somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একজন মায়ের অনুরোধে লিখছি

২১ শে আগস্ট, ২০১০ সন্ধ্যা ৭:১৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

প্রিয় ব্লগারবৃন্দ, এই লেখাটি আমি বারবার রিপোস্ট করতে থাকব। তাতে যদি আমার আইডি টি ব্যান করে দেয়া হয়, তাতেও আমার কোন আপত্তি নেই। তবু আমি চাই, এই লেখাটি যতজন মানুষ সম্ভব, পড়ুক।
আমি এইখানে, এই লেখাটির স্বত্ত্ব ত্যাগ করছি। যার ইচ্ছা মনে করলে এই লেখাটি কপি করে যেকোন জায়গায় দিতে পারেন, সূত্র বা লেখকের নাম উল্লেখের কোন প্রয়োজন বা দায়বদ্ধতা নেই। আমি নিশ্চিত জানি, এ পোস্ট এবং লেখার প্রাপ্তিযোগ বা ফলাফল শূন্য। তবু, একজন মা এবং তাঁর আবেগতাড়িত অনুরোধে মানুষ হিসেবে যে ন্যূনতম দায়িত্ববোধ এই অপবিত্র জীবনে এখনও অবশিষ্ট আছে বলে বোধ হয়, তার হিসাব ঘোচাতে এই ব্লগ, এই পোস্ট, এই লেখা।


প্রিয় পাঠক, শুরুতেই করজোড়ে আমি আপনাদের উপর একটি দায়িত্বের দায়ভার চাপিয়ে দিচ্ছি -- সেটি হচ্ছে লেখাটি থেকে কোন উপসংহারে পৌঁছবার দায়িত্ব আপনার -- আমি এখানে একজন বর্ণনাকারী মাত্র। এথেকেই বিবেকবান পাঠক তাঁর যেটি বোঝার, বুঝে নেবেন।

শায়লা ও অলক। দু'জনেই আমার বন্ধুপ্রতীম ও সুহৃদ। তরুণ দম্পতি। এবং নতুন বাবা, নতুন মা। তবে, তারা তাদের এই নতুন পরিচয়টি ভুলতে চায়, ভুলে থাকতে চায়। কারণ, তাদের ভালবাসার অতি আকাঙ্ক্ষিত দুই যমজ দেবশিশুর কেউই এখন বেঁচে নেই; একটু ভুল হলো বোধহয়, ওরা বেঁচে আছে শায়লা আর অলকের স্মৃতিতে। যদিও ওদের এই পৃথিবীর আলো-হাওয়াতেই বেঁচে থাকবার, ছুটোছুটি করবার, বেড়ে ওঠবার কথা ছিল, অধিকারও ছিল। তবে কারও সুনির্দিষ্ট অবহেলা ও দায়িত্বহীনতার জন্যই শিশু দু'টির বেঁচে থাকা হলো না। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে এটি, আমার বিবেচনায়, একটি হত্যাকান্ড। হয়ত বা, ইচ্ছাকৃত নয়, কিন্তু নিশ্চিতভাবেই, অবহেলা ও দায়িত্বহীনতাজনিত। তবে সেটি কার, শায়লা ও অলকের, নাকি তাদের উপদেষ্টা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের, পোস্টটি পড়বার পর তা নির্ধারণের দায়িত্ব পাঠকের।

বাস্তবে ঘটা এই গল্পের মূল চরিত্র তিনটি -- দুর্ভাগা মা : শায়লা, ব্যক্তিজীবনে উচ্চশিক্ষিত তরুণী ও ব্যাংকার, হতভাগ্য বাবা : অলক, মেধাবী ও দারুণ হিউমারাস, পেশায় সে-ও ব্যাংকার ও তাদের উপদেষ্টা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক : ডা. বিলকিস মাহমুদা, প্রসূতি ও স্ত্রী-রোগ বিশেষজ্ঞ, বিদেশে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সরকারী মিটফোর্ড হাসপাতাল ও ধানমন্ডী কেয়ার হসপিটালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক।

