”মেজবানি” - ফার্সি শব্দ। উইকিপিডিয়া হতে যার আভিধানিক অর্থ পেয়েছি - আপ্যায়ন, আপ্যায়নকারী, অতিথি আপ্যায়নকারী, আতিথেয়তা, মেহমানদারি। আমাদের চাটগাঁয়ে ও নোয়াখালীতে এর প্রচলন বা বহুল প্রচলন বলা যেতে পারে। দেশের অন্যত্রও দাওয়াত জেয়াফত, বিবাহ সহ নানান অনুষ্ঠানে আপ্যায়ন, আতিথেয়তা, মেহমানদারি হয়ে থাকে, তবে আমার দেখা আমাদের চাটগাঁয়ে ও নোয়াখালিতে যতোটা বড় আকারে হয়ে থাকে তা খুব সম্ভব অন্যত্র এতো বড় আকারে এতো ব্যাপক আকারে অনুষ্ঠান হয়ে উঠে না বা হয় না (আমার জানার ভুল থাকতে পারে)।
ব্যক্তিগতভাবে আমি অনেক দাওয়াতে অংশগ্রহণ করেছি। ভালোবাসা মায়া মমতা বন্ধুত্ব ও আত্মীয়তার কারণে দাওয়াতে অংশ নিতে হয় আবার সামাজিক দায়বদ্ধতার কারণেও দাওয়াতে অংশ নিতে হয়। আমার যতোটুকু মনে পড়ে, আমার জীবনে আমি প্রথম এমন উল্লেখ করার মতো বড় একটি দাওয়াতে অংশ নিই - আমাদের চট্টগ্রামের এক জনপ্রিয় মফস্বল থানা এলাকায়। সঙ্গত কারণে সাল সময় উল্লেখ করছি না। যিনি অনুষ্ঠান আয়োজন করেছিলেন তিনি পারিবারিকভাবে বনেদি ব্যবসায়ী মানুষ “সওদাগর ভাই”। কোনো রাজনৈতিক সংঘঠনের নেতা নন। দূর দূরান্ত পর্যন্ত কোনো রাজনীতির সাথে জড়িতও নন।
শীতের দিন। আমি যখন তাঁর গ্রামের বাড়িতে গিয়ে পৌছি তখন সন্ধ্যা শেষে ঘন কুয়াশাচ্ছন্ন রাত নেমে এসেছে। বাড়ির প্রধান সড়ক থেকে শুরু করে বাড়ি ও বাড়ি সংলগ্ন আশেপাশের এলাকায় ডেকোরেটরের ডিজেল জেনারেটরে টিউব লাইটে আলোয় আলোকিত। বাড়ির পাশের ধানি জমিতে রান্নার আয়োজন করা হচ্ছে - একদল মানুষ মাটিতে গর্ত করে ইট রেখে রান্নার জন্য অস্থায়ী চুলার ব্যবস্থা করছেন। ট্রাকে করে গাছের চিলি কাঠ ও কোরোসিন তৈল এসে নেমেছে। আরো এসেছে ড্রাম ভর্তি সরিষার তৈল, মসলা, গরম মসলা, বস্তা বস্তা পায়জাম আতপ চাল। প্যান্ডেলের নিচে একদল মানুষ চাটাইয়ের পাটিতে বসে বস্তা ভর্তি মণকে মণ পেঁয়াজ রসুন আদা ছিলে ছেঁচার ব্যবস্থা করছেন (তখন ব্লেন্ডার মেশিনের তেমন প্রচলন ছিলো না) ডজন খানেক বাবুর্চি দৌড়াচ্ছেন দায়িত্বরত কাজ বোঝাতে। গরু জবাই হয়েছে ৭টি। প্রতিটি গরুতে যদি কমপক্ষে ৫ মণ করেও মাংস হিসাব করি তাহলেও সর্বমোট মাংস দাড়ায় ৩৫ মণ। রান্নার আয়োজন সহজ - গরুর মাংসের রেজালা তরকারি, আর পায়জাম আতপ চালের ভাত।
আমি দেখেছি, বিচিত্র কারণে ধনি গরিব নির্বিশেষে মাছ মাংস খাওয়ার জন্য মানুষের মন কাঁদে। সওদাগর ভাই মনে প্রাণে খাবারের আয়োজন করেছেন। একদিন অন্তত এক বেলা যাতে তাঁর এলাকার নিম্নবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ পেটপুরে তৃপ্তি সহকারে ভাত মাংস খেতে পারেন। রাতভর রান্নার আয়োজন ও রান্না হয়েছে। অগনিত মানুষ নারী পুরুষ শিশু সহ কিশোর কিশোরী বৃদ্ধ বৃদ্ধা পরের দিন সকাল হতে দুপুর পর্যন্ত হাসি মুখে ভাত মাংস খেয়েছেন। আর তাঁদের মাঝে হয়তো অনেক অনেক মানুষ ছিলেন যারা একমাত্র কোরবানীর ঈদ ছাড়া মাংস খেতে পারেন না। তাদের চোখে মুখে যে আনন্দ ছিলো তা আমার সামান্য লেখার ভাষায় বোঝানো অসম্ভব বিষয় । এতোগুলো মানুষ খেয়ে যেই পরিমাণ খুশি ও আনন্দিত হয়েছেন সম্ভবত সওদাগর ভাই তার চেয়েও বেশী আনন্দিত। কারণ, তিনি প্রতি বছরই এই কাজটি করতেন।
