আবহমান গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য আর কৃষ্টির সঙ্গে জড়িয়ে আছে ঘুঘু শিকারের ইতিহাস। বন্দুক বা এয়ারগান দিয়ে ঘুঘু শিকার নয়, পোষা ঘুঘু দিয়ে বুনো ঘুঘু শিকার। এক সময় বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামের দু’একটি বাড়িতে দেখা যেত খাঁচাবন্দী পোষা ঘুঘু। অবস্থাপন্ন অনেক কৃষকের প্রধান শখ ছিল ঘুঘু শিকার। এভাবে ঘুঘু শিকার করতে হলে শিকারীকে হতে হয় যথেষ্ট অভিজ্ঞ। এই পদ্ধতিতে ঘুঘু শিকারের পিছনে জড়িয়ে থাকে শিকারী ধৈর্য আর কষ্টের ইতিহাস।
পোষা ঘুঘু দিয়ে বুনো ঘুঘু শিকারের জন্য শিকারী প্রথমে খুঁজে বের করে বুনো ঘুঘুর বাসা। বাসার সন্ধান পাওয়ার পর শুরু হয় তার অপেক্ষার পালা। ঘুঘু বাসায় ডিম পাড়ে, ডিম ফুটে এক সময় বাচ্চা বেরিয়ে আসে। শিকারী প্রতিদিন চুপি চুপি বাসার কাছে এসে ঘুঘুর বাচ্চা দেখে যায়। বাচ্চাগুলোর শরীরে ভালমত পালক গজিয়ে উঠবার পর শিকারী নিজের পছন্দ মত একটি বাচ্চাকে বাসা থেকে নামিয়ে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসে। একটা বাঁশের খাঁচায় ভরে পরম যতœ আর আদর দিয়ে সে বাচ্চাটাকে বড় করে তুলতে থাকে। এভাবে কয়েক মাস যাওয়ার পর বাচ্চাটা যখন ঘন ঘন ডাকতে থাকে তখন শিকারী বুঝে ফেলে, ঘুঘুটা শিকারের কাজে ব্যবহারের উপযুক্ত হয়ে পড়েছে। এখন দরকার একটা শিকারের খাঁচা। একমাত্র যথেষ্ট প্রধান আর অভিজ্ঞ শিকারীরাই এই খাঁচা তৈরি করতে পারে। নিজের ঘুঘুর বাচ্চা বড় হয়ে উঠবার পর প্রত্যেক শিকারীকে ছুটে যেতে হয় প্রধান শিকারীদের কাছে। অল্প কিছু অর্থের বিনিময়ে প্রধান শিকারীরা নতুন শিকারীদের খাঁচা বানিয়ে দেয়।
অনেকটা অর্ধ চন্দ্রাকার আকৃতির এই খাঁচা তৈরি করা হয় বাঁশের ছাল ও চিকন বেত দিয়ে। শুকনো লতা-পাতা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয় খাঁচার বেশির ভাগ অংশ। খাঁচার সামনের দিকটা যথেষ্ট ফাঁকা রাখা হয় এবং এই ফাঁকা অংশেই বিছিয়ে রাখা হয় জালের ফাঁদ।
নিজের পোষা ঘুঘুকে শিকারের খাঁচায় ভরে গ্রামের পথ ধরে হাঁটতে থাকে শিকারী। বুনো ঘুঘুর ডাক শোনবার আশায় সে কান পেতে রাখে। যে কোন গাছ থেকে ভেসে আসা ঘুঘুর গলার কুর-কুর ডাকের শব্দ শুনতে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শিকারী সাবধানী পায়ে এগিয়ে গিয়ে হাজির হয় সেই গাছের নীচে। খাঁচার সঙ্গে শিকারীর হাতে থাকে চিকন মুলি বাঁশের কয়েকটি খণ্ড। এগুলোকে বলা হয় ‘নল’। এই নলের সাহায্যে সে খাঁচাটাকে গাছের উপরের বুনো