুষ! কিছু না বলেই বের হয়ে গেলো! কেমন একটা শুন্যতা ঘিরে ধরলো যেন । মন থেকে “ রিদওয়ান” নামটি ঝেড়ে ফেলার জন্য কাঁধ ঝাঁকিয়ে নিজেকে বলি "চলে গেলেই বা আমার কি”! কাঁধ ঝাঁকিয়ে তাকে ঝেড়েই ফেলে দিলাম বলা যায়। তবে ভাগ্য যখন নির্ধারিত হয়ে যায় তখন আমাদের হিসেবের ভেতর কিছুই থাকেনা । অথবা আমাদের নিয়ন্ত্রণ থাকেনা।
পরের দিন অফিসে আমার জন্য নির্ধারিত চেয়ারে বসতে যেয়ে তার দিকে চোখ যায়। আকাশী রংয়ের শার্ট গায়ে তার নিজের চেয়ারে বসে কমপিউটারের দিকে ঝুঁকে আছে। আমার চেয়ার টানার শব্দ পেয়ে ঠায় বসে বাংলায় বললো “সুপ্রভাত “
আমি উত্তরে বললাম "গুড মরনিং"।
আসলে আমেরিকায় আমরা গুড মরনিং বলাতেই অভ্যস্ত হয়ে যাই। সে যে সুপ্রভাত বলেছে এ ব্যাপারটা আমি খেয়াল করিনি মোটেও। চেয়ারটা কিছুটা পেছন দিকে ঠেলে শুস্ক আবার কিছুটা রুক্ষ ও গম্ভীর গলায় বলে উঠলো —
"আমি বাংলাতে বলেছিলাম, উত্তর বাংলাতেই আশা করেছিলাম"।
মাথা ভর্তি কাঁচা পাকা চুল চোখে প্লাস পাওয়ারের চশমার আড়ালে ভীষণ আবেগীয় দুটি চোখের কালো তারায় কি দুর্নিবার আকর্ষণ আমার ভেতরটা কাঁপিয়ে দিলো যেন। আমি তাকে কিছুই বুঝতে না দিয়ে “ সুপ্রভাত “ বলে নিজের কাজে মনযোগী হয়ে উঠলাম।
আজকে অফিসের দ্বিতিয় দিনে মডিউল টেস্টের লিস্ট বেশ দীর্ঘ ছিলো। কখন যে লাঞ্চ টাইম হয়ে গেছে বুঝতে পারিনি। সে নিজের চেয়ার ছেড়ে এসে আমার পাশে দাঁড়িয়ে বলে উঠলো —
"খাওয়ার সময় খেতে হয়ে। চলো আজ তোমাকে পিওর বাংলাদেশি খাবার খাওয়াবো।"
উইকডেতে ঘরে রান্না করা হয়ে উঠে না। তাছাড়া কোন কোন শনি রবিবার ঘরের অন্যান্য কাজে ক্লান্ত হয়ে পিজা অর্ডার করেই খাওয়া শেষ করি। তবে কখনো উইক এন্ডে বাংলাদেশি খাবার রান্না করতে পারি। আয়েশ করে বাংলাদেশী খাবার রান্না করার সময় বিদেশে আসার পর খুব কমই জোটে। তাই তার কথায় আমার জিভ লকলক করে উঠলো।
চেরি হিলের এই এলাকাটি ছিমছাম নিরিবিলি। এ এলাকায় বাংলাদেশী, ইনডিয়ান , পাকিস্তানি দেখা যায়। তবে সংখ্যায় খুব কম।
বেশ কিছু সুপার চেইন শপ আর ব্র্যান্ড নেম কোমপানির স্টোর নিয়ে বড় একটা শপিং মল আছে এখানে। তার পাশেই সাদামাটা একতলা একটা বিল্ডিংয়ের সামনের অংশ মোটা কাচের ওয়াল দিয়ে ঘেরা বাহারী ডিজাইনে লেখা ইন্ডিয়ান কুজিন । তবে রেস্টুরেন্টের মালিক বাংলাদেশি । কাঁচের ভারি দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করতেই সুস্বাদু মুখরোচক বাংলাদেশী খাবারের গন্ধে ভীষণ ক্ষিধে পেয়ে গেলো।
মুখোমুখি চেয়ারে আমরা দুজন বসলাম। ততক্ষণে বেয়ারা সালাড আর রায়তা দিয়ে গেছে সাথে পাঁপড়। এতোটুকু খাবার দেখেই ক্ষুধায় পেট জ্বলতে লাগলো। আমি গোগ্রাসে সালাড আর পাঁপড় খেতে লাগলাম। আমার খাওয়ার ধরন দেখে রিদয়ান হেসে উঠে । গভীর মমতায় জানতে চায়— সকালে নাস্তা ঠিকমত করোনি না?
