somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নাগরপুরের নাচঘর

২০ শে অক্টোবর, ২০১৫ সকাল ১০:০৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ফেরার পথে বাবুর একটি সরল প্রশ্ন, " বাংলাদেশের মানিকগঞ্জ আর টাঙ্গাইলে প্রচুর জমিদার বাড়ী কেন দেখা যাচ্ছে, অন্যান্য অঞ্চলে কি এতো জমিদার ছিলো না?" নদীপথের সুবিধা, কলকাতা যাবার সুবিধা প্রভৃতি দুই চারটা কারণ বলার চেষ্টা করলেও বুঝলাম, প্রকৃত উত্তরটা কোন ইতিহাসবিদ হয়তো বের করতে পারবেন।
টাঙ্গাইলের নাগরপুরে এক জমিদার বাড়ি দেখে ফিরছিলাম। না, পর্যটন বা প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তরের অধীনে সাজানো গোছানো বা পুনর্নির্মিত কোন স্থাপনা নয়, "নাগরপুর মহিলা কলেজ" প্রাঙ্গনে যে বাড়িগুলো আছে সেগুলোই দেখে আসলাম মাত্র। বন্ধু বাবু কিছুদিন আগে এই কলেজে ভিজিলেন্স টীমের সদস্য হিসেবে কাজ করতে এসে দেখে- একটি জমিদার বাড়ীর প্রাঙ্গনে কলেজটি অবস্থিত, মূল ভবনের পিছনে যে কয়টি ভবন আছে, তার প্রত্যেকটির কারুকাজ এবং নির্মানশৈলী আমাদের দেখা "ঐতিহাসিক " নামে পরিচিত বাড়িগুলোর চেয়ে কোন অংশে কম নয়, বরং কিছু ক্ষেত্রে তার সৌন্দর্য ও স্থাপনার আবেদন অনেক বেশী।

টাঙ্গাইল শহর থেকে আরিচার পথে ২৫ কিলোমিটারের মতো দুরত্ব, তবে রাস্তা ভালো নয় বলে এক ঘন্টার কিছু বেশী সময় লেগে গেলো। কলেজের গেইটে এসে প্রিন্সিপালের অনুমতি নিয়ে ঢোকার কথা ছিলো, কিন্তু কলেজ বন্ধ, স্যারদের মিটিং চলছে এই অবস্থায় সেখানকার কর্মচারী বুড়ো চাচা আমাদের ঘুরে দেখার পরামর্শ দিলেন। মূল ভবন পাশ কাটিয়ে বায়ে মোড় নিতেই একই চেহারার দুটি ভবন যার তলায় খোদাই করা আছে মিস্ত্রীর নাম-'জয়নাল আবেদিন, সাং কলকাতা'। এই ভবন দুটিকেও পাশ কাটিয়ে আমরা চলে আসলাম সেই দিকে যেটির আকর্ষন আমাদের মনে কয়দিন ধরেই ঘুরপাক খাচ্ছিলো এবং যার জন্য দায়ী বাবুর বলা বর্ণনা- নাচঘর।



নাচঘরের সিড়ির নীচে এসে থমকে যাই, একজন অভয় দিলেন, ওখানে লোক থাকে, ওনাদের বললে দরজা খুলে দিবে। দেড় তলার মতো সিড়ি ভেঙ্গে উঠে দরজায় দাড়ালাম, দুই পাটির একটি শক্ত হয়ে লাগানো থাকলেও অন্য পাটির পুরো অংশই হাস্যকর ভাবে ভাঙ্গা, তার ফাক দিয়ে উকি মেরে বললাম, একটু ঢুকতে পারি, ঢাকা থেকে আসছিলাম দেখার জন্য। একটি স্টোভে রান্না করা অবস্থায় ভদ্রহিলা বললেন আসেন। আমি সেই ফুটা দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই ভ্দ্রমহিলা কাওকে বললেন দরজা খুলে দিতে। একটা বাচ্চা ছেলে দৌড়ে এসে দরজার উপরে থাকা একটি কাঠ সরিয়ে দিলো-অবস্থার বিশেষ কোন উন্নতি হলো না, কিন্তু দরজা খুলে গেলো। বাকীরা কোনমতে হাসি চেপে ভেতরে প্রবেশ করলো। এই জমিদারের বাড়ীগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ব্যায়বহুল এবং জৌলুসপূর্ণ ভবনটিতে অত্যন্ত দীনহীন ভাবে বাস করা পরিবারটির থাকার অবস্থাটাই প্রথমে চোখে পড়ে। এক কোনে স্টোভ জ্বালিয়ে রান্নার ব্যবস্থা, লম্বালম্বিভাবে তার ঝুলিয়ে কাপড় নাড়ার ব্যবস্থা, ইতস্তত মোড়া/চেয়ার চৌকি........



