ক’দিন ধরে একটা অদ্ভুত মেঘ জমে আছে মনের আকাশে । আকাশে কালো মেঘ এলে যেমন বৃষ্টি আসে , ধূলাবালি ধূয়ে মুছে গিয়ে প্রকৃতি নতুন সাজে সাজে । কেটে যায় সব গুমোট । আমিও অপেক্ষায় আছি ঝুম বৃষ্টির । শব্দরা উড়ে উড়ে জুড়ে বসুক ভাবনার রাজ্যে । মালাগাঁথি শব্দদের।
রোজা আসার পর থেকে ইফতারের পর আর কম্পিউটার এর সামনে বসা হয়না । বসলেও লেখালেখি বা পড়া কোনটাই এগোয়না । মাঝে মাঝে শুধু ফেইস বুকে ঢু’ মারি । বিংশশতাব্দীর বিস্ময় হলো এই ইন্টারনেট । মানুষের নিত্যদিনের জীবনে যা জড়িয়ে গেছে অদ্ভুতভাবে । ফেইসবুক একাউন্ট খোলার ক্ষেত্রে আমার বড়ছেলে রাশীক আমার চেয়ে এগিয়ে আছে । ওর কাছেই প্রথম শুনি ফেইসবুকের কথা। কিভাবে পুরাতন বন্ধুদের খুঁজে পাওয়া সম্ভব তাও জানতে পারি । আমাদের ছেলেবেলায় বন্ধু হতে সময় লাগতোনা । স্কুলের ক্লাসে কোন নতুন ছাত্রছাত্রী এলে অল্প সময়ে সখ্যতা হয়ে যেতো । খেলাধুলা,পড়ালেখা এইসব নিয়ে গল্প হতে হতে এগিয়ে যেতো বন্ধুত্ব । একটু বড় হবার পর সেই বন্ধুত্ব হতে সময় লাগতে শুরু করলো । বন্ধু হতে হলে নিজেদের চিন্তাচেতনার,কথাবলার কিছু কমন দিক থাকা চাই । নাহলে বন্ধুত্ব ঠিক সুদুরপ্রসারী হয়না ।হইচই আড্ডার জন্য অবশ্য সিলেক্টিভ হবার কারন থাকেনা । মানুষের জীবনে ছেলেবেলার বন্ধুদের একটা গভীর ছাপ থেকে যায়। সময়ের সাথে সাথে বন্ধু হবার ক্ষেত্রে অনেক বোধ পাল্টেছে । বয়স বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে কোন বিষয়না । কথা বলার স্বাচ্ছন্দ্যটাই আসল।
যাইহোক ফেইসবুকে বসলেই অদ্ভুত একটা রাজ্য মনেহয় । আমার বন্ধুতালিকায় অনেক গুনী মানুষ । লেখালেখির জগত থেকে চেনাজানা । অনেকেই এখানে নতুন লেখালেখি শেয়ার করে । স্মৃতিচারণ করে । নতুন কবিতা,গল্প,বেড়ানোর ছবি আরো কত কি । এখানে খুঁজে পেয়েছি আমার কলেজ জীবনের এক বন্ধুকে । যে লেখালেখি করেনা তেমন। তবে পড়ে । আর প্রোফাইল স্ট্যাটাস এ লিখে রাখে মনের নানান অনুভুতি,যা পড়লে অনায়াসে বুঝি ওর মনের আকাশের খবর । রাশীকের কাছে একদিন জানতে চাইছিলাম ওর কাছে কেমন লাগে এই এক ক্লিকে বন্ধু হওয়া ? ও হেসেছিল, আসলে ,বন্ধুত্ব ব্যাপারটা অনেক বড় । অনেক গভীর সে অনুভব...............সেটা সবার জন্যই একইরকম। প্রিয় বন্ধু নির্বাচনের ক্ষেত্রে সবারই নিজস্বতা থাকে ।