শায়লা প্রায় ছয়মাসের অন্তঃসত্ত্বা। তার গর্ভে দু'টি যমজ সন্তান। আসছে অক্টোবরে মা হচ্ছে সে, ডাক্তার হিসেব করে তা-ই বলেছেন। অন্যান্য পরীক্ষা-টরীক্ষা করে আরও বলেছেন যে, বাচ্চারা খুব ভালো আছে, সবকিছুই স্বাভাবিক। আহ্‌, কি আনন্দ, কি আনন্দ ! অলকের চোখে-মুখেও আনন্দ আর ধরে না।

কিন্তু পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ অন্যরকম। খাপছাড়া। অস্বাভাবিক।

২৯ জুলাই, বৃহস্পতিবার
সকাল ১১:০০ টা

শায়লা অফিসে। ভীষণ খারাপ লাগছে তার। পেটটা শক্ত হয়ে যাচ্ছে কেন ?
কোন সমস্যা হলো নাকি ? পেটের বাবু দু'টার কোন কষ্ট হচ্ছে না তো ! মায়ের মন আশংকায় কেঁপে ওঠে। শায়লা অফিস থেকেই ফোন করে তার তত্ত্বাবধায়ক চিকিৎসক ডা. বিলকিস মাহমুদাকে।

'আপা, আমার খুব খারাপ লাগছে। পেটটা শক্ত হয়ে আছে। আমি অফিসে আছি, একবার কি আসব আপনার কাছে ? একটু চেক করে দেখবেন ?'
শায়লা জিজ্ঞেস করে ডাক্তারকে।

'বাসায় যেয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে থাকুন। আসবার প্রয়োজন নেই। visceralgine
ওষুধটা তিনবার করে তিন দিন খাবেন।' -- ডা. বিলকিস উত্তর দেন।

শায়লা বাসায় চলে আসে। ডাক্তারের কথামত লম্বা হয়ে শুয়ে থাকে। ওয়াশ রুমে যায়। তার অনভিজ্ঞ চোখেই কিছু অস্বাভাবিকতা ধরা পরে। শায়লা আবার ফোন করে ডা. বিলকিসকে জানায়। এবারও তিনি রোগিণীকে সরাসরি দেখার পরিবর্তে আগের আরও একটা ওষুধ ভেসেটানল খাওয়া শুরু করতে বলেন। কোন ধরনের মুভমেন্ট একদম নিষেধ করে দেন।

তীব্র ব্যথা নিয়ে শায়লার দিন শেষ হয়।

৩০ জুলাই, শুক্রবার
দুপুর ০১:০০ টা

শায়লার ভয়ানক কষ্ট হচ্ছে। কোমর ও তলপেটে অসহ্য ব্যথা, ভারী হয়ে গেছে ও নাভির গোড়া শক্ত হয়ে আছে। নাহ্‌, আর সহ্য হচ্ছে না যে ! মা হওয়া এত কষ্টের ! না পেরে শায়লা আবারও ফোন দেয় ডাক্তারকে। প্রচন্ড ব্যথার কথা বলে, সমস্যা জানায়, প্রতিকার চায়। কিন্তু শুক্রবারে যে ডা. বিলকিস চেম্বারে বসেন না !!! তিনি ব্যথা সহ্য করবার উপদেশ দিয়ে বলেন, 'শনিবার তো আসতেই পারবেন।'

৩১ জুলাই, শনিবার
ভোর ০৫:০০ টা

রাতটা যে কিভাবে কেটেছে শায়লা আর অলকের, তা তারা নিজেরাও বলতে পারবে না। এত ভয়াবহ আর দীর্ঘ রাত। কি কষ্ট, কি কষ্ট !! ওদের দু'জনের শোবার ঘরের দরোজায় অলক একটা পোস্টার সেঁটে দিয়েছে। দু'টি মিষ্টি শিশু -- যমজ, দুষ্টু দুষ্টু হাসছে। মন খারাপ হলেই শায়লা এই ছবিটির দিকে তাকিয়ে থাকত। এই ভয়ানক রাতের শেষেও এই ছবির দিকে তাকিয়ে ওর চোখ থেকে দু' ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল, সেটি কি অনাগত সন্তানের জন্য ভালবাসার, নাকি প্রচন্ড শারীরিক কষ্টের কারণে, ঠিক বোঝা গেল না। সারা রাত জেগে ভোরের দিকে ক্লান্ত হয়ে অলকের চোখ একটুখানি বুঁজে এসেছিল। শায়লা তখন আর তাকে ডাকতে চায়নি। প্রতদিন ভোরের আগের সময়টাতে সে প্রাত্যহিক প্রার্থনা সেরে নেয় -- পরম করুণাময়ের কাছে মঙ্গল কামনা করে, তার নিজের, অনাগত সন্তানের।

