আজকের দিনে ছোটবেলার একটা খেলার কথা মনে পড়ে গেল। আমরা একুশে ফেব্রুয়ারিতে বাংলায় কথা বলার চেষ্টা করতাম। সারাদিন যাতে একটাও অবাংলা শব্দ না বলা হয় সে জন্যে প্রত্যেকটা শব্দের জন্য থাকত জরিমানা। পকেটে টাকা অল্পই থাকতো, তাই খুব সাবধানে কথা বলতাম।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় বান্দরবানে ঘুরতে গেলাম একবার। কেওকারাডং পাহাড়ের ঠিক আগেই দার্জিলিং পাড়া। ওখানে গিয়ে এক আশ্চর্য অনুভূতি হলো। দেখি এক বেড়া দেয়া ঘরে প্রাইমারী স্কুল চলছে। আমরা যে সময়টাতে হাজির হলাম ঐ সময় শিক্ষক ছাত্রদের পড়াচ্ছিলেন, "আমাদের দেশের নাম বাংলাদেশ, আমাদের মাতৃভাষা বাংলাভাষা।" প্রথম বাক্যটিতে যতটা আনন্দ পেলাম পরেরটাতে শিউরে উঠলাম। এদের মাতৃভাষা বাংলা না।
মনে পড়ে, বান্দরবানে আমরা তিনদিন ছিলাম। একটা বম পরিবারের অতিথি হয়ে। এক সন্ধ্যায় বম পরিবারের সদস্য আমাদের গাইড লালঝিক আমাদের বগালেকের জন্মকাহিনী বলতে শুরু করলেন। কাহিনীটি প্রায় সবারই জানা। পরে আমি আমার মেডিকেল পড়ুয়া বন্ধুর কাছ থেকে এই কাহিনীর যথার্থতা সম্বন্ধে নিশ্চিত হয়েছি। যথার্থতা নিশ্চিত করার প্রয়োজন পড়েছিল কারণ লালঝিক আমাদের সাথে কথা বলার সময় অদ্ভুত এক ভাষা ব্যবহার করছিল। বাংলা, ইংরেজী আর বম এর টান মিশ্রিত। ফলে শ্রুত কাহিনী ভাষাগুণে বিভিন্নতা অর্জন করেছিল।
আসামের ভাষাগত বিদ্রোহের কথা আমরা জেনেছি। ভারত ইউনিয়নের প্রায় প্রত্যেক রাজ্যেই এখন 'হিন্দী বনাম মাতৃভাষা' এ ব্যাপারে একটা শোরগোল উঠেছে। কারণ আর কিছুই না হিন্দীর আগ্রাসন। শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয় আমাদের ভাষাতেও হিন্দীর আগ্রাসন চলছে। আমি একে আগ্রাসনই বলবো। ভাষার আন্তর্জাতিকীকরণের মতো উদার শব্দের ব্যবহারের সময় এটা নয়। প্রেমিক প্রেমিকাকে বলছে, "জান", বন্ধু আরেক বন্ধুকে, "ইয়ার", এর সাথে যুক্ত হচ্ছে হিন্দী জনপ্রিয় চলচিত্রগুলির সংলাপের ব্যবহার।
কোনকালে কোলকাতা ভারতের রাজধানী ছিল, আর সেখানকার লোকেরা ইংরেজদের সংস্পর্শে এসে, তাদের উমেদারি করে লেখাপড়ার চল শুরু করেছিল ইউরোপীয়দের অনুকরণে আর তাই বাংলার প্রমিত রূপ দাড়াল নদীয়ার ভাষা। তাতেই ব্যকরণ লেখা হলো। গল্প কবিতা সাহিত্যের সবটাই ওকে কেন্দ্র করেই। তাহলে আমাদের চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, সিলেট পূর্ববাংলার অপরাপর ভাষাগুলির কি হবে? ওগুলিরও তো অস্তিত্ব নাই হলে চলবে না। একজন ঢাকাইয়াকে জিজ্ঞেস করে দেখুন সে কোন ভাষায় কথা বলে মনে শান্তি পায়, প্রমিত বাংলা নাকি ঢাকাইয়া।
কথ্য, লেখ্য যে কোন রূপে ভাষাকে বাঁচাতে হবে, মাতৃভাষাকে বাঁচাতে হবে। আঞ্চলিক ভাষাগুলি সাধারণত রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে না। তাই এই সব ভাষাগুলিকে বাঁচানোর উপায় এসব ভাষায় সাহিত্য রচনা করা। আরও উপায় থাকতে পারে।
সংবিধান মতে, "রাষ্ট্র জনগণের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার রক্ষণের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন এবং জাতীয় ভাষা, সাহিত্য ও শিল্পকলাসমূহের এমন পরিপোষণ ও উন্নয়নের ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন, যাহাতে সর্বস্তরের জনগন জাতীয় সংস্কৃতিতে অবদান রাখিবার ও অংশগ্রহণ করিবার সুযোগ লাভ করিতে পারেন।"
বাংলা একাডেমীতে রক্ষিত পুঁথিগুলি পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যাচ্ছে না, সেগুলি নিয়ে গবেষণা আর উন্নত সংস্কৃতির উন্মেষ, এগুলি তো দূরবর্তী আলেয়ার মতন।
সর্বস্তরে বাংলার প্রচলনের কথা বলা হচ্ছে অনেক দিন ধরে। স্বাধীনতার পর থেকেই প্রায়। আমাদের ইঞ্জিনিয়ারিং ডাক্তারি বিদ্যায় বা বিজ্ঞানের উচ্চতর শ্রেণীগুলোতে বাংলা এখনো অচল। বিজ্ঞাপণের ভাষাও হয়ে উঠতে পারে নি বাংলা, দেশীয় কোম্পানীগুলির নাম পর্যন্ত ইংরেজীতে।
এতদিনে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে বাংলা গৃহীত হয়ে যাবার কথা ছিল, কারণ এর আগেই আরো ৬-৭ টি ভাষা ওখানে হাজির। কিন্তু কোথায় আমাদের স্থান? ২১ শে ফেব্রিয়ারি ই বা কোথায়? তাই আমাদের চ্যালেঞ্জ অনেক বড়।
সামহোয়ারিনকে অনেক ধন্যবাদ তারা বাংলায় লিখতে দিচ্ছে।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা জুন, ২০২০ বিকাল ৪:২২