ক’দিন আগে দেখি একটা মেসেজ,”আপনি কি মৈত্রীহলে থাকা সাজি আপু? “, নামটা খুব চেনা লাগে । কথা হয় । মেয়েটা টরন্টোতে থাকে । মনে পড়ে যায় । ওর কাছে জানতে চাই ওর বন্ধুর কথা, যে আমার রুমমেট ছিলো । কত স্মৃতি ভীর করে আসে নিমেষেই । মিলি রহমান । কি দারুণ মিষ্টি চেহারার এক মেয়ে । একদিন ক্লাস থেকে ফিরছি, হলের ডাইনিং বন্ধ হয়ে গেছে অনেক আগে । বিডি আর গেটের কাছের দোকান থেকে টুকটাক খাবার কিনে রুমে ফিরছি । ক্লান্ত লাগছিলো ভীষন । আস্তে আস্তে উঠছিলাম । তিনতলা অনেক উঁচু মনে হচ্ছিল । দোতলা পার হয়ে তিনতলায় উঠার মুখে দেখি কোঁকড়া চুলের একটা মেয়ে বসে কাঁদছে।“কি হয়ছে তোমার?”, জানতে পারি ? নাহ কোন উত্তর নেই । ওর পাশে বসি । পাশ দিয়ে অনেকেই ওঠানামা করছে । আর অবাকচোখে তাকাচ্ছে । আমি খুব আস্তে আস্তে বললাম,”তোমার নাম কি?” নামটা বলার সময় চুল সরালো । কিছুক্ষনের মধ্যে জেনে গেলাম ওর কান্নার কারন।
একটা ক্লিকে বন্ধুত্ব হয়না কে বললো ? যখন হবার তখন এভাবেই হয় ! মানুষের জীবনটাতে এমন কত ম্যাজিক যে ঘটে ! জানলাম,” মিলি সেকেন্ডীয়ারে উঠে গেছে।তখনো হলে সিট পায়নি,এতদিন বোনের বাসায় থাকতো।বোন দুলাভাই অল্প ক’দিন পরই দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে । বাবা মা ঢাকার বাইরে থাকে” । ওকে সাথে করে নিয়ে রুমে আসলাম । হাতমুখ ধুয়ে খেতে খেতে কত গল্প হলো । আগে ভাবতাম আমি বুঝি খুব মিশুক, মানুষের সাথে খুব সহজে মিশে যেতে পারি । ভুল প্রমাণিত হলো । মিলি অল্প কিছুক্ষনের মধ্যেই আমার অন্য রুমমেটের বন্ধু হয়ে গেলো । এবং দুদিনেই আমাদের রুমের প্রিয় ম্যাও হয়ে গেলো ও । সারাক্ষন দুষ্টুমী, খুনসুটি । এখনো চাইলে সেইসব দিন ভাবতে পারি । ফিতাহীন রিলের স্মৃতিরা অনায়াসে ফিরে আসে একের পর এক । ক্লাসের আগে তৈরী হবার সময় মাথায় একটা চিরুণী থাকতো । চোখে কাজল দিতে দিতে একফাঁকে নাচ ও দেখাতো । আরো কত মজার মজার স্মৃতি । ক’দিনেই জেনে গেছিলাম সেই ছোট্ট মিলির ও একটা কাছের মানুষ আছে। দু’জনে একসাথে পড়তো । মাঝে মাঝে ক্যাম্পাসে ওদের সাথে দেখা হতো । আমাকে দেখলেই ছুটে আসতো । নিজের ছোট ভাইবোন ছিলোনা বলে অনেক আহ্লাদ আব্দারের কাছে পরিচিত ছিলাম না । মিলি অল্প ক’দিনে সব আদায় করে নিতে থাকে। যদিও ফাইনাল পরীক্ষার পর হল ছেড়ে দিতে হয় আমার । এর পর মাঝে মাঝে যেতাম দেখা করতে । বিয়ের পর দেশ ছেড়ে চলে আসি । প্রথম কিছুদিন যোগাযোগ থাকলেও আস্তে আস্তে তা ক্ষীন হয়ে যায় । প্রথমবার দেশে যাবার পর কথা হয় । ওরা দুজনে পাশ করে বিয়ে করেছে । চাকরী করছে। জেনে খুব ভালো লাগে।