সেদিন, আরও কিছুক্ষণ পরে বাধ্য হয়ে শায়লা দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে ডাক্তারকে মুঠোফোনে বার্তা পাঠায় (এসএমএস)। নিজের সমস্যার কারণে বারবার,
তা-ও আবার এত সকালে ডাক্তারকে বিরক্ত করতে তার লজ্জা হয়, ডাক্তার রেগে যান যদি ! হয়ত এমন ভীষণ যন্ত্রণাটাই স্বাভাবিক, প্রথম মা-বাবা হতে যেয়ে সে এবং অলক তা জানে না। তাছাড়া ডাক্তার তো বারবার বলছেনই যে, সব কিছু ঠিক আছে, কোন জটিলতা নেই। তাই, তত্ত্বাবধায়ক চিকিৎসকের পরামর্শ ও নির্দেশনাই শেষ সময় পর্যন্ত আদর্শ রোগীর মতো মেনে গেছে শায়লা-অলক দম্পতি। মুঠোফোনের বার্তায়ই শায়লা ডাক্তারকে অনুরোধ করে সম্ভব হলে যোগাযোগ করতে। আরও জানায়, অত্যন্ত তীব্র ব্যথা সে আর সহ্য করতে পারছে না। ডাক্তার যোগাযোগ করে আশ্চর্যজনকভাবে তখনও দেখা করতে নিষেধ করে ব্যথা খুব বেশী হলে সাপোজিটর নিতে বলেন। কোন ক্লিনিক বা হসপিটালে যাবে কি না -- শায়লার এই মরিয়া প্রশ্নের জবাবে তিনি নিষেধ করে তাঁর নিজস্ব কেয়ার হসপিটালে বেলা দেড়টায় আসতে বলেন, কেননা সে সময়টাতে তিনি ঐ প্রাইভেট হসপিটালটিতে থাকবেন। এদিকে তখনও অত সকালে ফার্মেসী খোলেনি। সেদিনটাতেই সকালবেলা তুমুল বৃষ্টি আর বৈরী আবহাওয়া।

এরপরের ঘটনাগুলো ঘটতে থাকে অতি দ্রুত, পরিস্থিতির অবনতি হয় তারও দ্রুততায়।

শায়লার অসহ্য চিৎকারে তাকে গৃহপরিচারিকার কাছে রেখে অলক উদভ্রান্তের মতো ছুটে বেরিয়ে যায়। পাড়ার লোকেদের সাহায্যে একটি দোকান খুলে সাপোজিটর কিনে অলক ফিরে আসে শায়লার কাছে। শায়লার ভয়ানক যন্ত্রণায় প্রায় সংজ্ঞাহীন অবস্থা। অলক দিশেহারা হয়ে সবচেয়ে কাছের মিরপুর জেনারেল হাসপাতালে সাপোজিটর দেয়ার জন্য শায়লাকে নিয়ে যায়। সে সময়টায় হাসপাতালে কোন ডাক্তার ছিলেন না। আর না পেরে শায়লা মেঝেতেই শুয়ে পড়ে। হায় ! সেবাকেন্দ্রের সেবিকারা কোন দুর্ঘটনার দায়িত্বের আশংকায় তাকে স্পর্শ পর্যন্ত করে না। রোগিণীকে ভর্তি করতেও তারা অস্বীকৃতি জানায়। অবশেষে একজন অ্যাটেন্ডেন্ট এগিয়ে এসে সাপোজিটর নিতে সহায়তা করে। মিরপুর জেনারেল হাসপাতালের পরামর্শ মত অলক শায়লাকে মিরপুর ২-এর বিএভিএস মেটারনিটিতে নিয়ে যায়।

