চোখের সামনে কবে থেকে যেন একটা রঙ ভেসে আছে তানি'র। হলুদ।
শুকনো পাতার মতো মাঝে মাঝে খুব হলুদ হয়ে যেতে ইচ্ছে করে ওর। ইচ্ছেটা স্বপ্নের মতন। কেমন কেমন যেন এই হলুদ রঙটা- ভাবতে ভাবতে, মনের মধ্যে একটা ছবি দেখতে পায় সে। দেখে- ''চুপচুপ বাতাস, শাদা কার্নিশে মোড়া একটা খোলা জানলা। অনেক বড়। হলুদ শাড়ি পড়ে ওই জানলা ঘেঁষে আনমনে বসে আছে ও আর বাতাসে ওর চুলগুলো উড়ছে। কোনোদিকে ওর খেয়াল নেই। চুলগুলো বোধহয় তাই রাগ করে বলে উঠছিল, নাটাইগুলো কেটে দাও না, আরও দূর উড়ি!''
আগপিছ কোনোকিছু না ভেবে ছোট ভাইকে সাথে করে একদিন হুট করেই শাড়ির দোকান ঘুরতে চলে যায় তানি।
'হলুদ রঙ কেউ যেন চেনেই না! এটা কোনো হলুদ হলো?!' চোখদুটো হতাশ প্রায়, ঠিক এমন সময়ে একটা দোকানের একটা শাড়িতে গিয়ে ওর চোখ আটকে যায়। খুব কোমল করে হাতের স্পর্শ পড়ে শাড়িটাতে- 'স্বপ্ন খুব সস্তা হতে পারে না, হাজারের ভিড়ে সে একটাই হতে পারে!' -এই কথাগুলো মনে করে শূন্যতার মাঝে একটা ভাললাগার নিঃশ্বাস পড়ে যায়।
-'শাড়িটা খুলে দেখানো যাবে?'
'জ্বী আপু, যাবে। আসুন আপনাকে শুধু আঁচলটা পড়িয়ে দেই, কেমন লাগবে সেটা বুঝতে সুবিধা হবে তাহলে।'
দোকানের আয়নার সামনে এক প্যাঁচ দিয়ে শাড়ির আঁচলটা পড়িয়ে দিতেই নিজেকে অন্যমনস্কভাবে দেখলো তানি। মনে হলো সে নিজে নয়, এভাবে যেন অন্যকেউই দেখছে তাকে! হাসি পেল, তবুও চেপে গেলো।
-'দাম কত?'
দাম শুনে চমকে ওঠার মতো চমকে ওঠেনি তানি, কিন্তু একটু মন খারাপ হয়। হ্যাঁ, টাকা তো আছেই। তাই বলে এতো দাম দিয়ে নিজের ইচ্ছেটাকে এতো সস্তায় পূরণ করে ফেলবে সে?! নাহ।
নেয়া হয়না শাড়িটা।
বাসায় ফিরে আসে দু'ভাইবোন।
দিন যাচ্ছে, কিন্তু ওই শাড়িটার ভাবনা মাথা থেকে একদমই যাচ্ছে না! 'নাহ, সম্ভব না! এতো টাকা দিয়ে শাড়িটা কেনার কোনো যুক্তিই নেই! কত মানুষের ন্যূনতম প্রয়োজনটাই মেটে না, আর সেখানে শাড়িটা কেবলই একটা মোহ!
'মোহ?'- থেমে যায় নিজের সাথে নিজের তর্ক। মোহ তো নয় এটা! মনটা আবার খারাপ হয়ে যায়। কয়েকটা দিন চলে যায়। শাড়িটার কথাও মনে পড়ে। একদিন মনটাকে শান্ত করে তানি অদ্ভুত একটা প্রার্থনা করে, 'ঈশ্বর, ওই শাড়িটা যেন কেউ নিয়ে যায়! আমি নিজেকে দমাতে পারছি না। প্লিজ, শাড়িটা যেন আমি কিনতে না পারি!'
তারপরও...মানুষকে কে রোধে তার পথ থেকে? তার ইচ্ছে থেকে? তানি নিজেকে থামাতেই পারে না। এবার মা'কে নিয়ে সরাসরি সেই দোকানটাতে চলে যায় আবার, যেখানে শাড়ি সেকশনের একটা কোণে সব রঙের ভিড়ে হ্যাঙ্গারে চেপে একটা অভিমানী রঙ সবার অলক্ষ্য হয়ে লুকিয়ে আছে। দোকানে ঢুকতে যতবার পা পড়ছে, ঠিক ততবারই বুকের মধ্যে কেমন যেন একটা অভাববোধ হচ্ছে। নিজে নিজেকে বলছে, 'শাড়িটা না থাকুক!' আবার প্রবোধও দিচ্ছে, 'থাকবে হয়তো!' হাসি পেয়ে গেলো তানি'র- কী অবস্থা!
