somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

“স্যালুত” পৃথিবীর প্রথম মহাকাশ অবকাশকেন্দ্র এবং কিছু বীরের গল্প

০৩ রা জুন, ২০১৬ বিকাল ৩:৫১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি বিজ্ঞানের যে কয়টি শাখায় আশাতীত উন্নতি হয়েছে তার মধ্যে মহাকাশ বিজ্ঞান অন্যতম।মানুষ সবসময় চেয়েছে অজানাকে জানতে, আকাশ জয় করতে। ইউরি গ্যাগ্যারিন আমাদের ততদিনে মহাকাশের সাথে পরিচয় করিয়েছেন। তারপর পেরিয়ে গেছে একে একে ৮ টি বছর মানুষ ছাড়িয়েছে সকল বাধা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জয় করেছে চাঁদ, নভোচারী নীল আর্মস্ট্রং চাঁদের বুকে পা দিয়ে বলেছেন “That's one small step for man, one giant leap for mankind.”. আহা কি সুন্দর কথা!সময় এখন নিজেদের চেনা আকাশকে ছাড়িয়ে যাওয়ার।
কিন্তু তখনো যে অনেক অপূর্ণতা রয়ে গেছ।মানুষ তার দৃশ্যমান আকাশকে ছাড়িয়ে যেতে চায়, কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন দীর্ঘ সময় ধরে মহাকাশে থাকা। তখন নভোচারীরা মহাকাশে খুব বেশিদিন থাকাতে পারতেন না। চন্দ্র অভিযানে মার্কিনীদের কাছে পরাজিত হয়ে সোভিয়েতরা মনোযোগ দেয় তাদের স্পেস স্টেশন প্রোগ্রামে। স্টেশন বলতেই আমাদের চোখে ভাসে রেল স্টেশন,বাস ষ্টেশন! হ্যাঁ ঠিক তেমনি পৃথিবী থেকে যেসব মনুষ্যবাহী নভোযান মহাকাশে যায় তাদের ও দরকার এরকম একটি ষ্টেশন। এই ধরনের ষ্টেশনকেই বলা হয় মহাকাশ ষ্টেশন, যা মূলত একটি কৃত্রিম উপগ্রহ, তবে এতে মহাকাশচারীদের থাকা এবং গবেষণার সুযোগ থাকে।


১৯৬৭ সালে সোভিয়েত মিলিটারি স্পেস প্রজেক্ট “Almaz” শুরু হয় মূলত এটাই স্পেস ষ্টেশন বানানোর প্রজেক্ট। প্রজেক্টটি শুরু হয় মস্কো থেকে কিছু দুরে “রিয়োটভ” নামক ছোট শহরে। এখানে অবস্থিত তৎকালীন সোভিয়েত রাশিয়ার মিসাইল প্রস্তুত কারক কোম্পানি “ NPO Mashinostroyeniy” প্রজেক্টটি বাস্তবায়নের সুযোগ পায়। প্রজেক্ট প্রধান ভ্লাদিমির চেলোমাই যিনি একই সাথে কোম্পানি ডিরেক্টর। সোভিয়েত নেতারা চাচ্ছিলেন যত দ্রুত সম্ভব মার্কিনীদের এপোলো প্রজেক্ট এর উপযুক্ত জবাব দিতে নতুন ধরনের কিছু তৈরি করে। তারা প্রজেক্ট বাস্তবায়নের জন্য ১৯৭০ সাল নির্দিষ্ট করে দেন, যখন সোভিয়েত নেতা লেলিনের শততম জন্ম বার্ষিকী। কিন্তু প্রজেক্ট প্রধান চেলোমাই স্পষ্ট বলে দেন তার আরও সময় প্রয়োজন। তাই ১৯৬৯ সালে প্রজেক্ট তার কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে কোলরেভ ডিজাইন ব্যুরোকে দেওয়া হয়, বর্তমানে এটি “NPO Energiya” নামে পরিচিত। সেই সাথে প্রজেক্ট এর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় Long Duration Orbital Station (DOS), প্রজেক্ট এর নতুন প্রধান হন ইউরি সিমোনেভ এবং সেই সাথে চেলোমাইকে আদেশ দেওয়া হয় তার গবেষণায় প্রাপ্ত সকল ফলাফল এবং ইকুইপমেন্ট কোলরেভ কোম্পানিকে সরবরাহ করার জন্য। ৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৭০ সালে সোভিয়েত সরকার আনুষ্ঠানিক ভাবে DOS-7K কোড নেমে প্রোগ্রাম শুরু করে। কোলরেভ কোম্পানি রেকর্ড সংখ্যক কম সময়ে প্রজেক্টটি প্রস্তুত করে। তবে স্টেশনে মালামাল এবং নভোচারী পরিবহনের জন্য নতুন TKS টাইপ রকেট বানানোর কথা থাকলেও কোলরেভ কোম্পানি সয়ুজ রকেট এর উন্নত ভার্সন ব্যাবহার করে। কারণ নতুন ধরনের যান বানানোর মত সময় ছিল না। অপরদিকে “Almaz” প্রোগ্রামকে চালু রাখা হয় মিলিটারি প্রোগ্রাম হিসাবে।
শুরুতে স্টেশনের এর নাম রাখা হয় যারিয়া, রুশ ভাষায় যার অর্থ “ভোর”। কিন্তু পরবর্তীতে নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় স্যালুত। ১৯ এপ্রিল ১৯৭১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের বৈকনুর কসমোড্রাম থেকে আকাশে ওঠে মানুষের তৈরি প্রথম মহাকাশ স্টেশন স্যালুত-১। ১৪ মিটার দৈর্ঘ্য এবং ৪ মিটার প্রস্থ এবং প্রায় ১৯ টন ওজনের এই কৃত্রিম উপগ্রহটি উৎক্ষেপণের পর সফলভাবে পৃথিবীর কক্ষপথে স্থাপিত হয়। সেই সাথে মানুষের মহাকাশ জয়ের ইতিহাসে যুক্ত হয় আরও একটি নতুন পালক। এতে নভোচারীদের থাকার জন্য সিলিন্ডার আকৃতির ৩টি কম্পার্টমেন্ট ছিল। পাওয়ার সরবরাহের জন্য ৯.৮ মিটার দৈর্ঘ্যের দুটি সোলার প্যানেল যুক্ত ছিল। স্যালুত-১ প্রায় ১৭৫ দিন তার কক্ষপথে থেকে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে। ১৯৭১ সালের ১১ অক্টোবর স্যালুত-১ এর ইঞ্জিন শেষ বারের মত স্টার্ট করা হয়,তারপর এটিকে ইচ্ছাকৃত ভাবে প্যাসেফিক সাগরে আছড়ে ফেলা হয়। পরবর্তীতে স্যালুত সিরিজে ৭টি স্পেস ক্রাফট পাঠানো হয়।
স্যালুত গল্পটা এখানে শেষ হলেও পারত। কিন্তু সব অর্জনের পিছনেই কিছু মানুষের আত্মত্যাগ থাকে। এই মিশনও তার ব্যতিক্রম নয়। ৬ জুন নভোচারী জর্জ দোব্রভস্কি, ভ্লাদিসেভ ভোকোভ, ভিক্তর পাতসায়েভ সয়ুজ-১১ রকেটে স্পেস ষ্টেশনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন।