এরপর ওখানকার আয়া এবং নার্সরা মিলে প্রথম বাচ্চাটিকে বের করে। তারপর ডা. মারিয়ম এসে প্রায় পঁচিশ মিনিট পর ছোট বাচ্চাকে বের করেন। বিএভিএস মেটারনিটি থেকেই বলে যে, বাচ্চারা সাত মাসের ভূমিষ্ঠ শিশুর মতো স্বাভাবিক, তবে ইনকিউবেটরে রাখতে হবে। তখন পুনরায়, ডা. বিলকিসকে ফোন করলে তিনি অপেক্ষা করতে বলেন। কেয়ার হসপিটালে জানিয়ে কেয়ারের অ্যাম্বুলেন্সে করে সেখানেই যেতে বলেন। যদিও শায়লা ও অলক অধিকতর সুবিধাসম্পন্ন স্কয়ার, এ্যাপোলো বা ইউনাইটেডের মতোই কোন হসপিটালে নিতে আগ্রহী ছিল, কিন্তু বাচ্চা দু'টোর এ অবস্থায় তত্ত্বাবধায়ক চিকিৎসকের পরামর্শের বাইরে যেয়ে কোন ঝুঁকি নিয়ে তাঁকে চটাতে চায়নি। বাচ্চা দু'জনকে কেয়ার হসপিটালেই ভর্তি করা হয়, তবে কেয়ারের অ্যাম্বুলেন্সের জন্য দেরী না করে মিরপুরের হার্ট ফাউন্ডেশনের অ্যাম্বুলেন্সে করে দ্রুতই ওদের স্থানান্তর করে ওরা।

এখানে দু'টি তথ্য উল্লেখযোগ্য।

১. বড় বাচ্চটির জন্মের সময় ওজন ছিল ৯৩০ গ্রাম, আর ছোটটির ৯১০ গ্রাম, অর্থাৎ প্রত্যেকেই প্রায় ১ কেজি ওজনের, যেটা বাচ্চা দু'জনের বার্থ সার্টিফিকেটে উল্লেখ আছে।

২. এরকম প্রি-ম্যাচিউরড্‌ বেবীদের উপযুক্ত চিকিৎসার জন্যই ইনকিউবেটরের সাহায্য নেয়া হয়, যেখানে তাদের অত্যন্ত নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখবার কথা।

বড় শিশুটির মৃত্যু হয় ৩ আগস্ট, ২০১০।
(কত সহজ আর অবলীলায়ই না আমি কথাটি লিখলাম ! )

বড়টির সৎকার কর্ম শেষ হতে না হতেই গভীর রাতে অলককে জানান হয়, রক্ত লাগবে, ছোটটির জন্য। অলক নিজ উদ্যোগেই আত্মীয় রক্তদাতা তৈরী করে রেখেছিলেন, রক্ত আগেও প্রয়োজন পড়েছে। এ+ রক্ত দেবার পরে, তখন হসপিটাল থেকে বলা হয় যে, রক্তের শুধুমাত্র হোয়াইট ব্লাড সেলই শিশুটিকে দিতে হবে। রেডিলি এ্যাভেইলেবল হোয়াইট ব্লাড সেল হসপিটালটিতে মজুদ নেই। হয় তা এই মুহূর্তেই জোগাড় করতে হবে, অথবা এই রক্ত থেকে হোয়াইট ব্লাড সেল আলাদা করতে বার ঘন্টা সময় লাগবে। আশ্চর্যের বিষয়, এমন একটি মুমূর্ষু নবজাত শিশু তাঁদের অধীনে গত প্রায় চারদিন যাবৎ নিবিড় পর্যবেক্ষণে আছে, যার জন্য আগেও রক্ত নেয়া হয়েছে, রক্তদাতাও তৈরী ছিলেন, কিন্তু তাঁরা এমনটি আগে থেকে ব্যবস্থা করেননি, এমনকি শিশুটির অভিভাবকদেরও জানাননি !!