এরপর অনেকদিন আবার কোন যোগাযোগ থাকেনা । মনে পড়লেই প্রার্থনা করি । ওরা ভাল থাক । সেই মিলিকে ফেইসবুকে দেখে কি আনন্দ যে লাগে । তবে ওর ছবিতে ওর চেহারায় কোথায় যেনো মেঘ । “তোর মেয়েটা দেখতে হুবুহু ওর বাবার মত” কথাটা লিখে আসি ছবিতে । মেইলে ওর ফোন নং পেয়েই ফোন করলাম । মিলি,”বল তো কে ?” সাজি আপা”...চিৎকার করে ওঠে । কতবছর পর । বললাম, কি করে চিনলি মিলি ? বললো," তোমাকে চিনবোনা ? তোমার মত করে কেউ ডাকেনা।” ম্যাও না ডেকে মিলিই ডেকেছি তবু চিনে ফেললো । চোখ ভেসে গেলো । ভালবাসা ব্যাপারটা এমনই। আমার ছেলেবেলায় কিছু প্রিয় মানুষকে আমি আমার দেয়া নিজস্ব নামে ডাকতাম। এখন আর ডাকিনা । ডাকা হয়না । সময়ের নিষ্ঠুর আয়োজনে সব কেমন দুরের হয়ে যায়!
মিলি আমাদের কথা জানতে চায় । বলে,” সাজি আপা,তোমার ছবি দেখলাম । তুমি ঠিক আগের মতন আছো”। আমি বলি কিছুই কি আগের মতন থাকেরে মিলি ?” ও ওর নিজের কথা বলতে শুরু করে । সেই প্রথম পরিচয়ের দিনের মত অল্প সময়ের মধ্যে জেনে যাই ওর এত বছরের খবর । কত প্রিয় একটা মানুষ এর সাথে কত স্বপ্ন ,কত আশা নিয়ে ঘর বেঁধেছিলো । সব কিছু কেমন এলোমেলো হয়ে যায়। অবাক হয়ে শুনছিলাম । মেয়ে জন্মাবার পর ও ভেবেছিলো সব ঠিক হয়ে যাবে । হয়নি। দিনে দিনে সম্পর্কর অবনতি হয়েছে শুধু । এক পর্যায়ে বাবার বাড়িতে চলে যায় ও । “বাঁচতে ইচ্ছা করতোনা সাজি আপা, শুধু মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বাঁচতে হয়েছে “, বললো মিলি। অনেক বছর একা ছিল । চাকরিটা থাকায় অর্থ কষ্ট তেমন হয়নি । তবে মেয়ে একটু বড় হবার পর থেকে বাবাকে খুঁজতে শুরু করে। “আর অবিবাহিত অবস্থায় একা থাকা যায় ,ডিভোর্সী মেয়ে হয়ে থাকা অনেক কঠিন “, বলে মিলি। একই কথাটা আমাকে আমার এক কাছের বন্ধু বলেছিল বেশ কয়েক বছর আগে। নিজের জীবনে নানান ঘটনার মুখোমুখি হয়ে ও একি কথা বলেছিলো আমাকে।
আমি শুনছিলাম আর ভাবছিলাম জীবনের কত কুৎসিত রুপ দেখেছে । প্রজাপতির মত ছুটে বেড়াতো যেই মেয়েটা সে কত শান্তভাবে কথা বলছে। “এদিকে চলে আয় মিলি” , বললাম আমি ।