উপরের দিকে তাকাতেই চমকে উঠলাম, চমকে উঠার কারণ রুমের পিলারগুলো। প্রতিটি পিলার প্রতিটি ইঞ্চি জুড়ে কাজ করা। বিশেষ করে পিলারের উপরের দিকে ত্রি-ডাইমেনশন কাজ (আর্কিটেক্ট রা ভালো বর্ণনা দিতে পারবেন নিশ্চয়ই)।


আর পিলারের বাকী অংশ টাইলস, মোটা কাচ আর রঙিন পাথর দিয়ে আবৃত। মানুষের অত্যাচারে নাগালের মধ্যে থাকা অংশে কাঁচের টুকরোগুলো উধাও কিন্তু নাগালের উপরে কাচ ঠিকরে জানান দিচ্ছে কতটা সুন্দর কম্বিনেশনে তৈরী হয়েছিলো। দিনের আলোয় এতো ঔজল্য ছড়ালে রাতের আলোতে কতটা অসাধারণ লাগবে ভাবতেই গায়ে কাটা দিয়ে উঠলো।



সেই সাথে পায়ের নীচে মার্বেলের মেঝে, শত অত্যাচারেও এখনও কতটা মসৃণ।



বড় মাপের পর্যটক নই বলে হাতে কোন এসএলআর ক্যামেরা নাই। ভরসা হাতের মোবাইল, কিন্তু ওইটা আবার স্মার্ট বলে প্রয়োজনের সময় চার্জ নাই বলে বিদায় নেয় প্রায়ই।
এবার নজর পড়ে দুই পাশের উচু জানলার মতোন জায়গায়, আরিব্বাস, ওখানে মনে হলো বসার মতো ব্যবস্থা আছে, তার দিকে উঠার জন্য সিড়ির দুই পাশে সিড়ির ব্যবস্থা যা এখন কাঠ দিয়ে আটকানো আছে। বাইরের দিক দিয়ে ছাদে গিয়ে টপকে হাজির হলাম সেই রুম দুটির একটিতে। নিশ্চয়ই অন্দর মহলের মানুষগুলো এখান থেকে নাচ ঘরের চকমকে পরিবেশে নাচ দেখতেন....



এই রুমের পাশের রুমটিতে ইট ভাঙ্গার স্তুপ। ভালো, সে সময় কিভাবে ইট তৈরী হতো তা জানা হয়তো সহজ হলো, সেই সাথে যে এই অসাধারণ স্থাপনা ধ্বংসের রাস্তা তৈরী হয়ে যাচ্ছে, তা কে দেখবে?





নাচঘরের সৌন্দর্য দেখে এবার চললাম অন্যান্য ভবনের দিকে, একটা জমিদার অঙ্গনের যা থাকার কথা, সবই মিলিয়ে মিলিয়ে পাওয়া গেলো। জানিনা,এই জমিদারদের নিয়ে কোন গবেষণা, তথ্য আছে কি না, কিন্তু বাংলাদেশের অন্যান্য জমিদারবাড়ীর সাথে মিলিয়ে অন্যান্য স্থাপনা, যেমন, জমিদারের অফিস ভবন, ফ্যামিলি থাকার ভবন, কর্মচারী থাকার ভবন, রসুই ভবন, এবং আর একটি ছোট অথচ অত্যন্ত কারুকার্যময় ভবন পাওয়া গেলো। দুঃখের বিষয়, ভবনটির চারদিক বিশেষ করে সামনের দুটি পিলার এবং ভিতরে অসাধারণ কারুকার্য থাকলেও ভবনটির ভেতর কাদা এবং ময়লায় পরিপূর্ণ। সফরসঙ্গীদের কেউ বললো, এটা রসুই খানা। কিন্তু অন্য একজন বললো, যেহেতু এতো সুন্দর এবং এতো বেশী ব্যয়বহুল কাজ করা হয়েছে এই ছোট ভবনে, সেই সাথে ভেতরে একটা বেদির মতো উচু জায়গাও আছে, সম্ভবত এটা পুজোর ঘর। শেষের জনের অনুমানই যুক্তিপূর্ণ মনে হলো। কিন্তু, ভাবতে কষ্টই লাগলো এই জন্যে যে, এক সময় এই ভবনটিকে সবচেয়ে যত্ন নিয়ে রাখা হলেও আজ কেউ দেখবার নাই। এরই মধ্যে আমার স্মার্ট সঙ্গীটি চার্জের অভাবে বিদায় বলে দিয়েছেন বলে এই ভবনগুলোর কোন চিত্র দেখাতে পারলাম না। পুজোর ঘরের পাশ দিয়ে কয়েকটি টানা ভবন। আকারে বড় হলেও নির্দিষ্ট মাপ এবং তুলনামূলক কম কারুকার্যের উপস্থিতিতে অনুমান করা গেলো ভবনগুলো সম্ভবত কর্মচারীদের।