রক্তের অভাব নিয়ে আরো বার ঘন্টা সময় শিশুটি যুদ্ধ করতে পারেনি। মৃত্যুর কারণ হিসেবে দেখান হয় ফুসফুসে রক্তক্ষরণ।

ছোট শিশুটির মৃত্যু হয় ৪ আগস্ট, ২০১০।

শ্রদ্ধেয় পাঠক,

এমন মর্মস্পর্শী একটি ঘটনার পরে ডা. বিলকিস মাহমুদা শায়লাকে বলেন, 'এটি একটি দুর্ঘটনা। ছয় মাস পর আবার কনসিভ করবেন।' দায়িত্বে অবহেলার প্রসঙ্গ উড়িযে দিয়ে তিনি বলেন, 'এটি একটা প্রি-ম্যাচিউরড্‌ ডেলিভারী ছিল না। প্লেন অ্যাবরশন কেস। এখানে দায়িত্বে অবহেলার কোন কারণ ঘটেনি। তাছাড়া রোগীর ইউটেরাসেও কিছু জটিলতা ছিল। মেয়েটির লেবার পেইন উঠেছে সেটি সে আমাকে স্পষ্ট বলতে পারেনি। তাছাড়া আমি তাকে নিয়মিত টাচে রেখেছি। একটি দুর্ঘটনা ঘটার কারণে চিকিৎসককে দায়ী করাটা অনেকটা কালচার হয়ে গেছে। আমি কখনই তাকে বিভ্রান্তিকর কিছু বলিনি। এটাও সঠিক নয় যে আমি টেলিফোনে চিকিৎসা দিয়ে এসেছি। আমি ওকে শিশু, বারডেম বা কেয়ারে আসতে বলেছি। এখানে কেয়ার বা আমার দায়িত্বহীনতার কোন সুযোগ নেই। বাচ্চা দু'টির অবস্থাও সংকটাপন্ন ছিল। যথাসম্ভব চেষ্টা করা হয়েছে। ওসময়ে যে সাজেশন দিয়েছি তা অন্য যে কোনও ফিজিশিয়ানই দিতেন। আর মেয়েটির সংকটাপন্ন অবস্থায় টেলিফোনে যতটা সম্ভব সহায়তা করেছি। একটি দুর্ঘটনা ঘটার পর আমি মনোবল ঠিক করতে রোগীকে যদি বলে থাকি আপনার শরীরে কোন সমস্যা নেই আবার কনসিভ করতে পারবেন, সেটা কি অপরাধ ? ইউটেরাসে সমস্যা ছিল এটা আগে অ্যাবরশন হিস্ট্রি থাকলে বলতে পারতাম।'

তবে একই প্রেক্ষাপটে আরেকজন প্রসূতি রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. নাজনীন বেগম জানান, 'টুইন বেবী সেনসিটিভ কেস হিসেবে বিবেচনা করতে হয়। ছয় মাসে ডেলিভারী মানে প্রি-ম্যাচিউরড্‌ কেস। তবে বেবীরা প্রত্যেকে ১ কেজি ওজনের ছিল, মানে ওরা সুস্থ ও স্বাভাবিক গঠনেই ছিল। ৬০০ পাউন্ড হলেই আমরা আশা করি বাচ্চার সারভাইভ করার সম্ভাবনা ৯৯ ভাগ। নরমালি এসময় সাপোজিটর দেয়া বেবীর জন্য রিস্ক হতে পারে বলে আমি মনে করি। তবে মার ইউটেরাস যদি যমজ বাচ্চা ধারণের জন্য পর্যাপ্ত স্থানের না হয়, তাহলে আগে থেকেই মায়ের বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়ার কথা ও তার তত্ত্বাবধায়কের তা আইডেন্টিফাই করার কথা। রিমোট এলাকায় যাতায়াত সমস্যা হলে হয়তো যুক্তি ছিল কিন্তু ঢাকা শহরে থেকে পেইনের সিম্পটম শুনে ট্রিটমেন্ট দেয়াটা কতটা জরুরী ছিল আমার কাছে তাও স্পষ্ট নয়।'

সেক্ষেত্র কিছু প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন অতি স্বাভাবিক।

ক. বারংবার রোগিণী অসহনীয় ব্যথার অভিযোগ করে সাক্ষাৎকার চাওয়ার পরও তাকে সরাসরি না দেখে ফোনে চিকিৎসা দেয়াটা কি পেশাদারী দায়িত্ববোধের পরিচয় বহন করে ?