খাবার আয়োজন করে সওদাগর ভাই মাঠের প্যান্ডেলে সকল দাওয়াতিদের মাঝে দাড়িয়ে করজোড় হাতে চাটগাঁয়ের বিশুদ্ধ আঞ্চলিক ভাষায় বললেন - “আমি আপনাদের সকলের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী, আপনাদের দাওয়াত দিয়ে হয়তো ভালোভাবে খাওয়াতে পারিনি, আমাকে ক্ষমা করবেন। দোয়া করবেন যেনো আপনাদের ভালো খাবারের ব্যবস্থা করতে পারি, দোয়া করবেন যেনো আপনাদের কর্মের ব্যবস্থা করতে পারি - যাতে একদিন আপনারা আমার চাইতেও বেশী আয়োজন করতে পারেন।
উপসংহার: সত্য ঘটনা অবলম্বনে লেখা, তবে সওদাগর ভাই কোনো ব্যক্তি বিশেষ কারোও নাম নয়। গল্পের কারণে একটি নাম নেওয়া হয়েছে। আমাদের চট্টগ্রাম নোয়াখালীতে এমন সওদাগর ভাই অনেক অনেক আছেন। যারা রোজার ঈদ কোরবানীর ঈদ বাদেও বছরে কমপক্ষে একবার হলেও এমন একটি বড় আয়োজন করেন যার নাম মেজাবানি। সওদাগর ভাই যারা আছেন তাঁরা শুধু মানুষকে বছরে একবার খাওয়ানোর জন্য ডাকেন না। তাঁরা ব্যবসা তৈরি করেন ও মানুষের জন্য কর্মসংস্থান করেন। মৌলিক অধিকার বঞ্চিত মানুষদের শিক্ষা ও চিকিৎসা সহযোগিতা করেন। মানুষকে স্বাবলম্বী তথা আত্মনির্ভরশীল করেন। সওদাগর ভাই আমাদের সমাজের ভালোবাসার মানুষ। বাংলাদেশের সত্যিকার মাটির মানুষ সওদাগর ভাই। আমাদের দেশে মেজবানি টিকে থাকুক শত সহস্র বছর আর আমাদের মাঝে সওদাগর ভাইও থাকুন শত সহস্র বছর। সওদাগর ভাইদের আমাদের খুব প্রয়োজন।
উৎসর্গ: ০৮-১১-২০২২ আমার লেখা দেশের বাজারে আগুন পোস্টে মোহাম্মদ গোফরান ভাই মোট ১৬টি মন্তব্য করেছেন। প্রতিটি মন্তব্য খুবই প্রয়োজনীয় মন্তব্য, অকারণ অযথা মন্তব্য চালাচালি নয়। আমাদের চাটগাঁ ও নোয়াখালীর মানুষ কাউকে তৈল দিতে পারেন না, তৈল নিতেও পারেন না। আমি নিজে পারিবারিকভাবে তৈলের ব্যবসার সাথে জড়িত। তৈল আমার ব্যবসা পণ্য, বিনামূল্যে তৈল বিতরণ আমারও কাজ নয়। আমার সামহোয়্যরাইন ব্লগ জীবনে কোনো একক পোস্টে কোনো একক ব্যক্তি হতে এতো মন্তব্য এই প্রথম পেয়েছি, যা আমার জন্য মাইল ফলক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। আমি কৃতজ্ঞ আমি আনন্দিত ও মোহাম্মদ গোফরান ভাইয়ের কাছে আমি ঋণী। এই পোস্টটি মোহাম্মদ গোফরান ভাইকে উৎসর্গ করছি হয়তো কিছুটা ঋণ পরিশোধ হবে, বাদবাকী ঋণ যদি থাকে মোহাম্মদ গোফরান ভাই পাওনা থাকবেন।
সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ।
ঠাকুরমাহমুদ
ঢাকা, বাংলাদেশ
০৯-১১-২০২২ ইংরেজি
ছবি সূত্র: বাংলাদেশ মানচিত্রে চট্টগ্রাম বিভাগ
বিশেষ দ্রষ্টব্য: “মেজবানি ও আমাদের চট্টগ্রাম” লেখাটি আমার ব্যক্তিগত স্মৃতি বিজড়িত চট্টগ্রামের মেজবানি নিয়ে অতি সাধারণ ও সামান্য একটি লেখা মাত্র। এটি সামহোয়্যারইন ব্লগের লেখা প্রতিযোগিতার জন্য নয়।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই নভেম্বর, ২০২২ দুপুর ১২:০২