খুঁজছে, খুঁজছে। থাকবে, থাকবে। কিন্তু নাহ, শাড়িটা নেই। আসলেই নেই। সেলসগার্ল আপুটা চেনা মুখ দেখে এগিয়ে আসে। তানি হেসে প্রশ্ন করে, 'শাড়িটা বিক্রি হয়ে গেছে, তাইনা?'
সেও হেসে উত্তর দেয়, 'জ্বী আপু।'
মনে মনে একটা ছোট্ট কষ্ট নিয়ে ঈশরকে ধন্যবাদ দেয়, আর ভাবে- 'যে নিয়েছে, সে আসলেও একটা চমৎকার কিছু নিয়ে গেছে। লাকি!' কিন্তু একটা বিষয়ও মাথায় নাড়া দেয়, 'এই বৈশাখী উৎসবে লাল-শাদার হুজুগে হলুদ কেন চোখে পড়বে কারো?! কে নিলো? কে নিলো! যাকগে, তারও মনে হয় দেখার চোখ অন্যরকম!'
কিন্তু তানি খালি হাতে ফেরেনি। তারপরও সে খুঁজেছিল একটা হলুদকে, যেটা সবার মতো হবে না। সে জানে, একটার জায়গায় অন্যকিছু কখনোই জায়গা করতে পারে না। বাগধারাটি মনে পড়ে যায়- 'দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো', তারপরও......।
**আজ আমার বৈশাখ একটা বৈরাগ্যের রঙে কাটবে। হম, সত্যি।
যদি বেরুই, তাহলে লাল-শাদার ভিড়ে একটা হলুদ অনেকেরই চোখে পড়বে।**
সব্বাইকে ।।শুভ নববর্ষ।।
(উপলব্ধি- গল্প সবসময় গল্প হয়ে ওঠার যোগ্যতা রাখে না। মানে, যেমনটা সবাই আশা করতে পারে কিংবা সুন্দর সমাপ্তির বাসনা রাখতে পারে, অথবা 'কে' দ্বারা নতুন কোনো দিকের মোড় খুঁজতে পারে- ঠিক তেমনটা নাও হতে পারে। মানুষের জীবনে বাস্তবটাই গল্প। বাকি যা আছে, তা কল্পকাহিনী। কোনোকিছুই অমূলক নয় তবুও। গল্পটা আমার। এটা সাম্প্রতিক নয়, অনেকদিন আগের একটা 'মাত্র ভাবনা' থেকে শুরু হয়ে ঠিক এই আজকে পূর্ণতা পেলো। সেদিক থেকে এটা পুরনোও নয়। সবকিছুর একটা মিশেল আছে, যা একান্তই আমি বুঝতে পারছি। চাইলে গল্পটাকে অন্যদিকে নিতে পারতাম, বড়ও হতে পারতো; কিন্তু তাতে আমার বাস্তবতাটা বা সত্যিটা হারিয়ে যেতো। ভালবাসার জিনিস কিংবা মানুষটাকে সবসময় হয়তো কাছে পাওয়া যায় না। তাতে এটাও দাঁড়ায় না যে- আর ভালবাসি না। খুব ভালবাসি, এবং এখনও। কিন্তু এটাই উপলব্ধি করেছি যে- আমার যতোটুকু দরকার ছিল তা ঐ না পাওয়া পর্যন্তই, যেটার অংশীদার আর কেউ নয়। শাড়িটা এতোটাই সুন্দর এবং সাধারণ যে এটা যে কারোর গায়ে সুন্দর করে শোভা ছড়াবে। এটা হচ্ছে শাড়িটার গুণ। যে পড়ছে সে কীভাবে এর যত্ন নেবে সেটা সেই মানুষটির গুণ। এখানে সেই মানুষটি আমি হলে একরকম হতো, আবার অন্য মানুষের ক্ষেত্রে অন্যরকম হবে। শাড়িটা তো একটা বস্তুগত উদাহরণ। মানুষের ক্ষেত্রেও মানুষ ভাগ হয়, কিন্তু ভাগ যে যার মতো করে বুঝে নেয়। আমি জানি, হয়তো সব পেঁচিয়ে ফেলেছি!
আচ্ছা, সহজ করে দেই- আমি যাকে ভালবাসি, সে আমার নাও তো হতে পারে। আর 'হয়ে থাকার' কি একটাই সংজ্ঞা?
আরও সহজে- ভালবাসা মানেই কি সবসময় অধিকার বুঝে নেয়া? )
-পেন আর্নার
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই ডিসেম্বর, ২০১৪ সকাল ৭:৪০