খ. এরূপ অবস্থার কোন অন্তঃসত্ত্বা মা-কে ব্যথা উপশমের জন্য সাপোজিটর নিতে বলাটা চিকিৎসা বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে কতখানি নিরাপদ ছিল ? (ডা. নাজনীন বেগমের মন্তব্য দ্রষ্টব্য, এছাড়া সম্মানিত ব্লগারবৃন্দের মধ্যে যাঁরা চিকিৎসা পেশায় নিয়োজিত আছেন, তাঁরা মূল্যবান মতামত দিতে পারবেন বলে আশা করি)

গ. শায়লা প্রথমবারের মত মা হতে যাচ্ছে। তার পক্ষে কিভাবে শনাক্ত করা সম্ভব কোন পেইনটা লেবার পেইন বা প্রসবকালীন ব্যথা ? নাকি একজন বিশেষজ্ঞ ও শায়লার তত্ত্বাবধায়ক চিকিৎসক হিসেবে ডা. বিলকিসেরই তা অনুধাবন করা উচিৎ ছিল ? 'শায়লা তাঁকে বলেনি যে তার লেবার পেইন হচ্ছে' -- এটি বলে কি তিনি উদোর পিন্ডি বুদোর ঘাড়ে চাপাতে চাচ্ছেন ?

ঘ. ঘটনাটি এরকম রূপ নেবার পর ডা. বিলকিস দাবী করছেন ইউটেরাসে সমস্যা ছিল, মায়ের ইউটেরাস বাচ্চা ধারণের থেকে ছোট। অথচ দীর্ঘ ছয়টি মাস শায়লা তাঁর নিবিড় তত্ত্বাবধানে থাকবার সময় তিনি একটি বারও একথাটি কখনও বলেননি। নরমাল ডেলিভারী হবার পর বাচ্চা দু'জন মারা গেলে তিনি বুঝতে পারলেন শায়লার সমস্যা ছিল। কেন ?

ঙ. ডা. বিলকিস বলছেন, 'ইউটেরাসে সমস্যা ছিল এটা আগে অ্যাবরশন হিস্ট্রি থাকলে বলতে পারতাম।' -- অর্থাৎ কারও ইউটেরাসে কোন সমস্যা আছে কি না তা বোঝার জন্য আগে তাকে একটি অ্যাবরশনের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে ?

চ. ঘটনাটিকে ডা. বিলকিস বর্ণনা করেছেন 'প্লেন অ্যাবরশন' হিসেবে। দু'জন জলজ্যান্ত প্রত্যেকে ১ কেজি ওজনের যমজ শিশুর বার্থ সার্টিফিকেট বর্তমান থাকবার পরও কীভাবে একজন চিকিৎসক একে অ্যাবরশন বলতে পারেন ?

ছ. বাচ্চাকে প্রয়োজনীয় সব রকমেরই চিকিৎসা প্রদান করা হয়ে থাকলে মৃত্যুর জন্য যথাসময়ে রক্ত সরবরাহে চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতা দায়ী কি না ? আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে প্রি-ম্যাচিউরড্‌ বেবীর ফুসফুসে রক্তক্ষরণ অতি জটিল সমস্যা কি এবং এটি বন্ধ করবার কোন উপায় আছে কি না ?

