চিঠির মত সুন্দর কিছু হয়না।ছেলেবেলা থেকে চিঠি ব্যপারটা নিয়ে অনেক ঘটনা,অনেক স্মৃতি জমা হয়ে আছে।যে বয়স এ ছেলেমেয়েরা বানান করে লিখতে শেখে কেবল,তখন থেকেই আমার ভাইজানের কাছে চিঠি লেখার গুরু দ্বায়িত্বটা আমার কাঁধে পড়েছিলো।ভাইজান তখন ঢাকা মেডিকেল এ পড়তো।
চিঠির বিষয় বেশি কিছুনা।আব্বা ,মা কেমন আছে।আমি কেমন আছি ।পড়া কেমন হচ্ছে।এভাবেই আমার চিঠি লেখার হাতে খড়ি।
এরপর অনেকগুলো বছর ভাইবোনদের কাছে চিঠি লিখতে লিখতে একদিন বড় হলাম আমি।আপু তখন শামসুন্নাহার হলে..একবার একটা চিঠি লিখেছিলাম।অনেকটা এই রকম,"আপু ,সালাম নিও।আশাকরি ভালো আছো।আব্বা ,মা আর আমি ভালো আছি।আমার পড়ালেখা ভালো চলছে।আমাদের গরুর একটা বাছুর হয়েছে।ওর নাম দিয়েছি বল্টু।কারন ওর নাকটা অমন।ভালো থেকো।ইতি সাজি।" আপু আমাকে রাগানোর জন্য সুযোগ পেলে গড়গড় করে এই কথাগুলো বলতো।আমি মাঝে মাঝে পিছনে দৌড়াতাম,কখনো কাঁদতে শুরু করতাম।
একবার ভাইজান বাড়ি আসলো ছুটিতে।আমাকে ডাকলো কাছে।সবার সামনে বললো আমার চিঠির বিবরন।সেটা অনেকটা হলো এইরকম,"ভাইজান ,সালাম নিবেন।আশাকরি ভালো আছেন।আমরা ভালো আছি।আমি এই মাত্র ফুটবল খেলে আসলাম।আমাদের দল ২-০ গোলে জিতেছে।আজ আরনা।আমি খুব ব্যস্ত।ইতি.....এই ব্যস্ত শব্দটা নিয়ে আমাকে ধরা হলো।আমি কেনো এত ব্যষ্ত।আমি যখন ক্লাস ফাইভ এ পড়ি ।মনে হয় সেই সময় একটা চিঠি পেলাম....আমার প্রথম পত্রমিতালী আপু।হীরা আপু।সিলেট থেকে চিঠি লিখতো ।এত সুন্দর সেইসব চিঠি,চিঠির কাগজ ও দারুন থাকতো.।কখনো নীল,কখনো সাদা.......।আমাদের বাসায় যে ডাকপিয়নটা আসতো.।বাসার সামনে এসে সাইকেলের বেল বাজাতো আর নাম ধরে ডাকতো...সাজিমনি চিঠি।বাসায় থাকলে দৌড়ে আসতাম।কখনো আপু,কখনো ভাইজান,কখনো হীরা আপু,কখনো পাশের বাসার বাবুদা।হীরা আপুর কাছ থেকে আমার ঠিকানা নিয়ে একদিন চিঠি লিখলো দাদামনি।এত সুন্দর হাতের লেখা।আমি দাদামনির হাতের লেখা নকল করতাম।অনেকটুকু পেরেছিলাম।
দাদামনির চিঠিতে থাকতো বৌদিমনি আর উনার মামনির কথা............আরো পরে উনাদের ছেলে ময়ূখের কথা।দাদামনি ও সিলেটেই থাকতেন।সিলেট মেডিকেল কলেজে রেডিওথেরাপি বিভাগে কাজ করতেন।উনার নাম ছিলো প্রবীর চৌধুরী।