পুরো বাটিকা ঘুরে আমাদের স্বল্পবুদ্ধির মাথায় মনে হলো ভবনগুলো তিনটি ভিন্ন সময়ে তৈরী। প্রথম ভাগে তৈরী ভবনগুলো তুলনামূলক পুরানো কায়দায় এবং উপকরণে তৈরী যেগুলো আজ ভগ্নাবস্থার কাছাকাছি পৌছে গেছে। দ্বিতীয় ভাগে তৈরী কয়েকটি ভবন(যেটিতে আবার সাং কলকাতা লেখা) একটু উন্নত মাল মসলায় তৈরী, সেগুলো আবার তালা বদ্ধ করে রাখা বলে ভেতরে দেখা গেলো না। আর বাকী অর্থাৎ সবচেয়ে লেটেস্ট প্রযুক্তিতে তৈরী ভবনটিতে বর্তমানে কলেজ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এই ভবনটিতে মোজাইক দেখা গেলো তা এখনও ঢাকার চল্লিশ- পঞ্চাশ দশকে তৈরী বিল্ডিংগুলোয় এখনও দেখা যায়। সেই সাথে, আধুনিক সিমেন্ট এর ব্যবহারও বর্তমান।

ফেরার পথে নিজেদের আত্নজিজ্ঞাসায় একদিকে সৌভাগ্য অন্যদিকে দুর্ভাগ্য দুটি অনুভুতিই কাজ করলো। সৌভাগ্য এই অর্থে যে, দেশের প্রত্নতাত্ত্বিক দপ্তর এখনও এই জমিদার বাড়ির দায়িত্ব নেয় নাই, ফলে বিশাল বাজেট খরচ করে সংস্কারের নামে প্রকৃত কারুকার্য গুলো ধ্বংস করে জগাখিচুড়ী বানানোর সুযোগ তারা পায় নাই (যেমনট করে তারা অনেক স্থাপনাই শেষ করে দিয়েছে)- সেই অর্থে সত্যিকারের জমিদারবাড়ী দেখাটা সৌভাগ্য ছাড়া আর কি? আর দুর্ভাগ্য এই যে, এই পুরোন স্থাপনায় কলেজ হয়েছে ভালো কথা, কিন্তু দুর্বল ও অতিপুরানো স্থাপনায় আবাসিকভাবে বাস করে তিলে তিলে সব কিছু নষ্ট করে দিচ্ছে যারা, তারা কি এর মূল্য বুঝতে পারছে? নাচঘরের পিলারে তার টাঙিয়ে কাপড় নেড়ে, স্টোভ জ্বালিয়ে রান্না করে, সবগুলো বারোটা বাজার পরও কারও টনক নড়বে না, সেটাই বাস্তবতা হয়তো বা।

সর্বশেষ এডিট : ২০ শে অক্টোবর, ২০১৫ বিকাল ৫:৫৪
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বারবাজারে মাটির নিচ থেকে উঠে আসা মসজিদ

লিখেছেন কামরুল ইসলাম মান্না, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৪০

ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার বারবাজার ইউনিয়নে মাটির নিচ থেকে মসজিদ পাওয়া গেছে। এরকম গল্প অনেকের কাছেই শুনেছিলাম। তারপর মনে হলো একদিন যেয়ে দেখি কি ঘটনা। চলে গেলাম বারবাজার। জানলাম আসল... ...বাকিটুকু পড়ুন

সৎ মানুষ দেশে নেই,ব্লগে আছে তো?

লিখেছেন শূন্য সারমর্ম, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:৪৮








আশেপাশে সৎ মানুষ কেমন দেখা যায়? উনারা তো নাকি একা থাকে, সময় সুযোগে সৃষ্টিকর্তা নিজের কাছে তুলে নেয় যা আমাদের ডেফিনিশনে তাড়াতাড়ি চলে যাওয়া বলে। আপনি জীবনে যতগুলো বসন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

পরিবর্তন অপরিহার্য গত দেড়যুগের যন্ত্রণা জাতির ঘাড়ে,ব্যবসায়ীরা কোথায় কোথায় অসহায় জানেন কি?

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:৫৭


রমজানে বেশিরভাগ ব্যবসায়ীকে বেপরোয়া হতে দেখা যায়। সবাই গালমন্দ ব্যবসায়ীকেই করেন। আপনি জানেন কি তাতে কোন ব্যবসায়ীই আপনার মুখের দিকেও তাকায় না? বরং মনে মনে একটা চরম গালিই দেয়! আপনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯

মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা বলতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

×