ঘুঘুর অবস্থানের কাছা-কাছি একটা স্থানে রেখে দেয়। পোষা ঘুঘু একের পর এক ডাক ছেড়ে বুনো ঘুঘুকে আকৃষ্ট করবার চেষ্টা করতে থাকে। সেয়ানা পোষা ঘুঘুর ছল-চাতুরী বুঝতে না পেরে বুনো ঘুঘু এক সময় তার ডাকে আকৃষ্ট হয়ে চলে আসে খাঁচার খুব কাছা-কাছি। আর খাঁচার সামনের অংশে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জালের ফাঁদে আটকে যায় বুনো ঘুঘুর সমস্ত শরীর।
বর্তমান সময়ে গ্রামীণ জনপদের এই ঐতিহ্যবাহী ঘুঘু শিকার-এর প্রক্রিয়াটি প্রায় বিলুপ্তির দোর-গোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে এসব শিকারীদের সংখ্যা খুবই নগণ্য। মূলত, প্রকৃতি থেকে ঘুঘুর সংখ্যা মারাত্মকভাবে হ্রাস পাওয়ার কারণে এরা শিকার ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। অনেকে হয়তো ভাবতে পারেন যে, এসব শিকারীদের কারণেই প্রকৃতি আজ
ঘুঘুশূন্য হয়ে পড়েছে; আসলে কিন্তু তা নয়। গ্রাম বাংলার বুক থেকে ক্রমান্বয়ে ঘুঘু পাখি হারিয়ে যাওয়ার জন্য দায়ী হচ্ছে এয়ারগান ও .২২ বোর রাইফেলের অবাধ ব্যবহার। শুধু ঘুঘুর সংখ্যা হ্রাসের কারণে নয়, গ্রামীণ জনপদের অনেক শিকারী শিকার ছেড়েছে মনের দুঃখে। ঘুঘুর বাচ্চা সংগ্রহ, আদর-যতেœ সে বাচ্চাকে বড় করে তোলা, শিকারের খাঁচা তৈরিÑএ ধরনের আরও বেশ কিছু কষ্টকর ও ধৈর্যশীল পর্যায় অতিক্রম করে একজন শিকারী পোষা ঘুঘু নিয়ে শিকারে বের হয়। এ সব শিকারীরা সারাদিনে দু’একটার বেশি ঘুঘু শিকার করতে পারে না। তারা যখন শিকারে বের হয়ে দেখতে পায় অত্যাধুনিক এয়ারগান বা .২২ বোর রাইফেলধারী কোন শিকারী একের পর এক গুলি করে টপা-টপ ঘুঘু মেরে চলেছে তখন স্বভাবতই তাদের মন ভরে যায় কষ্টে। তাদের এই কষ্ট অস্ত্রধারী শিকারীরা কখনও বুঝতে পারবে না; বোঝবার কথাও নয়। অস্ত্রধারীদের কাছে এ হচ্ছে নিছক এক খেলা, এই খেলায় অস্ত্রের পাশাপাশি তারা ব্যবহার করে তাদের মাথার বুদ্ধি। অন্যদিকে গ্রামীণ জনপদের শিকারীদের কাছে ঘুঘু শিকার জীবনেরই একটি অংশ, তাই শিকারের সঙ্গে মিশে আছে তাদের বুকের মমতা। গ্রাম-বাংলা ঘুঘুশূন্য হয়ে পড়লেও অস্ত্রধারী শিকারীরা তাতে কোন কষ্ট বোধ করবে না। মাথা খাটিয়ে তারা নতুন শিকার খুঁজে বের করবে। কিন্তু গ্রামীণ শিকারীদের কাছে ঘুঘু এক অমূল্য ধন। ঘুঘু শিকারে মস্তিষ্কের বদলে হৃদয়ের ভূমিকাই তাদের কাছে সব সময় বেশি প্রাধান্য পেয়ে এসেছে। তাই ঘুঘুশূন্য প্রকৃতি এক অপার কষ্টের সুর হয়ে বেজে উঠবে তাদের মনে।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