অনেক বছর পর ,আমি তখনে কলেজে পড়ি।ইডেনের হোষ্টেলে থাকি।ছুটিতে মির্জাপুরের কুমুদিনীতে ভাইজান /ভাবীর বাসায় যাই ।কুমুদিনী হাসপাতালে ভাইজান আর ভাবী কাজ করতো ।
দাদামনি এলেন বেড়াতে।ভাবনা বিলাসী আমি চিরদিনই,আমার লেখায় সবার সর্ম্পকে কি ধারনা করেছিলো কে জানে,সবার সাথে দেখা হয়ে মনে হয় তা পুরোপুরি খুঁজে পাননি।কি যানি কোন সে কারনে উনি ব্যথিত হয়েছিলেন।সেই যে দাদামনি গেলেন আর লেখেননি।আমার খুব মন খারাপ লাগতো।হীরা আপু দাদামনির সাথে আর যোগাযোগ থাকেনি।
যখন আমি যখন হোস্টেল এ থাকতাম.......আমাকে চিঠি লেখার তখন কেউ নেই।ভাই বোনরা সংসার নিয়ে ব্যস্ত।খুব ইচ্ছে হতো আমার ও চিঠি আসুক।কিন্তু আব্বা আর মা ছাড়া কারো চিঠি পাইনি তেমন।ইডেন পুরাতেন হোষ্টেলে আবার চিঠি খোলা হতো।বাবা মার খোলা চিঠি হাতে পেতে আমার খুব খারাপ লাগতো।যে কোন চিঠি হাতে পাবার পর যে আনন্দ আজ অনেকগুলো বছর পরবাসী জীবন কাটিয়েও সেই সব মনে পড়ে।প্রতিদিন মেইল বক্স এ চিঠি আসে.......ক্রেডিট কার্ডের বিল,ফোন আরো কত চিঠি।
ঝাপসা চোখে মা চিঠি লিখতেন আগে।প্রতি সপ্তাহে ২/৩ বার ফোন করা হয় বলে কথাও খুঁজে পাননা লেখার.......ভাইজান প্রথম দিকে লিখতো,ভাবী,বোনরা.এখন আর কেউ লেখেনা।ইমেইল ও না।মাঝে মাঝে কিছু অফ লাইন মেসেজ।
মাত্র কয়টা বছরে পৃথিবী কোথায় এগিয়ে গেলো.......মানুষের অনুভব গুলো সেকেন্ডেই পৌছে যায় অন্যখানে।ভালোবাসা,রাগ ,অনুযোগ এইসব অনুভূতি এখনো আছে...কিন্তু তা এতটাই তাৎক্ষনিক।ভাবনাটা গভীর কিনা বুঝবার আগেই অন্যখানে পৌছে যায়।
কি জানি একেই কি এগুনো বলে?
এখনো ড্রয়ারে জমে থাকা চিঠিগুলো আমাদের অনেক সুন্দর সময়কে এনে দেয়।কখনো কখনো মনে হলে ড্রয়ার খুলে মেঝেতে বসে চিঠিগুলো পড়ে আনন্দ হাসির দোলায় ভাসতে থাকি........
আর অন্যখানে পৃথিবীর কোথাও কোনখানে কোন ছেলে বা মেয়ে তার সারাক্ষনের সংগী ফোনটা হারিয়ে মন খারাপ করে থাকে...ফোনের সাথে হারিয়ে যায় অজস্র মেসেজ।ভালোবাসার ,বিরহের ,বেদনার।
(টাইপ করতে বসেছিলাম "চিঠি :নামে একটা যুগলের কিছু চিঠি ।কি জানি কেন এই এলোমেলো লেখাটা লেখা হয়ে গেলো।একান্ত ব্যক্তিগত কিছু অনুভব চলে এলো।ভাবনা প্রসূত কিছু নয়।এলোমেলোতার জন্য পড়তে ভালো না লাগলে মার্জনা চাইছি আগে ভাগেই)