মুড়মুড়ে পাঁপড় কুড়কুড়িয়ে ভাংতে ভাংতে বলি --- "এক স্লাইস টোসট আর কফি"
"পাগলী এতো অল্প খেলে চলে! দুধ ডিম খাবে রোজ। এ দেশে অনেক কাজ করতে হয় । ঠিকমত না খেলে শরীর খারাপ করবে। ঘরে দেখার মত কেউ কি আছে"? —
কি অবলিলায় সে পাগলী কথাটা বলে দিলো কিন্তু শুনতে আমার কেনো যেন ভীষণ ভালো লাগলো।
পরেরদিন অফিসে আমার চেয়ারে বসতে যেয়ে রিদওয়ানের চেয়ারের দিকে চোখ যায় । গত দুইদিন তাকে পাশের চেয়ারে দেখে কেমন অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। আজ তাঁর চেয়ারটা খালি, কম্পিউটারটি বন্ধ দেখে বুকের ভেতর কেমন এক শূন্যতা অনুভব করলাম। এখনো এসে পৌঁছায়নি? নাকি কফির জন্য গিয়েছে? হবে কিছু একটা। আমি আমার কাজে মন দেই।
কাজের ব্যস্ততায় লাঞ্চ টাইম হয়ে যায়। লাঞ্চের পর ম্যানেজারের কাছ থেকে মেইল পাই " অল টেস্ট মডিউল সেন্ড টু জেনিফার উইলিয়াম" --জেনিফারের নাম দেখে অবাক হলাম। তবে কি আজ রিওদয়ান অফিসে আসেনি? সে কি ছুটিতে আছে? শরীর খারাপ ? না অন্য কিছু ? এমন নানা ভাবনায় পেয়ে বসলো ।
ম্যানেজারের কথামত কাজ শেস করে ঘড়িতে দেখি পাঁচটা বাজে। কম্পিউটার বন্ধ করে আমার ডেস্ক থেকে উঠে আসতেই জেনিফারের সাথে দেখা। "হ্যালো রুবাবা" একগাল হাসি নিয়ে হাত বাড়িয়ে দিলো সে হ্যান্ডশেক করার জন্য। গতানুগতিক কাজের কথা হয় জেনিফারের সাথে কিন্তু ওইটুকু সময় রিওদয়ানের জন্য কৌতূহল আটকে রাখতে আমার কষ্ট হচ্ছিল খুব। তাই জানতে চাইলাম "রিওদয়ান কে আজ দেখলাম না - কোথায় কিছু জানো? "
-- " আগামী দুই দিনের জন্য রিওদয়ান বোস্টন অফিসে" কিছুটা ইঙ্গিত পূর্ণ হাসি দিয়ে জানতে চাইল --- "তুমি কি তাকে মিস করছ নাকি"?
আমিও হেসে বললাম -- "না, তেমন কিছুই না। শুধুই জানতে চাওয়া"।
অফিস থেকে ফিরে সন্ধেবেলা শরীরটা বিশেষ সুবিধার মনে হচ্ছিল না। কেমন যেন এক মন খারাপ ঘিরে ধরতে চাইছে। ডিসেম্বর মাসের শুরু, আস্তে আস্তে ঠান্ডা জেঁকে বসছে। অফিস ফেরত এই সময়টা কফি কাপ হাতে , গায়ে ওলের গাঊন চাপিয়ে জানালার পাশে বসে থাকতে বেশ লাগে । নিজের সাথে কথা বলার জন্যও এই সময়টি আমার খুব প্রিয়।
আজ শনিবার। সাপ্তাহিক ছুটির প্রথম দিনে সকালটা কেমন অন্যরকম লাগে! শীতের আমেজে পুরো পাড়া যেন কাথা কম্বলে মুড়ানো ঘুমন্ত এক নগরী। কারো কোন ব্যাস্ততা নেই । স্কুল বাসের সাইরেন নেই । গাড়ীর ছুটে চলার শব্দ নেই । বিছানায় গুটিসুটি কম্বল জড়িয়ে আমি ঘুম জড়ানো চোখে লেগে থাকে অলসতা । অসংখ্য এলোমেলো ভাবনা ।
আমেরিকায় এখন দুপুর ২ টা। ডিসেম্বর মাসে দিনের এই সময়কে বিকাল বলা যায়। এসময়ে সূর্য ডুবে যাবে সাড়ে চারটায়। কোনো এক কারণে আজ ঝকঝকে রোদ উঠেছে। চারিদিক আলোর মায়াবী ছোঁয়া।
গতকালও টিপ টিপ বৃষ্টির সাথে হাল্কা তুষার ঝরেছে। আমি রান্না ঘরে যেয়ে বুঝতে পারলাম ঘরের সাপ্তাহিক গ্রসারি শেষ হয়েছে। আমাকে সুপার মার্কেটে যেতে হবে।
মায়াবী এই রোদে ড্রাইভ করতে যেয়ে আমি স্মৃতি কাতর হয়ে যাই। আজওয়াদের জন্য বুকের ভেতর হুহু করে উঠে। আজওয়াদের বাবার সাথে সেপারেশানের পর থেকে উইকেন্ডগুলো আজওয়াদ তার বাবার সাথে কাটায়। দুটি দিন ছেলেকে দেখতে না পেয়ে আমি খুব অস্বস্তিতে থাকি।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০২২ সকাল ৮:৫৩