উৎক্ষেপণের ৩ ঘণ্টা পর তারা প্রথম মানুষ হিসাবে সফলতার সাথে স্টেশনে প্রবেশ করতে সক্ষম হন। সেখানে তারা ২৩ দিনে ৩৮৩ বার পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করেন, সৃষ্টি করেন নতুন ইতিহাস। ২৯ জুন নভোচারীরা পুনরায় সয়ুজ-১১ তে প্রবেশ করেন । সফলতার সাথে পৃথিবীর উদ্দেশ্যে তাদের যাত্রা শুরু হয়।সব কিছু যেন সাজানো, গোছানো চলছিল। কসমোড্রাম থেকে প্রায় ১২৫ কিলোমিটার দুরে তাদের বহনকারী ক্যাপসুল ল্যান্ড করে।
নিচে অপেক্ষমাণ ক্রুরা যখন যখন ক্যাপসুলের ঢাকনা খোলেন তারা অবাক হয়ে আবিষ্কার করেন তিন নভোচারীর প্রাণহীন মৃতদেহ।


শোকের ছায়া নেমে আসে সমগ্র সোভিয়েত ইউনিয়নে। মিশন কন্ট্রোল কোন উত্তর দিতে পারেনি এই ঘটনার। সোভিয়েত বাসি তাদের বীর সন্তানদের জাতীয় বীর হিসাবে পরম শ্রদ্ধায় সমাহিত করে ক্রেমলিন দেয়ালে।


পরবর্তীতে অনুসন্ধানে জানা যায় ক্যাপসুলটি যখন পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে, তখন এর মধ্যে চাপ কন্ট্রোলের ভাল্বটি খুলে যায় এবং ক্যাপসুলে চাপের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। নভোচারীরা চাপ বের হওয়ার হিসহিস শব্দ হয়তো শুনতে পেয়েছিলেন কিন্তু ভাল্বটি তাদের সিটের নিচের দিকে থাকায় তারা কোন ব্যবস্থা নিতে পারেননি, ৪০ সেকেন্ডের ভিতর সবার একসাথে মৃত্যু হয়। পৃথিবীর এই বীর সন্তানদের পৃথিবীতে আসার আগেই মৃত্যু হয়। পরম আক্ষেপে তারা দুর থেকে দেখতে পান তাদের এই প্রিয় ধরণী। তবে তাদের এই আত্মত্যাগ বিফলে যায়নি আজ আমাদের মহাকাশচারীরা দীর্ঘ সময় ধরে নিরাপদে মহাকাশে থাকছেন এবং ফিরে আসছেন। সয়ুজ-১১ দুর্ঘটনার পর ক্যাপসুলের আকার বড় করা হয় যেন নভোচারীরা ক্যাপসুলের ভীতরে স্পেস সুট পরে থাকতে পারেন। যেটা সয়ুজ ১১ নভোচারীরা পারেননি।
Reference:
http://www.zarya.info/Diaries/StationsDOS/Salyut1.php
http://www.roscosmos.ru/22171/
http://www.khrunichev.ru/main.php
http://www.mcc.rsa.ru/cup50_st.htm
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জুন, ২০১৬ রাত ৮:১৫
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:২৬

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।
প্রথমত বলে দেই, না আমি তার ভক্ত, না ফলোয়ার, না মুরিদ, না হেটার। দেশি ফুড রিভিউয়ারদের ঘোড়ার আন্ডা রিভিউ দেখতে ভাল লাগেনা। তারপরে যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আকুতি

লিখেছেন অধীতি, ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০

দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক- এর নুডুলস

লিখেছেন করুণাধারা, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫২



অনেকেই জানেন, তবু ক এর গল্পটা দিয়ে শুরু করলাম, কারণ আমার আজকের পোস্ট পুরোটাই ক বিষয়ক।


একজন পরীক্ষক এসএসসি পরীক্ষার অংক খাতা দেখতে গিয়ে একটা মোটাসোটা খাতা পেলেন । খুলে দেখলেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×