কে জানতো আরো গল্প বাকি আছে বলা? মিলি বলে ,”আরো আছে সাজি আপা" “। ওর জীবনে আরো একজন মানুষ এসেছে । তার জীবনেও মিলির মত দুঃখবোধ ছিলো । মিলির যত দুঃশ্চিন্তা মেয়েকে নিয়ে । সেইজন বলে সব ঠিক হয়ে যাবে । আবার ও স্বপ্ন দেখে মিলি। সব মানুষই দেখে । একটা দুঃখনদী সাঁতরে আর একটা দুঃখ নদীতে ঝাঁপ দেয় মানুষ । তবে আবার ঝড়ের সম্ভাবনা। ওর মেয়েটাকে ঠিক সহজভাবে নিতে পারছেনা ওর এখনকার সংগী । আমি বললাম যার সাথে যখন থাকছিস তার ভালো কিছু গুনাগুন বলতো । আমার প্রশ্নে অবাক হয়ে ও বলতে শুরু করলো । মিলিকে বললাম , “মিলি শোন , একসাথে থাকতে গেলে দুজনকেই অনেক ছাড় দিতে হয়ে । দুজনের বোঝাপড়া খুব জরুরী । সংসার ভেঙে যাওয়া সবচেয়ে সহজ । একসাথে সুন্দর ভাবে জীবন কাটাতে হলে দুজনকেই অনেক বুদ্ধি করে চলতে হয়” । তোদের মত অবস্থায় , যেখানে ছেলে মেয়েদের জীবন জড়িত থাকে। ছেলেমেয়েদের জীবনে বাবা এবং মা দুজনকেই দরকার "। মিলিকে বললাম ,"আলাদা হবার কথা ভাববি না । যতটুকু আলো আছে ততটুকুই নিয়ে পথ চলতে হবে । একসাথে থাকতে হলে নানান রকম সমস্যার মুখোমুখি হতেই হতেই পারে"।। আরও অনেক কথা হয়। ও শুধু বারবার বলে,”সাজি আপা, তোমার সাথে যোগাযোগ থাকলে হয়তো প্রথম সংসারটাও ভাঙতো না” ।
তা কি করে বলি? যা অনিবার্য তাইতো ঘটে ! তবে মানুষের ভিতরের বিশ্বাস যদি প্রগাঢ় থাকে, সুন্দর সময়ের স্মৃতিগুলোকে ভেবে , নিজেদের সন্তানের কথা ভেবে অন্ততঃ যদি একটু সহনশীল হয় মানুষ , তাহলে হয়তো এত ঘর ভাঙতো না।
বড় হবার জন্য,একটা স্বস্তিময় জীবনের জন্য ছেলেমেয়েদের দুজনকেই দরকার । নিজের মেয়েটা বেনী দুলিয়ে বাবার হাত ধরে স্কুলে যাবে। ছেলেটা বাবার সাথে কুস্তি খেলবে, এমন অনেক সুখ স্মৃতি নিয়ে ওরা বড় হবে এমন তো হওয়া চাই।
ফোন রাখার সময় মিলিকে আমার মায়ের বলা সেই কথাটা বলি,”যে সয় সেই রয়" । মিলি বারবার দুঃখ প্রকাশ করছিল, এত অল্প সময়ে এত কথা বলার জন্য । আমার বলতে ইচ্ছা করছিল,আসলেই ভীষন ভার রে মিলি । তৈরি ছিলাম না! অদ্ভুত সুন্দর একটা মেয়ে যাকে দেখলে শুধু প্রজাপতির উপমা মনে আসে । তার পালক পড়ে থাকুক অবহেলায় , চাইনি। কেউ কি চায় ? তবু তা হয়েছে।
যারা সংসারী মানুষ হবে,তাদের পরিমিতবোধ থাকা উচিত । একসাথে থাকতে গেলে সুন্দরতা থাকতে হয় , শ্রদ্ধা থাকতে হয়। নাহলে একা থাকাই ভালো । নিজেদের ভুলে কত মানুষ এফেক্টেড হয় । দূরে থাকা বাবার জন্য মেয়ের যে আকুলতা অথবা মায়ের জন্য ছেলের যে শূন্যতা তা যদি বাবা মা জানতো তাহলে এত বিচ্ছেদ হতোনারে মিলি!