এ প্রসঙ্গে আইনজ্ঞ অ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্না বলেন যে, কর্তব্যে অবহেলা হয়ে থাকলে ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটলে অবশ্যই তা ক্রিমিনাল অফেন্স হিসেবে আইনের শরণাপন্ন হওয়া যায়। অভিনেতা মৃত্যুর পর একই অভিযোগে ছয় চিকিৎসকের নামে সিএমএম কোর্টে মামলা চলছে। তাছাড়া মেডিকেল ল' অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট করে এসব অভিযোগের উল্লেখ ও প্রমাণিত হলে শাস্তির বিধান আছে। তবে এটা বলার থাকে না, এই মায়ের মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে। একটি মা তার দুই সন্তানকে হারানোর পর চিকিৎসক বলতে পারেন না -- 'এটা স্রেফ দুর্ঘটনা। ছয় মাস পর আবার কনসিভ করবেন।' এটা স্রেফ অমানবিক আচরণই নয়, একই সঙ্গে দায়িত্বহীন শব্দচয়নও বটে।

প্রিয় পাঠক, যদি কষ্ট করে এ লেখাটি পড়ে থাকেন, তবে এর উপসংহার টানার দায়ভার লেখার শুরুতেই আপনাকে দিয়েছি। এ ঘটনাটির কিছুদিন আগেই ধানমন্ডীর মেডিনোভাতে একজন সন্তান-সম্ভাবা নারী রহস্যজনকভাবে একটি ইনজেকশন পুশ করবার পরপরই মৃত্যুবরণ করেন। প্রায় অনুরূপ একটি ঘটনা ঘটে আদ-দ্বীন হসপিটালে। সেই সময়, আমি নিজেকে ওই ঘটনাপ্রবাহ থেকে বিচ্ছিন্ন ভেবেছিলাম। ভাবিনি এরকম কিছু কোনদিন আমাকেও স্পর্শ করতে পারে। তারপর, এর হিমশীতল অভিশাপ আমার, আমার অতি নিকটজনদের ছুঁয়ে যায়। অলক বা শায়লার চাওয়া, ডা. বিলকিস ও কেয়ার কর্তৃপক্ষ যেন তাঁদের ভুলটা স্বীকার করে নিজ নিজ দায়িত্বে আরেকটু সচেতন হয়, ভবিষ্যতে আর কাউকে যেন এমন খাম-খেয়ালীর শিকার হতে না হয়।

শ্রদ্ধেয় পাঠক, আপনার বিবেচনা বোধে এই ঘটনার জন্য আপনি কাউকে কি দায়ী মনে করেন ? যদি তা-ই হয়, তবে আপনার সহযোগিতার হাতটি বাড়িয়ে দিন ... আইনের কাঠগড়ায় না হোক, আসুন তাঁদেরকে বাধ্য করি বিবেকের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে প্রশ্নের উত্তর দিতে।

দৈনিক যুগান্তরে ১০ আগস্ট ২০১০-এ প্রকাশিত কাওসারা সোহেলী-র প্রতিবেদনটি দেখুন এখানে

নিছক দুর্ঘটনামাত্র !

[প্রিয় পাঠক, আমি হুমায়ূন আহমেদ নই, স্বপ্নের যাদুকর সুনীল গাঙ্গুলীও না, আমার ক্ষুদ্রতাকে অতি সামান্য বল্‌লেও বেশী বলা হয়ে যাবে, আমি জানি। এই ফোরামের পাঠক-প্রিয় একজন ব্লগার, যাঁর একটি পোস্টের পাঠক সংখ্যা ছিল পনের হাজারের বেশী এবং পোস্টটি সপ্তাহাধিককাল স্টিকি হয়েছিল, তাঁর দ্বারস্থ হয়েছিলাম। তিনি ব্যক্তিগত ব্যস্ততায় সময় করে লেখাটি লিখে উঠতে পারেননি। তবু আমি তাঁর কাছে সবিশেষ কৃতজ্ঞ,কেননা তাৎক্ষণিকভাবেই তিনি তাঁর বেশ ক'জন সাংবাদিক বন্ধুকে ফোন করে অনুরোধ জানিয়েছেন, সংবাদটি প্রকাশের এবং যার ফলেই একটি শীর্ষ স্থানীয় দৈনিকে খবরটি এসেছে। কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি 'যুগান্তর'-এর কাওসারা সোহেলীকে প্রতিবেদনটি প্রকাশের ঋণস্বরূপ।]
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে আগস্ট, ২০১০ সন্ধ্যা ৭:১৩
৬৪টি মন্তব্য ৪৫টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×